Advertisement
০৩ জানুয়ারি ২০২৫

‘প্রেমে পড়েছি সন্দেহে লোক লাগিয়েছিল মা’

তখন হাফপ্যান্ট পরার বয়স। রাসবিহারী মোড়ে লাল ঝান্ডা হাতে কিছু মানুষের মুখে ঝুটা আজাদির স্লোগান শুনে প্রশ্ন জেগেছিল মনে। কংগ্রেসি আবহাওয়ার বাড়িতে বেশি প্রশ্ন করলে বকুনি দিতেন দাদারা। বামপন্থার পাঠ পেয়েছিলাম মাস্টারমশাইয়ের কাছে, কিন্তু মা না থাকলে রাজনীতি করা হত না আমার। তখন হাফপ্যান্ট পরার বয়স। রাসবিহারী মোড়ে লাল ঝান্ডা হাতে কিছু মানুষের মুখে ঝুটা আজাদির স্লোগান শুনে প্রশ্ন জেগেছিল মনে। কংগ্রেসি আবহাওয়ার বাড়িতে বেশি প্রশ্ন করলে বকুনি দিতেন দাদারা। বামপন্থার পাঠ পেয়েছিলাম মাস্টারমশাইয়ের কাছে, কিন্তু মা না থাকলে রাজনীতি করা হত না আমার।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

বিমান বসু
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ০০:৩২
Share: Save:

কলেজ স্কোয়ারে বইয়ের স্টল উদ্বোধনে গিয়েছি। পুজোয় মার্ক্সীয় সাহিত্যের বিপণিতে নিজে বেছে মানুষের হাতে বই তুলে দিতে ভাল লাগে। কলেজ স্কোয়ারে সেটাই করছিলাম সে বারও। সাত-আট বছরের একটি ছেলে মন দিয়ে বই দেখছিল। কাছে ডাকলাম। বললাম, বই নিবি? সে বলল, তুমি একটা দাও। এঁকে রং করার বই দিলাম একটা। বলল, বইয়ে লিখে দাও। বই উল্টে-পাল্টে দেখে ছেলেটা শুনলাম মাকে বলছে, আমি কালার করব কিন্তু। এনে দেবে কালার। আমিও হেসে বললাম, হ্যাঁ করবি তো।

বাচ্চাদের সঙ্গে মেশা, কথা বলা বরাবারই খুব পছন্দ আমার। ওখান থেকে ফেরার সময়ে মনে পড়ছিল, কোচবিহার থেকে কলকাতা পদযাত্রা করতে গিয়ে এক বার পা প্রায় পচেই গিয়েছিল! ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, বিশ্রামে থাকতে হবে। হরিণঘাটায় একটা সরকারি বাংলোয় চুপচাপ কয়েকটা দিন কাটাতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের এক নেতাকে (বঙ্কিম ঘোষ, পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন)ডেকে বললাম, এলাকার বাচ্চাদের নিয়ে এসো না! ওদের সঙ্গেই মিটিং করব। আয়োজন হল। সেই আড্ডা থেকেই একটা সংগঠন তৈরি করে দেওয়া হল বাচ্চাদের জন্য। কথা দিয়েছিলাম, ক্যারম আর টেবল টেনিস বোর্ডের ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু আমার কাছে টাকা কোথায়? পরে পরিচিত এক অধ্যাপক আর ডাক্তারকে ধরে দু’টো বোর্ডের ব্যবস্থা করে ওদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। ওরা খুশি হয়েছিল খুব। আমিও ওই রকম আনন্দ কমই পেয়েছি। বাচ্চাদের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নে অবশ্য আর যাই না। নিজের তো টাকাপয়সা বলতে কিছু নেই, উপহার কী দেব? খারাপ লাগে খুব। তাই যাই না। সেটা অবশ্য অন্য কথা।

যে বাচ্চাটাকে আঁকার বই দিলাম, ওর বয়সে আমি কী বই পেয়েছিলাম? এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল! স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের উপরে বই। লেখক যোগেশচন্দ্র বাগল। তখন যা দেখি, যা শুনি, তা নিয়েই প্রশ্ন জাগে মনে। প্রশ্ন তুলতে গিয়েই তো অন্য রকম হয়ে গেল জীবনটা! প্রশ্নের উত্তর খুঁজব বলেই চলে এসেছিলাম রাজনীতির পথে। ছেড়ে এসেছিলাম বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন, সব পিছুটান!

গড়িয়াহাটে বাড়ি ছিল আমাদের। সে এক অন্য কলকাতা। এখন যেখানে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন, সেখানে ৩৩টা আমগাছ ছিল! ওখানে আমরা খেলতে যেতাম। ফুটবল ছিল পছন্দের খেলা। গড়িয়াহাটে থাকার সময়েই প্রথম বার প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি ফেরা আমার। সালটা ১৯৪৮ হবে। নেহাতই বছর আটেকের বালক তখন। হাফপ্যান্ট, চটি পরি। রাসবিহারী মোড়ের কাছে এক দিন দেখি, লাল ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে কিছু লোক দৌড়চ্ছে। আর লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে পুলিশ। দৌড়তে দৌড়তে লোকগুলো ‘আজাদি’ আর ‘ঝুটা’ কথাগুলো বলছিল। ওইটুকুই শুনেছিলাম। পুলিশের তাড়া খেতে খেতে লোকগুলো পালিয়ে গেল। আমিও একছুটে বাড়ি। দাদাদের জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছিল ওরা? কেন ওদের মারতে যাচ্ছিল পুলিশ?

দাদারা বলল, ওটা কমিউনিস্টদের মিছিল। ওরা বলে, ‘‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।’’ জানতে চাইলাম, এর মানে কী? উত্তর এল, ওদের গিয়ে জিজ্ঞেস কর! রাগ হল খুব। এর পাঁচ-ছয় বছর পর পুলিশের রুলের গুঁতো পড়ল আমারই পেটে! সেটা শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা দিয়ে কিছু লোক দৌড়চ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে রুল দিয়ে মারল পেটে। ব্যথা পেলাম খুব। বলেছিলাম, মারছেন কেন? মুখে বলুন না! পুলিশ আরও রেগে লাঠি উঁচিয়ে বলল, ভাগ এখান থেকে! পরে জেনেছিলাম, হ্যারিসন রোডে ট্রাম জ্বলছিল সে দিন। পুলিশ জনতাকে তাড়া করে সরিয়ে দিচ্ছিল। ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন সেটা। আমি তার কিছুই জানতাম না তখন। শুধু এই প্রশ্নটা নিয়ে ফিরেছিলাম, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছে কংগ্রেস। তাদের সরকারের পুলিশ অন্যদের এত মারে কেন?

ওই শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আমি বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের উদাত্ত গলার বক্তৃতা শুনেছি, চোঙা নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ভাষণ দিতে শুনেছি। কিন্তু গড়িয়াহাটের আমি শ্রদ্ধানন্দ পার্কে এলাম কী করে? মাঝে একটা কাহিনি আছে। আমাদের ছিল বিশাল পরিবার। বাবা রসিকলাল বসু, ডাক্তার ছিলেন। পারিবারিক ব্যবসাও ছিল আমাদের। সেই ব্যবসায় বড়সড় ধাক্কা এল ১৯৫২ নাগাদ। বড় পরিবার ভেঙে তিন টুকরো হল। পুরনো আসবাবপত্র, নানান জিনিস বিক্রি করে দেওয়া হল। ছোটবেলার ছবি, আরও নানা স্মৃতি সেই সময়েই হাতছাড়া হয়েছে। পরিবারের তিন টুকরোর মধ্যে আমি একটা টুকরোর সঙ্গে ছিলাম। চার-সাড়ে চার বছর ঘুরে ঘুরে আমাদের আস্তানা হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রিট, সারপেন্টাইল লেন, নারকেলডাঙা। আমার সঙ্গে ছিল আমার ন’দা। ভাই-বোনেদের মধ্যে ন’দাই শুধু এখনও আছে। ছত্তীসগঢ়ে ব্যবসা করে। নিজে আলাদা ব্যবসা দাঁড় করাবে বলে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে বেরিয়েই ভাগ্যানুসন্ধানে কলকাতা ছেড়েছিল ন’দা।

ন’দার কথা আলাদা করে বললাম, একসঙ্গে ওই কয়েক বছর ছিলাম বলে। এমনিতে আমাদের ভাইবোনের বাহিনীটা বিরাট! মজা করে বলতাম, ফুটবল টিম! পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। বড়দার সঙ্গে কংগ্রেসের একটা সম্পর্ক ছিল। সরাসরি পার্টি অবশ্য করত না। বাবা রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলতেন না। তবে ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। বাড়ির ঘরানাটা ছিল কংগ্রেসি। সেই বাড়িতে আমি যখন ফিরে এসে বলতাম, পুলিশ এত মারে কেন? কমিউনিস্টদের মিছিলে লাঠি চালায় কেন? দাদারা বিরক্ত হত খুব। বলত, ওরা অন্যায় করছে। তাই মারছে। আমার প্রশ্নে রেগে গিয়ে দাদারা মাঝে মাঝে মারধরও করত। এক বার বাড়ি ফিরে কী বলেছি, মার খেলাম খুব। রাগ করে খালি পায়েই দিদির বাড়ি চলে গেলাম। দিদি বুঝতে পেরেছিল। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু নতুন জামা-প্যান্ট, চটি কিনে এনে দিয়েছিল আমাকে।

বাড়িতে কড়া নিয়ম ছিল, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ফিরে আসতেই হবে। ছোড়দি গান শিখতে যেত। ওর গানের ক্লাস বা কোনও অনুষ্ঠানের জন্য ফিরতে দেরি হলেই বাড়িতে কথা শোনাত। তখন আমি ওর পক্ষে দাঁড়াতাম। ছোড়দির সঙ্গে বোঝাপড়া ছিল, ওর দেরি হলে আমি ওর হয়ে বলব। আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কী বই এনে পড়ছি, তা নিয়ে ও কিছু বলবে না কাউকে। ছোড়দিকে বলতাম, তুই দেখবিই না। দেখলে যদি কথা চেপে রাখতে না পারিস! মিছিল দেখতে গেলে আপত্তি, প্রশ্ন করলে রাগ, মারধর। কিন্তু খেলাধুলোয় কোনও বাধা ছিল না। ফুটবল খেলতাম, টিমের সঙ্গে মংপু শিল্ডে খেলতেও গিয়েছি। খেলার জন্য বাইরে যেতে দিতে কোনও অসুবিধা ছিল না। এখন যেমন দেখি গোল শোধ করার জন্য মরিয়া টিম কর্নার কিক পেলে গোলকিপারও বিপক্ষের বক্সে উঠে গিয়েছে, সে কালে ও সব ছক ওলটপালটের ব্যাপার ছিল না। ব্যাকে যে খেলবে, সে ডিফেন্সেই থাকবে। ফরোয়ার্ডে যে থাকবে, সে নামবে না। আমি ব্যাকে খেলতাম। আমাদের স্কুলের গেমস টিচার শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় (খেলার উপরে যাঁর লেখা বই আছে) এক বার সেই ছক বদলে দিলেন। বললেন, বিমানকে ফরোয়ার্ডে খেলাও। প্রথম ম্যাচে ফরোয়ার্ডে নেমেই গোল করেছিলাম, মনে আছে!

এ ভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু সেই কিশোর বয়স থেকেই বুঝতে পারছিলাম, আমার এত প্রশ্নের জবাব এ বাড়িতে কেউ দেবে না। মানসিক দূরত্ব বাড়াতে হবে, বুঝে ফেলেছিলাম তখনই। গড়িয়াহাটের বাড়ি ছেড়ে অন্য ঠিকানায় মাঝের কয়েক বছর থাকার সময়ে অবশ্য একটু স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তখন আর সন্ধ্যার মধ্যে ঢুকতে হত না। মিটিং-মিছিল হচ্ছে দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়তাম। অামার প্রথম স্কুল ছিল তীর্থপতি ইনস্টিটিউশন। গড়িয়াহাট ছেড়ে আসার সময়ে সেখান থেকে টি সি নিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হল হিন্দু স্কুলে। কিন্তু বছরের মাঝপথে ওরা ভর্তি নিল না। শেষমেশ ভর্তি হলাম সিটি স্কুলে। প্রায় প্রতি বছরই ক্লাসে মনিটর হওয়া বাঁধা ছিল! পরে মৌলানা আজাদ হিন্দ কলেজ। সেখানে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ে লম্বা লম্বা পায়ের সঙ্গে ম্যারাথন দৌড়ে বেঁটে আমি তৃতীয় পুরস্কারও পেয়েছি!

ছোটবেলায় বাড়িতে যে প্রশ্নের উত্তর পাইনি, সেটাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমার মাস্টারমশাই। সুবিমল রায়, সুকুমার রায়ের ভাই। ওঁদের বাড়ি ছিল লেকের কাছে। উনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে, আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, কমিউনিস্টরা মনে করেন এই স্বাধীনতা ‘স্বাধীনতা’ নয়। তাই তাঁরা বলেন, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। বলেন, স্বাধীনতা মানে দেশের সব মানুষ খেতে পাবে, লিখতে-পড়তে জানবে, কাজের ব্যবস্থা হবে। এ সবের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এক বারে হবে না, কিন্তু সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তবে মাস্টারমশাই সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বুঝিয়ে এটাও বলেছিলেন, প্রফুল্ল ঘোষ (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) পারেননি। বিধান রায়ও বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। ও পার থেকে দলে দলে কত লোক চলে আসছে দেখছ? সেই বয়সে মাস্টারমশাইয়ের কাছে শোনা কথাগুলো কাজে লেগেছিল খুব।

আরও একটা কথা মনে আছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে অনেক ছবি ছিল দেওয়ালে। ওঁর নিজের ছবিও। বলেছিলেন, ‘‘আমার ভাইপো মানিক খুব ভাল আঁকে। আমার ছবিটা ওরই এঁকে দেওয়া।’’

সেই যে মানিকের হাতের কাজ দেখে এসেছিলাম, পরে দুনিয়া তাকে চিনল সত্যজিৎ রায় নামে। আগেই আমি মানিকের কথা জানতাম, এইটুকু ভেবে পরে বেশ আনন্দ হত।

মাস্টারমশাইয়ের কাছে পাওয়া শিক্ষা নিয়ে আমি আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেলাম রাজনীতিতে। মিটিং-মিছিল যা হত, সবেতেই হাজির হতাম। কেউ আমায় হাত ধরে রাজনীতিতে নিয়ে আসেনি। নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিজেই পথ বেছে নিয়েছিলাম। পার্টিতে কোনও দাদা ছিল না। সেই সময়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জলি কলের সুপারিশ করা কাগজ নিয়ে বালিগঞ্জের লোকাল পার্টি অফিসে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। কাচের দরজা ঠেলে পার্টি অফিসে ঢুকতে হয়, ভেতরে গিলে করা পাঞ্জাবি পরা লোক বসে। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। বাবুয়ানি সহ্য হত না। অ্যারিস্টোক্র্যাট স্টুপিডদের সঙ্গে পার্টি করব না— ছোট মুখেই এত বড় কথাটা মুখের উপরে বলে দিয়ে চলে এসেছিলাম। তার পরে আমাকে পার্টির কাজ করতে পাঠানো হয় পার্ক সার্কাসে। সদস্যপদের ফর্ম পূরণ করছি যখন, বয়সের কলামে লিখেছি ১৭ বছর তিন মাস। যিনি ছিলেন, হাত দিয়ে কাগজটা চেপে ধরলেন। বয়স হয়নি, পার্টি মেম্বার হবে কী? ফিরে এলাম। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ হল। তখন পার্টি মেম্বার হলে রেড কার্ড পাওয়া যেত। জ্যোতি বসুর সই করা কার্ড পাওয়া ছিল আমার পরম প্রাপ্তি!

এ সব যত এগোচ্ছে, বাড়িতে থাকা ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ মাঝেমধ্যে ‘রেড’ করে। আমার পিছনে দাদারা আমায় নিয়ে বিরক্তি দেখায়। পিছনে কেউ কথা বললে সেটা আমার একেবারেই না-পসন্দ। ঠিক করেই ফেললাম, বাড়ি ছেড়ে দেব। পয়সা খরচ করে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম, ঘর চাই। পার্টি তখন সেলামির টাকা দেবে না, আর সেলামি ছাড়া কেউ ঘর দেবে না! শেষ পর্যন্ত বেনিয়াপুকুরে কৃষক সভার পুরনো অফিস অন্য জায়গায় উঠে গেল। ওদের একটা ছেড়ে যাওয়া রান্নাঘর হল আমার ঠিকানা। তখন হোলটাইমার হয়েছি। রান্নাঘরের দেওয়ালে ‘এল’ আকারে তাক লাগিয়ে বই রাখতাম। আর অফিসের টয়লেটটা ব্যবহার করতাম। পার্টির তখনকার সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া দেখতে এসে বলেছিলেন, বিমান, ইউ কান্ট স্টে হিয়ার! আই হ্যাভ সিন ইয়োর রুম! আমি বলেছিলাম, পারব। দিজ ইজ পিস অব হেভ্ন ফর মি!

ওই ঠিকানায় ছিলাম ১৩ বছর, তার মধ্যে রান্নাঘরে আট বছর। প্রমোদদা (দাশগুপ্ত) মারা যাওয়ার পরে ওঁর ঘরে উঠে গিয়েছিলাম। তার পরে অনিলের (বিশ্বাস) আমল থেকে এই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসেই ঘর-সংসার।

মাকে বলে এসেছিলাম, ‘সকলের অসুবিধা হচ্ছে। তোমাকে কথা শোনাচ্ছে। আমি চলে যাচ্ছি।’ কিন্তু মায়ের মন! সন্দেহ করেছিলেন, আমি বোধহয় প্রেমে পড়ে ঘর ছাড়ছি! লোক লাগিয়েছিলেন আমার পিছনে। তখন আমিই মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, ঘর ছেড়েছি নতুন ঘর বাঁধার জন্য নয়। সারা জীবন একাই থাকব, নিজের মতো থাকব বলে। মায়ের কাছে যেতাম মাঝেমধ্যেই। টাকা চাইতাম। কার স্কুলের ফি দিতে হবে, কার পরীক্ষার টাকা বাকি পড়েছে। শেষ দিকে মা বাঘাযতীনে থাকতেন। মায়ের কাছ থেকে আদায় করে এনেছি নানা কাজের টাকা।

এই পৃথিবীর আলো দেখার সময়েই মাকে অবশ্য খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি যখন গর্ভে, পূর্ববঙ্গ থেকে মাকে নিয়ে বাবা স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে কলকাতা এসেছিলেন। শুনেছি, স্টিমারযাত্রায় মায়ের রক্তক্ষরণ হয়েছিল। ট্রেনে উঠে রক্ত বন্ধ হয়। কলকাতায় এসে তখনকার ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নামী ডাক্তার নীলরতন সরকারের (এখন হাসপাতালটা তাঁরই নামে) কাছে বাবা লিখে পাঠিয়েছিলেন মাকে পরীক্ষা করাতে। প্রসবের সময় আর পাঁচটা শিশুর মতো আমার মাথা আগে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল পা। তাতে প্রচুর রক্তপাত হয়ে মা কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। ডাক্তার বলেছিলেন, স্টিমারযাত্রার সময়ে ‘হাইড্রলিক ইমপ্যাক্ট’-এ গর্ভস্থ শিশুর অবস্থান পরিবর্তন হয়েছিল। আমি বড় হয়ে পরিচিত ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করেছি, এ রকম আবার হয় না কি! ওঁরা বলেছেন, হতে পারে।

মা না থাকলে রাজনীতি করা, কমিউনিস্ট পার্টি করতে আসা সম্ভব হত না। এই বয়সে ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হলে আমার মা হেমবরণী বসুর কথাই তাই মনে পড়ে খুব।

অনুলিখন: সন্দীপন চক্রবর্তী

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Biman Bose CPM Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy