ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল।
আসতে পারি, স্যর?”
আবার পর্দা সরিয়ে এক জনের উঁকি। এই নিয়ে অন্তত কুড়ি জন শঙ্খর সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে এল। প্রথমেই এসেছিলেন অফিসের কর্মচারীরা। তার পর বিভিন্ন ধরনের কর্মীরা এসে দেখা করে যাচ্ছে।
গত মাসে শঙ্খ চ্যাটার্জি সহকারী বাস্তুকার থেকে নির্বাহী বাস্তুকার পদে পদোন্নতি পেয়েছে। তার পোস্টিং হয়েছে ঝাড়গ্রাম শহরে। আজই শঙ্খ দায়িত্বভার নিয়েছে। ঝাড়গ্রাম তার কাছে নতুন নয়। বিশ বছর আগে এই শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে জঙ্গল-ঘেরা শালবনি নামের এক জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে সে চাকরিজীবন শুরু করেছিল। তখন প্রায়ই ঝাড়গ্রামে আসা হত। আজ সেই সব দিনের কথা শঙ্খর খুব মনে পড়ছে। তার দেখা শহরটার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শাল জঙ্গল নিঃশেষিত। পাড়ায় পাড়ায় বহুতলের রমরমা। বনবীথির মধ্য দিয়ে ঘুমন্ত ময়ালের মতো নিঝুম পথে এখন অবিরত গাড়ি আর পথচারী।
শঙ্খর চেম্বারে প্রবেশ করা মানুষটা হাসিমুখে টেবিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাত হাত ঘষে বলল, “চিনতে পারছেন, স্যর? আমি জিতেন মাহাতো। শালবনি ব্রাঞ্চ ক্যানালের উপর সেই কাজটা স্যর আপনি সুপারভাইজ় করতেন…”
মনে আছে শঙ্খর। বিশ বছর আগে এই জিতেন মাহাতো ছিল লেবার সর্দার। তেলহীন উসকোখুসকো বড় বড় চুলদাড়িওয়ালা লোকটা কাজের সাইটে লেবারদের খাটাত। গা থেকে বেরোত ঘামের দুর্গন্ধ, মুখে অবিরত কাঁচা খিস্তি। আজ সেই জিতেনের চুল-দাড়ি নিখুঁত, চোখে সোনালি চশমা, উজ্জ্বল চামড়া। সদ্য ইস্তিরি-ভাঙা দামি শার্ট-প্যান্ট পরনে। তার গা থেকে আসছে ডিয়োডোরেন্টের সুগন্ধ। এখানে এসেই শঙ্খ জিতেন মাহাতোর খবর পেয়েছিল। সে আর লেবার সর্দার নয়, প্রভাবশালী ঠিকাদার। তার সঙ্গে অন্য ঠিকাদাররা এঁটে উঠতে পারে না। জিতেন মাহাতোর ঝাড়গ্রাম শহরে বিশাল বাড়ি, গাড়ি।
জিতেন বিনীত স্বরে বলল, “স্যর, এক দিন আসুন সাইটে। শালবনিতেই আমার একটা কাজ চলছে। আগামী সপ্তাহেই ঢালাই।”
এমন একটা সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল শঙ্খ। নির্দিষ্ট দিনে সে অফিসের গাড়িতে সাইটের পথ ধরল। কত পাল্টে গেছে চার পাশ। সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল শঙ্খ। জঙ্গল অনেক হালকা হয়ে গেছে। রাস্তার দু’পাশে সুদৃশ্য বাড়ি, দোকান। যেখানে কুড়ি বছর আগে জঙ্গলের মধ্যে প্রথম বাস থেকে নেমেছিল শঙ্খ, সেই জায়গাটা আমূল বদলে গেছে। সে দিন জনহীন স্থানে সে-ই একমাত্র যাত্রী ছিল। আজ প্রতীক্ষালয়ে অনেক যাত্রী বাসের জন্য অপেক্ষা করছে।
কুড়ি বছর আগে শঙ্খর জন্য জঙ্গলের ধারে একটা টালির চালের বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই থাকত সে। মাথার কাছে জানালা খুললেই দেখা যেত হতদরিদ্র আদিবাসী পাড়া। শুয়োর, ছাগল, মুরগির দাপাদাপি। জানালা থেকে ফুট কুড়ি দূরে একটা কয়েতবেল গাছ আর তার পাশেই একটা ছোট, খোড়ো চালের হতশ্রী মাটির বাড়িতে থাকত ফুলমণি নামে এক সুন্দরী যুবতী। তখন তার বছর কুড়ি বয়স। সময় পেলেই শঙ্খ জানলা খুলে ফুলমণিকে দেখত। মেদহীন ছিপছিপে শরীরের সেই জনজাতীয় যুবতী ক্যানালের কাজ করত। শঙ্খকে সকালেই কাজে বেরিয়ে পড়তে হত। ক্যানালের তলা দিয়ে বৃষ্টির জল যাওয়ার জন্য কৃত্রিম নালা তৈরি হত। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে শঙ্খ দাঁড়িয়ে কাজ দেখত। জিতেন মাহাতো সাইটে হম্বিতম্বি করত। ইট, বালি, পাথর, সিমেন্টের হিসাব রাখত, সরকারি বাবুদের দেখভাল করত। ফুলমণি জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটে আসত। শঙ্খকে দেখে হেসে বলত, “বাবু, তোকে দেখে খুব মায়াটো হয়। শহরে কাজ পাসনি বুঝি?”
ম্লান হাসত শঙ্খ। কাজের সাইটে ফুলমণি মশলাভর্তি কড়াই মাথায় নিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করত। শঙ্খ গভীর দৃষ্টিতে দেখত। কী সাবলীল ভঙ্গি! শরীরে হিল্লোল তুলে কোমর দুলিয়ে দৌড়ত ফুলমণি।
বছরখানেকের মধ্যেই সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছিল শঙ্খ। এক শীতের দুপুরে ক্যাম্প ছেড়ে চলে এসেছিল সে। আগের দিন ছিল পৌষ পরব। নতুন শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজে ফুলমণি শঙ্খর ঘরে পিঠে আর হাঁসের মাংস নিয়ে হাজির হয়েছিল। তখন সন্ধেবেলা। সেই পিঠে আর মাংসর স্বাদ আজও লেগে আছে শঙ্খর জিভে।
কুড়ি বছর আগে যেখানে সে কাজ করে গেছে, তার পাশেই ক্যানালের উপর তৈরি হচ্ছে নতুন সেতু। আজ ডেক স্ল্যাব ঢালাইয়ের প্রোগ্রাম ফেলেছে জিতেন মাহাতো। সকাল থেকেই ঢালাই শুরু হয়ে গেছে। জিতেন মাহাতো সাইটে শঙ্খর আপ্যায়নের জন্য ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি। ডাব কাটা হল। ফিনকি দিয়ে জল বেরিয়ে এল ডাব থেকে। তৃপ্তি করে জল খেল শঙ্খ। গদি-আঁটা চেয়ার পেতে দেওয়া হল শঙ্খর বসার জন্য। শঙ্খ বসল না। কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না সে দিকে নজর তার। এক পাশে স্তূপ করে রাখা সিমেন্ট, বালি, পাথর। নাগাড়ে মেশিন চলছে। ভাইব্রেটর-এর শব্দ মাঝে মধ্যে বিশ্রী রকম তীব্র হয়ে কানে লাগছে। সিমেন্টের গুঁড়ো উড়ছে। কড়াইভর্তি মশলা মাথায় নিয়ে ঢালাই লেবাররা দৌড়চ্ছে। ডেক স্ল্যাবের ঢালাই আজই সম্পূর্ণ করতে চায় জিতেন মাহাতো। শঙ্খর গা ঘেঁষে যাচ্ছে ঢালাই শ্রমিকরা। অনেক মহিলা শ্রমিকও রয়েছে। খুব কাছ থেকে লক্ষ করছে শঙ্খ। হঠাৎ এক জন মহিলা শ্রমিকের কড়াই থেকে শঙ্খের গায়ে চলকে পড়ল মশলা।
জিতেন মাহাতো হুঙ্কার দিল, “ফুলমণি, সাবধানে যেতে পারিসনে? গায়ের উপর দিয়ে গিয়ে সাহেবের প্যান্টে যে মাল ফেলে দিলি বে! লাথ মেরে দূর করে দেব সাইট থেকে।”
“তোরা সরে দাঁড়াতে লারছিস? এটা কি দাঁড়ানোর জায়গা বটে? ইখানে কি তামাসা লেগিছে তুদের? সব দোষ আমার তাই না?” মহিলা রুখে উঠল।
নামটা শুনে চমকে উঠল শঙ্খ। ফুলমণি! দেখল মহিলাকে। মধ্যবয়স্কা বিগতযৌবনা। সেই কুড়ি বছর আগের দেখা ফুলমণিই তো! তেমনই বলিষ্ঠ পায়ে, সাবলীল ভঙ্গিমায় কোমর দুলিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে চুর করা মশলা নিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষে দৌড়ে চলেছে।
“কত দিন কাজ করছে এই মেয়েটি?” পরনের পোশাক থেকে মশলা ঝাড়তে ঝাড়তে শঙ্খ প্রশ্ন করে জিতেন মাহাতোকে।
“তা স্যর, কুড়ি-বাইশ বছর তো হবেই। আপনি যখন এখানে ছিলেন, তখনও ফুলমণি ছিল। এ তল্লাটে কাজ থাকলেই ওর ডাক পড়ে।”
শঙ্খর সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ফুলমণিকে সে যে কাছ থেকে দেখেছে। এক দিনের ঘটনা আজও ভুলতে পারেনি শঙ্খ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসে মাটি কাটা কত দূর হবে, তা খুঁটি পুঁতে নির্দিষ্ট করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ সেই খুঁটি সরিয়ে কাছাকাছি করে দিয়েছিল। ফুলমণি শঙ্খর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে ফুঁসে উঠেছিল, “তুই কী করতে আছিছ বটে? এরা যে খুঁটিটো সরাইন দিল তুই নজর দিলি না! সব জিতেনের চালাকি বটে। আমার চোখকে অত সহজে ধুলো দিতে পারবি না বটে।”
কুড়ি বছর পর আবার ফুলমণিকে দু’চোখ ভরে দেখল শঙ্খ। ঠিক আগের মতো ফুলমণির শাড়ির আঁচল কোমরে বাঁধা। বুকে একটা লাল ছোট গামছা। কড়াইতে চুর করা মশলা নিয়ে সাবলীল ছন্দে অন্যদের টপকে দৌড়ে চলেছে সে। ফুলমণির বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল চ্যাপ্টা এবং বাঁকা। কুড়ি বছর আগে মাথা থেকে মশলাভর্তি কড়াই বাঁ পায়ে পড়ে গিয়েছিল শঙ্খর চোখের সামনে। রক্তে ভেসে গিয়েছিল পায়ের আঙুল।
শঙ্খ, জিতেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কড়া রোদে ফুলমণি দৌড়চ্ছে। সেই আগের মতো দৃঢ় পদক্ষেপ, সেই সহজ ছন্দ, সেই কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখ। তার মাথায় মশলাভর্তি কড়াই। একাগ্র মনোভাব। ফুলমণির চেহারা আগের মতো নেই। প্রৌঢ়ত্বের লক্ষণ স্পষ্ট। কিন্তু ফুলমণি আজও সেই ঢালাই শ্রমিক হয়েই রয়ে গেছে।
শঙ্খ সাইকেল থেকে চারচাকা গাড়ি, সরকারি কোয়ার্টার, বড় অঙ্কের মাসমাইনে, সব পেয়েছে। যে জিতেন মাহাতো কড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধুলোবালির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকত, সে রোদ লাগার ভয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে উড়ন্ত সিমেন্ট থেকে বাঁচতে সুগন্ধি রুমাল ঢাকা দিয়েছে নাকে। তার দু’হাতে সাত-আটটি হিরে মুক্তো পান্নার আংটি। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে পারে না শঙ্খ। তার মন পড়ে আছে কুড়ি বছর আগের সেই ক্যাম্পের দিকে। ক্যাম্পের পিছনেই যে ফুলমণির বাড়ি। দু’দিন পর দুপুরবেলায় আবার গেল শঙ্খ। একা। ফুলমণি তাকে সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না। প্রথমে গেল সদ্য ঢালাই হওয়া ব্রিজটার কাছে। ডেকে জল বাঁধা। সেখানে কেউ নেই। এ বার সে হাঁটতে শুরু করল। ওই তো সেই ক্যাম্প। পরিত্যক্ত। শঙ্খ যে ঘরটায় থাকত, সেখানে বসে ঝিমোচ্ছে দুটো ছাগল। জানলা দিয়ে শঙ্খ দেখল ফুলমণির মাটির বাড়ি। কুড়ি বছর আগের মতোই। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ফুলমণি এল। মাথায় করে নিয়ে আসা গাছের শুকনো ডালপালা ঘরের সামনে রাখল। তার পর কোমরে হাত দিয়ে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। শঙ্খর উচ্চপদের গরিমা, অর্থ, সম্মান, আভিজাত্য মুহূর্তে ফুলমণির মাটির বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল যেন।
ফুলমনি আগের ফুলমণিই আছে। আগের মতো উঠোনে চাল ছড়িয়ে দিল। তার পোষা মোরগ-মুরগিরা খুঁটে খুঁটে খেতে লেগে গেল। মুহূর্তে শঙ্খ নিজেকে নিয়ে গেছে কুড়ি বছর আগে। ক্যাম্প থেকে ফিরে কুয়োর জলে চান সেরে সেও বাইরের বারান্দায় বসে দুপুরের খাবার খেত। মোটা চালের ভাত, ডিংলা-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট। কখনও সখনও ডিমের ঝোল। ক্যাম্পের সামনের কুয়ো থেকেই জল তুলে ঢকঢক করে গলায় ঢালত শঙ্খ। এখন মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খায় না। বোনচায়না প্লেটে সরু চালের ভাত খায়।
ফুলমণি খাচ্ছে। তাকে ঘিরে ঘুরছে মোরগ-মুরগিরা। কয়েতবেল গাছে জড়ো হয়েছে এক ঝাঁক ছাতারে পাখি। তারা সমস্বরে কিচিরমিচির শুরু করল। কুড়ি বছর আগে এমনই দেখত শঙ্খ।
আবার সেই সেতুর জায়গায় ফিরে এল শঙ্খ। ডেক স্ল্যাবের ঢালাইয়ে একটা অদ্ভুত বুড়ো আঙুল থ্যাঁতলানো বাঁ পায়ের ছাপ। শঙ্খ নিশ্চিত, এই ছাপটা ফুলমণির। কাঁচা কংক্রিটের উপর হাঁটার জন্যই ছাপটি পড়েছে। শঙ্খের মনে হল, ঈশ্বর নিজেই তাঁর সন্তানের কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শঙ্খ স্বগতোক্তি করল, “ফুলমণি, তুমিই শুধু তোমাতে থাকতে পারলে... আমরা কেউ পারলাম না, কেউ না। ”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy