জন্মের প্রথম শুভক্ষণ...
পঁচিশে বৈশাখ আনুষ্ঠানিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর ভাগনি সরলা দেবী। অর্থাৎ ১৮৮৭ সালের (১২৯৪ বঙ্গাব্দ) ৭ মে প্রথম পঁচিশে বৈশাখের উৎসব শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ছাব্বিশ। তবে তার আগের বছর, অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ২৫ বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, “আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ—পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন”।
বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়ে, ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনে-ভাগনির কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাদরের অন্ত ছিল না। রবিমামার প্রতি সরলা দেবীরও ছিল গভীর ভক্তি। সেই ভক্তিবশতই তিনি তাঁর রবি মামার ‘জন্মদিন’ উৎসব সূচনা করলেন। সরলা দেবী তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’-য় সেই প্রথম জন্মদিন-উৎসব, সেই প্রথম পঁচিশে বৈশাখ পালনের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “রবিমামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা (সত্যেন্দ্রনাথ) ও নতুনমামার (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি ৪৯ নং পার্ক স্ট্রীটে থাকেন। অতি
ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন। পাশেই নতুনমামার ঘর। ‘রবির জন্মদিন’ বলে একটা সাড়া পড়ে
গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।” এর পর থেকে পারিবারিক পরিসরে কবির জন্মদিন নিয়মিত ভাবে পালিত হয়ে এসেছে।
এসো, এসো হে বৈশাখ...
কবির বয়স বাড়ছে। শান্তিনিকেতনে তখন প্রখর দাবদাহ। গরমের ছুটির জন্য পঁচিশে বৈশাখ আশ্রম খাঁ খাঁ করে। কবির সম্মতি নিয়েই আশ্রমিকরা ঠিক করেন, ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন, বর্ষবরণের পরই কবির জন্মদিন পালন করা হবে। তখন কবি ৭৫ বছরে। কবি সানন্দে সম্মতি দিলেন। এর পর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত।
১৯৪০ সালের নববর্ষ ও কবির জন্মোৎসবে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে গানের সঙ্গে কবির বিভিন্ন রচনা থেকে পাঠ চলছে। ‘শান্তিনিকেতন’ সঙ্কলন থেকে পড়া হয়েছিল ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ— ‘এই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি। এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক।’
১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিল। পরদিন ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর ছাপা হল, ‘সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে মন্দিরে উপাসনা আরম্ভ হয়। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আচার্য্যের আসন গ্রহণ করেন।...অনুষ্ঠানে কয়েকটি সঙ্গীত গান করা হয়। ইহার মধ্যে দুইটি কবিগুরু কর্ত্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে রচিত — ‘হে পুরুষোত্তম’ এবং ‘এস হে মহামানব’। (ঐ মহামানব আসে)। সে দিন কবির জন্মোৎসবের ভাষণ ছিল ‘সভ্যতার সংকট’।
দে পড়ে দে আমায় তোরা...
চার বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন। প্রথম চিঠি বাবাকে। জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী মহানন্দবাবুর কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে ছোট্ট রবি বাবা দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। প্রথম দু’-একটি চিঠি বাবার হস্তগত হলেও পরে বহু চিঠি পৌঁছয়নি। কারণ সেরেস্তার কর্মচারীরা শিশুর লেখা এই চিঠি নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে বাবাকে প্রথম চিঠি লেখার অভিজ্ঞতার কথা এ ভাবে বর্ণনা করেছেন— ‘বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো এক সময় গবরমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল।… এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠা সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালকের আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, ‘রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো’। মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতর খানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম।… এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছেন, ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন।’
প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে...
কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, নাম আন্না তড়খড়; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘নলিনী’। ঘটনা ১৮৭৮ সালের। এই প্রেমের গল্প বলেছেন কবি নিজেই। কৈশোরে বোম্বাইয়ের এক বাড়িতে কিছু দিন ছিলেন কবি। সেই বাড়ির এক শিক্ষিতা আধুনিকা তখনই বিলেত ঘুরে এসেছিলেন। তখন কবি নেহাতই অল্পবয়সি, পুঁথিগত বিদ্যার পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতেন যে, তাঁর কবিতা লেখার হাত আছে। যার কাছে নিজের এই কবিত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন, তিনিও মেনে নিয়েছিলেন। কবির কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন একটা ডাকনাম, ভাল লেগেছিল আন্নার। আন্না বলেছিলেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্ৰাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।” কবি লিখেছেন— ‘মনে পড়ছে তার মুখেই প্ৰথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ। ...একবার আমাকে বিশেষ করে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে।’
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ তরুণী আন্নার কথা স্মরণ করেছেন, ‘তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে।... সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী।... যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক।... আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।’
এক চাঁদনি রাতে সে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছিল কবির ঘরে। কবি তখন নিজের বাড়ির চিন্তায়, কলকাতার গঙ্গার চিন্তায় বিভোর।
কবি কী ভাবছে, জিজ্ঞেস করে সে বসে পড়ে কবির পাশে, কবির নেয়ারের খাটিয়াতেই। চিন্তামগ্ন কবির সঙ্গে কথাবার্তায় জুত না পেয়ে তরুণী আন্না প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে টানো তো— টাগ্-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে?’
কবি তাঁর খেয়ালিপনার সঙ্গী হয়েছিলেন, পরে বলেছিলেন— ‘আমি সত্যিই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তাঁর এতরকম খেলা থাকতে টাগ্-অফ-ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল। এমনকি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হার মানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ, না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল।’
‘শেষে একদিন বলল, তেমনি আচমকা: “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করে নি।’
রসশাস্ত্রের বিচারে আন্নাকে অনেকটা প্রগল্ভা নায়িকার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত রবীন্দ্রনাথের কাছে সে প্রেম যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে।
আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে। উপরোক্ত কথোপকথনের সূত্রেই তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনো দিন।... একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যেরকমই হোক না কেন।... আমি বরাবরই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালোবাসা তা সে যে-রকমের ভালোবাসাই হোক না কেন— আমার মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায়— সে ফুল হয়ত পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে।’
১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিটেল্ডলের সঙ্গে আন্নার বিয়ে হয়। আন্নার মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই এডিনবরা শহরে। লক্ষণীয়, বিবাহিত জীবনেও আন্না রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননি। সেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাকনাম ‘নলিনী’ স্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেন। এই তথ্যটিও উল্লেখ্য, তাঁর এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ।
সাগর উঠে তরঙ্গিয়া, বাতাস বহে বেগে
কৈশোর জীবনের শেষ দিকে তাঁর উচ্চশিক্ষার জন্য দাদা সত্যেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন রবীন্দ্রনাথকে বিলেত পাঠানো হোক। সেখানকার লেখাপড়া হয়তো তাঁর ভাল লাগবে। তাই মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিলেত যাত্রা।
সে বার জাহাজে চড়ার কিছু দিনের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের যাত্রা, পরিবেশ, আবহাওয়ার সঙ্গে তখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি শরীর, যাকে বলে সি সিকনেস। একেবারে ছয় দিন বিছানায়। সে সময় জাহাজের জনৈক স্টুয়ার্ড তাঁকে পরম মমতায় খাইয়ে দিতেন। সে কথা ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ, ‘আমাদের যে স্টুঅর্ড ছিল... আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন-তখন সে আমার জন্য খাবার নিয়ে উপস্থিত করত... বলত না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব...’
ছ’দিন পর যখন কবি শয্যা ছেড়ে উঠলেন, তখন দেখলেন, সত্যিই তিনি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছেন! কেমন সে অনুভূতি? কবি বলছেন, ‘মাথা যেন ধার করা, কাঁধের সাথে তার ভালোরকম বনে না; চুরি করা কাপড়ের মতো শরীরটা আমার যেন ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেকদিন পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম।’
এডেন থেকে জাহাজে সুয়েজ যেতে তাঁদের পাঁচ দিন লেগেছিল। সুয়েজে নেমে নৌকোয় খানিকটা পথ, তার পর ট্রেনে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর। কবি জানতেন যে, আফ্রিকা এক অনুর্বর মরুভূমির নাম। কিন্তু বাস্তবে দেখলেন উল্টো। রাস্তার দু’পাশে তিনি বিস্তীর্ণ ফসলের খেত দেখেছেন, দেখেছেন থোকায় থোকায় খেজুরসুদ্ধ গাছ। আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে তাঁদের জন্য অপেক্ষমাণ ‘মঙ্গোলিয়া’ জাহাজে চেপে তাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন।
অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছন। ব্রাইটন শহরে ঠাকুরবাড়িতে থাকেন কিছু দিন। সেখানে একটি স্কুলে (অনেকের মতে, ব্রাইটন কলেজে) ভর্তি হন। কিছু দিন পর, আরও ভাল লেখাপড়ার উদ্দেশে তিনি বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে লন্ডন চলে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে, আইন বিভাগে। কিন্তু থাকা-খাওয়া নিয়ে বাধল বিপত্তি। অনেক খোঁজ-খবরের পর এক জন ডাক্তারের বাড়ি পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথের থাকা ঠিক হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন না, তাই যে পরিবারে তিনি থাকবেন, সেখানে সকলের ঘোর আপত্তি। যে দিন রবীন্দ্রনাথের আসবার কথা, সে দিন ও বাড়ির মেজ ও ছোট মেয়ে, এক আত্মীয়বাড়ি পালিয়ে গেছিল। সপ্তাহখানেক ফেরেনি। তার পর যখন তারা শুনল যে, অতিথির মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলঙ্কার পরেনি, তখন বাড়িতে ফিরে এল!
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশি বছরের জীবনে পরম স্নেহময়ী মা-বাবা, ভাই-বোন, বৌদি, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, নাতি, ভাইপো-সহ আরও অনেক ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুস্থানীয় মানুষের মৃত্যু দেখেছেন। প্রতিটি মৃত্যু তাঁকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে, তার পরও তিনি সব কষ্ট পেরিয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস। তখন তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মার মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না— সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্নার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’
তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে
রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম নাটক ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’। কিন্তু নাটকটির পাণ্ডুলিপি তাঁর জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যায়। পরে রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাটক ‘রুদ্রচণ্ড’ (প্রকাশকাল: ১৮৮১)। প্রথম প্রকাশিত নাটক ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (প্রকাশকাল: ১৮৮১)।
তিনি আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখা আরম্ভ করেন। প্রথম কবিতা ‘অভিলাষ’ ১৮৭৪ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে প্রকাশিত এই কবিতাটির সঙ্গে স্বাক্ষর ছিল না। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা—
জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়।
তাঁর প্রথম স্বাক্ষরযুক্ত কবিতা বেরোয় ১৮৭৫ সালে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র চোদ্দ বছর। কবিতার নাম ‘হিন্দুমেলার উপহার’—
হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন’পরি,
গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি --
কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,
কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়।
১৮৭৭ সালে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রঙ্গালয়ে আবির্ভাব ঘটে নট রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’।
‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ। দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৮৮০ সালে কোনও ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আনলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুর ও অপেরা নাট্যশৈলী সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ফসল ১৮৮১ সালের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’। দু’বছর পরে, ১৮৮৩ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাস। বিষয়, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও বাকলার জমিদার রামচন্দ্রের ঐতিহাসিক বিবাদ...‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে ‘করুণা’ নামে একটা উপন্যাস লিখছিলেন, সেটি অসম্পূর্ণ ছিল।
রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম গান ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’। এই গানটি গুরু নানক রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ (জানুয়ারি, ১৮৭৫) সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়।
ঐ মহামানব আসে...
পয়লা বৈশাখ, ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষ। এই দিনই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত গানটি। এই নিয়ে শান্তিদেব ঘোষের লেখায় পাই এই গান রচনার অনুরোধের গল্প— “প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে বললেন ‘সৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে। সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান।’ কাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী, তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেন। কবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়া। সুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না, বললেন ‘কালকে হবে’। পরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত, বর্তমানে ‘ঐ মহামানব আসে’ গানটি যে আকারে আছে, সেই আকারে তাকে পেলাম”— ‘ঐ মহামানব আসে।/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে॥
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,/ নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক–/ এল মহাজন্মের লগ্ন...’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy