ছবি: বৈশালী সরকার।
ডেথ সার্টিফিকেটটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাড়ির সর্বত্র আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিল রূপম। কাগজটা সাত হাত ঘুরেছে। জামাইবাবু, ছোটমামা, দিদি, মা, এমনকি পাশের বাড়ির ঘোষাল আঙ্কল পর্যন্ত নেড়েচেড়ে দেখেছেন। কে যে কোথায় রাখল! এই জন্য জরুরি কাগজ কাছছাড়া করতে চায় না রূপম। আশপাশেও কোথাও চোখে পড়ছে না। ডাইনিং টেবিল, বসার ঘরের সোফাসেটের আনাচকানাচ, রূপমের বইয়ের তাক... সব জায়গা খুঁজে ফেলা হল। কোত্থাও নেই।
আশ্চর্য! জিনিসটা কি উবে গেল?
ড্রইং আর ডাইনিং পেরিয়ে বাবার শোওয়ার ঘরে ঢুকল রূপম।
ভোররাতের দিকে রূপমের বাবা মারা গেছেন।
পিতৃবিয়োগ গভীর শোকের বিষয়। হিসাব মতো বাবার মৃত্যুতে তাই দুঃখে ভেঙে পড়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। রূপম দুঃখ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙে পড়েনি।
তার একটা কারণ এই যে, রূপমের বাবা দেবশঙ্কর বসাক খুব একটা জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন না। অফিসে নয়, পাড়াতে নয়, সংসারে তো নয়ই।
এক জন সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কিছু বহুলপ্রচলিত ফর্মুলা আছে। মুখ থাকতে হবে হাসি হাসি, ঘাড় ঝুলিয়ে সকলের মতামত শুনতে হবে, সেই বক্তব্য পছন্দসই না হলেও মাথা নেড়ে যেতে হবে উপর-নীচে আর সবচেয়ে বড় কথা, অন্যায় হতে দেখলেও মুখের কুলুপ খোলা চলবে না।
এই মানসিকতার ঠিক বিপরীতে অবস্থান ছিল দেবশঙ্করের।
ঘরে-বাইরে সামান্য বেচালও সহ্য হত না তাঁর। এই হয়তো পাড়ার ক্লাবঘরে হানা দিলেন, “এ সব কী শুরু করেছ তোমরা? পুজোর প্যান্ডেলে তো পুরো রাস্তাটাই ব্লক করে দিয়েছ। আপদে বিপদে একটা অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত গলতে পারবে না।” ... অথবা সটান হাজির পুরসভায়, “দক্ষিণপাড়ায় অমন একটা জল-টলটলে পুকুর দিনের পর দিন আবর্জনা ফেলে ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর আপনারা দেখেও দেখছেন না! এর পর তো রাতারাতি সেখানে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠবে। আপনাদের নেগলিজেন্সে তো পরিবেশটা আর বাসযোগ্য থাকবে না মশাই। কিছু একটা স্টেপ নিন এ বার!”
কোনও স্টেপ নেওয়া হত না। আইন-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাস্তা আটকে দশ দিন ধরে উৎসব পালন চলত, জলাভূমিগুলো ভরাট হয়ে মাথা তুলত একের পর এক আকাশছোঁয়া বহুতল। আর একটু একটু করে নিজের মধ্যেই গুমরে মরতেন দেবশঙ্কর।
মায়ের চোখেও বাবার জন্য বাড়াবাড়ি সম্মান রূপম দেখেনি কখনও। সম্মান থাকার কথাও নয়। দেবশঙ্করের সহকর্মীরা যখন গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরছে, তাদের ঝাঁ-চকচকে নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসতেন সুলতা, আর নিজের দেড় কাঠা জমির একতলা বাড়ির বারান্দায় কাপড় মেলতে মেলতে ভাবতেন, ওদেরও তো বেতন কাঠামো একই। তা হলে এত বৈষম্য কেন?
জিজ্ঞেস করলেও দেবশঙ্কর উত্তর দিতেন না।
হায়ার সেকেন্ডারির রেজ়াল্টে তেমন সুবিধে করে উঠতে পারেনি রূপম। সুলতা কত করে বলেছিলেন, তবু নিজের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কলকাতার প্রথম সারির কলেজে ছেলের জন্য তদবির করেননি দেবশঙ্কর। বরং বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “আহ! পমের জন্য সুপারিশ করলে অন্য একটা ডিজ়ার্ভিং ক্যান্ডিডেটের ওপর কত বড় অন্যায় করা হবে, সেটা ভেবে দেখেছ?”
অগত্যা পছন্দের কলেজ নয়, অনার্স পেতে রূপমের জায়গা হয়েছিল শহরতলির এক মাঝারি মানের কলেজে।
এই ঘটনার পর থেকে রূপমের সঙ্গে দেবশঙ্করের মানসিক দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছিল। পৃথিবী অবশ্য থেমে থাকেনি। রূপম পড়াশোনা শেষ করেছে, ঘাড় গুঁজে লেগে থেকে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা ক্লিয়ার করে চাকরি জুটিয়েছে কয়েক বছর আগে, তবু দূরত্বটা আর কমেনি।
সরকারি চাকরিটা পেয়ে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার প্রথম দিন মা তাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “বড় হ’ বাবা। অনেক উন্নতি কর। আর যাই হ’, তোর বাবার মতো অন্তত হোস না।”
না, রূপম তার বাবার মতো হয়নি। সিভিল ডিভিশনে পোস্টিং-এর আট বছরের মধ্যে সে দু’হাতে উন্নতি করেছে। অ্যাপ ক্যাব ছাড়া এক পা চলে না সে, সাড়ে তিনশো টাকা প্যাকেটের সিগারেট খায়। নিউটাউনে থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট বুক করেছে, পুজোর আগেই পজ়েশন।
বাড়িতেও প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি করেছে রূপম। প্রতি ঘরে এসি বসেছে, পঞ্চান্ন ইঞ্চির এলইডি টিভি, প্রকাণ্ড রেফ্রিজারেটর, মায়ের জন্য মডিউলার কিচেন...
এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। সুলতাও চেয়েছিলেন এই বাড়ির পিছনে পয়সা না নষ্ট করে ছেলে বরং নিজের নতুন ফ্ল্যাট ঢেলে সাজাক। রূপম শোনেনি।
নিজের উন্নতিটা বাবাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছিল কি? দেবশঙ্কর অবশ্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন অনেক আগেই। নিজের ঘরে ছেলের সাফল্যের হাওয়া ঢুকতে দেননি। সেখানে আজও শান বাঁধানো মেঝে, দেওয়ালে চুনকাম।
তবে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে রূপমের উপরি আমদানি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই তো দু’দিন আগে কন্ট্রাক্টর প্রকাশ মেহরার কাছ থেকে একটা বড় পেমেন্ট পেয়েছে রূপম। কন্ট্রাক্টর প্রকাশ মেহরার উৎকোচ-পদ্ধতি চমকপ্রদ। পকেটমারির ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়া। সরকারি ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কুশল জিজ্ঞেস করে তাঁকে হালকা আলিঙ্গন করেন প্রকাশ... সেকেন্ড খানেক মাত্র।
তার পরেই অফিসার আবিষ্কার করেন, তাঁর পকেটে ঢুকে গেছে গোলাপি নোট ভরা পেটমোটা খাম।
এ ভাবেই ‘অফিশিয়াল’ আলিঙ্গন সেরে মোলায়েম হেসেছিলেন প্রকাশ মেহরা, “একটু মিঠাই-উঠাই খেয়ে লিবেন স্যর। আশি হাজার দিলাম ফিলহাল। কাজ হলে আপনাকে খুশ করিয়ে দিব।”
হাতজোড় করে ফলে ভরা গাছের মতো প্রায় নুয়ে পড়েছিলেন প্রকাশ মেহরা, “আমি মামুলি কন্ট্রাক্টর আছি, ছোটামোটা ধান্দা। আপনি, স্যর, যদি হামার ফাইলটা একটু দেখে লিতেন...”
তিন সদস্যের পরিবারের মিষ্টি খাওয়ার খরচ হিসেবে আশি হাজার টাকার পরিমাণটা সামান্য বেশি। তাই প্রায় গোটা টাকাটাই রূপমের ঘরের আলমারির লকারে রাখা আছে এখনও।
যাঁরা মুখের উপর স্পষ্ট কথা বলেন, সহসা আপসের পথে হাঁটেন না, শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলেন, সচরাচর সেই মানুষগুলো খুব একা একা বেঁচে থাকেন। দেবশঙ্কর চলেও গেলেন খুব নির্জন ভাবে। ভোর রাতে একা বিছানায় ঘুমের মধ্যেই একটা মেজর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
শেষ জীবনে আচমকাই ধর্মকর্মে মতি এসেছিল দেবশঙ্করের। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। রাজনীতির যে ধারা তিনি আজীবন অনুসরণ করে এসেছেন, তা যে কোনও রকম ধর্মাচরণের পরিপন্থী। তবুও অবসরের পর মঠে-মন্দিরে-আশ্রমে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু হয়েছিল দেবশঙ্করের। ধর্ম বিষয়ক মোটা মোটা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন দিনরাত। বাড়ির রোজকার পুজোপাঠের দায়িত্ব পর্যন্ত সুলতার কাছ থেকে এক রকম জোর করেই নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
এক-এক দিন রূপম নিজে দেখেছে, বাবা গদগদ হয়ে দিদিকে বলছে, “বুঝলি সোমা, মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্টের আসল কারণ হল প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা। অথচ ভাল ভাবে বেঁচে থাকতে কতটুকুই বা প্রয়োজন হয়, বল? প্রাণের ঠাকুর নিজে বলে গেছেন, ‘আমার পায়ে রোজ একটা করে সাদা ফুল রেখে দিবি, ব্যস! তোর আর কোনও অভাব থাকবে না।’”
হন্তদন্ত হয়ে এ ঘর-ও ঘর করছেন ছোটমামাও। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এমন সময়ে ডেথ সার্টিফিকেট মিসিং? কোনও মানে হয়! জামাইবাবু-অন্ত প্রাণ ছিল ছোটমামা, দেবশঙ্করও অমল বলতে অজ্ঞান।
এক দিন হয়তো বাড়িতে বসে রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক চলল দেবশঙ্কর আর অমলের। সেই তরজা শুনলে মনে হত আগামী দিন থেকে এই দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল বলে।
আবার পরদিনই জামাইবাবুর পছন্দের কড়াপাকের সন্দেশ নিয়ে এ বাড়িতে হাজির হতেন অমল। মনের প্রাণের যেটুকু কথা তাও একান্তে দেবশঙ্কর গুজগুজ করতেন শ্যালকের কাছেই।
বাবার ঘরের রাইটিং টেবিলে কাগজপত্রের স্তূপ। এরই মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেটটা থেকে যায়নি তো? সব বইপত্র, ডায়েরি, খাতার পাতা উল্টেপাল্টে দেখছিল রূপম।
আর তখনই কাগজটা দেখতে পেল সে।
বাবার ডায়েরির ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে পুরনো ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। কেন ছেঁড়া হয়েছে বোঝা গেল না। হয়তো রূপমের চোখেও পড়ত না, কিন্তু লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা, সহজে চোখ এড়িয়ে যাওয়ার নয়।
গোটা গোটা হরফে দেবশঙ্কর লিখেছেন, “ঈশ্বর এই স্খলন মার্জনা করুন। আমি অপরাধী।”
বারান্দায় শোওয়ানো দেবশঙ্করের বুকের উপর পকেট সাইজ় গীতা রাখা হয়েছে, দেহের উপর ফুল-মালার পরিমাণ বাড়ছে ক্রমশ। শোকের বাড়ি, বিমর্ষ সুলতাকে ঘিরে মাসিরা আর পাড়ার কয়েক জন মহিলা বসে আছেন, ইতস্তত চাপা কান্নার শব্দ, বাড়ির বাইরে শববাহী গাড়ি এসে ব্রেক চাপল।
রূপম তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে, কপালে ভাঁজ, দু’চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কাগজটা থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে।
পাশের ঘর থেকে ছোটমামার গলা পাওয়া গেল, “এই তো! এই তো, সার্টিফিকেট। ফ্রিজের পিছনে উড়ে এসে পড়েছে। বোঝো কাণ্ড!”
পাঁচমাথার মোড়ের লম্বা সিগন্যালে আটকে আছে শববাহী যান। রূপম পকেট থেকে বাবার ডায়েরির পাতাটা বের করে ছোটমামার সামনে তুলে ধরল, “কী কেস গো? জানো কিছু?”
ছোটমামা চোখ সরু করে কাগজটা দেখলেন কিছু ক্ষণ, ডায়েরির তারিখটা দেখলেন আরও সময় নিয়ে, তার পর বললেন, “ড্রাইভার সাহেব, এসি বন্ধ করে জানলার কাচটা নামিয়ে দিন।”
অন্তহীন পল একটু একটু করে কমছে সিগন্যালের লাল আলোয়, ছোটমামা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে আছেন জানলার বাইরে, এক সময় তিনি বললেন, “তোকে কথাটা বলা বারণ ছিল পম। জামাইবাবু এক রকম প্রমিস করিয়েই নিয়েছিলেন বলতে পারিস। কিন্তু আজ বোধহয় আর গোপন রাখা যাবে না। জামাইবাবু থাকলে নিজের ট্রেডমার্ক স্টাইলে বলতেন, ‘সবই অদৃষ্ট’। সত্যিই তা-ই, না হলে আজই এই লেখা তোর হাতে পড়বে কেন?”
“কী বলছ এ সব? কী হয়েছিল?”
ছোটমামা কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলেন, তার পর ধরা গলায় বললেন, “তোর চাকরিটা এমনি এমনি হয়নি পম। পার্টি ফান্ডে মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হয়েছিল। অন প্রিন্সিপল জামাইবাবু প্রথমে বেঁকে বসেছিলেন, তার পর এক দিন আমার বাড়ি এলেন। আমি তখন সরশুনার ও-দিকে ভাড়া থাকি। জামাইবাবুকে সে দিন খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল, বলেছিলেন, ‘দিনের পর দিন বাড়িতে বসে থেকে পমের মনটা ভেঙে যাচ্ছে বুঝলে, সারা দিন পর বাড়ি ফিরে ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’... কিন্তু ঘটনা হল অতটাকা তো আমাদের দু’জনের কাছে ছিল না। তাই...”
বিটি রোডে উঠতেই শহুরে যানজট অনেকটা কমে এসেছে। হু-হু করে হাওয়া বইছে। ঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে গাড়ির অন্দরে। সেই শব্দ ছাপিয়ে আর্তনাদের মতো বলে উঠল রূপম, “তাই... তাই কী? বলো!”
ছোটমামা কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রূপমের দিকে, তার পর বললেন, “এক জন সাবস্ক্রাইবারের কাছে টেন্ডার ডিটেলস ফাঁস করে দিয়েছিল জামাইবাবু। মোটা টাকার বিনিময়ে। আজকাল হয়তো এটা তেমন কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু জামাইবাবু নিজের জন্য যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছিলেন সেই জায়গা থেকে... হ্যাঁ, ভাল বাংলায় বোধহয় একেই স্খলন বলে।”
রূপম কিছু ক্ষণ কোনও কথা বলতে পারল না, তার পর বিড়বিড় করল, “বাবা! বাবা এ রকম একটা কাজ করল!”
ছোটমামা বললেন, “ভালবাসা জিনিসটা কী জানিস রূপম? যে কাজ মানুষকে দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় শত চেষ্টাতেও করানো যাবে না, সেইকাজ যদি মানুষ কারও জন্য অবলীলায় করে ফেলে, তবে সেটাকেই ভালবাসা বলে।”
ছোটমামা টুসকি দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেললেন জানলার বাইরে।
চৈত্র দুপুরেও রূপমের শীত করছিল। রক্তের সম্পর্ক, দীর্ঘ দিনের একত্র বসবাস... তবুও এ ভাবে অপরিচিত থেকে গেল মানুষটা? নাকি সবাইকে শুধু পরিচিতের মতো দেখায়, আসলে প্রতিটি মানুষ পরস্পর অপরিচিত! এক জন্ম কেটে যায়, নিজেকেই কি পুরোপুরি চিনে উঠতে পারে মানুষ?
বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছিল না রূপমের।
শ্মশানে বাবার শরীর ছুঁয়ে বসে আছে রূপম। পাহাড়ি ঝর্নার মতো স্মৃতিরা নেমে আসছে। কড়া গলায় বাবা বলে উঠল, “পড়াশোনাটা মন দিয়ে করোনি বলেই আজ অনার্সের জন্য এ ভাবে ছুটে মরতে হচ্ছে, বাবাকে দোষারোপ করারআগে সেইটা এক বার ভেবে দেখলে হত না?”
নতুন রং করা ঝাঁ-চকচকে ঘরে চোখ বোলাতে বোলাতে তিতকুটে স্বরে বাবা বলছে, “বসার ঘরে এসি! এই বিলাসিতাগুলো মানুষকে আরও অসুস্থ করে তোলে। শরীর হয় রোগের ডিপো।”
পুরীর সমুদ্রে বিশাল ঢেউ আর বালির চোরাটান গভীরে টেনে নিচ্ছে ছোট্ট রূপমকে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেবশঙ্কর, কোনও মতে টেনে-হিঁচড়ে ছেলেকে নিয়ে এলেন তীরে। রূপম হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে, চোখেমুখে আতঙ্ক। অথচ বাবা শান্ত ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার গায়ে মাথায়, রূপমের এক দিকে সাগর, আর এক দিকে বাবা, বাবার দু’চোখ ভরা আর একটা সাগর, সেই সাগরে অথৈ মায়া।
সাইকেল চালানো শিখতে শিখতে রূপম চেঁচাচ্ছে, “বাবা, ছেড়ে দিয়ো না, পড়ে যাব কিন্তু৷”
মাঠের সবুজ ঘাসে টালুমালু চলছে নতুন শেখা সাইকেল। পিছনে, অনেক দূর থেকে হো-হো হাসছে বাবা, “ছেড়ে তো সেই কখন দিয়েছি পম, তুই বুঝতেও পারিসনি। একদম পিছনে তাকাবি না, এগিয়ে যা, এগিয়ে যা...”
ইলেকট্রিক চুল্লি বাবাকে গিলে নেওয়ার ঠিক আগে শেষ প্রণাম করল রূপম। সাদা ফুলের মতো একটা ছেঁড়া পাতা সে গুঁজে দিল বাবার পায়ের আঙুলের ফাঁকে। দেবশঙ্করের নশ্বর শরীর পবিত্র হতে চলল।
নতজানু হয়ে বসে আছে রূপম। কঠিন সব প্রতিজ্ঞা করছে। আর কোনও দিন অসৎ উপায়ে পয়সা কামাবে না সে, শিরদাঁড়া সোজা করবে, প্রকাশ মেহরার টাকা পরদিনই তার মুখে ছুড়ে মারবে রূপম। সে ভুলে গিয়েছিল সে এক জন সৎ লোকের ছেলে। সেটাই তার একমাত্র পরিচয় হয়ে থাক।
চুল্লির আলোয় রূপমের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আচমকাই ছোট্ট শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
হয়তো এই প্রতিজ্ঞাগুলো একটু পরেই ভুলে যাবে রূপম। অচিরেই তাকে গিলে নেবে নিষ্ঠুর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী পৃথিবী। ডোমের সঙ্গে মামুলি কারণে বচসা করবে সে, শববাহী গাড়ির পেমেন্ট নিয়ে ঝামেলা বাধাবে। আর হয়তো বা কন্ট্রাক্টর প্রকাশ মেহরার ক্রীড়নক হয়েই থেকে যাবে বাকি জীবন।
তবু এই মুহূর্তটুকু বেঁচে যাক। বাবাকে শেষ বিদায় জানাতে এসে হাপুস নয়নে কাঁদছে তার ছেলে। চোখের জলে কত গ্লানি, কালিমা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে চিরচেনা মানুষটাও, মুছে যাচ্ছে পরিচয়।
রাস্তাজোড়া বিরাট প্যান্ডেল, অপরিকল্পিত বহুতল আর হাজারো বেআইনি টেন্ডারের মধ্যে দু’চোখ ভরে দেখার মতো মায়া-ঘেরা এই মুহূর্তটাই শুধু বেঁচে থাক।
বিদায়ের মুহূর্তও এত সুন্দর হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy