Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প
Bengali Short Story

প্লট

সৌগতর খেয়ালই ছিল না তনুপিসির জানালা থেকে এখানটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এখন পিসির নজরে পড়ে যেতেই আর এড়ানোর উপায় রইল না।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২২ ০৫:১৬
Share: Save:

আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারিস না?”

তনুপিসির করা এ রকম হঠাৎ আবদার-মাখানো প্রশ্ন শুনে থমকে গেল সৌগত। রাস্তার পাশেই তনুপিসিদের বাড়ি। শরিকি ভাগ-বাঁটোয়ারায় অনেক ভাগে বিভক্ত। অবিবাহিতা তনুপিসি এক ভাগ পেয়েছে। তার মেজভাইটি দিদিকে দেখাশোনার নামে সে ভাগও হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও দু’বেলা খেতে দেয়। কিন্তু সে তো বাড়িতে পোষা কুকুর-বেড়াল থাকলেও লোকে দেয়।

কয়েক মাস আগে একটি নামী পত্রিকার রবিবারের ক্রোড়পত্রে সৌগতর গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ও এই আধা-মফস্সলে বেশ নাম করে ফেলেছে। আসলে চোখের সামনে এক জন লেখককে দেখতে পেলে মানুষের এখনও একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। আজকাল সবাই যে বলে, মানুষের সাহিত্য পড়ার অভ্যেস আর নেই— কথাটা বোধহয় পুরো সত্যি নয়।

“তুমি পড়েছিলে আমার লেখা গল্পটা, তনুপিসি?”

“হুঁ। পড়েই তো মনে হল তোকে আর একটা গল্পের প্লট জোগান দিই!” তনুপিসির মুখে নির্ভেজালআন্তরিক হাসি।

সৌগত অবাক হয়ে গেল, তনুপিসি ‘গল্পের প্লট’ও জানে! পাড়ার সবাই বলে পিসির নাকি মাথা খারাপ! এই ছোট্ট ঘরটায় সারা দিন থাকে আর রাস্তা দিয়ে যে-ই যায়, তাকেই জানলা দিয়ে ডেকে ডেকে কথা বলে। প্রচুর কথা বলে। সে সব আবোল তাবোল কথা না হলেও অপ্রাসঙ্গিক তো বটেই। অনেকেই তনুপিসির কথার ঝুলি খোলার ভয়ে ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে চলে যায়, কিংবা ডাকলেও না শোনার ভান করে।

“আচ্ছা লিখব’খন তোমায় নিয়ে একটা গল্প,” সৌগত হেসে বলল।

“এর পর যে দিন আসবি, সময় নিয়ে আসিস,” তনুপিসির সিরিয়াস মুখে বলা কথাটা শুনে সৌগত আর কিছু না বলে হেসেই মাথা নাড়াল। যার মানে হতে পারে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চললাম।’

দিনকতক পরের কথা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিক এগোনোর পর তনুপিসির বাড়ির সামনে পৌঁছতেই জোর বৃষ্টিতে আটকে পড়ল সৌগত। মায়ের কথাটা শোনা উচিত ছিল। বেরোনোর সময় বার বার করে বলেছিল ছাতা নিয়ে বেরোতে। কত ক্ষণে বৃষ্টি ধরবে কে জানে! টিউশনটা বোধহয় গেল আজ! মাথা বাঁচাতে তনুপিসির বাড়ির বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সৌগত।

তনুপিসি তাকে দেখতে পেল জানালা দিয়েই।

“আরে! তুই বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছিস যে! আয় আয়, ভেতরে আয় এক্ষুনি। ভিজে জ্বরটর বাঁধিয়ে ফেলবি শেষ কালে...”

সৌগতর খেয়ালই ছিল না তনুপিসির জানালা থেকে এখানটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এখন পিসির নজরে পড়ে যেতেই আর এড়ানোর উপায় রইল না। তবে সৌগতর এই মাঝবয়সি পিসির সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা খারাপ লাগে না।

“এই নে, আগে মাথাটা মুছে নে!” ঘরে ঢুকতেই একটা পরিষ্কার তোয়ালে এগিয়ে দিল তনুপিসি।

মা-ও তো এমনই করে! সৌগতর ভাল লাগল। এই ভিজে স্যাঁতসেঁতে দিনে ছোট্ট ঘরটায় আলো বলতে সিলিং থেকে ঝোলানো বাল্‌ব। খুব জোরালো নয়। ঘরের এক কোণে রান্নার ব্যবস্থা। সে দিকে নজর যেতে সৌগত জিজ্ঞেস করল, “শুনেছিলাম যে, তুমি দীপুকাকুর কাছে খাওয়াদাওয়া করো...”

“আসলে আমি একটু বেশিই খাই তো, দীপুর বৌ এত রেঁধে উঠতে পারে না রে। আমাকে জিনিসপত্র কিনে দেয়, আমিই রেঁধে নিই। বাদ দে ও সব। চা খাবি? একটু আদা দিয়ে?”

তনুপিসির হালকা গলায় বলা কথাগুলোর ভিতরেও যে দুঃখের তিরতিরে নদীটা, সে একটা আস্ত নৌকো প্রত্যাশা করছে ভাসিয়ে নেবে বলে। সৌগতর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুখ ফুটে বলল, “আচ্ছা খাব। তবে চিনি কম দিয়ো। আর আমি চায়ে দুধ খাই না।”

একটু থেমে থেকে সৌগত বলল, “তুমি কী একটা গল্পের প্লট দেবে বলেছিলে না?”

“শুনবি? সময় হবে আজ?”

বাইরে অঝোর বৃষ্টি। সৌগত মাথা নেড়ে জানাল আজ সময় হবে।

সৌগতদের বাড়িতেও দুর্দান্ত কিছু চা খাওয়া হয় না। কিন্তু এই চায়ের স্বাদ বড় বিশ্রী। চায়ের কাপটাও হাতলভাঙা, ময়লা। তবে তনুপিসির আন্তরিক আতিথ্যে সব খুঁত ঢাকা পড়ে যায়।

“আমি পড়াশোনায় আহামরি ছিলাম না। কিন্তু অঙ্কে আমার হায়েস্ট মার্কস পাওয়া কেউ কোনও দিন আটকাতে পারেনি। কারণ ও আমাকে যে ভাবে অঙ্ক বোঝাত, তার পর মনে হত না যে, আর না বোঝার মতো কিছু থাকতে পারে। গোটা টেস্ট পেপারের অঙ্কের পেজগুলো সাত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত আমার। মাধ্যমিকেও একশোয় একশো বাঁধা ছিল।”

“ছিল কেন বলছ? পাওনি?”

“নাঃ! এক দিন আমাদের পড়া চলছে, একটা একস্ট্রা জিয়োমেট্রি কিছুতেই করে উঠতে পারছি না। আর ও বলেও দিচ্ছে না। বার বার বলছে, ‘চেষ্টা কর, পারবি।’ শেষে আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। খাতা বই বন্ধ করে ফেললাম।

“ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল রে?’

“পারছি না। আর তুমিও তো বলে দেবে না। তা হলে তো পড়াশোনা বন্ধই করে দিতে হয়।

“হাসতে হাসতে ও বলল, ‘চল ছাদে যাই। ফ্রেশ হাওয়ায় বুদ্ধিটা খুলিয়ে নিয়ে আসি তোর।’ আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে পড়লাম। খাতা-বই পড়ে রইল।”

“পড়তে পড়তে হঠাৎ ছাদে উঠে গেলে, কেউ কিছু বলল না? মানে মাস্টারমশাই তার ছাত্রীকে নিয়ে পড়ানো বন্ধ করে ছাদে উঠে যাচ্ছে, ব্যাপারটা একটু কেমন না! বিশেষ করে সেই সময়ে?” প্রশ্ন করে সৌগত।

“বলার কথা তো ছিলই। কিন্তু কেউই কোনও দিন কিছু বলেনি, কারণ ওকে তো সবাই চিনত। বিশ্বাস করত। হয়তো ভেবেছিল সিগারেট খেতে গেছে।

“সে দিন জ্যোৎস্না ছিল। আকাশে ভরাট চাঁদ। আমাদের বাড়িটা পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ছিল বলে চারপাশটা দেখা যেত। আমায় দেখাল, অন্ধকারেও কেমন সব কিছু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! আসলে তা হয় না, কিন্তু ঘোর কল্পনাপ্রবণতা এমন এক প্রত্যয়ে অবতীর্ণ হয় যে, মনে হয় যেন সব কিছু স্পষ্ট। এ ভাবে দৃশ্যের ভিতর থেকে দৃশ্যের ছানা কেটে আসে, কঠিন ও তরলের পৃথক হয়ে যাওয়ার ভিতরে যে নির্বিকল্প বোধিলাভ, তা বুঝতে গেলে অতল পর্যন্ত জার্নির ধকলটুকু তো নিতে হয়। আমাকে বুঝিয়েছিল এ ভাবেই। একটাও অঙ্কের কথা না বলেও কী ভাবে যে সে দিন না-মিলতে-চাওয়া জ্যামিতির মিলে যাওয়া শিখিয়ে দিয়েছিল! আমি দুদ্দাড়িয়ে নেমে এলাম ছাদ থেকে। এসেই খাতা খুলে সটান করেও ফেললাম। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, এ ভাবে তো এত ক্ষণ ভাবিনি!”

সৌগতর ঘোর লেগে গিয়েছিল শুনতে শুনতে। ও দেখছিল ভাঙাচোরা মানুষটার দু’গালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে, মাথার চুলে প্রায় সব সাদা, পরনের পোশাকও তেলচিটে, চোখের দৃষ্টিতে ঘোলাটে আবছায়া, টানা কথা বলে হাঁপিয়ে ওঠেন। তবু তাঁর আশ্চর্য শব্দগুলো স্যাঁতসেঁতে ঘরটায় উদ্ভাসিত মায়াজগৎ গড়ে তুলেছে। তাঁর স্মৃতি আগলে রাখার ভঙ্গিটি এত রাজকীয়, যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

“তার পর?” চুপ করে থাকা তনুপিসিকে যেন আবার জাগিয়ে তুলল সৌগত।

“চুপ করে পিছন থেকে আমার অঙ্ক করা দেখে বলে উঠল, ‘নিজেই পারলি তো?’ শুনে আমার সে কী লজ্জা! আমাকে বিভিন্ন বই নিয়ে এসে সল্ভ করাত। জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘তুই অঙ্কের ভিতর দিয়ে পরম আনন্দ লাভ করিস, তাই আমারও ভাল লাগে করাতে।’ এ ভাবেই চলছিল বেশ।

“সারা দিন পড়াত অন্যদের। ঠিক সন্ধের সময়টা রাখা থাকত আমার জন্য। রোজ। বললে বিশ্বাস করবি না, আমার যেন কেমন একটা রিফ্লেক্স তৈরি হয়ে গেছিল! বিকেল ফুরিয়ে আসার আগেই রেডি হয়ে পড়ার ঘরে। আসলে ওই বয়সটা তো ও রকমই। কেউ কেউ ঠাট্টাও করত। আমি কেয়ার করতাম না। টেস্টেও অন্যান্য সাবজেক্টে মোটামুটি, আর অঙ্কে যথারীতি ফুল মার্কস।”

সৌগত বলে ওঠে, “তা হলে মাধ্যমিকে হল না কেন?” সৌগত বেশ বুঝতে পারছে যে ও ঘটনাটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনুপিসি ফের শুরু করল, “জানুয়ারি মাসে ও হঠাৎ ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়ে গেল। প্রথম পোস্টিং গোয়ালিয়র। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন পরীক্ষা দিচ্ছিল। সে দিন সন্ধেয় আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে জানাল। বাবা-মা আশীর্বাদ করলেন। লুচি বেগুনভাজা মিষ্টিও খাওয়ালেন। আমার কেন যেন খুব চোখ জ্বালা করেছিল। সবার সামনে বলল, ‘তনুর যা প্রিপারেশন, আমি আর না এলেও ও অঙ্কে একশো পাবেই।’ আমায় আলাদা করে বলেছিল, ‘তিন মাস একদম ছুটি নেওয়া যাবে না বুঝলি। তবে আমি খুব চেষ্টা করব পরীক্ষার সময় এক বার আসতে।’

আমি কিছুই বলিনি। শুধু মনে মনে বলেছিলাম, আসবে তো?”

“এসেছিল?” কৌতূহলী সৌগত।

“নাঃ। ছুটি পায়নি। বাংলা পরীক্ষা হল বৃহস্পতিবার। পরের দিন ইংরেজি। অঙ্ক ছিল তৃতীয় পরীক্ষা, সোমবার। শুক্রবার রাত থেকেই বেদম জ্বর। এলাকার ডাক্তারের চিকিৎসায় ভরসা না রেখে রবিবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হল আমাকে। সোমবার পরীক্ষা দিতে যেতেই পারলাম না।”

“সে কী! হাসপাতালে তো অ্যারেঞ্জ করা যেত।”

“প্রথম কথা, আমার উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না। তা ছাড়া আমাদের বাড়ির কেউ ও সব নিয়মকানুন জানত বলে মনে হয় না।”

“মানে তুমি...” সৌগত রীতিমতো উত্তেজিত। তনুপিসি আলতো মাথা নাড়ল, বলে চলল, “এই শক পেয়ে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। আর লেখাপড়া করিনি। বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন এক রকম। তার পর আস্তে আস্তে আমাকে বাতিলের দলে ফেলে দিল সবাই।

“অনেক দিন পর যখন সামনে এসে দাঁড়াল, দেখলাম সে এক অন্য মানুষ। আমার ব্যাপারটা শুনেছে, কষ্ট পেয়েছে। শুধু বলল, ‘তোর আবার পরীক্ষায় বসা উচিত। অ্যাকসিডেন্ট হতেই পারে। তা বলে কেউ বরাবরের জন্য হাল ছেড়ে দেয় না কি?’ কিন্তু...”

“কিন্তু কী?”

“আমি আর আগের মতো ইনস্পায়ার্ড হতে পারলাম না। কেমন যেন মেকি মনে হচ্ছিল কথাগুলো। হয়তো আমারই ভুল। আমি যে মানুষটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম রে! দীর্ঘ দিন এক সঙ্গে থাকতে থাকতে একটা দাগ পড়ে যায়। দেখবি, দেওয়াল, আয়না, মেঝে সর্বত্র দাগে দাগে ভরে ওঠে জীবনযাপন। মোছা যায় না। হালকা একটা ছাপ থেকেই যায়। এর ভিতরেই আমাদের জড়িয়ে থাকা কতটা ঘন হয়ে থাকে, তা বোঝানো যায় না কাউকে। উপলব্ধির সেই বারান্দায় একা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই মোহ ভারী হয়ে আসে। এক দিন বোঝা যায় মোহের পাথর আর ঠেলে সরানো যাবে না।”

শোনার পর একটু চুপ করে থেকে সৌগত বলে, “তনুপিসি। তুমি সত্যিই একটা গল্প লেখার প্লট দিলে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এর পরও বাকি রয়ে গেল অনেক কিছু।”

সৌগতর কথায় তনুপিসি চমকে উঠে তাকাল ওর দিকে। আমতা আমতা করে বলল, “সবটাই তো বললাম। আর কী বাকি রইল?”

“সেটাই তো শুনতে চাইছি। তবে তুমি না চাইলে থাক।”

তনুপিসি হাত দেখিয়ে থামাল সৌগতকে, বলল, “কী করে বুঝতে পারলি জানি না, ঠিকই ধরেছিস। ভেবেছিলাম আকাশের তারা ছাড়া আর সবার কাছ থেকে আড়ালেই রয়ে যাবে সব কিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যাওয়ার আগে কারও কাছে অন্তত খোলা রেখে যাই পৃষ্ঠাগুলো। কেউ পড়ল কি পড়ল না, তাতে আমার আর কী-ই বা এসে যায়...

“সে দিন সম্মোহিত আমাকে নিয়ে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা আগ্নেয়গিরি নামিয়ে এনেছিল ও... কাঁপিয়ে দিয়েছিল থরথর করে কয়েক পলের সে উদ্দামতায়। বলেছিল, ‘এই অন্ধকার সাক্ষী রইল তনু, এক দিন আমরা ঠিক আলোর নীচে এসে দাঁড়াব দেখিস। সে দিন আমাদের আর অন্তরাল প্রয়োজন হবে না। সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোর সব অঙ্কগুলো মিলে যাবে।’

“আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, ‘পাগলি একটা...’

“সে ডাক আজও শুনতে পাই। চমকে ওঠে আমার নিঃসঙ্গ মুহূর্তেরা। এত এত কথা বলত, এত পরিকল্পনা করেছিল, শুনতে শুনতে আমার অনাঘ্রাত সত্তা ভরে উঠছিল ক্রমশ।”

“এখান থেকে সব এলোমেলো হয়ে গেল কী করে?” সৌগত জিজ্ঞেস না করে পারল না।

“মাধ্যমিকের ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার দিন কথায় কথায় শ্যামলীর থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, ওর এক দূরসম্পর্কের বোনের সঙ্গে আমার টিউটরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। গোয়ালিয়র থেকে ফিরে এসেই রেজিস্ট্রি হবে। পরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে রিসেপশন। শ্যামলীও পড়ত ওর কাছে, খবরও রাখত অনেক। ও আরও জানাল এই চাকরিতে এমপ্যানেলড হয়ে ছিল অনেক দিন আগেই। অথচ আমাদের জানিয়েছিল ফাইনালি চলে যাওয়ার আগে। কেন!”

তনুপিসি থামল। সৌগতও চুপ। দু’জনের চুপ করে থাকা দু’রকম।

সৌগতর সংবিৎ ফেরে আবার তনুপিসির কথায়, “তা হলে কি শুধুমাত্র আমাকে লেখাপড়ায় ইনস্পায়ার্ড করতেই... এত কষ্ট হয়েছিল! এত ফুরিয়ে গেছিলাম যে... তবু একে কিন্তু ঠকানো বলব না। আমি যে এ তুচ্ছ জীবন বাজি রেখেছিলাম, সেটা ওকে বুঝতেই হবে এমন মাথার দিব্যি তো দিইনি কখনও। শুধু নীরব কান্নায় ভেঙেচুরে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এত বড় ভুল কেন করলাম, যেখান থেকে কিছুতেই ফেরা যায় না!”

ইনকাম ট্যাক্সের চাকরি, গোয়ালিয়র পোস্টিং, শ্যামলীমাসি এ সব কথা শুনতে শুনতেই সৌগতর ভিতরে অনেক জিজ্ঞাসা মুছে এসেছিল নিজেরাই। ভাবতে ভাবতে কত দূর যে চলে গিয়েছিল ও!

সেই সুদূর থেকে ওর উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করেছিল প্রশ্নের আদলে কয়েকটি কথার শিমুলতুলো... ‘এত দিন পর আমাকেই বা এ সব বলতে কেন ইচ্ছে হল তোমার? কেন?’

কিন্তু বলতে পারল না। ওর মনে পড়ে গেল, বহু দিন আগে বাবার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা পুরনো ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একটি ধূসর হয়ে আসা সাদা পৃষ্ঠায় একটি নামহীন চিঠি লেখা ছিল— ‘আমাকে ভুল বুঝিস না। অঙ্কে তৈরি হয়ে উঠলেও তুই যে ভিতরে ভিতরে হিসেবে এত কাঁচা থেকে গেছিস, বুঝতে পারিনি রে। এ আমারই দায়। কখনও পারলে ক্ষমা করে দিস...’ যাকে লেখা চিঠি, তাকে হয়তো আর দেওয়াই হয়ে ওঠেনি নানা ব্যস্ততায়। কিংবা বিস্মৃতিতে।

একটা ভারী প্লটের নীচে চাপা পড়ে যেতে যেতে সৌগতর উপলব্ধি হল, জীবন কখন কাকে দিয়ে কার আখ্যান কী ভাবে লিখিয়ে নেয়, বোঝা বড়ই দুষ্কর!

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Short Story Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy