Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ২১)
bengali literature

মায়া প্রপঞ্চময়

পূর্বানুবৃত্তি: বোসস্যর বিপদ কাটিয়ে ফিরে আসার পর কর্মকর্তা ধীরেনবাবুও বুঝলেন, এঁকে ঘাঁটিয়ে বিশেষ লাভ নেই। এক রকম আপস-রফাই করে নিলেন তিনি। পরদিনই ময়ূরঝরনায় হাতির পাল ঢোকার সাইট দেখতে গিয়ে আচমকা এক ধাক্কায় অপ্রস্তুত বেন্দাকে শুকনো নদীখাতে ফেলে দিলেন বোসস্যর। অন্য দিকে অন্নুর কাছে খবর আসে, তাদের এনজিও-র চার বছরের অটিস্টিক শিশু বেণু একটি পাঁচ টাকার কয়েন গিলে ফেলেছে। গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে হসপিটালে পৌঁছয় সে।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বোসস্যর বিপদ কাটিয়ে ফিরে আসার পর কর্মকর্তা ধীরেনবাবুও বুঝলেন, এঁকে ঘাঁটিয়ে বিশেষ লাভ নেই। এক রকম আপস-রফাই করে নিলেন তিনি। পরদিনই ময়ূরঝরনায় হাতির পাল ঢোকার সাইট দেখতে গিয়ে আচমকা এক ধাক্কায় অপ্রস্তুত বেন্দাকে শুকনো নদীখাতে ফেলে দিলেন বোসস্যর। অন্য দিকে অন্নুর কাছে খবর আসে, তাদের এনজিও-র চার বছরের অটিস্টিক শিশু বেণু একটি পাঁচ টাকার কয়েন গিলে ফেলেছে। গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে হসপিটালে পৌঁছয় সে।

বেণুকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে যখন অন্নু ছাড়া পেল, তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। মোবাইলে গোটাপাঁচেক মিস্ড কল, তার ভিতর দুটো প্রীতের। তাড়া থাকায় ড্রাইভারকে বলল শর্টকাট করতে, মেন রোড ধরে ড্রাইভার একটা বস্তির মধ্যে গাড়ি ঢোকাল। সরু রাস্তা, থিকথিকে নোংরা, রাস্তার পাশে ড্রেন যেন উপচে পড়ছে। গাড়ি খুব আস্তে যাচ্ছে, এসি গাড়ির কাচ তোলা থাকলেও অস্বস্তিতে শরীর কেমন করছে ওর। এক জায়গায় ওর চোখ আটকে গেল, যেন বহু যুগ আগের এক দৃশ্যের ফ্ল্যাশব্যাক।

একটা নোংরা কাদা-মাখা বাচ্চা, বেণুগোপালের বয়সিই হবে, পরনে কিচ্ছুটি নেই, মায়ের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে। কিছুতেই চান না করার মতলব তার। মা তাড়া করে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে গুমগুম করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা এ বার মাকেই জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তিরিশ বছর আগে পটনায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে হুবহু এমন একটা দৃশ্যই চোখে পড়েছিল ওর।

তখন ওর আর মানিকের সম্পর্কের অন্তিম পর্যায় চলছে। মানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়ার, আর অনামিকা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মানিক পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়ে চাষবাস করবে, বা স্কুলের চাকরি, কিংবা প্রাইভেট টিউশন করবে হয়তো। অনামিকা রিসার্চের কাজ কমপ্লিট করবে। তার বাইরে কিছু ভাবা তখন ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ও দিকে প্রীতের তরফ থেকে আল্টিমেটাম আসছে, বিয়ে করতে হলে এখনই ঠিক করে নাও, বাড়ির লোক এই বিয়েতে এমনিতেই নিমরাজি, বেশি দেরি করলে পস্তাতে হবে।

অনামিকা তখন গভীর দ্বিধায়। এত বছরের পুরনো সম্পর্ক এখন ভাঙে-ভাঙে অবস্থায়, সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্য সম্পর্কটাকে দাঁড়ি টেনে দেবে, না কি মানিককে ধরে রাখার চরম সিদ্ধান্ত নেবে— ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছিল না ও। সে দিনও মানিক দেখা হতে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়েছিল। কথাগুলো হজম করার মতো মনের অবস্থাও ওর সে দিন ছিল না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে ফেলেছিল, ‘‘আমার হাল আজকে রাস্তায় দেখা ছেলেটার মতো, যে-মায়ের হাতে মার খাচ্ছে, তাকেই আবার জড়িয়ে ধরছে! তোমার এত অপমান সহ্য করি যে কহতব্য নয়, তবু বারবার তোমার কাছেই কেন আসি মরতে, সেটাই বুঝে উঠতে পারি না! তুমি কাছে থাকলেই মনে হয় সব মানসিক চাপ, সব দুশ্চিন্তা যেন হালকা হয়ে গেল। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্যে কেন তুমি এখানে থাকবে?’’

মানিক কিছু ক্ষণ নির্বাক ওর দিকে তাকিয়েছিল, তার পর সুর নরম করে বলেছিল, ‘‘হয় তুমি তোমার মন বুঝে উঠতে পারোনি, নয়তো আমি তোমাকে বুঝতে ভুল করেছি। আমার জীবনে তোমার আগে কেউ ছিল না, আর তোমার জীবনের কথা ঈশ্বর জানেন! তোমার মধ্যে দ্রৌপদী-সিনড্রোম কাজ করছে না তো?’’

অনামিকা হতবাক হয়ে গিয়েছিল ওর সঙ্গে মানিক দ্রৌপদীর তুলনা করায়, তার পর মনে হয়েছিল কার উপর রাগ করবে ও? যা ক্ষতি করার তা তো ও করেই দিয়েছে মানিকের। নিজে তো এত দিনের কাঙ্ক্ষিত জীবনে চলে যাবে বিয়ের দিনটা ঠিক হয়ে গেলেই। ছেলেটা চরম দারিদ্র থেকে লড়াই করে উঠে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরই একটু ভুলের জন্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ফের একটা অনিশ্চয়তার জীবনে ফিরে যাচ্ছে। তার অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। যা মনে আসছে বলে নিক এই সময়ে! তবু বলতে হয় বলেই মন্তব্য করেছিল, ‘‘বাঃ! এটাই বলতে শুধু বাকি ছিল তোমার! তা তোমার দ্রৌপদী কী এমন করেছিল, যাতে সেই খোঁটাটা আমাকে পর্যন্ত খেতে হল?’’

মানিক বলেছিল, ‘‘তেমন কিছু নয়, আসলে কাশীরাম দাসের অনূদিত মহাভারতে আছে, বনপর্বে কাম্যক বনে অনেক মুনি-ঋষির কাছে প্রশংসা পেয়ে দ্রৌপদীর সতীত্বের অহঙ্কার হয়েছিল। সেই দর্প চূর্ণ করার জন্যে শ্রীকৃষ্ণ একটা পরীক্ষা নিয়েছিলেন। কঠোর তপস্যার পর দিনশেষে সন্দীপন মুনির একমাত্র খাদ্য ছিল একটি অসময়ের আম। কিন্তু দ্রৌপদীর ইচ্ছেয় পার্থ গাছ থেকে সেটা পেড়ে ফেলেন। তখন ক্ষুধার্ত মুনির অভিশাপের ভয় দেখিয়ে শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডব আর দ্রৌপদীকে বাধ্য করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁরা যে যা ভাবছিলেন, মনের গভীরে থাকা সেই গোপন কথাগুলো অন্যদের সামনে খোলসা করে বলতে। তিনি বলেন, প্রত্যেকের স্বীকারোক্তি অন্যদের সামনে মেলে ধরলেই মুনি আম নিতে আসার আগে গাছের আম গাছে গিয়ে লাগবে।’’

মানিক থামতে অনামিকা খোঁচা দেয়, ‘‘বুঝলাম, কিন্তু মেয়েরা এত বোকা নয় যে, মনের কথা কেউ চাইলেই গলগল করে উগরে দেবে। ক’জন মেয়েকে দেখেছ তুমি জীবনে, মিস্টার শুকদেব? শুধুই তো আমাকে, তাও সম্পূর্ণ মানুষটাকে নয়। জেনে রেখো, একটা মানুষকে সম্পূর্ণ করে অন্য আর এক জন পায় না। তার ধরাছোঁয়ার বাইরেও অনেকটা রয়ে যায়, যার নাগাল হয়তো পায় তৃতীয় আর এক জন। আমরা পরস্পরকে খানিকটা পেয়েছি বলে আমি যেমন সহজলভ্য নই অন্যের কাছে, তেমনই অন্য যে কোনও মেয়েও আবার তোমার কাছে সহজলভ্য নয়। যা-ই হোক, ওদের স্বীকারোক্তির কী হল শেষ পর্যন্ত, সেটাই শুনি!’’

‘‘হ্যাঁ, পাণ্ডবরা এক-এক করে তাদের মনের কথা বলতে লাগল, যেমন, কারও রাজত্ব ফিরে পেলে দানধ্যানের বাসনা, কারও দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপানের বাসনা, কারও সমস্ত মহারথীদের পরাস্ত করার বাসনা ইত্যাদি প্রকাশ করার সঙ্গে-সঙ্গে আমটা একটু-একটু করে শূন্যে উঠে গাছের ডালে প্রায় লাগে-লাগে অবস্থায় পৌঁছল। এ বার দ্রৌপদীর পালা, কিন্তু যেই না তিনি যুধিষ্ঠিরের নকল করে শুরু করেছেন যে, পাণ্ডবেরা রাজত্ব পেলে আবার কুরুরাজ্যের মহারানি হয়ে দানধ্যান ইত্যাদি ইত্যাদি...অমনি আমটা আবার নীচে এসে মাটি ছুঁই-ছুঁই! তৃতীয় পাণ্ডব তখন মারমুখী হয়ে দ্রৌপদীকে তেড়ে যান। শ্রীকৃষ্ণও খুব সরল গলায় অনুরোধ করেন মনের কথা বলে ফেলার জন্য। শেষটায় বাধ্য হয়ে দ্রৌপদীকে স্বীকার করতে হয়, স্বয়ম্বর সভায় কর্ণকে দেখে অবধি তাঁর মন উচাটন। পঞ্চপাণ্ডবের সবার গুণের সমন্বয় একা কর্ণের মধ্যেই রয়েছে। আমটা পাড়ার সময়েও ওই কথাটাই মনে এসেছিল যে, কর্ণও যদি সারথিপুত্র না হয়ে এদের আর-একটা ভাই হত, তা হলে ষষ্ঠ পতি হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে আপত্তি হত না!

‘‘যুধিষ্ঠির আর শ্রীকৃষ্ণ হস্তক্ষেপ না করলে ভীমসেনের হাতে স্ত্রীহত্যার মতোই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল প্রায়। সুতরাং বুঝতেই পারছ স্ত্রীজাতির আকাঙ্ক্ষা কত দূর যেতে পারে! আমাকে নিয়ে তোমার মনে কী বাসনা ছিল জানি না, তবে তার পরিণতি আমাদের উভয়ের পক্ষেই মারাত্মক হতে চলেছে। আমার তো বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই গেল। তোমার কোনও ক্ষতি বর্তমানে বোঝা না গেলেও পরে এর জেরে কিছু হবে কি না, কে জানে!’’

আর চুপ করে থাকতে পারেনি অনামিকা। দাঁতে দাঁত চেপে বলেই ফেলেছিল, ‘‘কী ক্ষতি হল আমার সেটা বুঝতে পারোনি? নিজে তো কথায় কথায় নানা উদাহরণ দাও, এটা জানো না যে, হাত-পায়ের হাড় এক বার ভেঙে গেলে তা যত ভাল করেই জোড়া লাগুক, আগের জোর আর ফিরে আসে না ? আমার ক্ষতির মাপ তুমি করে উঠতে পারবে না। তবে তার জন্যে আমার কোনও রাগ বা ক্ষোভ নেই। কারণ আমি জানি, মায়ের অভিশাপ তোমার চেহারা নিয়ে আমার জীবনে এসেছে।

‘‘খুলে বললে বুঝতে সুবিধে হবে তোমার। আমার প্রেম নিয়ে মায়ের খুব আপত্তি ছিল। প্রীত মায়ের পছন্দের পাত্র ছিল না। আমি অতিরিক্ত জেদ ধরার জন্য মায়ের আপত্তি ধোপে টেকেনি। তবে মা বলেছিল যে, এক দিন আমার পছন্দ আর একগুঁয়েমির জন্যে আমাকে আফসোস করতে হবে। সেই শাপ ফলতে শুরু হয়েছিল তোমার সঙ্গে আমার টক্কর লাগার দিন থেকেই, এখন তা পুরোপুরি সত্যি হয়েছে। যা আমি আগে চেয়েছিলাম, তা ততটা জোর দিয়ে এই মুহূর্তে আর চাই না। আবার এখন যা একান্ত ভাবে চাই, তা আমার আয়ত্তের বাইরেই থেকে যাবে চিরদিন। তাই বারবার ভাবি, মানুষের পাওয়ার পরিধি এত সীমিত কেন? কেন মানুষ তার মাপের চেয়ে একটু বেশি আশা করতে পারবে না?’’

মানিকের গলা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসে, ‘‘তোমার মায়ের অভিশাপের ফল ভুগতে গিয়ে তোমার জীবনে ছন্দপতন হয়েছে, মানলাম। কিন্তু আমি তো আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও যাইনি কোনও দিন, তা হলে আমার কেন পৃথক যাত্রায় একই ফলভোগ হল? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? আমার মানসিক গঠন আমাকে কিছু ভুলতেও দেবে না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তোমার স্বভাব অনুযায়ী তোমার এই শূন্যতা শিগগিরই ভরাট হয়ে যাবে অন্য অনেক কিছুর প্রভাবে।’’
অনামিকা ঠিক করেছিল যে শেষ দিকে আর মানিকের সঙ্গে ঝগড়া করবে না, কিন্তু মানিক ওকে যে ভাবেই হোক তাতাবে বলে যেন পণ করেছিল। এত ক্ষণে অসহ্য লাগায় অনামিকা তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেছিল, ‘‘মনে রাখার সব দায় তোমার একার, না? আমিও সারা জীবন একটা বিদঘুটে, আনাড়ি শয়তানকে মনে পুষে রেখে জ্বলে-পুড়ে মরব কি না, সে ব্যাপারে এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?’’

একই রকম নিচু গলায় দৃঢ়তার সঙ্গে মানিক বলেছিল, ‘‘দারিদ্রের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে লড়াই করতে-করতে মানুষের চরিত্র ভালই বুঝতে শিখেছি। সব মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। কিছু মন আছে গ্র্যানাইট পাথরের মতো, দাগ পড়ে না তো পড়ে না, আবার পড়লে মোছেও না। কিছু মন আছে সোপ স্টোনের মতো, হালকা নখের আঁচড়ও সে যত্ন করে নিয়ে নেয়, তবে খুবই হালকা করে, যাতে পরবর্তী দাগ বা চাপ এলেই আগেরটা মুছে যেতে একটুও সময় না লাগে! আমাদের কার মনের গঠন কেমন তা সময়ই বলে দেবে। চিরদিনের মতো দূরে চলে যাওয়ার আগে শুধু একটা কথা বলে যাই— তোমার জীবনে প্রথম পুরুষ আমি হতে পারিনি, একমাত্র তো নয়ই। সে আমাদের নিয়তি। তবে যদি শেষ পুরুষও না হতে পারি, সেটা হবে আমার দুর্দৈব। তোমাকে নিঃশর্তে ছেড়ে যাচ্ছি শুধু একটা আশা নিয়ে— তোমার এই খেলা তুমি এখানেই শেষ করবে! পুরুষকে সম্মোহিত করে তোমার এই যে এক্সপেরিমেন্ট নিজের ক্ষমতা পরখ করার, তার শিকার যেন আর কেউ না হয়!’’

সজোরে একটা ঝাঁকুনি আর তীব্র হর্নের আওয়াজে ভাবনার সূত্র ছিঁড়ে যায় অন্নুর। তাকিয়ে দেখে, বস্তির সঙ্কীর্ণ রাস্তায় তার গাড়িটা এক জন বয়স্ক মহিলাকে চাপা দিতে দিতে একটুর জন্যে বেঁচেছে। মেজাজ হারায় ও, ‘‘এক দিন মে এক হি মুসিবত কাফি নেহি হ্যায় কেয়া? আঁখ বন্‌ধ করকে ড্রাইভ করতে হো, কিসিকো মারকে জেল যাওগে তুম কিসি দিন! ওয়ক্ত বঁচানে কে ওয়াস্তে শর্টকাট লেনে কে লিয়ে বোলি থি। মেরি হি গলতি। তুম কিসি তরিকে সে মেনরোড পাকড়ো ফির সে।’’ ড্রাইভার বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা করে যে এই কথাটাই সে ম্যাডামকে গত পাঁচ মিনিট ধরে বলে যাচ্ছিল, কিন্তু ম্যাডাম শুনতে পাননি। অন্নু তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে ফের চিন্তায় ডুবে যায়।

মানিকের বলা কথাগুলোকে ভবিষ্যদ্বাণী বলে ধরে নেয়নি ও। কিন্তু তিরিশ বছর পর আজ যদি হিসেব করতে বসে যে, সেই কথাগুলো ফলেছে না ফলেনি, তা হলে কী উত্তর পাবে অন্নু? বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই বারংবার অনুরোধ করে, চিঠিতে ম্যাপ এঁকে ওর ঠিকানার হদিশ মানিককে দিয়েছিল অন্নু— প্রথমে এটাই তো ওর বিরুদ্ধে যাবে। কী চেয়েছিল ও সেই সময় মানিকের কাছে? শুধু এক বার চোখের দেখা, ব্যস! তার পরও তো ছাব্বিশ-সাতাশ বছর কেটে গিয়েছে, কই, মন তো সে রকম উচাটন হয়নি দ্বিতীয়বার ওকে দেখার জন্য?

আজ যখন মানিক ওর দুঃস্বপ্নে হানা দিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে, ‘‘কেমন, বলেছিলাম কি না, যে মানুষ আল্টিমেটলি নিজের জন্যই বাঁচে? যেমন বাচ্চা-সহ মা-বানরীকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্টে দেখা গিয়েছিল যে, যখন বাঁচা-মরার প্রশ্ন আসে, তখন বাচ্চাকে ফেলেই মা শেষ মুহূর্তে নিজের প্রাণ বাঁচানোর উপায় খোঁজে। তারাশঙ্করের ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে, জলের পোকা তারিণী প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী সুখীকে গলা টিপে মেরেছিল নিজে শ্বাস নিয়ে বাঁচার জন্যে। তুমিও কি আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে তোমার বৈবাহিক জীবনের নিরাপত্তা খোঁজোনি? তখন কি তুমি একবারও ভেবেছিলে, আমি কতটা কষ্ট পেতে পারি?’’ তখন কোনও উত্তর কেন মেলে না?

এখন ও দুই ছেলে-মেয়ের গর্বিতা মা। দু’জনেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত ও সাময়িক ভাবে প্রবাসী। ভাল বুঝলে হয়তো বিদেশেই সেট্‌ল করবে। প্রীতের সংসারে ও এতটাই সুখী এবং প্রাচুর্যময়ী যে পরিচিত মহিলারা ওকে আড়ালে হীরকসম্রাজ্ঞী বলে ডাকে। কিন্তু ও নিজে কতবার ভেবে দেখেছে এই তিরিশ বছরে, সবার চোখে হদ্দ বোকা, অন্তর্মুখী ও উচ্চাশাহীন একটা ছেলে অন্ধকারের কোন অতলে তলিয়ে গেল শুধুমাত্র একটা অদ্ভুত সম্পর্কের জেরে? কার জন্যে বাবা-মাকে সুখী করার ছোট্ট একটা চাহিদাও তার পূরণ হল না? সেও তো বিদেশে গিয়ে তার বাবা-মায়ের মুখ উজ্জল করতে পারত, যেমন ওর ছেলে-মেয়ে করছে!

প্রীত আর ও একে-একে আর্থিক উন্নতি এবং পারিবারিক উচ্চাশা পূরণের ধাপ পেরিয়েছে আর ও নতুন করে পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করেছে। কখনও তো ওর মনে সেই কখনও না ভোলার প্রতিজ্ঞা ভুলেও ঘাই মারেনি! যত দিন না অপালা মানিকের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়েছে, তত দিন তো ওর কথা আবছা ভাবেও মনে আসেনি! যখন এল, তখনও তো এল অপরাধবোধ থেকে, ভালবাসা থেকে নয়। তার জন্যে তো ওর বিবাহবার্ষিকীর রজতজয়ন্তী আটকাল না, মনে-মনে অতি গোপনে একটু আপসেট হয়ে থাকা ছাড়া কিছুই তো বদলাল না। এটা ঠিক যে, অপালা খবরটা দেওয়া অবধি গত পাঁচ বছরে নিয়ম করে মানিকের স্মৃতি ওর সামনে ঘুরে-ফিরে এসেছে, বিশেষ করে ও যখনই অল্পবিস্তর ড্রিঙ্ক করেছে। কিন্তু বেনারস থেকে ওর চলে যাওয়ার পরের প্রায় দু’যুগ ব্যাপী দীর্ঘ সময়?

মনে-মনে স্বীকার করে ও এত দিন বাদে, হ্যাঁ, মানিকই ঠিক ছিল, শুধু মানবচরিত্র বিশ্লেষণে নয়, ভবিষ্যদ্বাণীতেও। এতগুলো বছরের অতীতে, অন্নু সব জায়গাতেই খুবই সহজে পূর্বানুমেয় কাজগুলোই করে গিয়েছে। শুনতে খুব খারাপ হলেও এর একটাই মানে হয়, ও আত্মকেন্দ্রিক আর সুবিধেবাদী। প্রথম নমুনা, মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রেম; দ্বিতীয়, প্রেমিককে তার লক্ষ্মণরেখা বোঝাতে গিয়ে নিজের আখের বাজি রাখা; তৃতীয়, মানসিক অসহায়তা কাটাতে একটা সেফ সাপোর্ট বেছে নেওয়া; চতুর্থ, সেই সাপোর্টও যে একটা রক্তমাংসের মানুষ, সেটা ভুলে গিয়ে আবার পুরনো সেফার সাপোর্টে ফিরে আসা; পঞ্চম, মরে-যাওয়া মানুষকে জীবিত করে তাকে ফের মেরামতির কাজে লাগানো এবং সর্বশেষ, ‘ব্যবহার করে ফেলে দাও’ নীতি মেনে তাকে আবার বিস্মৃতির অতলে পাঠানো।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Literature Bengali Novel Kanailal Ghosh Maya Prapanchamay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy