ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ
সব ক’টি ক্ষেত্রেই যে কাজ ওকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কাজ-চলা গোছের পর্যায়ে এনে দেওয়ার পর ওকে জানানো হয়েছে, ‘‘ব্যস, ব্যস... ঠিক আছে। এ বার যেতে পারো। এর পর স্পেশালিস্টরা বাকিটা ঠিকঠাক করে নেবে। আসলে তো তুমি হাতুড়ে! তা সত্ত্বেও যে এতটা পর্যন্ত তোমাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটাই তোমার ভাগ্য, বুঝলে!’’— ঠিক যেমনটা অনামিকা হাবেভাবে বুঝিয়েছিল ওকে।
কালীপুর জ়ু-তে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর প্রথম প্রথম নিজেকে একটা বড় গাপ্পি মাছ বলে মনে হত অনিকেতের। জমা জলে মশা কিলবিল করছে, ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়া, কখন যে কী হয়ে যায় ঠিক নেই! যাও, তুমি বাবা গপগপ করে মশার লার্ভাগুলো খেয়ে শেষ করো! তার পর ডোবাটা সুইমিং পুল হয়ে গেলেই তোমার ছুটি। সে দিক দিয়ে বিচার করলে গাপ্পির রোলটা ভাল করেই উতরে দিয়েছে অনিকেত। ফলে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এ বার জানান দিচ্ছে, ‘‘ওঠো হে মুসাফির, বাঁধো তোমার গাঁঠরি, এখানকার কাজ যা ছিল, সেটা শেষ হয়েছে... এ বার হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে তোমার কাজ।’’
ভাবনাটা ভুল নয়, কেন না শীতঘুমে থাকা মানুষজন নড়েচড়ে বসছেন, তাঁদের স্বর্গারোহণের সোপানে ওকে বাধার মতো মনে হচ্ছে যেন আজকাল। তা ছাড়াও জ়ু-র আনাচে কানাচে ফিসফিস— এই খড়ুশ ডিরেক্টর আর ক’দিন থাকবে এখানে? পাখি, সাপের মতো ছোটখাটো জীবজন্তু ছাড়াও জ়েব্রা, মার্মোসেট বানর, এ সবও ফাঁক পেলেই বাইরে বেরিয়ে পড়ছে যে! কাল যদি হাতি বা বাঘ ছাড়া পেয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, তবে তো ইডি শূলে চড়বেই চড়বে!
অনিকেত বুদ্ধিমান— এমন অপবাদ ওর বন্ধুরাও দেবে না, শত্রুরা তো দূরস্থান, কিন্তু অপবাদ নেওয়ার জন্য খোলা ময়দান ও শত্রুদেরও ছেড়ে দেবে না। বার বার অ্যাস্ট্রাল সফরে ওর শরীর-মনের সংযোগ ঠিক ভাবে হবেই, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। যদি ও বেঁচে ফেরে, তা হলে বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত ওকে নিতেই হবে। কেন জানে না, কিন্তু ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইদানীং মেসেজ দিচ্ছে, অনামিকা ওর কথা ভাবছে বেশ কিছু দিন ধরে, তবে নিজের মতো করে। পুরনো সম্পর্কটাকে ঘষেমেজে, তরল করে, নিজের মনের মতো একটা চেহারা দিতে চাইছে। কিন্তু যে মানুষটা এতগুলো বছর ধরে র’ রেক্টিফায়েড স্পিরিটে গলা-বুক জ্বালিয়ে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছে, তাকে সফ্ট ড্রিঙ্কসের অফার দিলে কিছু ফল হওয়ার কথা কি?
অনিকেত স্থির করে নেয়, যদি এ বারেও যমরাজ ওকে ফের উগরে দেয়, তা হলে ও নিজের বেশ কিছু পুরনো সিদ্ধান্তে বদল ঘটাবে। তবে স্পিরিটের বদলে সফ্ট ড্রিঙ্কসে ফিরবে না কোনও মতেই। ও নিজের বাতিল হয়ে যাওয়া নোটের বান্ডিল, তামাদি হয়ে যাওয়া তমসুক বুকে জড়িয়ে আকণ্ঠ র’ স্পিরিটে ডুবে থাকবে, কিন্তু অন্যের অফার করা বিদেশি ড্রিঙ্কস নৈব নৈব চ। আর মৃত্যুর দেবতা ওর শরীর যদি ফিরিয়ে না দেয়? তাতেও কোনও আফসোস থাকবে না। ওর প্রিয় গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার থেকে সার সত্য তো ও জেনেই গিয়েছে— ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।/ অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥
আনমনা হয়ে ও ঘুরে বেড়ায় এক এনক্লোজ়ার থেকে আর-এক এনক্লোজ়ারের সামনে। বিপুল আপন মনে ঘাস, ফলের খোসা আর খোল-ভুসির জাবনা চিবোচ্ছে। এখন আর অনিকেত ওকে ডাকল না, এক ঘণ্টা আগেই তো এখান থেকে ঘুরে গিয়েছে। তখন ছিল দেহধারী, আর এখন দেহটা দু’কিলোমিটার দূরের নার্সিং হোমে নামানো হচ্ছে হয়তো। কালুর খাঁচার সামনে যেতে সে নাক ফুলিয়ে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুঁকতে লাগল। শিম্পাঞ্জিদের বোধশক্তি অনেক বেশি প্রখর, কালু কি ওর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে? তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে ঝিলের ধারে তেঁতুলগাছটার তলায় এসে বসল অনিকেত। হঠাৎই মাথায় একটা চিন্তা এল।
বহু বছর আগে কিশোর বয়সে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেবযান’ বইটা পড়েছিল ও। যতীন, পুষ্প, আশালতা, নেত্যনারান, কেবলরাম কুণ্ডু, তার নাতি রামলাল... আরও কত কত দেহী-বিদেহী চরিত্র যেন চোখের সামনে ভিড় করে এল। লেখার সেই জায়গাটা ওর খুব মনে ধরেছিল, ‘‘মানুষের মনের মন্দিরে অনেক কক্ষ, এক এক কক্ষে এক এক প্রিয় অতিথির বাস। সে কক্ষ সেই অতিথির হাসিকান্নার সৌরভে ভরা, আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না।... তার নামেই উৎসর্গীকৃত সেই ঘর আর-কারো অধিকার থাকে না দখল করবার।’’
সত্যিই যদি অনন্যা ওকে বাঁচাতে না পারে, তা হলে ও কি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে নানা লোকে ঘুরে বেড়াবে? না কি যতীন আর আশালতার মতো শেষে আবার পৃথিবীতে জন্ম নেবে? ওর মনের মধ্যে কার কার নামে কক্ষ আছে? কার কার মনে ওর নামে কক্ষ রাখা আছে? আদৌ কোথাও তেমন কক্ষ নিজের নামে লিখে রাখার যোগ্যতা কি ও অর্জন করেছিল কখনও? অনন্যা কি ওর নামে কোনও একটা ছোট্ট কামরা রেখে দিয়েছে কোথাও? অথবা অনামিকার কি কোনও দিন মনে হয়েছিল সে রকম কিছু?
কেন রাখবে অনন্যা মনের মধ্যে অনিকেতের জন্যে এক কামরার অতিথিশালা? দুঃখ ছাড়া আর কিছু কি পেয়েছে সে ওর কাছ থেকে? পরজন্মের সঙ্গী হওয়া তো দূরের কথা, এ জন্মেই মাঝে মাঝে আফসোস করে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে! আর অনামিকা? সে তো তার চির দিনের আকাঙ্ক্ষিত সঙ্গী-প্রেমিক-স্বামী প্রীতম-পেয়ারের জন্যে বিশাল পাঁচতারা অতিথিশালার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে অনিকেতকে ত্রিপদ ভূমিও দিতে পারেনি ঠিকমতো! সে আবার কবে এত উদার হল?
অনিকেত মনস্থির করে ফেলে, ও আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য বাড়তি আগ্রহ দেখাবে না। যদি বিবেকের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী অনন্যা প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে তো ভাল, না হলে ও পরজন্মই বেছে নেবে, ও জন্মাবে নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে। পুজোয় যাকে হন্যে হয়ে খোঁজে মানুষ, যার দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের প্রতীক, তেমনই একটা পাখি হয়ে, বুকভরা অভিমান নিয়ে একা একা উড়ে বেড়াবে ও, দুঃখের বোঝা বইতে আর কোনও সঙ্গী ওর চাই না।
মনকে আপাত ভাবে নির্লিপ্ত করে অনিকেত চলে আসে চেনা নার্সিং হোমে। বিবেককে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না, তবে অকুস্থলে একটু চাপা টেনশন চলছে। বন্ড সই না করলে ওকে অ্যাডমিট করানো যাচ্ছে না। লম্বা করিডরের শেষ প্রান্তে ওর ট্রলিটা দাঁড় করিয়ে বোর্ডের তিন জন স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করেছেন। সবচেয়ে সিনিয়র যিনি, টর্চ জ্বেলে ওর নিমীলিত চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করে বলেই ফেললেন, ‘‘ইস, এ তো কংকাশনের এক্সট্রিম স্টেজ! অলমোস্ট লস্ট! একে তো আনতেই দেরি করে ফেলেছেন, তার উপর বন্ড এগজ়িকিউট করা নিয়ে কনফিউশন অ্যান্ড ডিলে, পেশেন্ট এক্সপায়ার করলে তখন তো আমাদের উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন!’’
শুনে মনে মনে হাসে অনিকেত, আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে ঠিক এই ধরনের কথাই শিলিগুড়ির নার্সিং হোমে নিজের শরীরের থেকে দশ-বারো ফুট দূরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল ও, আর ওর শরীরটা আঁকড়ে বসেছিল অনন্যা। কিছুতেই তাকে সরানো যাচ্ছিল না, মুখে একটাই কথা, ‘‘আমি ছেড়ে দিলেই ও মরে যাবে!’’ আর ওর জন্যে তৈরি মেডিক্যাল বোর্ডের হেড ডাক্তার শর্মা বিড়বিড় করছিলেন, ‘‘ঠিক এক সপ্তাহ আগে সেম সিম্পটম নিয়ে একই রকম অ্যাকিউট কন্ডিশনে অ্যাডমিট হয়েছিলেন ডাক্তার রস্তোগি, আমাদের কলিগ, এ রকমই বয়স। তাঁকে আমরা বাঁচাতে পারিনি, ভেরি স্যাড ইনসিডেন্ট!’’
সিনিয়র এক জন নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে জানাল, ‘‘পেশেন্টের ব্লাড গ্রুপ ও-নেগেটিভ, ইনডেন্ট দেওয়া হয়েছে, হাতে পেতে একটু সময় লাগবে। তবে মাত্র এক ইউনিট পাওয়া যাবে, রেয়ার গ্রুপ বলে এত ক্রাইসিস! এ দিকে পেশেন্টের তো...’’ কথা শেষ হওয়ার আগেই কমবয়সি ডাক্তারবাবুটি বলে ওঠেন, ‘‘ব্লাড লস যা হয়েছে, তা রিক্যুপ করতে কমপক্ষে চার ইউনিট দরকার, আর তার মধ্যে দু’ইউনিট এক্ষুনি দরকার! পেশেন্টের কনভালশন শুরু হতে যাচ্ছে! কুইক!’’
উপস্থিত ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন ওঠে, ‘‘এত তাড়াতাড়ি ও-নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড জোগাড় করা, পনেরো মিনিট সময় তো অন্তত লাগবে, তা ছাড়া বন্ড সই...’’ করিডরের শেষ প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘‘বন্ডটা কই? আমার ব্লাড গ্রুপ ও-নেগেটিভ, আমি দু’ইউনিট রক্ত দিতে পারব না?’’ সৌম্যদর্শন ডাক্তারবাবু হেসে বলেন, ‘‘আসুন মা, আপনার জন্যেই সব আটকে ছিল, বন্ডটা সই করে আপাতত এক ইউনিটই দিন। তার বেশি এক বারে এক জনের কাছ থেকে নেওয়া যায় না তো। তা ছাড়া, এক সঙ্গেই তো আর একাধিক ইউনিট রক্ত ট্রান্সফিউজ় করব না। আপনিই তো অনন্যা বোস, এখানটায় সই করুন। বাকিটা দেখছি কী করা যায়!’’
চাঁদু এত ক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার আরাধ্য আখণ্ডলমণির নাম জপছিল, কে যেন চেনা গলায় ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘‘কী হে চন্দ্রবর্ধন, তোমার মুখটা কেন এমন শুকনো-শুকনো? একটুখানি হাসো, দেখি! টেনশন লেনে কা নেহি...’’ চমকে চোখ খুলে চাঁদু দেখতে পায় ডিরেক্টর সায়েবের নিথর শরীরটাকে নিয়ে ট্রলিটা সবুজ পর্দার ফাঁক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক পিছনেই চলেছেন ম্যাডাম, শ্রীমতী অনন্যা বোস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy