Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

প্রকৃতির পাশাপাশি হিংসা আর নিষ্ঠুরতার কথকতা

তিনি শুধু রোম্যান্টিক নন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় এসেছে ক্ষুধা, ঈর্ষা, রক্তপাত। মৃত্যুও কড়া নেড়েছে বারংবার। তাঁর চরিত্রেরা ঔপনিবেশিক বাংলার ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সাক্ষী। আছে ক্ষুধা, অভাব, দারিদ্র, শাস্তি, চুরি। ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে থাকে পয়সা না দিয়ে ধার করে আনা একটি নোনা। সোনার সিঁদুরকৌটো চুরি করার পর মুখুজ্যেবাড়ির সেজবউ মেরে দুর্গার নাক ফাটিয়ে দেয়।

শোকার্ত: হরিহর-সর্বজয়া। দুর্গার মৃত্যুর পর। ‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্য

শোকার্ত: হরিহর-সর্বজয়া। দুর্গার মৃত্যুর পর। ‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্য

রাহুল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বাইরের জগতে যা ঘটে, তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর, ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে,’ লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাদের চিনিয়ে দিয়েছেন জীবনের সেই অতি পরিচিত ছবিগুলো, চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও যেগুলো আমরা খেয়াল করি না, তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিই না। বিভূতিভূষণকে দীর্ঘ দিন ধরে ভাবা হয়েছে প্রকৃতিপ্রেমিক, শান্তস্বভাব এক লেখক হিসাবেই। কিন্তু তাঁর উপন্যাসে রয়েছে হিংসাও। সেই হিংসা চিৎকৃত নয়, চাপা। তাই তার প্রকাশও ভয়ানক। এমনকি চুরি, ডাকাতি, রক্তপাত, ক্ষুধা, অভাব, দারিদ্র, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, কী নেই সেখানে? ঔপনিবেশিক বাস্তবতার এক আলেখ্য পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের লেখায়, তার সমস্ত হিংসা আর ভয়াবহতা সমেত।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের শুরুতেই হত্যা ও অপহরণের কাহিনি। বীরু রায়ের বেতনভোগী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও তার পুত্রকে হত্যা করে তাদের সর্বস্ব অপহরণ করে। পরের বছরই বীরু রায়ের একমাত্র পুত্রকে গাঙের চরে কুমির এসে তুলে নিয়ে যায়। হিংসা ও তার পরিণামের গল্প দিয়েই উপন্যাসের শুরু। মৃত্যু কিন্তু কাহিনির পিছু ছাড়ে না, ছড়িয়ে পড়ে বইয়ের পাতায় পাতায়। ইন্দির ঠাকরুনের অকালমৃত মেয়ে বিশ্বেশ্বরীই যেন ‘দুর্গা’ হয়ে ফিরে আসে, আর সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি সর্বজয়ার ঈর্ষার কারণ। যেমন নিষ্ঠুর ভাবে ইন্দির ঠাকরুনকে মৃত্যুর দিকে এক প্রকার ঠেলেই দেওয়া দেয়, তাকে কি স্বাভাবিক বলা যায়?

দুর্গা আর হরিহর মারা যায় প্রায় না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায়। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে ক্রমে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত দুর্গা ফুটো চাল দিয়ে পড়া বৃষ্টিতে রাতভর ভিজতে থাকে। নোনতা বিস্কুট চেয়ে জোটে শুধু নিমছাল সিদ্ধ। কাশীতে গিয়ে বাড়ির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বুকে ঠান্ডা লেগে মৃত্যু হয় হরিহরের। একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় সে, সঠিক পথ্য বা খাদ্য জোটে না। প্রতিটি মৃত্যুর মধ্যেই মিশে থাকে নিরুপায়তা আর নৃশংসতা।

আছে ক্ষুধা, অভাব, দারিদ্র, শাস্তি, চুরি। ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে থাকে পয়সা না দিয়ে ধার করে আনা একটি নোনা। সোনার সিঁদুরকৌটো চুরি করার পর মুখুজ্যেবাড়ির সেজবউ মেরে দুর্গার নাক ফাটিয়ে দেয়। দুর্গা যাতে চুরি করতে না পারে, সতু তাই বেল-কাঁটা পুঁতে রাখে। নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার জন্য গুলকিকে বেধড়ক ঠ্যাঙায় তার জেঠি। কাশীর কথকঠাকুর যে ভাবে বাসি পুরি আর শক্ত হয়ে যাওয়া লাড্ডু খায়, তা দেখে অপুও অবাক হয়ে যায়। নিজের মানসম্মান খুইয়ে শুধুমাত্র পেটের ভাত জোগাতে রাঁধুনির কাজ নিতে বাধ্য হয় সর্বজয়া। অপুকে সেখানে অন্যায় ভাবে বেত দিয়ে মারা হয়। এ ভাবেই শ্রেণিবৈষম্যের নিষ্ঠুর চেহারাটা ফুটিয়ে তোলেন বিভূতিভূষণ।

অপুর জীবনে ঘটে একের পর এক মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। মায়ের মৃত্যু তার জীবনে আনে মুক্তির উল্লাস, স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ সে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করে, তিন বছরেরও বেশি সময় পরে নিজের ছেলেকে দেখতে যায়। মামাবাড়িতে ছেলের অনাদর দেখেও তাকে ফেলেই চলে আসে, স্ত্রীর গয়না বেচে নিজের প্রথম বই ছাপায়, আর শেষ পর্যন্ত ছেলেকে নিশ্চিন্দিপুরে রেখে বিদেশে চলে যায়, যাতে খোকা কষ্ট পেয়ে মানুষ হয়। অপুর জীবনে আসে একের পর এক নারী। তাদের প্রতি অপু যে শরীরী আকর্ষণ বোধ করে, সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। যৌনতার ব্যাপারে বার বার তিনি চাপা আভাস দেন, কখনও উচ্চকিত হন না। সবার মধ্যে থেকেও, সহৃদয় ও মানবিক স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও অপুকে শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ, বহিরাগত মনে হয়। বাইরে থেকে তাকে বিচার করলে তাই বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। নিজের জীবনকে নিজের মতো করে পাওয়ার জন্য আসলে সে ভিতরে ভিতরে একটু নিষ্ঠুর। কোনও কিছুর সঙ্গেই আপস করতে রাজি নয়।

‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসে স্বামীকে দিয়ে না খেতে পেয়ে মরা মতি মুচিনীর রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ হয়ে ওঠে আসন্ন দুর্ভিক্ষের হাতছানি। একটু একটু করে দুর্ভিক্ষ এগিয়ে আসছে, নানা ভাবে তার ইশারা দিয়ে গেছেন বিভূতিভূষণ। প্রতিটি চরিত্রের কথায় ও আচরণে, প্রতিটি ঘটনার বর্ণনায় তিনি আসন্ন সর্বনাশের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। অনাহার কী ভাবে মানুষকে নৈতিক স্খলনের দিকে ঠেলে দেয়, দেখিয়েছেন। ভায়োলেন্স যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তাকে যে কী সংযত, নান্দনিক ভাবে প্রকাশ করা যায়, তার অসামান্য নমুনা এই উপন্যাস।

প্রায় নিরন্ন, গরিব স্কুলশিক্ষকদের নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘অনুবর্তন’। গোটা উপন্যাস জুড়েই ক্ষুধা, অভাব, বেঁচে থাকার লড়াই আর রোজগারের দুশ্চিন্তা। এক কাপ বাড়তি চা বা টোস্ট পেলেই ধন্য শিক্ষক সম্প্রদায়। একটু মুখরোচক খাবারের জন্য কত না কৌশল তাঁদের। দারিদ্র যে শিক্ষিত মানুষকেও কতটা মর্যাদাহীন করে তুলতে পারে, তারই হিংস্র দলিল এই বই। একটা জাতি শিক্ষকদের শ্রদ্ধাসনে বসিয়েও তাঁদের প্রায় না খাইয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে, এই ভণ্ডামিকেই তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ।

‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ উপন্যাসে জিতুর শৈশব কাটে কার্শিয়াংয়ে। জিতুর বাবা ছিল খামখেয়ালি, ভাবুক স্বভাবের মানুষ। চাকরি চলে যাওয়ার পর সে ফিরে আসে নিজের গ্রামে। কিন্তু এক দিকে অভাব ও কর্মহীনতা, অন্য দিকে নিকট-আত্মীয়দের তাচ্ছিল্য ও নির্যাতনে পাগল হয়ে যায় জিতুর বাবা। হোগলা বনের ভিতরে তাকে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়, যাতে সে পথ চিনে ফিরে আসতে না পারে। ফিরে আসার পর গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় তাকে। নিজের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত মানুষটার প্রতি উদাসীন হয়ে যায়। জিতুর বোন সীতা পড়াশোনা করতে ভালবাসত, বিয়ে দিয়ে তার জীবনটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। এ ভাবেই একটা হৃদয়বান পরিবারের ওপর সর্বনাশ নেমে আসে। কেউ তাদের করুণা করে না, বরং সবাই তাদের অভাব ও অসহায়তার সুযোগ নেয়।

নারী ও শিশুর মৃত্যু, শেষ বয়সে অসহায় নারী-পুরুষের জরাগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকা বা আত্মহত্যার প্রবণতা বিভূতিভূষণের বহু গল্পেই এসেছে। দারিদ্র, হতাশা, পরশ্রীকাতরতা, এ সব নিয়ে কোনও মতে খেয়ে বা না খেয়ে শেষে পরেই যায় ঔপনিবেশিক বাংলার মানুষ। যারা বেঁচে থাকে তারা জলাজমি, খাল বিল পুকুর ঘেঁটে কোনও রকমে কচুশাক মেটে আলু ডুমুরসেদ্ধ গুগলি-গেঁড়ি, মোটা ভাত আর খুদকুঁড়ো খুঁটে খায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতীয় চোরাবাজার, কী পরম ফুলেফেঁপে উঠেছিল, তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা বিভূতিভূষণের বহু গল্পে আছে। আছে জাপানি বোমার ভয়ে শহর ছেড়ে পালানো আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের জীবনের বর্ণনা।

মেদিনীপুর, কুমিল্লা, ত্রিপুরা, পুরুলিয়া ও বাংলা-বিহার সীমান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মন্বন্তরের ভয়াল রূপ বিভূতিভূষণ তুলে ধরেছেন তাঁর লেখালিখিতে। তাঁরই ভাষায়, ‘এই সময় মন্বন্তর শুরু হইয়া গেল। চাউলের দাম আগুন হইয়া উঠিতেছে দিন দিন। আমাদের এই ক্ষুদ্র টাউনের আশেপাশের পল্লীগ্রাম হইতে দলে দলে ক্ষুধারত নরনারী হাঁড়ি ও মালসা হাতে ফ্যান ভিক্ষা করিবার জন্য ছুটিয়া আসিতে লাগিল। ক্রমে এমন হইল ফ্যানও অমিল। লোক দু-একটি করিয়া মরিতে শুরু করিল।’ শহরে কন্ট্রোলের চালের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মানুষ মরে যায়। কচু আর জামরুল পাতা খেয়েও বাঁচতে চায় খিদের জ্বালায় পুড়তে থাকা মানুষ। ন্যাংটো ছেলেমেয়েরা পিছল ড্রেনের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফ্যানের জন্য, এঁটো পাতা চেটে খায়, সামান্য খাবার নিয়ে রাস্তার কুকুরের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে। খিদের জ্বালায় আর সামাজিক নিপীড়ন সইতে না পেরে মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বনে বাধ্য হয়। ‘পুঁইমাচা’ বা ‘মৌরীফুল’ গল্পে হিংস্র অসহায়তার শিকার নারীজীবনকে দেখিয়েছেন বিভূতিভূষণ।

ব্রাহ্মণ পূজারি, নীলকুঠির আমিন, দেওয়ান, ব্যবসায়ী, কৃষক, মুচি, জেলে, ক্ষৌরকার, ময়রা, কামার, সুদখোর মহাজন, ডাক্তার, শিক্ষক, ধর্মব্যবসায়ী, উকিল, হোটেল ব্যবসায়ী, কেরানি, লেখক, কাঁসারি, ঘরামি, পাথুরে চুন বিক্রি, খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি— ইত্যাদি নানান পেশার মানুষের জীবন উঠে এসেছে বিভূতিভূষণের লেখায়। রান্না, খাওয়ানোর মতো বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর মতো লেখা। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে ঢুকেছেন প্রত্যন্ত প্রদেশে— অরণ্যের অনাহারী মানুষের মধ্যে, আদিবাসী জীবনের অন্তঃপুরে। ‘দেবযান’ উপন্যাসে উঠে এসেছে এক মিথের জগৎ, ঔপনিবেশিকতার দমচাপা অবস্থা থেকে যেখানে তিনি মুক্তি খুঁজেছেন। ‘অথৈ জল’ উপন্যাসে এসেছে খেমটা নাচের দলের কথা, যেখানে গ্রামের চিকিৎসক শশাঙ্ক আকৃষ্ট হয় মুজরো পরিবেশন করা নারীটির প্রতি। তাঁর ‘ইছামতী’ উপন্যাসের বিষয় নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ। অথচ এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ঘটনার ঘনঘটা নেই, কোনও রকম উত্তেজনা, যুদ্ধ বা বীরত্বের রবরবা নেই। প্রজাপীড়ন রয়েছে, প্রজাদের প্রতিবাদও। আছে হিংসার সমস্ত উপাদানই, কিন্তু তার প্রকাশ সংযত, সংহত। ঔপনিবেশিক স্বদেশের বাস্তবতাকে এ ভাবেই তন্নতন্ন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন বিভূতিভূষণ, স্পর্শ করতে চেয়েছেন তার হিংস্র বাস্তবতাকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Bibhutibhushan Bandyopadhyay Colonial Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy