শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্য়ায়।
বিশ শতকের শুরুর দিক। বর্মা তখন ভাগ্যের সন্ধানে ঘরছাড়া বাঙালি তরুণদের ‘দ্বিতীয় আবাস’। প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে সেখানে গড়ে উঠেছে ‘বেঙ্গল সোশ্যাল ক্লাব’, ‘রামকৃষ্ণ সেবক সমিতি’র মতো প্রতিষ্ঠান। এক বার ‘বেঙ্গল সোশ্যাল ক্লাব’-এর আমন্ত্রণে এসেছেন কবি নবীনচন্দ্র সেন ও তাঁর পুত্র নির্মলচন্দ্র। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন রেঙ্গুনে। নবীনচন্দ্রের সংবর্ধনা সভায় গান গেয়েছিলেন তিনি। তবে গান গেয়ে আর সামনে আসেননি, সরে গিয়েছিলেন নিভৃতে। সেই থেকে মুগ্ধ নবীনচন্দ্রের ইচ্ছে, এই গায়কের সঙ্গে আলাপ করবেন, সামনাসামনি গান শুনবেন।
ক’দিন পরে সুযোগ এল। সে সময় রামকৃষ্ণ সেবক সমিতির উদ্যোগে রেঙ্গুনে এসেছিলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ বা শশী মহারাজ। তাঁর সংবর্ধনা সভায় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ হল নবীনচন্দ্রের। কবি জানতে পারলেন, তাঁর সংবর্ধনা সভার কণ্ঠশিল্পী ছিলেন শরৎচন্দ্রই। উৎফুল্ল নবীনচন্দ্র তাঁকে গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন, “আপনার গান শোনবার আশায় আমি তৃষিত চাতকের মত লালায়িত হয়ে আছি।” স্বামী রামকৃষ্ণানন্দও বললেন— “আজ এখানে একত্রে নবীনচন্দ্র, নির্মলচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের উদয় হয়েছে বটে, কিন্তু আমি শরৎ-সুধাই পান করতে চাই।”
এত জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের দাবির সামনে পড়ে লাজুক শরৎচন্দ্রকে গান ধরতেই হল— ‘আমার রিক্ত শূন্য জীবনে সখা বাকি কিছু নাই…’ সবাই স্তব্ধ। গান শেষ হতে নবীনচন্দ্র বললেন, “আপনার গানের ভাব-উদ্দীপনা সেই চিরসুন্দরকে মনে করাইয়া দেয়... আমি আজ আপনাকে ‘রেঙ্গুনরত্ন’ উপাধি দিলাম।” পরবর্তী কালে সাহিত্যের জগতে অমর কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেলেও, গানের জন্য এমন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র— এ খবর হয়তো আজ অনেকেরই অজানা।
ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজাতেন শরৎচন্দ্র। ভালবাসতেন যাত্রা, কীর্তন। গানের টানে নিয়মিত পালাগায়কদের দলে, বৈষ্ণবদের আখড়ায় যাতায়াত। এ ভাবেই বাজাতে শিখলেন এস্রাজ, পাখোয়াজ, তবলা, হারমোনিয়াম। বন্ধু রাজেন্দ্রনাথ বা রাজুর সঙ্গে দস্যিপনা করে বেড়ানোর পাশাপাশি, তার কাছে বেহালা বাজাতেও শিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। এই রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের আদলেই তিনি গড়েছিলেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি।
শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি ছিল ভাগলপুরে। সেখানে আর্য থিয়েটারের এক অনুষ্ঠানে এক বার নারী চরিত্রে অভিনয় আর গান করেছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর গানের গলা ছিল ভারী মিষ্টি। তাই অল্পবয়সে নারী চরিত্রে তাঁকে বেশ মানাত।
১৯০২ সালে শরৎচন্দ্র চলে যান বর্মায়। প্রথম চাকরি পেলেন পেগুতে, পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টসে। সেখানকার ডেপুটি এগজ়ামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্র শরৎচন্দ্রের গানের ভক্ত হয়ে উঠলেন অচিরেই। সেখানে তাঁর মূল পরিচয়ই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। গাইতেন মূলত কীর্তন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয় ছিল কীর্তন— তাঁর লেখায় বৈষ্ণব আখড়ার বর্ণনায় সঙ্গীত আর প্রেম একে অপরের পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথের গানও ছিল তাঁর প্রাণের খুব কাছাকাছি। বর্মায় প্রবাসজীবনে গেয়েছেন— ‘ওহে জীবনবল্লভ’, ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা’, ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে’ প্রভৃতি গান।
এক বার হরিদাস শাস্ত্রীকে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, “নারীজাতি সম্বন্ধে আমার চরিত্র কোনকালে উচ্ছৃঙ্খল ছিল না, এখনও নয়।… যাকে ভালোবাসতে পারি নে, তাকে উপভোগ করার লালসা আমার দেহে ওঠেনি কখনও।… বিশ্বকবির গানটা তোমার মনে আছে কী?— ‘কখনো কুপথে যদি/ ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি/ অমনি ও মুখ স্মরি/ শরমেতেহই সারা’।”
‘তোমারেই করিয়াছি’ গানটির কথা হয়তো ঠিকমতো মনে ছিল না শরৎচন্দ্রের। ‘বিপথে’র জায়গায় ‘কুপথে’, ‘হেরি’র পরিবর্তে ‘স্মরি’ বলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কতখানি গভীর ভাবে তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন, তা এই আত্ম-সমীক্ষা থেকেই পরিষ্কার।
গানে শরৎচন্দ্রের প্রথাগত তালিম ছিল না। সঙ্গীত ছিল তাঁর ছন্নছাড়া অথচ দরদি, প্রেমিক-হৃদয়ের প্রকাশ। ভাগলপুরের রাসবিহারী দাস ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী, তাঁর কাছে বার বার কীর্তন শুনতে চেয়েছেন। এ ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে গান শোনার জন্য আকুল হতে দেখা গেছে তাঁকে। দিলীপকুমারের গলায় দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ও কে গান গেয়ে গেয়ে চলে যায়/ পথে পথে ঐ নদীয়ায়’ গানটি শুনে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন।
পরবর্তী কালে গান গাওয়া থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন আকস্মিক ভাবেই। যা কিছু গান তিনি গেয়েছেন, সবই কিশোর বয়সে, ভাগলপুরে বা আদমপুরে, সাহিত্যের আড্ডায় বা গানের আসরে, অথবা রেঙ্গুনে প্রবাসকালে। তবে দু’-একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে তিনি গান না গাইলেও বাদকের ভূমিকা নিয়েছেন। কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। এক বার সামতাবেড়ের বাড়িতে এক ঘরোয়া বৈঠকে বাজিয়েছিলেন সেতার।
নাটকের জন্য গান লিখেছেন শরৎচন্দ্র। ১৯২৭ সালে নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ হয় ‘ষোড়শী’— শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’-র নাট্যরূপ। পরিচালনা ও অভিনয়ে ছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ী। এই নাটকের জন্য একটি গান লিখে দেওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। শরৎচন্দ্র নিজেই লেখেন গানটি, ‘তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন/ ওরে অবোধ মন/ মরণখেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন...’
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এক বার ‘বিচিত্রা’-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করলেন যে, বাণীর উপর অত্যধিক গুরুত্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুক্ত পথে সুরের প্রকাশে বাধা দেয়, ফলে গান যেন শিকলে বাঁধা পড়ে যায়। শরৎচন্দ্র প্রতিবাদ করে বললেন, “উপীন, তোমরা ভুলে যাচ্ছ যে, বাংলা গানের কথাটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই;... সংগীতের ওস্তাদেরা কথাকে আমল না দিয়ে সুরকে বড় করেন— এই তো? কিন্তু কথা তো বাদ দিতে পারেন না। তোমরা যদি কথা বাদ দিয়ে তেলেনা গাও, দেখবে শ্রোতার সম্পূর্ণ অভাব হয়েছে। ওস্তাদি গানের চরম উদ্দেশ্য হতে পারে সুর, কথা নয়; কিন্তু সেখানেও মুশকিল দাঁড়ায় সুরের কুস্তি নিয়ে। সেটা করা শক্ত হতে পারে; কিন্তু সেখানেও সংগীত শৃঙ্খলিত।… বাংলা গানের নিজের বিশেষত্ব আছে সেটাকে আমি বলব নিজের প্রতিভা।... বাংলার কীর্তন গান বাদ দিলে বাঙালির থাকে কী? সুর আর কথার আদর্শ সাহচর্য-র কথাই রবিবাবু বলেছেন। তোমাদের বয়স হলে বুঝতে পারবে।”
শরৎচন্দ্রের মতো এক জন সঙ্গীতরসিক সাহিত্যিক মাত্র একটি প্রবন্ধ লিখে গেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে, ‘ভারতীয় উচ্চ-সংগীত’ (ভারতবর্ষ, ফাল্গুন, ১৩৩১)। নাটকের দু’-একটি গান লিখলেও, গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার কথাও হয়তো তাঁর মনে হয়নি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেন পরবর্তী কালে সঙ্গীতজগতের সঙ্গে আর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখলেন না, এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy