ঐতিহাসিক: বর্ধমানের নবাববাড়ির স্মৃতিসৌধ
দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর, চরম মতবিরোধ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে আওরঙ্গজেব-পুত্র মুয়াজ্জেম প্রথম শাহ আলম বাহাদুর শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। মাত্র ছ’বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি। কিন্তু যে গতিতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হচ্ছিল, তা রোখার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয় রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃবিরোধ। জ্যেষ্ঠ পুত্র আজিম-উস-শান তখতে বসেন, এক বছরের মধ্যে তিনিও বাহাদুর শাহের আর এক ছেলে জাহাঙ্গির শাহের চক্রান্তে নিহত হন। আজিম-উস-শানের পুত্র ফারুখ শিয়ার জাহাঙ্গির শাহকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন। দিল্লির এই ভ্রাতৃঘাতী গৃহবিবাদে দেশ জুড়ে গোলযোগ ও বিদ্রোহ দেখা দেয়। তাঁর আঁচ এসে লাগে সুদূর বাংলার বর্ধমানেও।
এখানে পাঠান সর্দারদের প্রধান রহিম খান মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ফারুখ শিয়ার বিদ্রোহ দমনে দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি খাজা সৈয়দ আনোয়ার ও খাজা আবুল কাসেমকে পাঠিয়ে দেন। শহরের দক্ষিণ দামোদর এলাকা মূলকাঠিতে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। রহিম খান সন্ধি প্রস্তাব পাঠালে যুদ্ধ থামে, কিন্তু রহিম এই সুযোগে হত্যা করেন দুই সেনাপতিকেই। দিল্লিতে সে খবর পৌঁছলে শোকের ছায়া নেমে আসে, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার দুই সেনাপতিকে শহিদ আখ্যা দেওয়া হয়। ফারুখ শিয়ারের নির্দেশে বর্ধমান শহরে বেড় এলাকায় লক্ষাধিক স্বর্ণমুদ্রা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। দুই সেনাপতির বংশধরদের ‘নবাব’ আখ্যা দিয়ে তাদের জন্য তৈরি হয় রাজকীয় প্রাসাদ, মকবরা, বাঁধানো সরোবর, ফুলবাগান। বর্ধমানে আজও রয়েছে মুঘল স্থাপত্যের এই নিদর্শন।
সমাধিভবনটি দেওয়াল ঘেরা, প্রায় ১০ বিঘা জমির উপরে। প্রবেশপথের উঁচু অর্ধবৃত্তাকার তোরণদ্বারটিতে চোখে পড়ে সুরম্য শিল্পশৈলী। সামনে একটি সরোবর, তার দক্ষিণ পাড়েই উঁচু, বিশাল সমাধিগৃহ। এখানেই খাজা সৈয়দ আনোয়ার, খাজা আবুল কাসেম ও তাঁদের সঙ্গীদের সমাধি। মুঘল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইন্দো-সিরীয় আঙ্গিক ও মিনার শৈলীর সঙ্গে বাংলার দোচালা মন্দিরের স্থাপত্য মূল সৌধের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে সংযোগ ঘটিয়েছে। এই যুগলবন্দি বঙ্গ- ইসলামিক রীতির অপরূপ নমুনা। মূল সৌধের সংযোগকারী দোচালা দুটি দেখতে ঠিক হাতির মতো। সরোবরের পূর্ব পাড়ে ছিল ইমামবাড়া, এখন আর নেই। পশ্চিম পাড়ে তিন গম্বুজওয়ালা বিশাল মসজিদটি আজও দাঁড়িয়ে। মসজিদটিতে কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নেই, তবে স্থানীয় বিশিষ্টজনের মতে, এটি ফারুখ শিয়ারের আমলে তৈরি। মসজিদের দক্ষিণে ছিল বেগম মহল। খাজা সৈয়দ আনোয়ারের মেয়ের বংশধরেরা প্রথমে ওই মহলে থাকতেন। এটিও সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু ভিত্তিস্থলটির অস্তিত্ব আছে। বেগম মহলের সামনে, সরোবরের পশ্চিম পাড় জুড়ে একটি ফুলবাগান ছিল, যার কেয়ারিগুলি আজও আছে। বিশাল সরোবরের চারটি পাড় বাঁধানো, উত্তর ও পূর্ব পাড়ে স্নানের ঘাট। সরোবরের মাঝখানে একটি জলটুঙ্গি, সেতুর দ্বারা যা পশ্চিম পাড়ের সঙ্গে যুক্ত। নবাববাড়ির শৌখিন মানুষেরা পূর্ণিমার রাতে এখানে বসতেন। পুকুরের উত্তর পাড়ে বিরাট তোরণদ্বার-সহ নতুন বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। খাজা সৈয়দ আনোয়ারের মেয়ের শেষ বংশধরেরা এখানেই থাকতেন।
সমাধিক্ষেত্রটি যথাযথ সংরক্ষণের জন্য একটি বাদশাহি ফরমান বংশধরদের কাছে এসেছিল। দিল্লীশ্বর এই উপলক্ষে পাঁচটি গ্রাম দান করেন, যার আয় থেকে মকবরার মেরামত, রক্ষা এবং কর্মচারীদের ভরনপোষণ করা যাবে। কিন্তু এর পরেই শুরু হয়ে যায় বর্গি হাঙ্গামা। বাংলার বহু স্থান মরাঠা সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, বর্ধমান থেকে কাটোয়া পর্যন্ত এলাকা হয়ে ওঠে অবাধ লুণ্ঠনের জায়গা। সেই সময় সম্রাটের দেওয়া সনদটি খোয়া যায়। শহিদদের অধঃস্তন পুরুষ হিসাবে আশরফ খান সম্রাটের দরবারে এ খবর জানালে বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম আর একটি সনদ দান করেন। ১৭৬৭ সালের এই দ্বিতীয় ফরমানে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, সমাধিক্ষেত্রের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ভার প্রদত্ত ভূসম্পত্তির আয় থেকে খরচ হবে, করবেন আইনসম্মত উত্তরাধিকারীদের প্রতিনিধিরা।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার আগে ফরমানে উল্লিখিত পাঁচটি মৌজা বর্ধমান মহারাজার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। পরিবর্তে বর্ধমানের মহারাজা বছরে ৩,৬৯০ টাকা দুই সেনাপতির বংশধরদের প্রতিনিধিকে দিতে থাকেন। এ দিকে বছর বছর বা কয়েক বছর অন্তর ভূমিরাজস্ব ইজারা দেওয়ার ফলে দেশে এক শ্রেণির বিত্তবান আধা-জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদেরকেই স্থায়ী জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। নবাববাড়ির সম্পত্তিও বর্ধমান মহারাজার জমিদারিভুক্ত হয়। মহারাজা বার্ষিক ৩,৬৯০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতেন, ব্রিটিশ সরকারের তরফে সমাধিক্ষেত্রের ব্যয়ভারের জন্য মাসিক তিনশো একুশ টাকা পাঁচ আনা চার পাই শহিদদের বংশধরদের নির্ধারিত প্রতিনিধিকে দেয়া হত।
মকবরা রক্ষণের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিনিধি টাকা পেতেন। এঁদের শেষ প্রতিনিধিরূপে মির্জা শি গুপ্তা ১৯৪৮-এর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রদত্ত অর্থ গ্রহণ করেন। মির্জা শি গুপ্তার মৃত্যুর পর তাঁকেও এই নবাববাড়ি প্রাঙ্গণেই সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর বংশধরেরা বর্ধমান ছেড়ে চলে যান। পৌনে তিনশো বছর ধরে শিয়া প্রথানুযায়ী সমাধিক্ষেত্রটি রক্ষিত হলেও মকবরায় হাওয়া মঞ্জিল এখন সংরক্ষণের অভাবে ক্ষয়িষ্ণু। অথচ এই প্রাঙ্গণে এখনও প্রতি বছর পয়লা মাঘ মেলা বসে। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়। অনেকে স্নান করেন, শ্রদ্ধা জানান, ঘুরে দেখেন। ইতিহাসের বিস্তর ঝড়জল সয়ে টিকে রয়েছে বর্ধমান শহরের এই নবাববাড়ি। আঞ্চলিক স্থাপত্যের এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy