Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
চারপাশের বাস্তব থেকেই তুলে ধরেছেন সময়কে। তিনি বিমল কর। বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার এই পথিকৃৎ শতবর্ষ পূর্ণ করবেন আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর।
Bimal Kar

Bimal Kar: রেকর্ডে আগমনি গান মানেই পুজোর লেখা শেষ

সে লেখাও হত নতুন কলমে, রংবেরঙের কালিতে। স্বভাবে শৌখিনতা ছিল, কিন্তু সাহিত্যচর্চায় তা ছিল না। প্রেম, গার্হস্থ্য, মৃত্যু, সন্দেহ, টানাপড়েন থেকে খুঁজে নিয়েছেন বিষয়।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:০৭
Share: Save:

একটি দ্বিমাসিক পত্রিকায় (‘গল্পপত্র’) বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন এক নবীন লেখিকা। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সূত্রে, গ্রাম-জীবনের কথা সে সব গল্পে ফিরে আসে। সম্পাদকের জিজ্ঞাসা, ‘তুমি গ্রাম দেখছো তোমার নাগরিক অনুভূতি দিয়ে... গ্রামের মানুষের সঙ্গে তোমার শহুরে দূরত্ব পুরোপুরি মুছে ফেলতে পেরেছো? পারোনি। তাহলে শৌখিন মজদুরি কেন?’ সঙ্গে জানালেন নিজের অভিমতও, এ ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখলে গল্প হবে ঠিকই, তবে তা হবে প্রতিমা গড়ার মতো। তাতে ‘প্রাণ-প্রতিষ্ঠা’ হবে না।

‘চোখ খুলল’ লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের। সম্পাদক, বিমল কর।

আসলে সাহিত্যচর্চায় ‘শৌখিনতা’র ধার ধারেননি বিমল। চোখ মেলে দেখেছেন চার পাশ। আর নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় বুকে নিয়ে লগ্ন হয়েছেন সময়ের ছবিতে। সে ছবিতে মৃত্যু, মূল্যবোধ, গৃহস্থ-টানাপড়েন, এ সবই মূল উপজীব্য।

এই দেখাটার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর জন্ম, মামারবাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার টাকি লাগোয়া শঙ্খচূড়ায়, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২১-এ। বাবা, জ্যোতিষচন্দ্র কর। মা, নিশিবালা দেবী। তবে বাবা-কাকাদের রেল ও খনিতে চাকরির সূত্রে দীর্ঘ সময় কেটেছে ধানবাদ, হাজারিবাগ, কুলটি, আসানসোল, ডিসেরগড়, কালীপাহাড়ি-সহ বিস্তীর্ণ রেল ও কয়লা-শিল্পাঞ্চলে। প্রাথমিক পড়াশোনা ধানবাদেই। রেলের প্রাথমিক স্কুল ডিঙিয়ে ভর্তি হওয়া ধানবাদ অ্যাকাডেমিতে। ছোট্ট বিমল দেখে, পুরনো রেলপাড়ার দিকে, পাঁচিল ঘেরা বিরাট জায়গায় ছায়া বিছিয়েছে নিম, আম, তেঁতুলের সারি। সেখানেই মেটে লাল রঙের ‘কটেজ’বাড়িতে এই স্কুল।

শুধু দেখা নয়, বিমলের সাহিত্য-মনের মহীরুহটিও এখানেই হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করল। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, রেল ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘হাতেমতাই’ প্রভৃতি সিনেমা দেখা আর বিস্তর বইপত্র পড়া— এ সব নিয়েই দিন কাটে তার। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘যকের ধন’...‌ বেশ চলছিল। তাল কাটে জেঠামশাই সতীশচন্দ্রের ছেলে, বড়দার আনা একটা বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে। বেশ পড়া চলছে সে বই। আচমকা, বড়দার এক হাতে রইল বিমলের কান, অন্য হাতে শরৎচন্দ্র। নিশিবালার কাছে নালিশ, ‘মেজো কাকিমা, তোমার ছেলে ‘দেবদাস’ পড়ছে, উচ্ছন্নে যাবে।’

মাকে কম জ্বালাতন করে না বিচ্ছু ছেলেটি। এক বার ‘মেঘনাদবধ পালা’ দেখে লিখে ফেলল একটি ছোটখাটো পালা। ঠা-ঠা দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে চলছে অভিনয়। বিমল স্বয়ং মেঘনাদের ভূমিকায়। প্যাকিং বাক্সের লোহার পাত, রান্নাঘরের হাতা-খুন্তি নিয়ে যুদ্ধ বেশ জমে ওঠে। তবে, ‘অস্ত্রের’ ঝনঝনানিতে দুপুরের ঘুম ভেঙে গেল নিশিবালার। অগত্যা তাঁর হাতেই মেঘনাদ-নিধন!

এমন সাহিত্য-প্রীতির জন্য বার বার বিপদে পড়তে হয় বিমলকে। আসানসোল রেল স্কুলে বছর দুয়েক পড়াশোনা, ছ’মাসের অসুস্থতা, এ সব কাটিয়ে সে তখন কুলটি ম্যাকমিলান ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক। সে জন্য তার আগে, বোর্ডিংয়ে ক্যাম্পখাটে সামনে জ্যামিতির বই খুলে লণ্ঠনের মিঠে আলোয় বিমল পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর ‘সাড়া’ উপন্যাস! দেখে ফেললেন পণ্ডিতমশাই। মুহূর্তে পাঁচ অক্ষরের বিশেষণ প্রয়োগ করে উক্তি, ‘তুমি বুদ্ধদেব বসু পড়তাছ।... পরীক্ষায় ডাল গুলবা তুমি।’ সঙ্গে বিমলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন এক রাশ সংস্কৃত ব্যাকরণের বোঝা।

উনিশ দিনের অন্য পৃথিবী

প্রথাগত পড়াশোনা হোক বা জীবন, বিমলের দেখার চোখটা যেন ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়। এই দেখাটার পূর্ণতা যেন, তাঁর ‘স্বপ্নের রাজ্য’ কলকাতায়। আর তাই, কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে (বর্তমানে আর জি কর) ডাক্তারি পড়তে এসে বিমল ঘুরে বেড়ান গ্রেটা গার্বো, ক্লোদেত কোলবার্ট, মার্লিন ডিয়েট্রিচের ছবি দেখতে, টকি শো-হাউসে। অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, রাণীবালা প্রমুখের মঞ্চাভিনয়ও বড় টানে তাঁকে। হাতে আসে জীবনানন্দ দাশ থেকে আনাতোল ফ্রাঁস, এজ়রা পাউন্ড, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ থেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, এমন আরও কত কী। ডাক্তারির পড়াশোনা লাটে উঠল। পরিবার ভাবল, ডাক্তার না হোক, ছেলে ইঞ্জিনিয়ারটা অন্তত হোক। ভর্তি হওয়া শ্রীরামপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখানেও বিষয় ও কলেজ, দুই সম্পর্কেই বিতৃষ্ণা জন্মায়। অবশেষে, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করলেন বিমল কর, ১৯৪৩-এ।

এই টাল খেতে থাকা শিক্ষাজীবনকে আলগোছে পাশে রেখে, মহানাগরিক-সময়ের আগাপাশতলায় যেন ধীরে ধীরে ডালপালা মেলল সাহিত্যিক বিমলের মনটি। দেখলেন অনেক না-দেখাকে। ছাত্রজীবনে এক দিন দেখলেন, মহানগর ভাসছে জনসমুদ্রে। তাতে ভাসতে ভাসতে চলেছেন এক জন। কিন্তু সে সমুদ্রের তরঙ্গে বিমলের চশমাটি গেল ভেঙে। চটি জোড়াও ছিঁড়ে গেল। ‘অনাথ বালকের’ মতো অলিগলি ঘুরে ক্লান্ত বিমল দিনান্তে বাড়ি ফিরলেন। জনসমুদ্রের উদ্গাতা যিনি, তাঁকে অবশ্য দেখা হল না। বদলে, তাঁর কবিতা শোনালেন দাদামণি: “ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি/ চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে...”— দিনটা ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন।

ব্যক্তিজীবনেও তিনটি মৃত্যু ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে তাঁকে। তখন বিমল ছোট্টটি। হাজারিবাগ রেল-কোয়ার্টার্স ঠিকানা। সেখানে উঠোন জুড়ে দু’-আড়াই বছরের ছোট্ট বোনটি ঘুরপাক খেতে খেতে খেলছে। ওর গায়ের রংটা একটু শ্যামলা, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। আচমকা, পড়ে গেল সে। আর চোখ খোলে না। বিমলের স্মৃতিকে যেন ধিক্কার জানায় মৃত্যুর এমন নিরর্থক আগমন। তাতে বিসর্জনের বাজনার মতো সঙ্গত দেয় মা নিশিবালার ‘এস্রাজের ছেঁড়া তারে ছড় টানার মতো অদ্ভুত...’ কান্নার সুর।

এই হাহাকার যেন আরও প্রকট হল ঠাকুমা শরৎকুমারীর মৃত্যুতে। নাতি বিমল তখন কুলটির স্কুলে পড়ে। জরুরি তলব পেয়ে জামডোবায় এল। ঠোঁটটা নড়ে ওঠে শরৎকুমারীর, ‘দাদা, এলি?’ ওই শেষ... শীতের বাতাসে তখন যেন সব পাতা ঝরে গেল। ওই ঝরাপাতার ছায়াতেই বিমল রইলেন, আজীবন...। বাবার মৃত্যুতে এই ছায়াটাও বোধহয় টাল খেল। সেরিব্রাল স্ট্রোকে আপাত-ভাবে জগৎ-সংসার থেকে উদাসীন মানুষটির মৃত্যুতে বিমল অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

মৃত্যু এ ভাবেই বারংবার এসেছে তাঁর লেখায়। ‘জননী’ গল্পে ছেলেরা প্রয়াত মায়ের কথা ভেবে শোক করে না, তারা মায়ের অসম্পূর্ণতা ঢেকে দেওয়ার জন্য নিজেদের এক একটি বৈশিষ্ট্য যেন উপহার দিতে চায়। বিমল কর মৃত্যুমুখী নন, বরং কিঞ্চিৎ অবক্ষয় ও নৈরাশ্যবাদী।

নৈরাশ্য কী, তা কলেজ-পড়ুয়া বিমলকে চিনিয়েছে মহানগর কলকাতাও। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ। মহানগর কলকাতা, দিনে-রাতে যেন নিঝুম আঁধারে কাঁদে। এর মধ্যেই উপস্থিত ’৪৩-এর মন্বন্তর। এআরপি-তে চাকরিরত বিমল তখন বৌবাজারপাড়ায়। কলকাতা যেন অভাগীর স্বর্গ, তার শরীরের খানাখন্দে গ্রাম থেকে উঠে আসা নিরন্ন মুখ, আবর্জনা খুঁটে খাওয়া মানুষের ভিড়। এই সময়টাকে বিমল ধরেছেন ‘দেওয়াল’ উপন্যাসে। আবার, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর পটভূমিকায় লিখেছেন ‘অন্তরে’ গল্প। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলন, ‘পুলিশি-সন্ত্রাস’ নিয়ে লিখেছেন ‘নিগ্রহ’, ‘ওরা’, ‘সে’। ঘটনাচক্রে, ‘পুলিশি সন্ত্রাস’ টের পেয়েছেন বিমল নিজেও, দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন আগে। মানিকতলায় তখন দাঙ্গা চলছে। পুলিশ অকারণে তুলে নিয়ে গেল তাঁকে। অভিযোগ খুনের চেষ্টা ও খুনের ষড়যন্ত্র! বড়তলা থানা, লালবাজার হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেল... উনিশ দিনের মাথায় জামিন মিলল। তত দিনে, যেন অন্য পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাঁর।

শুধু সমসময় বা মৃত্যু নয়, প্রাত্যহিক জীবনের টানাপড়েনও বিমল করকে তাঁর সৃষ্টির উপাদান জুগিয়েছে বার বার। এই সমস্ত উপাদানকে সঙ্গী করেই লেখা ‘সুধাময়’, ‘পিঙ্গলার প্রেম’, ‘আত্মজা’, ‘জননী’, ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘আঙুরলতা’, ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’, ‘অম্বিকানাথের মুক্তি’, ‘খড়কুটো’, ‘বালিকা বধূ’, অসময়’, ‘পূর্ণ-অপূর্ণ’, ‘উপাখ্যানমালা’ প্রভৃতি বাংলা কথাসাহিত্যে বিমল করকে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। লিখেছেন ‘সায়ক’, ‘শঙ্খ’, ‘ঘাতক’ প্রভৃতি নাটক, ‘উড়ো খই’-এর মতো স্মৃতিকথা। আবার ‘সরস গল্প’-এ কৌতুকের গহন অরণ্যের আড়ালে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পিছলে আসা আলোর মতো আটপৌরে বাঙালির প্রাত্যহিক অসঙ্গতিগুলির সঙ্গেও পরিচিত করিয়েছেন পাঠককে। পারিজাত মল্লিক ছদ্মনামে লিখেছেন রহস্য গল্প, ‘গোলাপ কাঁটা’-ও। কখনও বা সৃষ্টি করেছেন ‘কিকিরা’ গোয়েন্দা-চরিত্র। যদিও,
কিঙ্কর কিশোর রায়, ওরফে কিকিরা নিজেকে গোয়েন্দা নয়, ‘ম্যাজিশিয়ান’ বলতেই পছন্দ করে।

উপাদানের পাশাপাশি বিমল আঙ্গিক-সচেতনও। এ বিষয়ে তাঁর মতান্তর ঘটেছে খোদ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘আঙুরলতা’। পুজোর পরে এক আড্ডায় উপস্থিত টালা পার্কের বাসিন্দা তারাশঙ্কর। এক সময় বিমল করকে বললেন, ‘চল, এগিয়ে দে।’ নবীনে-প্রবীণে চলেছেন। তারাশঙ্কর জানালেন, ‘আঙুরলতা’ গল্পটি ভালই। তবে পরামর্শ,
‘...অনেকটা না ছড়িয়ে, তুই সোজাসুজি গল্পে চলে আসতে পারতিস।’ বিনয়ের সঙ্গে বিমল কর জানালেন, তা সম্ভব নয়। কারণ, গল্পের পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি, তার নিজস্ব ‘লজিক’-এর জন্য। তারাশঙ্করের জবাব, ‘...এ যেন বাংলাদেশ দেখাতে গিয়ে প্রথমে ভারতবর্ষের ম্যাপ দেখিয়ে তার পরে বাংলাদেশ দেখাচ্ছিস।’ কথার যুক্তিটা মানলেন বিমল কর। কিন্তু স্থিত রইলেন, নিজমতেই।

নিজের মতকে এ ভাবেই বিশ্বাস করেন বিমল। আবার, ‘ছোটগল্প: নতুন রীতি’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় এক প্রবন্ধে জানিয়ে দেন, ‘...নতুন রীতির পথে সবাইকে আসতে হবে এমন নয়।’ নতুনের প্রতি আগ্রহটা বিমল করের স্বভাবজাত। তাই তিনি অবতীর্ণ হন শব্দান্বেষীর চরিত্রেও। অভিজ্ঞতাটা সুধাংশু ঘোষের: বর্মন স্ট্রিটে তখন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিস। সেখানেই গিয়েছেন সুধাংশু। হঠাৎ বিমল জানতে চাইলেন, ‘গরুর কতরকম প্রতিশব্দ জানো?’ আসলে, একটা লেখায় ব্যস্ত তখন লেখক। তাতে গরুটি একটি চরিত্র। কিন্তু যে পরিবেশ তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাতে ‘গরু’ শব্দটি খাপ খাচ্ছে না। আবার, পুরনো গল্পের আমেজ, মজার জন্য ‘বালিকা বধূ’-তে বাহন করেন সাধু বাংলা।

এই সমস্ত সাহিত্যকীর্তি ও ভাবনার জন্যই দু’বার আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে আসে প্রাপ্তির নিজস্ব নিয়মেই। তাঁর গল্প নিয়েই তৈরি হয়, ‘বালিকা বধূ’ (বাংলা ও হিন্দিতে), ‘ছুটি’, ‘বসন্ত বিলাপ’ প্রভৃতি সিনেমা।

তবে পুরস্কার বা সিনে-জগতের হাতছানি, সবেতেই যেন নিস্পৃহ বিমল, হয়তো সেটা তাঁর স্বভাব ও মূল্যবোধের কারণেই।

বিমল করের লেখা অবলম্বনে তৈরি ‘রৌদ্রছায়া’র প্রিমিয়ার হবে নিউ এম্পায়ারে। সেখানে যাচ্ছেন লেখক, সঙ্গী সুধাংশু। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সামনে এসে বললেন, ‘ধুর ওখানে যাব না। কত চেনা লোকজন। ফর্মালিটি!’ গেলেন লাইট হাউসে, অন্য সিনেমা দেখতে। আবার, বিমল করের ‘কালিদাস ও কেমিস্ট্রি’ অবলম্বনে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘দিল্লাগী’ তখন মারমার কাটকাট চলছে। তা দেখে, মুম্বইয়ের প্রযোজক মহলে বিমল করের গল্পের চিত্রসত্ত্ব কেনার হুড়োহুড়ি। মুম্বইয়ের এক পরিচালক হোটেল বুক করে ফেললেন। মুম্বইয়ে যাওয়ার প্লেনের টিকিটও পাঠিয়ে দিলেন লেখককে। সঙ্গে চিঠি, ‘আপনি অনুগ্রহ করে এলে আমি ছাড়াও, আরও অনেক প্রযোজক আপনার গল্প উপন্যাসের চিত্রসত্ত্ব কিনবেন।’ কিন্তু তিনি যে বিমল কর। বিনয়ের সঙ্গে জবাব, ‘যাঁর দরকার, কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে!’ অর্থাৎ বাজারে বেচতে যাব না আমার সৃষ্টি, মনোভাবটা এমন।

একই ভাবে, শুধুমাত্র প্লেনে চাপার ভয়ে আমেরিকা-সহ নানা বিভুঁইয়ের ডাক তিনি বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়ের একটি ঘটনা এখনও ভাসে সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিতে। তিনি বলেছেন, “সে সময়ে ওঁর সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিলাম। পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনে বিমলদা প্রথমে বলেছিলেন, দিল্লি তো অনেক দূরে। অত দূরে কে যাবে! অবশেষে জোরাজুরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম!”

ভাগ্যিস নিয়ে গিয়েছিলেন! অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত এই উপন্যাসই ‘অসময়’। সেখানে তরুণ আয়না-তপুর প্রেমের পাশাপাশি আছেন জ্যাঠাইমা। আছে মোহিনী ও তার ভাইয়ের বন্ধু অবিনের নিরুচ্চার সম্পর্ক। অবিন আদৌ অবাঙালি নাম নয়। নায়ক ঘোষণা করেছিল, তার অবিনয় নামটি সে এভাবে ছেঁটে দিয়েছে। একদা বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতায় জানিয়েছিলেন, ‘বিনয় বৃদ্ধের বিদ্যা’। সত্তর দশকের বিনয়হীন এই অবিন নামে তাই আজও ‘কিছু মায়া রয়ে গেলো’।

বিয়ের ঘোষণা, ট্রাম থেকে লাফ

বিমল কর এমন ধারারই, আপাতদৃষ্টিতে খামখেয়ালি। কিন্তু আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর ‘তফাত শুধু শিরদাঁড়া’য়। এ জন্য বার বার তাঁর কর্মজীবনে তাড়া করেছে অনিশ্চয়তা। ৩০ টাকা মাইনের এআরপি-র কাজ, নৌবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েও ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ না করতে পারা, ৫৬ টাকা মাসমাইনের রেলের অ্যাকাউন্টস অফিসের চাকরি, পরে রেলেরই ‘চেক-রাইটার’-এর চাকরি— সবই খোলসের মতো ঝরে পড়ে সদা-নবীন এই প্রাণের চলনটি থেকে। চেক রাইটারের চাকরিতে ঘুষ নিতে পারেননি যে বিমল! অগত্যা সব ছেড়ে কলকাতায় চলে আসা। ‘পরাগ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ৪০ টাকা মাইনের চাকরিতে যোগ দিলেন বটে। কিন্তু এখানে মাইনে হওয়ার কোনও দিন-তারিখ নেই। পত্রিকার ঝাঁপও ক্রমে বন্ধ হল। বন্ধুদের নিয়ে ‘রহস্যরোমাঞ্চ’ নামে একটি কাগজ খুললেন তিনি। পরে, ‘পশ্চিমবঙ্গ’, ‘সত্যযুগ’ প্রভৃতি পত্রিকায় চাকরি। কিন্তু কোথাও যেন বোল ফোটে না জীবনে।

ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। বন্ধু ও কবি অরুণ ভট্টাচার্য এক তরুণ লেখকের সঙ্গে বিমলের আলাপ করিয়ে দিলেন। ওই লেখকই বিমল করের ‘ইঁদুর’ গল্পটি নিয়ে গেলেন, ‘দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ পড়লেন গল্পটি। বললেন, “তোমার বিমল করকে বলো ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য একটি গল্প লিখতে।” ভূমিষ্ঠ হল, ‘বরফসাহেবের মেয়ে’!— ওই তরুণ লেখকটি গৌরকিশোর ঘোষ। ‘দেশ’ পত্রিকায় পর পর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হল। অবশেষে, ১৯৫৪-য় ‘দেশ’ পত্রিকাতেই চাকরি। অনিশ্চিত জীবনের তরী যেন তটে ভিড়ল।

বিমল করের বাবাও ছেলের এ চাকরির খবরে খুব খুশি। কিন্তু এ ছেলের মতিগতিতে যে তেমন আস্থা নেই। তাই চিঠিতে লিখলেন, ‘দায়দায়িত্ব বেড়েছে তোমার। মতি স্থির রেখে কাজকর্ম করবে।’ ‘দেশ’ পত্রিকায় কাজটা অবশ্য প্রায় তিন দশক ধরে ‘মতি স্থির রেখে’ই করেছেন বিমল। কিন্তু বাবার চিঠিতে ওই যে ‘দায়দায়িত্ব বৃদ্ধি’র কথা, সেটির সৌজন্যেও গৌরকিশোর।

সালটা ১৯৫১। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে চিনেবাদাম সঙ্গতে আড্ডা চলে। আজ বিমলের জবাব ছাড়া উঠবেন না, জানিয়ে দিয়েছেন গৌরকিশোর। প্রশ্নটা অবশ্য বেশ কঠিন: ‘বিমল, আজই একটা সিদ্ধান্ত নাও।... বিয়ে করবে, কি করবে না?’ দীর্ঘ নীরবতার পরে, সম্মতি দিলেন বিমল। উঠলেন শ্যামবাজারগামী ট্রামে। কলেজ স্ট্রিটে ডাবপট্টির কাছে দুলকি চালে চলেছে ট্রাম। ভর্তি যাত্রী। সহসা, গৌরকিশোরের চিৎকার, ‘বন্দে মাতরম্’ বলে, বিমলের বিয়ের ঘোষণা করতে লাগলেন। ট্রাম থেকে লাফ মারলেন বিমল... পাত্রী, কোচবিহারের। আলিপুর ডুয়ার্স গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা, গীতা। দেখাশোনার ঠিক পাঁচ দিন বাদে, ১০ জুন, ১৯৫১-য় বিয়েটা সারা হল। নতুন দম্পতির সংসার জমে ওঠে মণীন্দ্র রোডের অদূরে, ভাড়াবাড়িতে, পাইকপাড়ায়। এঁদের চার সন্তান: দূর্বা, শুভা, অনুভা এবং সমীর।

গাওস্করের কণ্ঠহার

‘দেশ’-এর চাকরি, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী— বেশ কাটে বাউন্ডুলে স্বভাবের মানুষটার। কিন্তু খেয়ালিপনাটা তার মধ্যেও থাকে নিজস্ব গতিপথে। তবে সব কিছুর পরেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বিমল ‘আন্তরিকতা ও সামাজিকতায় নির্ভুল গৃহস্থ’। এই গৃহস্থ-আটপৌরে মানুষটির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সর্বদা ফিটফাট, ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে এই ছ’ফুট লম্বা শীর্ণ চেহারার মানুষটির হাতে সর্বদা জ্বলন্ত সিগারেট। আদ্যন্ত শৌখিন মানুষটি বাড়িতে থাকলেও বিকেলে গায়ে দেন রকমারি রঙিন পাঞ্জাবি! দেবদ্বিজে তেমন আসক্তি নেই, পুজোপাঠও করেন না। তবে, বিশেষ প্রিয় ‘উপনিষদ’ ও ‘বাইবেল’। এই মানুষটির নানা খামখেয়ালিপনা আগলে রাখেন স্ত্রী গীতা।

যেমন— শীত নামলেই পাইকপাড়ার ঘরে রোদ-বারান্দায় লিখতে বসেন বিমল। লেখার আগে স্ত্রীকে অনুরোধ, ‘...লেখার প্যাডটা একটু সেঁকে দাও!’ রান্নাঘরে আগুনের উপরে প্যাডটা ধরে কায়দা করে মোচড় দেন গীতা। উষ্ণ পাতা পেয়ে লেখকের প্রতিক্রিয়া, ‘এই বার কালিটা ভাল সরবে।’ আর সে লেখা পুজোর মরসুমে হলে, তার আগে একটি নতুন কলম কেনা চাই-ই তাঁর, ধর্মতলায় কে সি দাশ লাগোয়া এক দোকান থেকে। তার পরে, নির্দিষ্ট কোম্পানির কাগজে লাল, কালো, নীল, সবুজ আখরে ফুটে ওঠে নতুন গল্প, উপন্যাস। সঙ্গে ভরে ওঠে লেখার টেবিলের পাশে রাখা বেতের ঝুড়িটাও— না-পছন্দ, বাতিল লেখার ছেঁড়া পাতায়। মগ্ন সাহিত্যিকের আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে তখন লম্বা ছাই। —দৃশ্যটা স্মৃতিতে রয়েছে কন্যা শুভার। স্মৃতিতে আরও রয়েছে, পুজোর লেখা চলাকালীন বাবার থমথমে মুখটাও। আর যে দিন বাড়িতে আগমনি গানের রেকর্ড শোনা যেত, বোঝা যেত, লেখা শেষ। এ বার পুজোর ফর্দ হবে। বিমল-গীতার পুজোর বাজারে ফেলে আসা হাজারিবাগ, আত্মীয়স্বজনদের জন্য একটা বিশেষ জায়গা থাকে। বাজারের তালিকায়, জামাকাপড় ছাড়াও, সদ্য-ওঠা ফুলকপি, নামী ব্র্যান্ডের তামাক পাতা, আরও কত কী! এক-এক বার হাওড়া স্টেশনে সে সব লটবহর নিয়ে যেতে ভাড়া করতে হয় টেম্পো!

বিমলের আর একটা খেয়ালি অভ্যেস, ভাড়াবাড়ি বদলের। পাইকপাড়া, দমদম, বাঙুর, সিঁথি, এমন নানা জায়গায় তিনি থেকেছেন। বাজার করতে গিয়েও বাড়ি পছন্দ করে এসেছেন! অনেক পরে, সল্টলেকে করেছেন নিজের বাড়ি।

এই বাড়ির এক-একটি সম্পদ, ছেলেমেয়েরা। আর তাই, তাদের নিয়ে সব সময় ভারী উদ্বেগ বিমল করের। চান না, তারা বাইরে খেলাধুলো করুক, যদি চোট-আঘাত পায়, এই ভয়ে! তাই ঘরেই নানা রকম খেলাধুলোর বন্দোবস্ত। কত রকমের লুডো, সিঁথির বাড়ির লনেই হকি ও ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা, সবই করেছেন বিমল। তবে, সঙ্গে দিয়েছেন সততার পাঠ। তাই কন্যা শুভার গল্প ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে দেখে ‘দেশ’-এ চাকরিরত বিমল পরিষ্কার নির্দেশ দিলেন, ‘তুই আমাদের কাগজে (‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’) লেখা পাঠাস না।’

নিত্য উদ্বেগ, মৃত্যু সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি বিমল করকে ব্যক্তিজীবনে অতিমাত্রায় সাবধানী করে তোলে। গল্পটা শুনিয়েছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সত্তরের দশক। ঘি-ঘি রঙের ফিয়াট গাড়ি কিনেছেন বিমল। নিজেই চালান। প্রায়ই দেখা যায়, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। পাশে বসে সঞ্জীব। বিমলের নির্দেশ, ‘তুই পেছন দিকটা দেখবি। বিরাট কিছু আসতে দেখলে আমাকে আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে বলবি।’ ফলে, দৃশ্যটা এমন দাঁড়াত: বিমল কর গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে বসা সঞ্জীব পিছন দিকে মুখ করে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন, ‘...একটা বাস তীব্র গতিতে আর একটা বাসকে ওভার-টেক করে আসছে। দূরে একটা অয়েলট্যাঙ্কার দেখা যাচ্ছে!’ শেষমেশ আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু এক চালকের বন্দোবস্ত করে দেন।

কখনও বা ‘ধ্রুপদী আড্ডাবাজ’ বিমল কর ধর্মতলার এক নামী দোকানে বসে, চামচে করে শিঙাড়া খান। যদি, শিঙাড়ার মশলায় কাচের টুকরো থাকে! সত্যি এক দিন তা পাওয়াও গেল!

রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রেও এমনই সাবধানী। অজয় দাশগুপ্তর স্মৃতিতে রয়েছে— মহাত্মা গাঁধী রোড পারাপার করতে হবে। একটি ট্রাক দেখা গেল হাজির। সেটি চলে যাওয়ার পরেও নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে বিমল। কারণ? ‘ট্রামটা যাওয়ার পরে দোলানি লেগে তারগুলো কাঁপছিল, ওই অবস্থায় তা ছিঁড়েও তো যেতে পারে!’

এমনই ভয় যে, বইমেলাতেও একা যান না, দাঁত তুলতে গেলেও চার-পাঁচ জন সঙ্গী লাগে বিমলের। ভাঙা পায়ের অস্ত্রোপচারের বন্দোবস্ত হয় বাড়িতে। এমন সাবধানী, ঘরকুনো মানুষটিই কিন্তু আবার ক্রিকেট নিয়ে খুবই উৎসাহী। প্রায়ই তাঁকে দেখা যায়, রেডিয়োয় ভারতের টেস্টের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে উত্তেজিত হতে। আচমকা চিৎকার, হাততালি... এমএল জয়সীমা শতরান করেছেন! তবে, ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে আচমকা তীব্র অভিমান করে বসলেন এক বার, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেরেছে যে! দেশের হয়ে খেলবে, আর তুমি তার মান রাখবে না, এমন একটা ধারণা থেকেই বোধহয় এই বিতৃষ্ণা জন্মায় তাঁর। যদিও, খুঁটিনাটি বিষয়গুলি ভালই প্রত্যক্ষ করেন। তাই, ‘ক্রিকেট খেলার তুকতাক’-এ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে সুনীল গাওস্করের আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার দৃশ্যটি তুলে ধরেন। প্রত্যক্ষ করেন, গাওস্কর হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন তাঁর ছিঁড়ে যাওয়া কণ্ঠহার!

নিজের প্রয়াণলেখ

এমন নানা রঙের জীবনকে সঙ্গী করে, উপস্থিত হল ২০০৩। তখন তিনি বেশ অসুস্থ। আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যার জন্য তবুও যদি কিছু লেখা পাওয়া যায়, অনুরোধ রমাপদ চৌধুরীর। বলে চলেন বিমল কর, লেখেন স্বপন সাহা। ২৬ অগস্ট, মৃত্যুর সাত-আট দিন আগে শেষ করলেন ‘ইমলিগড়ের রূপকথা’। বিমল কর কোনখানে স্বতন্ত্র? উত্তরটা বোধ হয় লুকিয়ে ২০ জানুয়ারি, ২০০১-এ ‘দেশ’-এর প্রাক্তন সম্পাদক হর্ষ দত্তকে লেখা বিমল করের একটি চিঠিতে। তাতে লেখা, ‘এরপর বাকি থাকল নিজের অবিটিউয়ারি লেখা। যদি বলো সেটাও লিখে যেতে পারি।...’ লিখলেনও, ‘একদা ছিলেন তিনি/ এখন বিগত;/ কত শালা শোক করে/ হয়ে বিগলিত।’— নিজের অস্তিত্ব এবং চারপাশ নিয়ে এমন নির্ভেজাল রসিকতা বিমল করই বোধহয় করতে পারেন।

আসলে এই ভেজালহীন সাহিত্য-সাধনাতেই বিমল করের অধিষ্ঠান। মহাভারতের ‘উদ্যোগপর্ব’-এর একটি শ্লোক বিমল করের খুব প্রিয় ছিল: ‘নাসৌ ধর্ম্মো যত্র ন সত্যমস্তি ন তৎ সত্যং যচ্ছলেনাভ্যুপেতম্’। অর্থাৎ, যার মধ্যে সত্য নেই, তা ধর্ম নয়। যার মধ্যে ছল রয়েছে, তা সত্য নয়। — এ কথা আদর্শগত ভাবেই বিশ্বাস করেছেন বিমল। আর তাই শতবর্ষে বিমল-সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে সময়ের প্রতি ঋণী এক ছলহীন, সত্যান্বেষীকেই যেন বার বার খুঁজে পান পাঠক।

তথ্যঋণ: ‘উড়ো খই’, ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ’, ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকার বিমল কর সংখ্যা’, ‘বিমল কর: সময় অসময়ের উপাখ্যানমালা’: সম্পাদনা, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, ঊর্মি রায়চৌধুরী, শচীন দাশ

একটি দ্বিমাসিক পত্রিকায় (‘গল্পপত্র’) বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন এক নবীন লেখিকা। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সূত্রে, গ্রাম-জীবনের কথা সে সব গল্পে ফিরে আসে। সম্পাদকের জিজ্ঞাসা, ‘তুমি গ্রাম দেখছো তোমার নাগরিক অনুভূতি দিয়ে... গ্রামের মানুষের সঙ্গে তোমার শহুরে দূরত্ব পুরোপুরি মুছে ফেলতে পেরেছো? পারোনি। তাহলে শৌখিন মজদুরি কেন?’ সঙ্গে জানালেন নিজের অভিমতও, এ ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখলে গল্প হবে ঠিকই, তবে তা হবে প্রতিমা গড়ার মতো। তাতে ‘প্রাণ-প্রতিষ্ঠা’ হবে না।

‘চোখ খুলল’ লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের। সম্পাদক, বিমল কর।

আসলে সাহিত্যচর্চায় ‘শৌখিনতা’র ধার ধারেননি বিমল। চোখ মেলে দেখেছেন চার পাশ। আর নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় বুকে নিয়ে লগ্ন হয়েছেন সময়ের ছবিতে। সে ছবিতে মৃত্যু, মূল্যবোধ, গৃহস্থ-টানাপড়েন, এ সবই মূল উপজীব্য।

এই দেখাটার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর জন্ম, মামারবাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার টাকি লাগোয়া শঙ্খচূড়ায়, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২১-এ। বাবা, জ্যোতিষচন্দ্র কর। মা, নিশিবালা দেবী। তবে বাবা-কাকাদের রেল ও খনিতে চাকরির সূত্রে দীর্ঘ সময় কেটেছে ধানবাদ, হাজারিবাগ, কুলটি, আসানসোল, ডিসেরগড়, কালীপাহাড়ি-সহ বিস্তীর্ণ রেল ও কয়লা-শিল্পাঞ্চলে। প্রাথমিক পড়াশোনা ধানবাদেই। রেলের প্রাথমিক স্কুল ডিঙিয়ে ভর্তি হওয়া ধানবাদ অ্যাকাডেমিতে। ছোট্ট বিমল দেখে, পুরনো রেলপাড়ার দিকে, পাঁচিল ঘেরা বিরাট জায়গায় ছায়া বিছিয়েছে নিম, আম, তেঁতুলের সারি। সেখানেই মেটে লাল রঙের ‘কটেজ’বাড়িতে এই স্কুল।

শুধু দেখা নয়, বিমলের সাহিত্য-মনের মহীরুহটিও এখানেই হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করল। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, রেল ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘হাতেমতাই’ প্রভৃতি সিনেমা দেখা আর বিস্তর বইপত্র পড়া— এ সব নিয়েই দিন কাটে তার। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘যকের ধন’...‌ বেশ চলছিল। তাল কাটে জেঠামশাই সতীশচন্দ্রের ছেলে, বড়দার আনা একটা বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে। বেশ পড়া চলছে সে বই। আচমকা, বড়দার এক হাতে রইল বিমলের কান, অন্য হাতে শরৎচন্দ্র। নিশিবালার কাছে নালিশ, ‘মেজো কাকিমা, তোমার ছেলে ‘দেবদাস’ পড়ছে, উচ্ছন্নে যাবে।’

মাকে কম জ্বালাতন করে না বিচ্ছু ছেলেটি। এক বার ‘মেঘনাদবধ পালা’ দেখে লিখে ফেলল একটি ছোটখাটো পালা। ঠা-ঠা দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে চলছে অভিনয়। বিমল স্বয়ং মেঘনাদের ভূমিকায়। প্যাকিং বাক্সের লোহার পাত, রান্নাঘরের হাতা-খুন্তি নিয়ে যুদ্ধ বেশ জমে ওঠে। তবে, ‘অস্ত্রের’ ঝনঝনানিতে দুপুরের ঘুম ভেঙে গেল নিশিবালার। অগত্যা তাঁর হাতেই মেঘনাদ-নিধন!

এমন সাহিত্য-প্রীতির জন্য বার বার বিপদে পড়তে হয় বিমলকে। আসানসোল রেল স্কুলে বছর দুয়েক পড়াশোনা, ছ’মাসের অসুস্থতা, এ সব কাটিয়ে সে তখন কুলটি ম্যাকমিলান ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক। সে জন্য তার আগে, বোর্ডিংয়ে ক্যাম্পখাটে সামনে জ্যামিতির বই খুলে লণ্ঠনের মিঠে আলোয় বিমল পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর ‘সাড়া’ উপন্যাস! দেখে ফেললেন পণ্ডিতমশাই। মুহূর্তে পাঁচ অক্ষরের বিশেষণ প্রয়োগ করে উক্তি, ‘তুমি বুদ্ধদেব বসু পড়তাছ।... পরীক্ষায় ডাল গুলবা তুমি।’ সঙ্গে বিমলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন এক রাশ সংস্কৃত ব্যাকরণের বোঝা।

উনিশ দিনের অন্য পৃথিবী

প্রথাগত পড়াশোনা হোক বা জীবন, বিমলের দেখার চোখটা যেন ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়। এই দেখাটার পূর্ণতা যেন, তাঁর ‘স্বপ্নের রাজ্য’ কলকাতায়। আর তাই, কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে (বর্তমানে আর জি কর) ডাক্তারি পড়তে এসে বিমল ঘুরে বেড়ান গ্রেটা গার্বো, ক্লোদেত কোলবার্ট, মার্লিন ডিয়েট্রিচের ছবি দেখতে, টকি শো-হাউসে। অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, রাণীবালা প্রমুখের মঞ্চাভিনয়ও বড় টানে তাঁকে। হাতে আসে জীবনানন্দ দাশ থেকে আনাতোল ফ্রাঁস, এজ়রা পাউন্ড, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ থেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, এমন আরও কত কী। ডাক্তারির পড়াশোনা লাটে উঠল। পরিবার ভাবল, ডাক্তার না হোক, ছেলে ইঞ্জিনিয়ারটা অন্তত হোক। ভর্তি হওয়া শ্রীরামপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখানেও বিষয় ও কলেজ, দুই সম্পর্কেই বিতৃষ্ণা জন্মায়। অবশেষে, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করলেন বিমল কর, ১৯৪৩-এ।

এই টাল খেতে থাকা শিক্ষাজীবনকে আলগোছে পাশে রেখে, মহানাগরিক-সময়ের আগাপাশতলায় যেন ধীরে ধীরে ডালপালা মেলল সাহিত্যিক বিমলের মনটি। দেখলেন অনেক না-দেখাকে। ছাত্রজীবনে এক দিন দেখলেন, মহানগর ভাসছে জনসমুদ্রে। তাতে ভাসতে ভাসতে চলেছেন এক জন। কিন্তু সে সমুদ্রের তরঙ্গে বিমলের চশমাটি গেল ভেঙে। চটি জোড়াও ছিঁড়ে গেল। ‘অনাথ বালকের’ মতো অলিগলি ঘুরে ক্লান্ত বিমল দিনান্তে বাড়ি ফিরলেন। জনসমুদ্রের উদ্গাতা যিনি, তাঁকে অবশ্য দেখা হল না। বদলে, তাঁর কবিতা শোনালেন দাদামণি: “ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি/ চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে...”— দিনটা ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন।

ব্যক্তিজীবনেও তিনটি মৃত্যু ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে তাঁকে। তখন বিমল ছোট্টটি। হাজারিবাগ রেল-কোয়ার্টার্স ঠিকানা। সেখানে উঠোন জুড়ে দু’-আড়াই বছরের ছোট্ট বোনটি ঘুরপাক খেতে খেতে খেলছে। ওর গায়ের রংটা একটু শ্যামলা, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। আচমকা, পড়ে গেল সে। আর চোখ খোলে না। বিমলের স্মৃতিকে যেন ধিক্কার জানায় মৃত্যুর এমন নিরর্থক আগমন। তাতে বিসর্জনের বাজনার মতো সঙ্গত দেয় মা নিশিবালার ‘এস্রাজের ছেঁড়া তারে ছড় টানার মতো অদ্ভুত...’ কান্নার সুর।

এই হাহাকার যেন আরও প্রকট হল ঠাকুমা শরৎকুমারীর মৃত্যুতে। নাতি বিমল তখন কুলটির স্কুলে পড়ে। জরুরি তলব পেয়ে জামডোবায় এল। ঠোঁটটা নড়ে ওঠে শরৎকুমারীর, ‘দাদা, এলি?’ ওই শেষ... শীতের বাতাসে তখন যেন সব পাতা ঝরে গেল। ওই ঝরাপাতার ছায়াতেই বিমল রইলেন, আজীবন...। বাবার মৃত্যুতে এই ছায়াটাও বোধহয় টাল খেল। সেরিব্রাল স্ট্রোকে আপাত-ভাবে জগৎ-সংসার থেকে উদাসীন মানুষটির মৃত্যুতে বিমল অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

মৃত্যু এ ভাবেই বারংবার এসেছে তাঁর লেখায়। ‘জননী’ গল্পে ছেলেরা প্রয়াত মায়ের কথা ভেবে শোক করে না, তারা মায়ের অসম্পূর্ণতা ঢেকে দেওয়ার জন্য নিজেদের এক একটি বৈশিষ্ট্য যেন উপহার দিতে চায়। বিমল কর মৃত্যুমুখী নন, বরং কিঞ্চিৎ অবক্ষয় ও নৈরাশ্যবাদী।

নৈরাশ্য কী, তা কলেজ-পড়ুয়া বিমলকে চিনিয়েছে মহানগর কলকাতাও। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ। মহানগর কলকাতা, দিনে-রাতে যেন নিঝুম আঁধারে কাঁদে। এর মধ্যেই উপস্থিত ’৪৩-এর মন্বন্তর। এআরপি-তে চাকরিরত বিমল তখন বৌবাজারপাড়ায়। কলকাতা যেন অভাগীর স্বর্গ, তার শরীরের খানাখন্দে গ্রাম থেকে উঠে আসা নিরন্ন মুখ, আবর্জনা খুঁটে খাওয়া মানুষের ভিড়। এই সময়টাকে বিমল ধরেছেন ‘দেওয়াল’ উপন্যাসে। আবার, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর পটভূমিকায় লিখেছেন ‘অন্তরে’ গল্প। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলন, ‘পুলিশি-সন্ত্রাস’ নিয়ে লিখেছেন ‘নিগ্রহ’, ‘ওরা’, ‘সে’। ঘটনাচক্রে, ‘পুলিশি সন্ত্রাস’ টের পেয়েছেন বিমল নিজেও, দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন আগে। মানিকতলায় তখন দাঙ্গা চলছে। পুলিশ অকারণে তুলে নিয়ে গেল তাঁকে। অভিযোগ খুনের চেষ্টা ও খুনের ষড়যন্ত্র! বড়তলা থানা, লালবাজার হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেল... উনিশ দিনের মাথায় জামিন মিলল। তত দিনে, যেন অন্য পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাঁর।

শুধু সমসময় বা মৃত্যু নয়, প্রাত্যহিক জীবনের টানাপড়েনও বিমল করকে তাঁর সৃষ্টির উপাদান জুগিয়েছে বার বার। এই সমস্ত উপাদানকে সঙ্গী করেই লেখা ‘সুধাময়’, ‘পিঙ্গলার প্রেম’, ‘আত্মজা’, ‘জননী’, ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘আঙুরলতা’, ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’, ‘অম্বিকানাথের মুক্তি’, ‘খড়কুটো’, ‘বালিকা বধূ’, অসময়’, ‘পূর্ণ-অপূর্ণ’, ‘উপাখ্যানমালা’ প্রভৃতি বাংলা কথাসাহিত্যে বিমল করকে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। লিখেছেন ‘সায়ক’, ‘শঙ্খ’, ‘ঘাতক’ প্রভৃতি নাটক, ‘উড়ো খই’-এর মতো স্মৃতিকথা। আবার ‘সরস গল্প’-এ কৌতুকের গহন অরণ্যের আড়ালে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পিছলে আসা আলোর মতো আটপৌরে বাঙালির প্রাত্যহিক অসঙ্গতিগুলির সঙ্গেও পরিচিত করিয়েছেন পাঠককে। পারিজাত মল্লিক ছদ্মনামে লিখেছেন রহস্য গল্প, ‘গোলাপ কাঁটা’-ও। কখনও বা সৃষ্টি করেছেন ‘কিকিরা’ গোয়েন্দা-চরিত্র। যদিও,
কিঙ্কর কিশোর রায়, ওরফে কিকিরা নিজেকে গোয়েন্দা নয়, ‘ম্যাজিশিয়ান’ বলতেই পছন্দ করে।

উপাদানের পাশাপাশি বিমল আঙ্গিক-সচেতনও। এ বিষয়ে তাঁর মতান্তর ঘটেছে খোদ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘আঙুরলতা’। পুজোর পরে এক আড্ডায় উপস্থিত টালা পার্কের বাসিন্দা তারাশঙ্কর। এক সময় বিমল করকে বললেন, ‘চল, এগিয়ে দে।’ নবীনে-প্রবীণে চলেছেন। তারাশঙ্কর জানালেন, ‘আঙুরলতা’ গল্পটি ভালই। তবে পরামর্শ,
‘...অনেকটা না ছড়িয়ে, তুই সোজাসুজি গল্পে চলে আসতে পারতিস।’ বিনয়ের সঙ্গে বিমল কর জানালেন, তা সম্ভব নয়। কারণ, গল্পের পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি, তার নিজস্ব ‘লজিক’-এর জন্য। তারাশঙ্করের জবাব, ‘...এ যেন বাংলাদেশ দেখাতে গিয়ে প্রথমে ভারতবর্ষের ম্যাপ দেখিয়ে তার পরে বাংলাদেশ দেখাচ্ছিস।’ কথার যুক্তিটা মানলেন বিমল কর। কিন্তু স্থিত রইলেন, নিজমতেই।

নিজের মতকে এ ভাবেই বিশ্বাস করেন বিমল। আবার, ‘ছোটগল্প: নতুন রীতি’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় এক প্রবন্ধে জানিয়ে দেন, ‘...নতুন রীতির পথে সবাইকে আসতে হবে এমন নয়।’ নতুনের প্রতি আগ্রহটা বিমল করের স্বভাবজাত। তাই তিনি অবতীর্ণ হন শব্দান্বেষীর চরিত্রেও। অভিজ্ঞতাটা সুধাংশু ঘোষের: বর্মন স্ট্রিটে তখন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিস। সেখানেই গিয়েছেন সুধাংশু। হঠাৎ বিমল জানতে চাইলেন, ‘গরুর কতরকম প্রতিশব্দ জানো?’ আসলে, একটা লেখায় ব্যস্ত তখন লেখক। তাতে গরুটি একটি চরিত্র। কিন্তু যে পরিবেশ তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাতে ‘গরু’ শব্দটি খাপ খাচ্ছে না। আবার, পুরনো গল্পের আমেজ, মজার জন্য ‘বালিকা বধূ’-তে বাহন করেন সাধু বাংলা।

এই সমস্ত সাহিত্যকীর্তি ও ভাবনার জন্যই দু’বার আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে আসে প্রাপ্তির নিজস্ব নিয়মেই। তাঁর গল্প নিয়েই তৈরি হয়, ‘বালিকা বধূ’ (বাংলা ও হিন্দিতে), ‘ছুটি’, ‘বসন্ত বিলাপ’ প্রভৃতি সিনেমা।

তবে পুরস্কার বা সিনে-জগতের হাতছানি, সবেতেই যেন নিস্পৃহ বিমল, হয়তো সেটা তাঁর স্বভাব ও মূল্যবোধের কারণেই।

বিমল করের লেখা অবলম্বনে তৈরি ‘রৌদ্রছায়া’র প্রিমিয়ার হবে নিউ এম্পায়ারে। সেখানে যাচ্ছেন লেখক, সঙ্গী সুধাংশু। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সামনে এসে বললেন, ‘ধুর ওখানে যাব না। কত চেনা লোকজন। ফর্মালিটি!’ গেলেন লাইট হাউসে, অন্য সিনেমা দেখতে। আবার, বিমল করের ‘কালিদাস ও কেমিস্ট্রি’ অবলম্বনে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘দিল্লাগী’ তখন মারমার কাটকাট চলছে। তা দেখে, মুম্বইয়ের প্রযোজক মহলে বিমল করের গল্পের চিত্রসত্ত্ব কেনার হুড়োহুড়ি। মুম্বইয়ের এক পরিচালক হোটেল বুক করে ফেললেন। মুম্বইয়ে যাওয়ার প্লেনের টিকিটও পাঠিয়ে দিলেন লেখককে। সঙ্গে চিঠি, ‘আপনি অনুগ্রহ করে এলে আমি ছাড়াও, আরও অনেক প্রযোজক আপনার গল্প উপন্যাসের চিত্রসত্ত্ব কিনবেন।’ কিন্তু তিনি যে বিমল কর। বিনয়ের সঙ্গে জবাব, ‘যাঁর দরকার, কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে!’ অর্থাৎ বাজারে বেচতে যাব না আমার সৃষ্টি, মনোভাবটা এমন।

একই ভাবে, শুধুমাত্র প্লেনে চাপার ভয়ে আমেরিকা-সহ নানা বিভুঁইয়ের ডাক তিনি বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়ের একটি ঘটনা এখনও ভাসে সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিতে। তিনি বলেছেন, “সে সময়ে ওঁর সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিলাম। পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনে বিমলদা প্রথমে বলেছিলেন, দিল্লি তো অনেক দূরে। অত দূরে কে যাবে! অবশেষে জোরাজুরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম!”

ভাগ্যিস নিয়ে গিয়েছিলেন! অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত এই উপন্যাসই ‘অসময়’। সেখানে তরুণ আয়না-তপুর প্রেমের পাশাপাশি আছেন জ্যাঠাইমা। আছে মোহিনী ও তার ভাইয়ের বন্ধু অবিনের নিরুচ্চার সম্পর্ক। অবিন আদৌ অবাঙালি নাম নয়। নায়ক ঘোষণা করেছিল, তার অবিনয় নামটি সে এভাবে ছেঁটে দিয়েছে। একদা বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতায় জানিয়েছিলেন, ‘বিনয় বৃদ্ধের বিদ্যা’। সত্তর দশকের বিনয়হীন এই অবিন নামে তাই আজও ‘কিছু মায়া রয়ে গেলো’।

বিয়ের ঘোষণা, ট্রাম থেকে লাফ

বিমল কর এমন ধারারই, আপাতদৃষ্টিতে খামখেয়ালি। কিন্তু আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর ‘তফাত শুধু শিরদাঁড়া’য়। এ জন্য বার বার তাঁর কর্মজীবনে তাড়া করেছে অনিশ্চয়তা। ৩০ টাকা মাইনের এআরপি-র কাজ, নৌবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েও ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ না করতে পারা, ৫৬ টাকা মাসমাইনের রেলের অ্যাকাউন্টস অফিসের চাকরি, পরে রেলেরই ‘চেক-রাইটার’-এর চাকরি— সবই খোলসের মতো ঝরে পড়ে সদা-নবীন এই প্রাণের চলনটি থেকে। চেক রাইটারের চাকরিতে ঘুষ নিতে পারেননি যে বিমল! অগত্যা সব ছেড়ে কলকাতায় চলে আসা। ‘পরাগ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ৪০ টাকা মাইনের চাকরিতে যোগ দিলেন বটে। কিন্তু এখানে মাইনে হওয়ার কোনও দিন-তারিখ নেই। পত্রিকার ঝাঁপও ক্রমে বন্ধ হল। বন্ধুদের নিয়ে ‘রহস্যরোমাঞ্চ’ নামে একটি কাগজ খুললেন তিনি। পরে, ‘পশ্চিমবঙ্গ’, ‘সত্যযুগ’ প্রভৃতি পত্রিকায় চাকরি। কিন্তু কোথাও যেন বোল ফোটে না জীবনে।

ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। বন্ধু ও কবি অরুণ ভট্টাচার্য এক তরুণ লেখকের সঙ্গে বিমলের আলাপ করিয়ে দিলেন। ওই লেখকই বিমল করের ‘ইঁদুর’ গল্পটি নিয়ে গেলেন, ‘দেশ’ পত্রিকার কার্যালয়ে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ পড়লেন গল্পটি। বললেন, “তোমার বিমল করকে বলো ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য একটি গল্প লিখতে।” ভূমিষ্ঠ হল, ‘বরফসাহেবের মেয়ে’!— ওই তরুণ লেখকটি গৌরকিশোর ঘোষ। ‘দেশ’ পত্রিকায় পর পর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হল। অবশেষে, ১৯৫৪-য় ‘দেশ’ পত্রিকাতেই চাকরি। অনিশ্চিত জীবনের তরী যেন তটে ভিড়ল।

বিমল করের বাবাও ছেলের এ চাকরির খবরে খুব খুশি। কিন্তু এ ছেলের মতিগতিতে যে তেমন আস্থা নেই। তাই চিঠিতে লিখলেন, ‘দায়দায়িত্ব বেড়েছে তোমার। মতি স্থির রেখে কাজকর্ম করবে।’ ‘দেশ’ পত্রিকায় কাজটা অবশ্য প্রায় তিন দশক ধরে ‘মতি স্থির রেখে’ই করেছেন বিমল। কিন্তু বাবার চিঠিতে ওই যে ‘দায়দায়িত্ব বৃদ্ধি’র কথা, সেটির সৌজন্যেও গৌরকিশোর।

সালটা ১৯৫১। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে চিনেবাদাম সঙ্গতে আড্ডা চলে। আজ বিমলের জবাব ছাড়া উঠবেন না, জানিয়ে দিয়েছেন গৌরকিশোর। প্রশ্নটা অবশ্য বেশ কঠিন: ‘বিমল, আজই একটা সিদ্ধান্ত নাও।... বিয়ে করবে, কি করবে না?’ দীর্ঘ নীরবতার পরে, সম্মতি দিলেন বিমল। উঠলেন শ্যামবাজারগামী ট্রামে। কলেজ স্ট্রিটে ডাবপট্টির কাছে দুলকি চালে চলেছে ট্রাম। ভর্তি যাত্রী। সহসা, গৌরকিশোরের চিৎকার, ‘বন্দে মাতরম্’ বলে, বিমলের বিয়ের ঘোষণা করতে লাগলেন। ট্রাম থেকে লাফ মারলেন বিমল... পাত্রী, কোচবিহারের। আলিপুর ডুয়ার্স গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা, গীতা। দেখাশোনার ঠিক পাঁচ দিন বাদে, ১০ জুন, ১৯৫১-য় বিয়েটা সারা হল। নতুন দম্পতির সংসার জমে ওঠে মণীন্দ্র রোডের অদূরে, ভাড়াবাড়িতে, পাইকপাড়ায়। এঁদের চার সন্তান: দূর্বা, শুভা, অনুভা এবং সমীর।

গাওস্করের কণ্ঠহার

‘দেশ’-এর চাকরি, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী— বেশ কাটে বাউন্ডুলে স্বভাবের মানুষটার। কিন্তু খেয়ালিপনাটা তার মধ্যেও থাকে নিজস্ব গতিপথে। তবে সব কিছুর পরেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বিমল ‘আন্তরিকতা ও সামাজিকতায় নির্ভুল গৃহস্থ’। এই গৃহস্থ-আটপৌরে মানুষটির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সর্বদা ফিটফাট, ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে এই ছ’ফুট লম্বা শীর্ণ চেহারার মানুষটির হাতে সর্বদা জ্বলন্ত সিগারেট। আদ্যন্ত শৌখিন মানুষটি বাড়িতে থাকলেও বিকেলে গায়ে দেন রকমারি রঙিন পাঞ্জাবি! দেবদ্বিজে তেমন আসক্তি নেই, পুজোপাঠও করেন না। তবে, বিশেষ প্রিয় ‘উপনিষদ’ ও ‘বাইবেল’। এই মানুষটির নানা খামখেয়ালিপনা আগলে রাখেন স্ত্রী গীতা।

যেমন— শীত নামলেই পাইকপাড়ার ঘরে রোদ-বারান্দায় লিখতে বসেন বিমল। লেখার আগে স্ত্রীকে অনুরোধ, ‘...লেখার প্যাডটা একটু সেঁকে দাও!’ রান্নাঘরে আগুনের উপরে প্যাডটা ধরে কায়দা করে মোচড় দেন গীতা। উষ্ণ পাতা পেয়ে লেখকের প্রতিক্রিয়া, ‘এই বার কালিটা ভাল সরবে।’ আর সে লেখা পুজোর মরসুমে হলে, তার আগে একটি নতুন কলম কেনা চাই-ই তাঁর, ধর্মতলায় কে সি দাশ লাগোয়া এক দোকান থেকে। তার পরে, নির্দিষ্ট কোম্পানির কাগজে লাল, কালো, নীল, সবুজ আখরে ফুটে ওঠে নতুন গল্প, উপন্যাস। সঙ্গে ভরে ওঠে লেখার টেবিলের পাশে রাখা বেতের ঝুড়িটাও— না-পছন্দ, বাতিল লেখার ছেঁড়া পাতায়। মগ্ন সাহিত্যিকের আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে তখন লম্বা ছাই। —দৃশ্যটা স্মৃতিতে রয়েছে কন্যা শুভার। স্মৃতিতে আরও রয়েছে, পুজোর লেখা চলাকালীন বাবার থমথমে মুখটাও। আর যে দিন বাড়িতে আগমনি গানের রেকর্ড শোনা যেত, বোঝা যেত, লেখা শেষ। এ বার পুজোর ফর্দ হবে। বিমল-গীতার পুজোর বাজারে ফেলে আসা হাজারিবাগ, আত্মীয়স্বজনদের জন্য একটা বিশেষ জায়গা থাকে। বাজারের তালিকায়, জামাকাপড় ছাড়াও, সদ্য-ওঠা ফুলকপি, নামী ব্র্যান্ডের তামাক পাতা, আরও কত কী! এক-এক বার হাওড়া স্টেশনে সে সব লটবহর নিয়ে যেতে ভাড়া করতে হয় টেম্পো!

বিমলের আর একটা খেয়ালি অভ্যেস, ভাড়াবাড়ি বদলের। পাইকপাড়া, দমদম, বাঙুর, সিঁথি, এমন নানা জায়গায় তিনি থেকেছেন। বাজার করতে গিয়েও বাড়ি পছন্দ করে এসেছেন! অনেক পরে, সল্টলেকে করেছেন নিজের বাড়ি।

এই বাড়ির এক-একটি সম্পদ, ছেলেমেয়েরা। আর তাই, তাদের নিয়ে সব সময় ভারী উদ্বেগ বিমল করের। চান না, তারা বাইরে খেলাধুলো করুক, যদি চোট-আঘাত পায়, এই ভয়ে! তাই ঘরেই নানা রকম খেলাধুলোর বন্দোবস্ত। কত রকমের লুডো, সিঁথির বাড়ির লনেই হকি ও ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা, সবই করেছেন বিমল। তবে, সঙ্গে দিয়েছেন সততার পাঠ। তাই কন্যা শুভার গল্প ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে দেখে ‘দেশ’-এ চাকরিরত বিমল পরিষ্কার নির্দেশ দিলেন, ‘তুই আমাদের কাগজে (‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’) লেখা পাঠাস না।’

নিত্য উদ্বেগ, মৃত্যু সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি বিমল করকে ব্যক্তিজীবনে অতিমাত্রায় সাবধানী করে তোলে। গল্পটা শুনিয়েছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সত্তরের দশক। ঘি-ঘি রঙের ফিয়াট গাড়ি কিনেছেন বিমল। নিজেই চালান। প্রায়ই দেখা যায়, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। পাশে বসে সঞ্জীব। বিমলের নির্দেশ, ‘তুই পেছন দিকটা দেখবি। বিরাট কিছু আসতে দেখলে আমাকে আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে বলবি।’ ফলে, দৃশ্যটা এমন দাঁড়াত: বিমল কর গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে বসা সঞ্জীব পিছন দিকে মুখ করে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন, ‘...একটা বাস তীব্র গতিতে আর একটা বাসকে ওভার-টেক করে আসছে। দূরে একটা অয়েলট্যাঙ্কার দেখা যাচ্ছে!’ শেষমেশ আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু এক চালকের বন্দোবস্ত করে দেন।

কখনও বা ‘ধ্রুপদী আড্ডাবাজ’ বিমল কর ধর্মতলার এক নামী দোকানে বসে, চামচে করে শিঙাড়া খান। যদি, শিঙাড়ার মশলায় কাচের টুকরো থাকে! সত্যি এক দিন তা পাওয়াও গেল!

রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রেও এমনই সাবধানী। অজয় দাশগুপ্তর স্মৃতিতে রয়েছে— মহাত্মা গাঁধী রোড পারাপার করতে হবে। একটি ট্রাক দেখা গেল হাজির। সেটি চলে যাওয়ার পরেও নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে বিমল। কারণ? ‘ট্রামটা যাওয়ার পরে দোলানি লেগে তারগুলো কাঁপছিল, ওই অবস্থায় তা ছিঁড়েও তো যেতে পারে!’

এমনই ভয় যে, বইমেলাতেও একা যান না, দাঁত তুলতে গেলেও চার-পাঁচ জন সঙ্গী লাগে বিমলের। ভাঙা পায়ের অস্ত্রোপচারের বন্দোবস্ত হয় বাড়িতে। এমন সাবধানী, ঘরকুনো মানুষটিই কিন্তু আবার ক্রিকেট নিয়ে খুবই উৎসাহী। প্রায়ই তাঁকে দেখা যায়, রেডিয়োয় ভারতের টেস্টের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে উত্তেজিত হতে। আচমকা চিৎকার, হাততালি... এমএল জয়সীমা শতরান করেছেন! তবে, ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে আচমকা তীব্র অভিমান করে বসলেন এক বার, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেরেছে যে! দেশের হয়ে খেলবে, আর তুমি তার মান রাখবে না, এমন একটা ধারণা থেকেই বোধহয় এই বিতৃষ্ণা জন্মায় তাঁর। যদিও, খুঁটিনাটি বিষয়গুলি ভালই প্রত্যক্ষ করেন। তাই, ‘ক্রিকেট খেলার তুকতাক’-এ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে সুনীল গাওস্করের আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার দৃশ্যটি তুলে ধরেন। প্রত্যক্ষ করেন, গাওস্কর হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন তাঁর ছিঁড়ে যাওয়া কণ্ঠহার!

নিজের প্রয়াণলেখ

এমন নানা রঙের জীবনকে সঙ্গী করে, উপস্থিত হল ২০০৩। তখন তিনি বেশ অসুস্থ। আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যার জন্য তবুও যদি কিছু লেখা পাওয়া যায়, অনুরোধ রমাপদ চৌধুরীর। বলে চলেন বিমল কর, লেখেন স্বপন সাহা। ২৬ অগস্ট, মৃত্যুর সাত-আট দিন আগে শেষ করলেন ‘ইমলিগড়ের রূপকথা’। বিমল কর কোনখানে স্বতন্ত্র? উত্তরটা বোধ হয় লুকিয়ে ২০ জানুয়ারি, ২০০১-এ ‘দেশ’-এর প্রাক্তন সম্পাদক হর্ষ দত্তকে লেখা বিমল করের একটি চিঠিতে। তাতে লেখা, ‘এরপর বাকি থাকল নিজের অবিটিউয়ারি লেখা। যদি বলো সেটাও লিখে যেতে পারি।...’ লিখলেনও, ‘একদা ছিলেন তিনি/ এখন বিগত;/ কত শালা শোক করে/ হয়ে বিগলিত।’— নিজের অস্তিত্ব এবং চারপাশ নিয়ে এমন নির্ভেজাল রসিকতা বিমল করই বোধহয় করতে পারেন।

আসলে এই ভেজালহীন সাহিত্য-সাধনাতেই বিমল করের অধিষ্ঠান। মহাভারতের ‘উদ্যোগপর্ব’-এর একটি শ্লোক বিমল করের খুব প্রিয় ছিল: ‘নাসৌ ধর্ম্মো যত্র ন সত্যমস্তি ন তৎ সত্যং যচ্ছলেনাভ্যুপেতম্’। অর্থাৎ, যার মধ্যে সত্য নেই, তা ধর্ম নয়। যার মধ্যে ছল রয়েছে, তা সত্য নয়। — এ কথা আদর্শগত ভাবেই বিশ্বাস করেছেন বিমল। আর তাই শতবর্ষে বিমল-সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে সময়ের প্রতি ঋণী এক ছলহীন, সত্যান্বেষীকেই যেন বার বার খুঁজে পান পাঠক।

তথ্যঋণ: ‘উড়ো খই’, ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ’, ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকার বিমল কর সংখ্যা’, ‘বিমল কর: সময় অসময়ের উপাখ্যানমালা’: সম্পাদনা, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, ঊর্মি রায়চৌধুরী, শচীন দাশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bimal Kar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy