ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
দেবারতিকে পড়াতে গেলে চা-বিস্কুট জোটে, আজ তা আর হবে না। সে চায়ের অর্ডার দিয়ে মাথা চেপে বসে রইল। মাসের রোজগার থেকে তিন হাজার কমে গেল! তার দিক থেকে কি কোনও ত্রুটি হয়েছিল? সে মন দিয়েই পড়াত, ফাঁকি দিত না। একটা টিউশন চলে যাওয়া খুব কিছু সাঙ্ঘাতিক ঘটনা নয়, তবে এখানেও বিপদের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। টিউশনের বাজারেও সে কি ফ্লপ হয়ে যাবে? এক জন স্টুডেন্টকে ভাল পড়ালে সে টিচারের সুখ্যাতি করবে, তা শুনে অন্যরা আগ্রহ দেখাবে। এটা একটা ধারাবাহিক পদ্ধতি।
গতকালই সান্যাল স্যর তাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্যারামেডিক্যালের পার্ট-টাইম জবটায় তাকে কনসিডার করা যাচ্ছে না। অফিশিয়াল ফর্ম্যালিটি মেনে লোকাল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। দু’জন নেট কোয়ালিফায়েড ছেলে অ্যাপ্লাই করেছে। একটি মেয়েও অ্যাপ্লাই করেছে, সে পিএইচ ডি-র পেপার সাবমিট করে বসে আছে। প্রত্যেকেরই বয়স ছাব্বিশ থেকে আঠাশের মধ্যে, সাবজেক্টের টাচে রয়েছে, ম্যানেজমেন্ট সব দিক বিবেচনা করে এই তিন জনকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে। এদের বঞ্চিত করে অভ্রর কথা ভাবা সম্ভব হচ্ছে না।
অভ্র উত্তর লিখেছিল, “আচ্ছা।”
সান্যাল লিখেছিলেন, “দেশের কী অবস্থা ভাবো! এত কোয়ালিফায়েড ছেলেমেয়ে মাত্র আট হাজার টাকার চাকরি পেতেও মরিয়া।”
অভ্র জানতে চেয়েছিল, “কিন্তু আপনি যে আমায় কথা দিয়েছিলেন!”
কোনও উত্তর আসেনি। ধাক্কাটা সে সামলে নিয়েছিল। ওটা সে প্রত্যাশা করেনি, ঘটনাচক্রে প্রস্তাব হিসেবে এসেছিল। নিজের অবস্থান যে কতটা নড়বড়ে, তা সে টের পেয়েছিল। ধাক্কাটা ভুলতেই সে হাব্বাডাব্বা খেলার নেশায় আজ ছুটে গিয়েছিল। জুয়ায় হার এবং বিনা নোটিসে একটা টিউশন চলে যাওয়া তাকে কেমন যেন টালমাটাল করে দিচ্ছে। সে পর পর দু’খানা সিগারেট খেল। সিগারেট পুড়িয়েও শান্তি আসছে না, মন যেন অন্য কিছু চাইছে। আজ দিনটাই খারাপ, কখন কোন বিপত্তি আসবে বলা মুশকিল। পুলিশের হাতে পড়লে ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্রাইভের দায়ে মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। তার চেয়ে বাড়িতে বাইকটা রেখে আসাই শ্রেয়।
গত এক বছর ও-সব ছোঁয়নি সে, আজ তার কুডাক কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। টোটো চেপে সে জলট্যাঙ্কের কাছে নামল। মিনিট দুই হাঁটার পরে সে ‘ললিত বার’-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এসেই যখন পড়েছে তখন দ্বিধা করে লাভ কী? কাচের দরজা ঠেলে সে ঢুকে পড়ল।
দু’নম্বর পেগ শেষ করার পরে অভ্রর মাথা রিমঝিম করতে লাগল। অভ্যেস নেই, অল্পতেই এত নেশা হওয়ার কথা নয়। নেশা হলেই বা ক্ষতি কোথায়? সে আজ বুঁদ হবে, তার জ্বালা জুড়োবে, এই মুহূর্তে সে কিছুই পরোয়া করে না। ফোকটের টাকা, হিসেব না করে সে এক প্লেট তন্দুরি চিকেন নিয়েছে, দামি স্কচ ঢালছে গলায়। তিন নম্বর পেগ শেষ করতেই মাথার ভিতর জমে থাকা রাগ লাভা উগরে দিতে চাইছে। সান্যালকে সে হোয়াটসঅ্যাপে লিখল, “কখনও কারও প্রত্যাশা নিয়ে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।”
দেবারতির বাবাকে লিখল, “নিশ্চয়ই কোনও নামকরা নিট-বিশেষজ্ঞের খোঁজ পেয়েছেন! ভগবান আপনার মঙ্গল করুক।”
হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে সে এ বার ফোন করল।
“হ্যালো।”
“আছিস কোথায়?”
“এক জায়গায় শিখিয়ে বেরোলাম এইমাত্র। আরও এক জায়গায় শেখানো বাকি,” মল্লার বলল।
অভ্র বলল, “তুই শালা আমাদের বন্ধুত্বকে অসম্মান করেছিস।”
“আমি?”
“হ্যাঁ রে হতভাগা! আগে বল, বন্ধুত্বে গোপনীয়তা থাকে?”
“না।”
“কিন্তু তুই সেই অপরাধ করেছিস। এই অপরাধের জন্য তোর গায়ে কৃমি চরে বেড়াবে।”
“আগে শুনি অপরাধটা কী?”
“ন্যাকা! প্রমিতদার বৌকে নিয়ে সিনেমা যাওয়া হচ্ছে! তার জন্য তুই গাড়ল আমাকে ডাহা মিথ্যে বলে দিলি? লজ্জা করে না তোর?”
মল্লার শান্ত ভাবে বলল, “তুই অমন জড়ানো গলায় কথা বলছিস যে! কোথায় আছিস?”
“ললিত বারে। স্কচ খাচ্ছি। খাও খাও বুঁদ হয়ে ডুবে যাও... প্যাঁও।”
“তুই বেশি নেশা করেছিস মনে হচ্ছে। বাড়ি যা। ও-সব তোর সহ্য হবে না।”
অভ্র চেঁচাল, “চোপরাও! জ্ঞান দিবি না। নিজে কী করছিস? নরম মহুয়ার নেশায় মজেছিস এই বয়সে। তাও পরস্ত্রী! কেঁদে কূল পাবি না বলে দিলাম।”
মল্লার বলল, “তোকে বোঝানো যাবে না। তুই এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তবে চিরশ্রীর কথা ভুলেও কাউকে বলবি না। আমাদের বন্ধুত্বের দিব্যি।”
“হ্যাং ইয়োর দিব্যি।”
মল্লার লাইন কেটে দিল। অভ্র আবার কল করল। রিং হয়েই চলল, মল্লার সাড়া দিল না। রাগ থিতিয়ে উঠে আসছে কান্না। অভ্র ফোঁস ফোঁস করে কিছু ক্ষণ কাঁদল, রুমালে চোখ মুছে হুকুম দিল, “আর এক পেগ।”
স্কচে চুমুক দিতে দিতে রুমকির মুখ মনে পড়ল তার। নিজে থেকে কখনও ফোন করেনি। আজ এক বার করতে ইচ্ছে করছে। হালকা নীল আলোয় মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখে অভ্র। রুমকির নম্বর সে সেভ করে রেখেছিল। কিন্তু কনট্যাক্ট লিস্টে ‘রুমি’ দেখতে পাচ্ছে কেন সে? হয়তো কোনও খেয়ালে রুমি নামেই সেভ করে রেখেছিল। তুমুল প্রেমপর্বে সে অবশ্য মাঝেমধ্যে আবেগে ওই নামেই ডাকত।
এই তো, কলটা ধরেছে রুমকি।
“হ্যালো।’’
“রুমি, তোর কথাকে পাত্তা দিইনি। জানিস, আজকেও জুয়া খেলতে গিয়েছিলাম। হাব্বাডাব্বা। লোভ বেড়ে গিয়েছিল যে! চার হাজার টাকা লস হল। তোর চেতাবনি শোনা উচিত ছিল। কী করব বল, নেশা হয়ে গিয়েছে। রোববার হলেই হাব্বাডাব্বার আসর আমাকে টানে। এভরিথিং ইজ় গোয়িং রং। সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আজকাল মাঝেমধ্যে মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
“অভ্রদা, আ-আমি...”
থামিয়ে দিল অভ্র, “তুই আমাকে নিয়ে মজা করছিস! অভ্রদা! কী ব্যাপার, তোর বর কি আশপাশে আছে? মজা করিস না। কাল থেকে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মাসের রোজগার থেকে তিন হাজার কমে গেল। তিন হাজার টাকা আমার মতো বেকারের পক্ষে অনেক মূল্যবান। এ রকম চললে এর পর সিগারেট ছেড়ে বিড়ি ধরতে হবে। তুই কিছু ফিল করছিস রুমি? বিয়েশাদি এ জন্মে হবে না। ও আমি বুঝে গিয়েছি। নিজের রোজগারে ভাল করে বেঁচে থাকতে চাই শুধু। এই ঢ্যামনা সমাজ আমাকে কিছুতেই মাথা তুলে বাঁচতে দেবে না। আই হেট দিজ় লাইফ। এমন জীবনের মুখে লাথি মেরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“তুমি কি মদ খেয়েছ, অভ্রদা?”
“আবার! তুমি বলছিস আমাকে! শেষে তুইও আমাকে নিয়ে খিল্লি করছিস!”
“আমাকে তো কথা শেষ করতেই দিচ্ছ না। একটানা প্রলাপ বকে গেলে। আমি সুমি। কাকে কল করতে গিয়ে কাকে করেছ খেয়াল নেই? এমন নেশার ঘোর!”
অভ্র মিইয়ে গেল, “সুমি! তুমি কী ভাবে বুঝলে যে আমি মদ খাচ্ছি?”
“অভিজ্ঞতা থেকে। আমার মাতাল বরকে দু’বছর সহ্য করেছি, তাই জানি। সাবধানে বাড়ি ফিরবে। যা অবস্থা তাতে ড্রেনে গড়াগড়িও খেতে পারো। সুপ্রীতিপিসির ছেলে বেহেড মাতাল হচ্ছে! বলি, এত ফ্রাস্ট্রেশন কিসের? তোমাকে পিসি
ওই অবস্থায় দেখলে কী অবস্থা হবে, ভগবান জানেন। রাখছি।”
অভ্র থম মেরে গেল। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে গ্লাসের বাকি তরল গলায় ঢেলে নিল। বিল মিটিয়ে বাইরে আসতেই বুঝতে পারল যে তার পা টলছে, দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। রিমঝিম ভাব কেটে গিয়ে মাথাটা লাট্টুর মতো ঘুরছে।
হাত তুলে একটা টোটোকে থামিয়ে উঠে পড়ল অভ্র। চোখ জড়িয়ে আসছে, শরীর জুড়ে ঘুমঘোর, হাত-পা ছড়িয়ে সে পিছনে ঠেস দিল। তার পর টোটোচালককে মৃদু জড়ানো গলায় বলল, “বলছি দাদা, একটা কথা ছিল।”
“বলুন।”
“আপনার ছেলেমেয়ে আছে?”
“হ্যাঁ। এক মেয়ে, এক ছেলে।”
“ছেলের বয়স কত?”
“বাইশ। এই সবে অনার্স পাশ করল।”
অভ্র বলল, “মারিয়েছে রে! আপনি সর্বনাশ করেছেন দাদা!”
“সর্বনাশ?”
“আপনার ছেলে শিক্ষিত বেকার হবে। চাকরিবাকরি হবে না। ডিগ্রি ধুয়ে জলও খেতে পাবে না। তার চেয়ে ছেলেকে হাতে-কলমে কাজ শিখতে বলুন। ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ফিটার যা হোক কিছু হতে বলুন। পুঁথিগত জ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে ঘণ্টা হবে। মেয়েকেও পড়াচ্ছেন নাকি?”
“মেয়ে নার্সিং পড়ছে। দু’বছর হয়ে গেল।”
“দ্যাট’স গুড। শুকনো জ্ঞানে চাকরি হয় না, পয়সা আসে না। বলছিলাম দাদা, একটা জিনিস কিছুতেই মনে পড়ছে না। লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি চাপা পড়ে সে— এই ছড়াটা কোন সিনেমায়
যেন দেখেছিলাম!” অভ্র চোখ খুলে তাকাল, “আপনি জানেন?”
“না, দাদা।”
“চোপ! দাদা বলছেন কেন আমাকে? আপনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। নিজের প্রেস্টিজ রাখতে জানেন না?”
কোনও উত্তর পেল না অভ্র। সে গুনগুন করে গান ধরল, “আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল/ সকলি ফুরায়ে যায় মা।”
টোটো থেকে নেমে টাকা বার করল অভ্র। আবার জানতে চাইল, “মানুষ মাতাল হলে শ্যামাসঙ্গীত গায় কেন দাদা?”
“আপনি বুঝুন। ভদ্রঘরের ছেলে, সে-ও বেহেড হয়ে ফিরছে! দেশটা রসাতলে গেল দেখছি।”
পাল্টা কিছু বলতে যাচ্ছিল অভ্র। তার আগেই টোটো ঘুরিয়ে নিয়ে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে চালক। বাগানের গেট খুলে ডোরবেল বাজাল অভ্র। ঘরে ঢুকে স্লিপার খুলে কিছুটা এগোতেই হুমড়ি খেয়ে মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল সে।
সুপ্রীতি গালে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এমন দিনও তাঁকে দেখতে হবে ভাবতে পারেননি।
সকালে ওঠার পরে সুপ্রীতির চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না অভ্র। তড়িঘড়ি বাইক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। মদ্যপান সে বলতে গেলে করেই না, কাল কেন যে সে ও ভাবে টালমাটাল হয়ে গেল! খুব লজ্জা করছিল তার। নিশ্চয়ই ভীষণ নেশা হয়েছিল তার, আচ্ছন্ন অবস্থায় রুমকি ভেবে সুমিকে ফোন করে ফেলেছিল। সুমি কি তাকে পাঁড় মাতাল ভেবে বসল?
কী যেন বলছিল সুমি? মাতাল বরের সঙ্গে সুমি ঘর করেছে, তার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। তার মানে সুমি বিবাহিতা! বিবাহিতা হলেও তার কোনও চিহ্ন সুমি রাখেনি। বড় গোলমেলে ব্যাপার।
মল্লার কল করেছে দেখে অস্বস্তিতে পড়ল সে। কাল নেশার ঘোরে মল্লারের সঙ্গে সে ব্যবহারটা ভাল করেনি।
মল্লার ফোনটা ধরতেই অভ্র বলল, “স্যরি। তুই গালমন্দ করার আগেই সারেন্ডার করছি। নেশাটা বেশিই হয়ে গিয়েছিল, তাই তখন উল্টোপাল্টা বলে দিয়েছিলাম। ও সব মনে রাখিস না।”
মল্লার বলল, “সব কিছু সবার জন্য নয়। সাতসকালে তোকে গালমন্দ করার মুড নেই। জেলার পাতায় খবরটা পড়েছিস?”
“কোন খবর?”
“তনুময়ের খবর।”
“পেপার এখনও পড়াই হয়নি। কেন বল তো?”
মল্লার কাঁপা গলায় বলল, “আমাদের তনুময় সুইসাইড করেছে।”
অভ্রর সারা শরীর থরথর কাঁপতে শুরু করল। সে শুধু বলতে পারল, “কেন?”
“ও কোনও সুইসাইড নোট রেখে যায়নি। তবে কারণ স্পষ্ট। কোর্টের নির্দেশে দু’নম্বরি উপায়ে চাকরি পাওয়া টিচারদের বোধহয় চাকরি চলে যাবে। সন্দেহজনক শিক্ষকদের লিস্টে তনুময়ের নাম ছিল। চাকরি হারানোর ভয় আর সামাজিক লজ্জার ভয়— এই দুটোর চাপ নিতে পারেনি বোধহয়। গতকাল দুপুরে নিজের ঘরে গলায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিল।”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy