পূর্বানুবৃত্তি: ধনুর্বিদ্যায় একলব্যের অসামান্য ব্যুৎপত্তি দ্রোণকে বিস্মিত করে। অর্জুন যে এই ঘটনায় ম্লান ও বিষণ্ণ, তাও নজর এড়ায় না দ্রোণের। তিনি একলব্যকে শিষ্যের স্বীকৃতি দেন এবং গুরুদক্ষিণা চান। একলব্যের দেয় কোনও অর্ঘ্য বা আহার্য নয়, দ্রোণ যাচ্ঞা করেন একলব্যের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি। সমবেত সকলে বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেও, একলব্য সহাস্যমুখে গুরুদক্ষিণা দানে স্বীকৃত হয়। এই আশ্চর্য বৃত্তান্ত সাত্যকির মুখে বিশদে শ্রবণ করেন বাসুদেব কৃষ্ণ।
চিন্তান্বিত বাসুদেব প্রশ্ন করলেন, “সাত্যকি! তার পর কী হল? অঙ্গুলি-কর্তনের পর? নিষাদের তো তীব্রধারায় রক্তপাত হওয়ার কথা! মুমূর্ষু হয়ে পড়ার কথা অচিরেই! তোমরা বা আচার্য দ্রোণ— কেউ তাকে শুশ্রূষার উদ্যোগ করলে না?”
“ঘটনার অভিঘাতে আমরা প্রত্যেকে বিমূঢ় ও আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম, মান্যবর! রক্ত নির্গত হচ্ছিল প্রস্রবণের মতো। একলব্যের হাতের তালু ভেসে যাচ্ছিল, বনের মৃত্তিকা শোণিতসিক্ত হয়ে উঠছিল। কিন্তু তার মুখে কাতরতা ছিল না। সে আর্তশব্দ করেছিল মাত্র এক বার, যখন ছুরিকা তার অস্থিচ্ছেদ করছিল। ব্যস, তার পরে আর এক বারও না! স্থির দাঁড়িয়েছিল গুরুর সামনে। কিন্তু অর্জুনের মুখে অপরাধবোধ ফুটে উঠেছিল, সে করুণ মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে। যুধিষ্ঠির স্তব্ধ প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। দুর্যোধন অনুচ্চকণ্ঠে বলছিল, “এ কাজটি কি উচিত হল?” তার উত্তরে অশ্বত্থামা যেন পিতার পক্ষে যুক্তি সাজাতে চেষ্টা করছিল, “গুরু নিজের ইচ্ছানুসারে দক্ষিণা চাইতেই পারেন...” ইত্যাদি। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন সময় শুনলাম গুরু দ্রোণ স্বয়ং অশ্বত্থামাকে বলছেন...”
“কী? কী বলছেন?”
সাত্যকি একটু থামল। তার পর বলল, “আচার্য আদেশ করলেন পুত্রকে, আশ্রমের ধাতুশালা-কক্ষ থেকে রুধিরতঞ্চক ভেষজ ও ক্ষতপুষ্টি-রসায়ন নিয়ে আসতে। এই দুর্লভ ঔষধের মিশ্রণে সার্ধদণ্ডের মধ্যে এই প্রকৃতির অঙ্গহানির ক্ষত উপশম হয়। নিজ হস্তে গুরু সেই ঔষধ লেপন করলেন একলব্যের ক্ষতস্থানে। তার পর অপেক্ষা করলেন, যত ক্ষণ না সে কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করল।”
“আচ্ছা! কিন্তু অপেক্ষা করার প্রয়োজনটিহল কেন? দ্রোণের তো অভীষ্ট সিদ্ধ হয়ে গিয়েছে, আর কী?”
সাত্যকি মুখ নিচু করল। যেন ঈষৎ আত্মগ্লানি এল তার কণ্ঠে, “কী বলব হে বাসুদেব! গুরু দ্রোণ অদ্ভুত রকমের একাগ্রমতি। নিজ অভীষ্টের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিরঙ্কুশ ভাবে সিদ্ধ হয়েছে কি না,সে সংক্রান্ত সমস্ত সংশয় তিনি নিষ্ঠুরভাবে অপনোদন করে নেন। বিনা অঙ্গুষ্ঠে একলব্য যে আর পূর্বের মতো নৈপুণ্য-সহকারে শরক্ষেপ করতে পারছে না, সেটি তিনি পুনর্বার পরীক্ষা করলেন। শতভাগ নিশ্চিত হলেন— তার পর আশ্রমাভিমুখে যাত্রা করলেন।”
“ওহ্হ্,” কৃষ্ণ মাথা নাড়লেন এক বার, তার পর বললেন, “কিন্তু... শোনো, শোনো! অঙ্গুষ্ঠ তো শরপ্রয়োগকালে তত প্রত্যক্ষ কাজে লাগে না! মধ্যমা আর তর্জনীই মূলত প্রয়োজনীয়। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করার ফলে, হ্যাঁ, তূণীর থেকে শর সংগ্রহ করে আনতে কিছু সমস্যা হবে বটে...”
“সেইটুকুই যথেষ্ট, মহাভাগ!”
কৃষ্ণ ভ্রু উত্থিত করলেন, “অঙ্গুলি-কর্তনের পরে তার পূর্বের হস্তলাঘব বস্তুতই হ্রাস পেল,তুমি দেখলে?”
“হ্যাঁ! সেই অনন্য তীব্রতাটি... আর নেই, দেখলাম। লক্ষ্য এখনও নির্ভুল, কিন্তু ক্ষিপ্রতা অনেক কম। যে দ্রুত নিক্ষেপসামর্থ্য তাকে অদ্বিতীয় করে তুলেছিল, তার পিছনে দ্রুত চয়ন-ক্ষমতার ভূমিকা ছিল বিপুল, যা অনেকাংশেই তার সহজাত। প্রকৃতিদত্ত পাঁচ অঙ্গুলির পরিবর্তে এখন মাত্র চার— প্রভাব তো পড়বেই। বস্তুত, তার অঙ্গুষ্ঠের অতিরিক্ত সবলতাই ছিল তার সাফল্যের মূল রহস্য। আচার্য দ্রোণ অভিজ্ঞ চোখে তা অনুধাবন করেছিলেন,” সাত্যকি ম্লান হাসল, “অঙ্গুষ্ঠ-কর্তনের পরে একলব্য কেবল এক জন ‘ভাল’ ধানুকীতে পরিণত হয়েছে এখন। শ্রেষ্ঠত্বের যাত্রাপথ থেকে তাকে অর্ধচন্দ্র দেওয়া হল।”
“অতএব, অর্জুন এখন...”
“হ্যাঁ, নিষ্কণ্টক!”
সাত্যকি কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার ঠিক আগে কৃষ্ণ তাকে আর এক বার ডাকলেন। অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাঁকে। প্রদীপটির শিখার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সেই ভাবেই বললেন, “শৈনেয়, ওই নিষাদ একলব্য তার পিতৃপরিচয় কী দিয়েছিল বললে?”
সাত্যকি ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “বলেছিল, সে নিষাদদের গোষ্ঠীপতি হিরণ্যধনুর পুত্র। মগধ-পৌণ্ড্রের অরণ্যে তাদের নিবাস, সেখান থেকেই সে হস্তিনায় এসে...”
“ম-গ-ধ! ...মগধ! মগধের অরণ্যে... নিষাদ-গোষ্ঠী!” অস্ফুটে স্বগত চিন্তা ব্যক্ত করলেন কৃষ্ণ, “কিন্তু, কিন্তু... তাকে দেখে অনার্য নিষাদ মনে হয় না, ক্ষত্রিয় মনে হয়... এমনই বলেছিল না যুধিষ্ঠির?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ। গুরু দ্রোণও তা-ই বলেছিলেন।”
“তুমি? তুমিও তো তাকে নিকট থেকে দেখেছিলে। তোমারও কি মনে হয়েছিল সে নিষাদ-গোত্রীয় নয়?”
“ঠিকই। একেবারেই তার আকৃতি নিষাদসুলভ ছিল না। বরং, তার মুখের গঠন...,” মধ্যপথে থেমে গেল সাত্যকি।
“বলো! কেমন গঠন?”
“না, সে এক হাস্যকর ভাবনা, বাসুদেব,” কুণ্ঠিত দেখায় সাত্যকিকে, “তাকে দেখে চকিতে আমার একটা চিন্তা এসেছিল, এক মুহূর্তের নিতান্ত নাবালকসুলভ কল্পনাকৌতুক মাত্র, আপনার প্রণিধানের যোগ্য নয়।”
“একেবারেই নির্দ্বিধায় বলো, প্রিয় যুযুধান! নাবালকের দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়, তা থেকে সত্য সহজে ধরা পড়ে অনেক সময়। বলো, কী মনে হয়েছিল?”
“প্রগল্ভতা মার্জনা করবেন যদুশিরোমণি। আমার আচম্বিতে মনে হয়েছিল, যে আপনার পিতা... পূজ্য ও বরিষ্ঠ যাদব বসুদেবের মুখাবয়বের সঙ্গে এই বালকের মুখের সামান্য সাদৃশ্যআছে বুঝি!”
১৯
রাজছত্রের নীচে দাঁড়িয়ে কুরুনৃপতি ধৃতরাষ্ট্রের মুখ কঠিন হয়ে উঠছিল।
সাধারণ লক্ষ্যবেধ নয়, আজকের পরীক্ষাটি বাস্তবিকই অতি দুরূহ। আজ শিক্ষাশ্রমে রাজ-পরিদর্শন হবে জেনেই উচ্চতম পর্যায়ের যোগ্যতা-নির্ণায়ক পরীক্ষার এই ব্যবস্থা। ভীষ্ম স্বয়ং আয়োজন করেছেন। সঙ্গে রয়েছেন কৃপ, বিদুর, শকুনি ওঅন্য অমাত্যবৃন্দ।
সূত সঞ্জয় অতি প্রাঞ্জল বিবরণ দিচ্ছেন, ঘটনাবলি যেন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে পারছেন রাজা। কী ভাবে একের পর এক কুমারকে প্রশ্ন করছেন আচার্য দ্রোণ, “কী দেখছ?”— আর উত্তরগুলি শুনে তাদের সরিয়ে দিচ্ছেন শরনিক্ষেপের আগেই। ধৃতরাষ্ট্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছিলেন বেশ। দুর্যোধন তো ভালই উত্তর দিল, বলল সে চার পাশের যাবতীয় বস্তু স্পষ্ট লক্ষ করতে পারছে— বৃক্ষশাখা পত্রপুষ্পাদি, নীল আকাশ, শুভ্র মেঘ, এমনকি ভূমিতে দণ্ডায়মান গুরু ও সতীর্থদের উপরেও তার সতর্ক দৃষ্টি! এতে কেন যে দ্রোণ তাকে কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করে “সরে যাও হে, এ লক্ষ্যভেদ তোমার কর্ম নয়” বললেন, ধৃতরাষ্ট্র বুঝলেন না।
অবশ্য, শুধু ধার্তরাষ্ট্রদের নয়, যুধিষ্ঠির ভীম আদি অন্য পাণ্ডবদেরও আচার্য একই ভাবে অনুপযুক্ত ঘোষণা করে সরিয়ে দিয়েছেন। তাতে ক্রমশ এই ধারণাই রাজার মনে দৃঢ় হচ্ছে যে, দ্রোণ পক্ষপাতী শিক্ষক। ইচ্ছা করেই অর্জুনের পাশে অন্যদের তিনি হেয় করতে চান! অর্জুনকে একেবারে শেষে আহ্বান করা হবেই বা কেন!
বৃক্ষের উচ্চ শাখায় একটি কৃত্রিম ভাস-পক্ষী স্থাপন করেছেন আচার্য দ্রোণ। পত্রান্তরালে সেটি এমনিতেই বেশ দুর্নিরীক্ষ্য। ভূমিতে দাঁড়িয়ে সমস্ত কুমার একযোগে সেটিকে লক্ষ্য করে শরসন্ধান করেছিল। পক্ষীর মুণ্ডটি কেটে ভূপাতিত করতে হবে, এই ছিল নির্দেশ। কিন্তু শরক্ষেপের আগের প্রশ্নোত্তর-পর্বেই গুরুকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি কোনও শিক্ষার্থী।
সকলেই অপসারিত। শুধু অবশিষ্ট রয়েছে শেষ প্রতিযোগী, অর্জুন।
“কী দেখছ, বৎস অর্জুন?” দ্রোণ জিজ্ঞাসা করছেন পূর্ববৎ, শুনতে পেলেন ধৃতরাষ্ট্র। একই প্রশ্ন।
“পক্ষী, গুরুদেব।”
“বিস্তারিত বলো। কী কী দেখছ, সমস্ত উল্লেখ করো কুমার!”
“গুরুদেব, শুধু পক্ষী দেখছি। শুধু পক্ষী... আর কিছু নয়, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না!”
“কিচ্ছু না! সে কী! ঊর্ধ্বে আকাশ, বৃক্ষশাখা, পত্রসম্ভার... নিম্নে তোমার ভ্রাতৃবৃন্দ... কিচ্ছু না?”
“না, গুরুদেব! আপনাকেও না। শুধু পক্ষী...”
ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। অতি অনুচ্চ স্বরেও তাঁর আপ্লুতি ধরা পড়ছে, “শুনতে পাচ্ছ? পার্থক্য বুঝতে পারছ কিছু?”
অন্ধ রাজাকেও এত ক্ষণে যেন অভিভূত দেখায় একটু। অস্ফুটে বলেন, “সত্যিই! এমনভাবে ভাবিনি...”
বিদুর বলেন, “অর্জুনের উত্তরটি শুনে আমার দেহ মুহূর্তে রোমাঞ্চিত হল, হে ভারতশ্রেষ্ঠ! এই তরুণ কুরুবংশের যোগ্য রক্ষক হবে সন্দেহ নেই!”
কিন্তু দ্রোণ এখনও নির্দেশ দিচ্ছেন না শরক্ষেপণের। এখনও প্রশ্ন করছেন, “আবার বলো, অর্জুন! এই শেষ বার! ঠিক কী দেখছ, যথাযথবিবৃত করো!”
অর্জুনের উত্তর ভেসে আসে। অন্য রকম শোনাচ্ছে তার কণ্ঠ। যেন সম্মোহিত... কিন্তু প্রতিজ্ঞা-কঠিন! যেন ধ্যানের মধ্য থেকে শব্দগুলি উচ্চারণ করছে সে।
“পক্ষী... গুরুদেব! কেবল পক্ষী... পক্ষী... না, সমগ্র পক্ষীও নয়, কেবল তার মস্তক... মস্তকটুকু দেখছি মাত্র, গুরুদেব, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না!”
“শর নিক্ষেপ করো, অর্জুন!” দ্রোণ চিৎকার করে বলেন। আর, নিমেষমধ্যে তীব্র টঙ্কার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, বৃক্ষতলে পতনশব্দ!
শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই করতালি দিয়ে ওঠে। হর্ষধ্বনি শোনা যায়। ধৃতরাষ্ট্র ঈষৎ উত্তেজিত ভাবে বলেন, “সঞ্জয়...?”
“হ্যাঁ, রাজন্! নির্ভুল লক্ষ্যভেদ হয়েছে! ছিন্নমুণ্ড ভাসপক্ষী এখন ভূমিতে। ক্ষুরধার শর তার কণ্ঠটি কেটে দিয়েছে নিপুণ ভাবে!”
কিছু ক্ষণ নীরব থাকেন রাজা। তার পর মাথাটি সামান্য নিচু হয় তাঁর। সঞ্জয়কে বলে, “আচার্য দ্রোণের সঙ্গে আমি একান্তে কথা বলব। শিক্ষার্থীরা দূরে থাকুক।”
ধাতুশালা-কক্ষের সংলগ্ন বৃক্ষতলের ছায়াঘন নিভৃতে দাঁড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণাচার্যের হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে বললেন, “আমাকে মার্জনা করবেন আচার্যশ্রেষ্ঠ। আমি কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধচিত্তেই আজ আশ্রম-পরিদর্শনে এসেছিলাম। আমার ক্ষোভ ছিল, কেন আমার পুত্রদের মধ্যে এক জনকেও ধনুর্বেদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুলি দেওয়া হচ্ছে না, শুধুই কুমার অর্জুনকে কেন বিশেষ ভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে! ...কিন্তু আজ আমার ভ্রান্তি অপনোদনহয়েছে, বিপ্রবর!”
দ্রোণ হাসলেন। শান্তস্বরে বললেন, “রাজন, অন্নদাতা হিসেবে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে বেতনভুক কর্মীর ক্রিয়াকলাপ বিচার করেদেখার। আপনার সন্তুষ্টিবিধানই ভৃত্য হিসাবে আমার প্রধান দায়।”
“ছি ছি! এই সব শব্দ-শ্রবণ আমাকে অপরাধী করছে, বিপ্রবর! আচার্য-ব্রাহ্মণের স্থান রাজারও ঊর্ধ্বে। আপনি গুরু-রূপে যথার্থই সদ্বিচারী, আমার অন্ধদৃষ্টিতে তা বিলম্বে প্রতিভাত হল,আমি ক্ষমাপ্রার্থী!”
“গুরুর কর্তব্যই হল প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রকৃত প্রবণতা ও দৌর্বল্য পৃথক পৃথক ভাবে অনুধাবন করে, তাদের প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ততম পথটি নির্বাচন করা। সবাই সব শিক্ষা যথাবিধি অনুশীলন করবে, কিন্তু একটি শাখাতেই অর্জিত হবে শ্রেষ্ঠত্ব— ক্ষাত্রনীতির বিধানই তাই,” দ্রোণ বললেন, “এ ক্ষেত্রে গুরু নিরুপায়। মহারাজ, এ কথা অনস্বীকার্য যে, ধনুর্বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা— কিন্তু সেই ক্ষেত্রটির শ্রেষ্ঠত্ব সকলের আয়ত্তগম্য নয়। অর্জুন, একমাত্র অর্জুন স্পর্শ করতে পেরেছে সেই শিখর। তার নিদর্শন আজ আপনি প্রত্যক্ষ করলেন। সে এই আশ্রমেরই শুধু নয়, এই রাজ্যের নয়— ত্রিভুবনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী হতে চলেছে অচিরেই। দিব্যাস্ত্রের কয়েকটি নিগূঢ় বিদ্যা তার এখনও অর্জন করতে সামান্য দেরি আছে, এইমাত্র!”
সপার্ষদ রাজা বিদায় নেওয়ার আগে বিদুর একাকী এক বার দ্রোণের কাছে ফিরে এলেন। জনান্তিকে বললেন, “আশ্রম-সংক্রান্ত কয়েকটি রটনা নগরে ঈষৎ গুঞ্জিত হচ্ছে, আচার্য। রাজার কর্ণেও পৌঁছেছে। ...সূত অধিরথের পুত্রটি ক্ষুব্ধ হয়েই আশ্রম ত্যাগ করেছিল, এ কি সত্য?”
দ্রোণ গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, “তার ধারণা হয়েছিল, সে গূঢ় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
“ধারণাটিও অসত্য ছিল না, যত দূরআমার অনুমান?”
“আপনি অসামান্য প্রজ্ঞাবান, মহামতি বিদুর,” দ্রোণের কণ্ঠ পূর্ববৎ মন্দ্র, “কুরুবংশের বাইরে, বিশেষত অক্ষত্রিয় ব্যক্তিকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটি বিতরণের প্রশ্নই নেই— এ আপনাকে বলার অপেক্ষা রাখে না। তার দিব্যাস্ত্রের লোভ প্রবল ছিল, ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান ছিল তার কাম্য। এবং সেই আকাঙ্ক্ষার মূলে ছিল মাৎসর্য-রিপু! সে অভিপ্রায় এখানে সিদ্ধ হবে না— সে কথা বুঝেছিল সে।”
বিদুর সামান্য চিন্তিত হন, “হুম্! কিন্তু সেই লোভী যুবক মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে উঠেছে, এই গুপ্তবার্তা মিলেছে সম্প্রতি!”
দ্রোণ বিস্মিতমুখে তাকালেন, “পরশুরামের আশ্রমে! কিন্তু... মহৎ তপস্বী ক্ষত্রিয় অথবা ব্রতধারী ব্রাহ্মণ ব্যতীত তো সেখানে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান...”
“সেই সূতনন্দন ব্রাহ্মণ-পরিচয়েই সেখানে প্রবেশ করেছে! শিক্ষালাভও চলছে সেখানে। আমি খোঁজ করে জেনেছি, সে প্রবল উচ্চাশী, কার্যসিদ্ধির জন্য অনৃতভাষণেও দ্বিধাহীন...”
“সত্য বটে!” দ্রোণ হাসলেন এ বার, “বার্তা যখন পেয়েছেন, তবে অঙ্কুশ নির্মূল করতে আর বিলম্বকী, মহামাত্য? পরশুরামকে গোপনে এক বার অবহিত করলেই...”
সামান্য চকিত হয়েই ভ্রু উত্তোলন করলেন বিদুর। কয়েক পল তাকিয়ে রইলেন স্থিরদৃষ্টিতে, ওষ্ঠপ্রান্তে একটি রহস্যময় হাস্যলেখা ফুটল। বললেন, “চিন্তাধারার মিল বেশ চিত্তাকর্ষক লাগল, আচার্য! খুবই উপযুক্ত পরামর্শ! কুরুসাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক বা প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে এমন সব আশঙ্কা দূরীভূত করাই কর্তব্য। যা-ই হোক, পৌরব-বংশ আপনার কাছে ঋণী থাকবে!” বিদায় নেওয়ার আগে বিদুর বললেন, “নিষাদবালক একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ-কর্তনের কাহিনিটিও আমার কানে এসেছে, আচার্য! আপনি প্রকৃতই হস্তিনার হিতাকাঙ্ক্ষীর মতো কর্ম করে চলেছেন।”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy