বসন্তপঞ্চমী: খুলে গিয়েছে শিক্ষাঙ্গন। ফিরে এসেছে সবাই মিলে একসঙ্গে মেতে ওঠার বাণীবন্দনা
এই তো গত বছরই সেই অতিকায় মাহেন্দ্রসংযোগটি প্রায় ঘটে গিয়েছিল। সরস্বতী পুজো পড়েছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি, আর ভ্যালেন্টাইনস ডে এল তার দু’দিন আগেই, একে সে ১৪ ফেব্রুয়ারি তায় রবিবার। হ্যালির ধূমকেতু ৭৫ বছরে এক বার এলেও, সরস্বতী পুজোর হাত ধরাধরি, গা ঘেঁষাঘেঁষি ভ্যালেন্টাইনস ডে-র এই ‘লাভ’জনক অফার কিন্তু দু’-চার বছর অন্তরই ঠিক মিলে যায়। তিরে গাঁদাফুল গেঁথে তাক করে তাকে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে দেন কিউপিডকিশোর কিংবা মদনদেবতা। অথবা স্বয়ং প্রেমনামধারী সলমন খান। এবং, তাঁদের উপর নির্ঘাত কৃপাদৃষ্টি থাকে ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে’রই।
তিনি যে আছেন, এবং বিদ্যা ছাড়াও বিদ্যার্থীদের জীবনে মননে রোম্যান্স-রাগিণীর প্রথম উন্মেষে যে তাঁরই মুখ্য ভূমিকা— এ বছরও, সপ্তাহান্ত ও ফের এক রবিবারকে সঙ্গে নিয়ে বসন্তপঞ্চমীর পুনরভ্যুত্থানে আবারও সে কথাই ঘণ্টাকাঁসরশঙ্খধ্বনিযোগে প্রমাণিত হল। স্বাভাবিক। শীত গিয়ে বসন্ত আসবে, হংসারূঢ়া দেবী বরাভয় হস্তে আসনে উপবিষ্টা হবেন, তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে এক পলকের একটু দেখার বিনিময় হবে। তার জন্য সময়মতো স্কুল-কলেজ, গ্রন্থাগার-পাঠাগার ইত্যাদির তালা খুলে দিয়ে পুজোর ব্যবস্থাটুকু না করলে চলে?
মকবুল ফিদা হুসেন দেবীর মধ্যে রতিভাব পরিস্ফুট করে, বহু মানুষের রোষ-দাবানলে পড়েছিলেন। এই খবরটি যে বছর শুনেছিলাম, তখন তার গূঢ়ার্থ বুঝিনি, কিন্তু সেই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বীণাপাণি নিজেই আমার জীবনে আশা ভোঁসলে রূপে আবির্ভূত হলেন। হয়েছিল কী, পড়তাম তো শতবর্ষপ্রাচীন প্রকাণ্ড কড়া গার্লস স্কুলে। সেখানে সাহিত্য ভূগোল ইতিহাস ইত্যাদি হামেশাই এক রাত পড়েই স্টেজে মেরে দিতাম। মুশকিলটা বাধত বিজ্ঞানে, মূলত অঙ্কে। সেগুলোকে হাত করতে তো প্রতি দিন বইখাতা নিয়ে বসতে হবে, কে সি নাগের ষোলোটা অনুশীলনীর বত্রিশটা করে অঙ্ক শেষ করে ‘নবগণিত মুকুল’ নামের আর একটি ইট ভাঙতে হবে। আমার কি অত সময় আছে রে ভাই? বুধসন্ধেয় ‘চিত্রহার’ দেখে আমাকে শ্রীদেবীর নাচ তুলতে হয়, শুক্র-শনি-রবি হিন্দি সিনেমা গুলে খাওয়ার পালা, তার উপরে আছে সুপারহিট মুকাবলা। আনন্দমেলা তখন আদ্ধেক বই জুড়ে টিনটিনের কমিকস ছাপছে, পাড়ার লাইব্রেরির সদস্যও হয়েছি। এট্টুস রবীন্দ্র-শরৎ রচনাবলী টুকুস করে তুলে নিচ্ছি। লাইব্রেরিতে গিয়ে বলি ইস্কুলে বলেছে, আর বাড়িতে বিনোদিনী-চন্দ্রমুখীদের লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ, নারান গাঙ্গুলি দিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে রাখি। অতএব আমি অত্যন্ত ব্যস্ত লোক, অঙ্ক করার সময় পাইনে।
কিন্তু পরীক্ষার খাতা লুকোনোর আর রেজ়াল্টে অভিভাবকের সই নকলের সাহস তখনও জুটিয়ে উঠতে পারিনি। স্কুল সোজা পুলিশে দিয়ে দিতে পারত, আর জেলে কি টিভি দেখতে দিত? অতএব, শর্টকাট নিতে ‘সা মে বসতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী’র শরণ নিলাম। স্কুলের প্রার্থনাবই আর রিপোর্ট কার্ডের উপরে তাঁর মাধুরী দীক্ষিতকে টক্কর দেওয়া ফ্যাশনেবল ছবি আছে, তাই বেশ পছন্দের, নিজের মনের মতো লোক মনে হয়। আর প্রেয়ার-লাইনে রোজই সরস্বতী বন্দনা করে পেন্নাম ঠুকে তবে ক্লাসে যাই। উপরন্তু, তাঁর সঙ্গে আমাদের বাড়িরও খুবই সুসম্পর্ক। প্রতি বছর আলাদা ঘর খুলে লোক ডেকে প্যান্ডেল বেঁধে পুজো হয়। আমার মনে হল, প্রচণ্ড ভক্তি দেখালে তিনি আমাকে নিশ্চয়ই অঙ্কজয়ের অস্ত্র দেবেন। আসলে আইডিয়াটা এসেছিল পর্দার পিছন থেকে। ক’দিন আগেই সেখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ঠাকুমার ঘরে ডিডি বাংলায় ‘দাদার কীর্তি’ দেখছিলাম। তাপস পালও হাঁদাকান্ত ছিলেন, এক গলা জলে শীতে ঠকঠক করতে করতে দেবীর নাম জপায় তাঁর সরস্বতীপ্রাপ্তি ঘটে। ভাগ্যিস, কালিদাসের গল্পটা তখনও ভাল করে জানতাম না, নইলে হয়তো মোটা দড়িগাছা নিয়ে গাছ খুঁজতে বেরোতে হত...
তা, সে বার বাসন্তিক শুক্লপক্ষে সরস্বতী ঠাকুর বাড়ি আসতেই স্কুলের স্তবগুচ্ছ, গীতা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সামনে মাদুর পেতে ধর্নায় বসে পড়লাম। বাড়ির লোকের দেখে চক্ষে জল এসে গেল। আহা! এই বয়সেই এত ভক্তি! তাঁদের পিঠচাপড়ানিতে আমার উৎসাহের আগুনে ঘৃতাহুতি হল। ‘যা কুন্দেন্দু তুষারহারধবলা, যা বীণা বরদণ্ডমণ্ডিতকলা’ থেকে শুরু করে ‘নয়ননন্দনং চিত্ততর্পণং মরণবারণং তপ্তজীবনং’ হয়ে খেপে উঠে ‘বাণীবিদ্যাপ্রদায়িনী নমামি ত্বং’ বলে সারদেশ্বরীর চরণপঙ্কজে মন্ত্রঃপূত জলে ধৌত চন্দনচর্চিত গাঁদা নিক্ষেপ করে চললাম টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা! ঠাকুরমশাই পুজো করে সবাইকে হোমের টিপ পরিয়ে চলে গেলেন। এক বার ব্রেক নিয়ে টমেটো-গাজর-কড়াইশুঁটির সুবাসিত খিচুড়ি ও ফুলকপির মচমচে বড়া খেয়ে এসে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে, ঘণ্টা নাড়িয়ে ফের শুরু করলাম। ‘জয় জয় দেবী চরাচরসারে কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’— কচিকণ্ঠের এ হেন পুজোর চোটে বাগবাজারের পথচলতি দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে এসে আমাদের ঠাকুরকে গদগদচিত্তে প্রণাম করে যেতে লাগলেন। শুধু প্ল্যানে একটা গলতি হয়ে গেল।
শেষ শীতের দুপুরের মায়াবী রোদের ঝাঁঝে হোক বা পেটভর্তি খিচুড়ি আর টোপা কুলের চাটনির আয়েশে, কিংবা এমন সাঙ্ঘাতিক তপস্যার ক্লান্তিতে, আমি মা সরস্বতীর সামনের মাদুরেই হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম।
এবং বিদ্যাহস্ত বলছি, স্বপ্নে তিনি এলেন। লাল লাল আলতারাঙা পায়ের ছাপ, মৃন্ময়ী চিন্ময়ী হয়ে উঠে আমার সামনে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছেন। পাশে বসলেনও মনে হয়। আমি আধো তন্দ্রায় শিউরে উঠে তাঁকেই জড়িয়ে আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল মূর্তির সামনে টুং-টাং, খুটখাটে। মা সন্ধ্যারতির জোগাড় করছেন।
এমন আশীর্বাদ, বললেই তো তার প্রভাব নষ্ট। ঘটনাটি নিজের পেটে গচ্ছিত রাখলাম। কয়েক হপ্তাতেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। তখনও অঙ্ককে বাগে আনতে পারছি না, তবে জানি পরীক্ষা-হলে পেনের উপর সরস্বতী ভর করে ঠিক উতরে দেবেন। আমি রামানুজন হব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন।
না। অঙ্কের নম্বরের সবিশেষ হেরফের হল না। স্বপ্ন কি তবে সিম্পল স্বপ্নই ছিল? ভাবতে ভাবতে ভুলেই গেলাম এক দিন। তার পর ফল ফলল, আস্তে আস্তে। স্লো-পয়জ়নের মতো, স্লো মির্যাকল। এমনিতে, এর পর থেকে কে সি নাগ নিয়ে বসলেই ‘কোই মিল গয়া’-র হৃতিকের মতো ঝড়ের বেগে সব সমীকরণ মিলিয়ে ফেলার কথা ছিল। তার বদলে, এক পবিত্র সন্ধেয় পাটিগণিতের খাতা খুলতেই কানের কাছে আশা ভোঁসলের গলা শুনলাম— “তোলো ছিন্ন বীণা, বাঁধো নতুন তারে। ভরে নাও সুর গাও জীবনেরই জয়গান!”
দু’কান হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। গান এ বারে একেবারে মস্তিষ্কের ভিতর হতে কলকল করে উঠল। “দুনিয়া মাঙ্গে আপনি মুরাদেঁ ম্যায় তো মাঙ্গু সাজন... ও ও ও! ও ও!... দিল দিওয়ানা... বিন সজনাকে...”
ধীরে ধীরে সমস্তটাই বোঝা গেল। জীবন আমার বরাবরের জন্য সরস্বতী পুজো হয়ে গিয়েছে। শুনেছিলাম, কুম্ভকর্ণ যখন ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর চেয়েছিলেন, তখন বাগ্দেবী তার জিভে ভর করেন। ব্যস, অনন্ত জীবন চাইতে গিয়ে কুম্ভকর্ণমশাই বলে বসলেন, আমি অনন্ত নিদ্রা চাই। তার পর থেকেই, ছ’মাসের ঘুম। কিন্তু, আমার বেলায় কী হল? আমি তো পুজোর আগে কুল খাইনি! শুধু জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের আরাধ্যা শ্বেতপদ্মাসনার করুণাই ভিক্ষা করেছিলাম মোটে, যাঁর স্তোত্রে নাকি মুখরিত থাকে সরস্বতী নদীর প্রবাহপথের কুঞ্জগুলি। তাঁর বদলে এ কার মুখচন্দ্রিমা ধরা দিল শুক্লাষষ্ঠীর গোধূলিবেলায়, কাঁচা হলুদ গোলা জলের তিরতির দর্পণে! ইনি তো কোনও শ্বেতচন্দনবর্ণা চঞ্চলা কিশোরী, পারাবতপ্রিয়া! যাঁর জ্যোৎস্নামাখা গণ্ডদেশে জীবনের প্রথম প্রেমস্পর্শ এঁকেছিল বলে মুখ ফুটে জানিয়ে আজীবন ধিক্কৃত হলেও, ঠিক তক্ষুনি দিকশূন্যপুরের রাস্তাটাও খুঁজে পেয়ে গিয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের সেই স্কুলবালক। তাঁর এই অন্য রূপ সন্ধানের ইঙ্গিত স্বয়ং বিদ্যাসাগরের কলমেও। বিসর্জনের যাওয়ার আগে সেই তিনিই কি আমাকে শ্রীরাধার সত্তায় দীক্ষিত করে গেলেন?
দুষ্টু সরস্বতীর সেই মিষ্টি আলো যে আমার ক্লাসের অনেককেই ছুমন্তর জাদুঅন্তর করছে, সেও ক্রমেই দেখতে পেলাম। ক্লাস এইট, তিনটি সেকশন মিলিয়ে ছাত্রী সংখ্যা ১১৮, মোটামুটি প্রত্যেকের প্রিয় বই ‘ন হন্যতে’। তাদের মধ্যে সাত-আট জন ইতিমধ্যেই বাগ্দেবীর কৃপায় বাগ্দত্ত। ভাগ্যবানরা দাদার বন্ধু, কলেজপড়ুয়া টিউটর, পাশের ছাদের ক্রিকেটার। বাকিদের পঞ্চাশ শতাংশ রাজ, রাহুল অথবা ‘টাইটানিক’-এর জ্যাককে খুঁজছে। অবশিষ্টরা চশমা পরে পাঠ মুখস্থ করতে করতে কড়াইশুঁটির কচুরি খাচ্ছে। ক্লাস নাইনে উঠতে ছাত্রীসংখ্যা হয়ে দাঁড়াল ১০৪। ১৪ জন অমনোযোগিতার কারণে টিসি পেয়েছে।তার মধ্যে এক জন স্কুল পালিয়ে কার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল। মেট্রো থেকে স্কুলে আসার পথে দিদিমণি দেখে ফেলেছেন। আর এক জন অক্ষয়কুমারের ছবি নিয়ে ইশকুলে এসেছিল। দিদিরা দেখে প্রশ্ন করতে বলেছিল, আজ্ঞে আমার মামা হন। এক অল্পবয়সি শিক্ষিকা বিষয়টা ধরে ফেলেন। তা, সে মেয়েটিও ডাহা ফেল করেছে। তার পর অবশ্য ক্লাস নাইনে উঠতেই প্রণয়পাশে বন্দিনীদের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে দাঁড়াল অন্তত কুড়ি-বাইশ। সৌজন্যে মাধ্যমিকের কো-এড কোচিং ক্লাসগুলি।
সেই অক্ষয়কুমার-পর্বের পর স্কুল যারপরনাই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। সে বছর সরস্বতী পুজোর দিন দুই আগের ঘটনা। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার গুমোটের মাঝেও ক্লাসের মেজাজ ঈষৎ চনমনে। কারণ সেই পিরিয়ডের দিদিমণি পুজোর শিকলি বানাচ্ছেন। তাই ক্লাসে আসতে দেরি হচ্ছে। ক্লাসরুমে একটি মেয়ে বিনুনিতে আঙুল পাকাতে পাকাতে বেড়াতে গিয়ে গাইডের সঙ্গে তার ফ্লার্ট-কাহিনি কিঞ্চিৎ রং চড়িয়ে বিবৃত করছে, যেন রিয়েল লাইফ ‘রাজা হিন্দুস্তানি’! হুসহাস করে শুনছে বাকিরা, এমন সময় একটি ক্লাস ফাইভের পুঁচকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ক্লাসে ক্লাসে সাবধান করে গেল। “পালাও পালাও। মানে, লুকোও লুকোও। দিদিরা সিক্স টু টেন ব্যাগ চেক করছেন।” গোটা স্কুলে হুলস্থুল। কার প্রেমপত্র তখনই কুচি হয়ে ড্রেন দিয়ে বয়ে গেল, কে এত ক্ষণ লাস্ট বেঞ্চে আলুলায়িত ভঙ্গিমায় বসে সদ্য ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে পাওয়া লেটেস্ট সেন্টেড কার্ড শুঁকছিল, সে তড়াক লাফিয়ে উঠে এ দিক ও দিক দেখে হাইবেঞ্চে চড়ে উঠে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের বিরাট ছবির পিছনে গঁদ সেঁটে কার্ডখানি আটকেই ধপ করে বসে ভ্যাবলাটে মুখ বানিয়ে ফেলল। অনেকে হাঁউমাউ করে ব্যাগ খাতা ঝেড়ে খুঁজতে লাগল তার কাছে ঠিক কী নিষিদ্ধ বস্তু, বা বুদ্ধদেব গুহ, শরদিন্দুর বড়দের বই রয়েছে। নার্ভাস আমি ছুটতে ছুটতে টয়লেটে গিয়ে খিল দিলাম। স্কুলকে বিশ্বাস নেই, আমার মাথা ফুটো করে হাত ঢুকিয়ে মনের ‘বেণীমাধব বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব’ ভাবটাকেই ঘ্যাঁক করে ধরে ফেলতে পারে।
তবে, সরস্বতী-তৃতীয়ায় ব্যাগ চেকিংয়ের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। বরং পঞ্চমীর সুপ্রভাতে স্কুলের জানলার খড়খড়ি ফাঁক করে নীচে তাকালেই প্রেমোৎসবের বিশ্বরূপ চোখে পড়ে যেত। গঙ্গার ধারের সরু গলির মধ্যে কয়েকখানা বাড়ি নিয়ে স্কুল ক্যাম্পাস। শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ। কিন্তু সে রাস্তাই সরস্বতী পুজোর দিনে চাক্কা-জ্যাম। পাঞ্জাবি, নাগরাই শোভিত তরুণরা দল বেঁধে কোনও ব্যর্থ আশায় কেবলই তাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। হুডস ডেনিম সানগ্লাসধারী স্মার্ট কিশোর স্কুলের সামনে এসেই আনমনে হোঁচট খাচ্ছে, আর নিচু হয়ে এক যুগ ধরে জুতোর ফিতে বাঁধছে। শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাসই সার। এ স্কুলে সরস্বতী পুজোর দিনও তাদের প্রবেশ নিষেধ।
স্কুলের আশপাশে আর যত ম্যাজিক জয়েন্ট আছে, কোন রহস্যে যেন সেগুলোরও খোঁজ মিলল এই এইট টু নাইনেই। বিশেষ করে ক্লাস নাইন যখন, তখন টেনের দিদিরা মাধ্যমিক নিয়ে ব্যস্ত, তাই স্কুলে আমরাই সবচেয়ে হোমরাচোমরা। ফলে, আগের দিন স্কুলে গিয়ে পুজোর জোগাড়ের ডিউটিও আছে। সে দিনেই বোঝা গেল, ওই ১০৪-এর মধ্যে ২০-২৫ জনের অনুরাগের হিসেব গোটাটাই জল। ফল কাটা, আলপনা দেওয়া, সব্জির খোসা ছাড়ানো ইত্যাদি রাজ্যের কাজ। তাই সে দিন ইউনিফর্ম পরার সাজা মাফ ছিল। তাই বলে, জনে জনে করিশ্মা আর কাজল সেজে আসতে হবে? আর মোটামুটি জনা চল্লিশকেই দেড়টা-দুটোর মধ্যে ছেড়ে দিলে ভাল। কেউ বাড়ির ঠাকুর আনতে কুমোরটুলি যাবে, কার দিদিমার ডাক্তার-ভিজ়িট। কার আবার সকাল থেকে ভয়ানক মাথাব্যথা, তাই তো শ্যাম্পু করে চুল খুলে আসতে হল, চুল বাঁধলেই মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাই জন্য চোখে কর্পূরের কাজল দিয়েছে, সেও তো ওষুধ ইত্যাদি ইত্যাদি। দিদিরা মুখ হাঁড়ি করে বসে রইলেন। তিনটের মধ্যেই স্কুল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল।
আসল দিনে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেল। ঠাকুরদালানে ধূপধুনো চামর ব্যজনে বীণাপাণির অর্চনা চলছে, সামনের উঠোনে বারান্দায় থোকা থোকা জ্যান্ত সরস্বতী উড়ছে। লালপাড় সাদা কাপড় বা ঢোলা ফ্রকের দল শাড়ি পরেছে, অঙ্গরাগে-আতরের আঘ্রাণে বাতাস পর্যন্ত মোহিত। যেন রাশি রাশি মথ রাতারাতি প্রজাপতির রূপ ধরেছে। টিচাররা কাউক্কে চিনতে পারছেন না। ‘নীপা কোথায়’ বলে হাঁক দিচ্ছেন, পাশ থেকে লাজুক এক কিশোরী মুখ বাড়াতে ভিরমি খাচ্ছেন। তেল চপচপে বেণির আড়ালে এত কায়দার চুলের গুচ্ছ ছিল, তা তিনি আগে দেখেননি, না কাল মেয়ে পার্লারে ঢুকেছিল ভাবতে গিয়ে খেই হারাচ্ছেন। আর এক জনের কানের দুল কতটা ভারী তা নিজে হাতে পরখ করে দেখতে গিয়ে আর একটু হলে আছাড় খাচ্ছিলেন। স্কুলের দরজার বাইরে আরও মনোহর দৃশ্য। একটি করে নতুন কলি একলাটি বেরোচ্ছে, তিন পা এগিয়েই সে কোন ইন্দ্রজালে জোড়া হয়ে গিয়ে ট্যাক্সি ধরছে। স্কুলের কিছুটা অরক্ষিত পিছন-দরজার পাশে ঝাঁকে ঝাঁকে সৌমিত্র-অপর্ণা, অমিতাভ-রেখা, আমির-জুহি, সলমন-ঐশ্বর্য, হৃতিক-করিনা। পাড়ার ক্লাব সকাল থেকেই মাইক স্কুলমুখো করে বাজাচ্ছে, ‘আপকে পেয়ারমে হম সওয়রনে লগে’।
সে বার সেই গানের আমিষগন্ধে মন উচাটন হওয়ার খেসারতে কি না কে জানে, বহু বার বহু বছর সরস্বতী পুজোয় লতা মঙ্গেশকর আমার উদ্দেশেই গেয়ে শুনিয়েছেন, ‘ও মোর ময়না গো, কার কারণে তুমি একেলা?’ (তখন জানতাম, ও মনময়না গো!) সবচেয়ে বড় দাগা খেয়েছিলাম ক্লাস ইলেভেনে। কোচিংয়ের পুজো দেখতে গিয়েছি, প্রিয় বান্ধবী ফিসফিসিয়ে বলল, এই পার্ক স্ট্রিট যাবি? আমি ওরই মোবাইল থেকে বাড়িতে বলে দিলাম, আর এক বার স্কুলে যাচ্ছি। সেই অনৃতভাষণের অপরাধে, দু’জনে চুপি চুপি পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে নামতেই দেখি, কোচিং-এরই অন্য এক সহপাঠী তথায় আগেই হাজির। অর্থাৎ আমি সেই জুটিটির জনসমক্ষে দেখানোর কুমিরছানা। আমার মনের ময়ূরমহলের দীপ ওখানেই দপ করে নিবে গেল। ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ করল, তরুণটি আজ আমাকে নিয়েই বেশি উৎসাহিত। এবং বান্ধবী তা বুঝে যথেষ্ট কুপিত। সতেরো বছর বয়সে সরস্বতী পুজোর ভরা বিকেলে শহর থইথই রোমিয়ো-জুলিয়েটদের পাশ দিয়ে চোখভর্তি জল নিয়ে একা মেট্রোর টিকিট কেটে শ্যামবাজার ফিরতে খুব কষ্ট হয়েছিল। তার পরে সন্ধেবেলা কোচিং-এর নেমন্তন্নে একটু রঙের সন্ধানে গিয়ে দেখি, সেই দু’জনের ব্রেকআপ সম্পূর্ণ! বান্ধবী আমাকে অঙ্গারদৃষ্টিতে দেখছে। আহাম্মকটি যে আমার পাতেই ঘন ঘন পরিবেশন করে চলেছে। ফ্রায়েড রাইস চিলি পনিরের নিরামিষ মেনুতেও মনে হচ্ছিল আদম-ইভদের সাপটা
বিড়ে পাকিয়ে শুয়ে আছে। লকলকে জিভ দেখাচ্ছে। কোচিং থেকে বাড়ি পনেরো মিনিট হাঁটা, মনে হচ্ছিল দশ জন পিছনে আসছে। কে এক জন বাইকে পাশ দিয়ে ঘেঁষে আই লাভ ইউ ছুড়ে বেরিয়ে গেল! ছুটে বাড়ি ফিরে সদর দরজা বন্ধ করে হাঁপ ছাড়লাম।
সে বছর থেকেই বৃন্দাবনকাকুকে মনেপ্রাণে মিস করি। না, তাঁর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের প্রহরী। সরস্বতী পুজোয় স্কুলের দরজার সামনে বুক চিতিয়ে আমাদের গার্ড দিতেন। বয়েজ় স্কুলের দেবার্ঘ্য, প্রিয়াঙ্করা যত বার ‘এক বারটি ঠাকুর দেখে আসি’ বলে ঢুকতে যেত, তত বার সিংহনাদে তাদের উত্তর কলকাতার সীমানা পার করিয়ে দিয়েছেন। প্রথম কৈশোরে তাঁর প্রতি কিছু অভক্তি ছিল, কিন্তু সব দ্বন্দ্ব কেটে গিয়েছিল বাণীবন্দনার দিনে অন্য স্কুল বেড়াতে গিয়ে। গার্লস স্কুলগুলো সব বয়েজ় স্কুল হয়ে গিয়েছে। হেডমিস্ট্রেস অবধি ঘরে সিঁটিয়ে বসে আছেন। ছেলেদের স্কুলে আরও বিপদ। গ্রুপ ফোটো তোলা হল, তাতে কে যে বেশি পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল দেখিনি। পরে শুনলাম সে কোচিংয়ে এসে রটিয়ে দিয়েছে, তার পরে আমি তার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম! তাতে না কি আবার তাদের প্রতিবেশী স্কুলের একটি ছেলের গোঁসা হয় ও কলেজ স্ট্রিটের উপরেই তাদের মধ্যে তুলকালাম মারপিট বেঁধে যায়।
প্রেম মানে আইসক্রিম, প্রেম মানেই ঝামেলা। খোদ শ্রীপঞ্চমীতে তার ভাগ থাকবে না, তাই কখনও হয়? এই সব ঝঞ্ঝাট শুরু হতে আমি কিশোরকুমারের পরামর্শ মতো ‘সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে থাকব জীবনে’ স্থির করে বাড়ির পুজোয় মনপ্রাণ সঁপে বসেছিলাম। তার অত্যন্ত সুফল ঘনাল, নম্বর নধরকান্তি হল, প্রাইজ়স্বরূপ জীবনের ইতিহাসে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির নাম জুড়ল, সেই পথে এক রণবীর কপূরেরও দেখা মিলল।
এবং, তিনি আসতে এত দিনে আমি জানতে পারলাম, আমার ইঁচড়ে পাকা বন্ধুরা স্কুল পালিয়ে যেত কোনখানে। শোভাবাজারের রাজপথ হয়ে এসপ্লানেডের রেস্তরাঁ থেকে গড়িয়াহাটের অলিগলি তস্য গলিতে স্কুল কলেজের মোড়ে, সশীষ ডাবওয়ালা বাড়ির ছাদে-উঠোনে, মোহর কুঞ্জ থেকে নন্দনের উপবনে বাসন্তীবসনে শহরের রাজহংস আর হংসীরা ভেসে চলেছে দু’-চার ঘণ্টার নিরুদ্দেশের দেশে। আকাশে মঘা নক্ষত্র দেখা দিলে যেমন শীতের কামড় কাটিয়ে উঠে শ্যামল-সবুজ পাতায় আস্তে আস্তে সেজে ওঠে বনবৃক্ষ, তেমনই মাঘী পূর্ণিমার
চাঁদ যত একটু একটু করে পূর্ণাকার ধরে, শৈশবকে সরিয়ে দিয়ে সিংহাসনে প্রমত্ত যৌবনের রাজতন্ত্র শুরু হয়। তার উদ্দাম জলোচ্ছ্বাসে
কখনও পাড় ভাঙে, আবার কখনও নতুন নগরেরও পত্তন হয়। কত শত মন রোজ মুখোমুখি বসে থাকে দেবীর বেদির তলে। ইন্টার-স্কুল কম্পিটিশনে, কলেজের ফেস্টে, ন্যাশনাল লাইব্রেরির সিঁড়িতে, যাদবপুরের ঝিলপাড়ে, প্রেসিডেন্সির বাস্কেটবল মাঠে, বইমেলা প্রাঙ্গণের ব্যান্ডসঙ্গীতে। তার পর শ্যামের বাঁশি মোবাইলের মেসেঞ্জার টোনে টং করে বেজে ওঠে, আর সরস্বতী মণ্ডপে একা বসে নিষ্পলক স্মিতমুখে সবটাই দেখে যান। দৈবাৎ তাঁর পলক একটি বার পড়লেই বন্ধনে সাত জন্মের গিঁট পড়ে যায়। শপিং মল থেকে নলবনে সন্তানদের স্বপ্নচারণায় ছেড়ে দিয়ে শূন্য মঞ্চে, ডায়াসে, প্যান্ডেলে একলাই তো বসে থাকেন মরালবাহনা মাতৃমূর্তি, তাই তাঁর এ হেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা দেখতে পায় না সকলে। তবে যারা কখনও দেখেছে, তাদের জীবনেই বসন্তথেকে গেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy