Sourced by the ABP
পূর্বানুবৃত্তি: তেরো দিন নীরব থাকার পর মল্লারকে ফোন করে চিরশ্রী। জানায়, প্রমিতের প্রোমোশন নিয়ে এরিয়া ম্যানেজার হওয়া এবং সেই সূত্রে তাদের চুঁচুড়া চলে যাওয়ার কথা। এত দিন যোগাযোগ না রাখার জন্য চিরশ্রীর প্রতি ক্ষোভ-অভিমান প্রকাশ করলেও, শেষে কান্নায় বুজে আসে মল্লারের গলা। সেই মুহূর্ত থেকে তার শুরু হয় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। কয়েক দিন পর ভাইঝি হওয়ার খবর দিতে অভ্রর বাড়ি গিয়ে পৌঁছোয় মল্লার। গিয়ে শোনে চার দিনে ভুগে সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে অভ্র। ওর অসুস্থতার খবর জানত না মল্লার। দুই বন্ধুতে নানা কথা হয়, মল্লার জানায় চিরশ্রীর বলা কথাগুলো। মল্লার নিজেকে অনেকটা সামলে নিতে পেরেছে দেখে ভাল লাগে অভ্রর।
অভ্র মৃদু হেসে বলল, “এক হিসেবে তোর ভালই হল রে মল্লার। দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে কষ্টের তীব্রতা কমে যায়, সময় সব ভুলিয়ে দেয়।”
মল্লার বলে, “প্রমিতদা আমাকে কেন ফোন করেছিল জানিস?”
“আশ্চর্য প্রশ্ন। আমি কী করে জানব?”
“আমিও জানি না। খুব ভয় করছে।”
“বুঝলাম না।”
“আজ সন্ধে সাতটার সময় ওর বাড়িতে যেতে বলেছে। আমি যেন অবশ্যই যাই। তবে কি কোনও বোঝাপড়া করে নিতে চাইছে? সরাসরি আমার এবং চিরশ্রীর রিলেশন নিয়ে যদি প্রশ্ন করে বসে?”
অভ্র মাথা নেড়ে বলল, “মনে হয় না সে রকম কোনও সিচুয়েশন আদৌ হবে। তা হলে তোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করত। তুই অকারণ ভয় পাচ্ছিস। অক্টোবরের টাকা পেয়ে গিয়েছিস?”
“না।”
“ওই জন্যই হয়তো ডেকেছে। তোকে ফোনে কী বলেছে অ্যাকচুয়ালি?”
“আগামী কাল ওরা চলে যাচ্ছে চুঁচুড়া। জিনিসপত্র গোছানোয় ব্যস্ত। অফিশিয়াল কিছু কাজও সেরে নিতে হচ্ছে। তাই আমি যেন সন্ধে সাতটায় ওর বাড়িতে যাই। বলেছে, ইটস আর্জেন্ট।”
অভ্র বলল, “আর কিছু বলেনি?”
“না তো!”
“তুই অকারণ ভয় পাচ্ছিস। জীবন সিরিয়ালের ড্রামা নয়, নাটকীয় কিছুই ঘটে না। চিরশ্রীর প্রসঙ্গ আসবে বলে মনে হয় না। তা হলে বাড়িতে ডাকত না, অন্যত্র ডেকে শাসাত। অবশ্য প্রমিতদা সেই টাইপের মানুষ নয়। জানলেও তোকে তা নিয়ে জেরা করবে না। এতে নিজেরই অসম্মান বাড়বে।”
মল্লার বলল, “তুই কত ম্যাচিয়োর! আমার তো বুদ্ধিই বসল না। হাবাগোবাই রয়ে গেলাম।”
অভ্র হাসল, “হাবাগোবারা দেখছি অবৈধ প্রেমে সিদ্ধহস্ত হয়। যাক গে, অনেক দিন পরে একটা কমপ্লিমেন্ট পেলাম। সো-কলড ম্যাচিয়োরিটি দিয়ে কানাকড়ি রোজগার হবে না। তাই তার কোনও ভ্যালু নেই। পোকায় কাটা বেগুনের বাজারদর থাকে না। যা বলছিলাম মেডিকেল রিপ্রেজ়েন্টেটিভের কাজটা তোর কেমন লাগে?”
মল্লার হাসল, “কেমন লাগে! কোনও চয়েস আছে আমার? এটা একটা ফালতু কথা হল। আর্টসে পড়েছি, বয়স হয়েছে, স্মার্ট বা বলিয়ে-কইয়ে নই। কে দেবে আমাকে ও রকম জব?”
“তা কী ভাবে বলব? জীবনে ছোটখাটো ম্যাজিক ঘটার আশা কি করা যেতে পারে না? কাজের গ্যারান্টি এই বাজারে কেউ কি দিতে পারে?”
“ফালতু বকোয়াস বাদ দে। বাঁজা চর্চায় আমি নেই। তা শেয়ার খেলা কেমন চলছে তোর? শুনলাম তোর এক জন ট্রেনার হয়েছে। কাকিমা বলল।”
অভ্র মৃদু হাসল, “হ্যাঁ, হয়েছে। মেয়েটির নাম সুমি। জীবনদীপ হসপিটাল কাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করে। ইসিজি টেকনিশিয়ান। তোর সঙ্গে এক দিন আলাপ করিয়ে দেব।”
“বাহ! মেয়ের এলেম আছে বলতে হবে। তোকে শেয়ারের ফান্ডা দেয়।”
“খুব দৃঢ় চরিত্রের মেয়ে। কেন জানি না, ও ভীষণ ভাবে মোটিভেট করে আমাকে,” অভ্রর মুখ উজ্জ্বল হল হাসিতে, “আমার ওয়েল-উইশার। তা তোর কেমন চলছে?”
মল্লার বলল, “বিভিন্ন ফাংশনে ডাক পাচ্ছি। বন্ধ রাস্তাটা একটু হলেও খুলছে। জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে বেশ কয়েকটা ফাংশনে বাজানোর ডাক পেয়েছি। ওই সময় পরপর চারটে সন্ধেই বুকড।”
খুশি হয় অভ্র, বলে, “বাহ! প্রাইমারি টেটের ফর্ম ফিলআপ করেছিস?”
মল্লার মাথা নাড়ল, “করিনি। ভেবে দেখলাম চাকরির পরীক্ষায় সুবিধে করতে পারব না। এতগুলো বছর জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেল, যখন টাচে ছিলাম পরীক্ষা নামের প্রহসন হল। এখন পড়াশোনা থেকে পুরোপুরি আউট অব টাচ হয়ে গেছি। নিজের পেশাতেই এগিয়ে যাব। অল্পতেই খুশি আছি। জানি না পরে অন্য রকম ভাবব কি না!”
“সন্ধেয় অবশ্যই তুই প্রমিতদার ওখানে যাচ্ছিস। এসকেপ করবি না। আমার মন ভাল কিছু আশা করছে!”
“জ্বরের দুর্বলতা কাটেনি মনে হচ্ছে! এতে আশা খুঁজে পাচ্ছিস তুই?” মল্লার ম্লান হাসল, “শোন, হাফবুড়ো বেকারের লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে নয়। তাই যাব। একটা মাসের মাইনে মানে পাঁজরের একটা হাড়। ছাড়ব কেন?”
মল্লার চলে যেতেই মনে মনে হাসল অভ্র। প্রমিতদার কোম্পানি এই এরিয়ার কাজের জন্য নতুন কাউকে আর্জেন্ট বেসিসে নেবে। প্রমিতদাকে সে বলেছিল, “যাওয়ার আগে আমার কথাটা ভেবে দেখো। একটা কাজ চাই। ব্যাগই বইব আবার। এত দিন নিশ্চয়ই আমার এক কালের ব্যাড রেপুটেশন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।”
প্রমিতদা উত্তর দিয়েছিল, “একটা ভেকেন্সি হয়েছে। তোমার নাম রেকমেন্ড করতেই চেয়েছিলাম। ইচ্ছে থাকলেও অন্য এক জনের নাম রেকমেন্ড করতে হয়েছে। তুমি তাকে চেনো।”
“চিনি?”
“ঘরের সুপ্রিম অথরিটির আবদার। সংসার করোনি, করলে বুঝতে পারতে যে, এ ক্ষেত্রে আবদারের অর্থ হল নির্দেশ। বান্দা সেই নির্দেশ মেনে কাজ করছে। চলে যাওয়ার আগে তার সিন্থেসাইজ়ার টিচারের হিল্লে করে দিয়ে যেতেই হবে।”
“মল্লার!”
“হ্যাঁ।”
আজ সন্ধে ছ’টা থেকে ফোনে তাগাদা দিতে হবে মুডি ছেলেটাকে। দেখা না করলে প্রমিত চক্রবর্তী ক্ষুণ্ণ হবেই, মল্লারের জন্য রেকমেন্ড করবেই না। এই পেশাদারি জগতের কিছু নিয়মকৌশল সে জানে।
রাত আটটা বাজল। মল্লারের উচ্ছ্বসিত আনন্দমাখানো গলা ফোনের ও-প্রান্তে শোনার জন্য মুখিয়ে রয়েছে অভ্র। থাকতে না পেরে নিজেই কল করল। আশ্চর্য, ফোন সুইচড অফ। এমন তো হওয়ার কথা নয়। প্রমিতদা কি তা হলে চাকরির গাজর ঝুলিয়ে মল্লারকে ডেকে সত্যিই হেনস্থা করল? না, মানুষ চেনায় তার এতটা ভুল হবে না।
ভাবতে ভাবতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্রমিতদা।
“হ্যালো!”
“তোমার বন্ধুটি কি পাগল?”
অভ্র ভয় পেল, বলল, “কেন বলো তো?”
“হাতের লক্ষ্মী কেউ এ ভাবে পায়ে ঠেলে? সে ওই কাজ করবে না। প্রথমে আমার প্রস্তাব শুনেই তার মুখের রং বদলে গেল। চাকরির সুযোগ শুনেও কারও যে মুখ অমন পাংশুটে হতে পারে, তা আজ প্রথম দেখলাম। বিশ্বসংসারে কত কী যে দেখা বাকি! তার পর বোঝালাম। বললাম, যে তোমার ছাত্রীর উপরোধ-অনুরোধেই এই বন্দোবস্ত করা হয়েছে। শুনেই সে উঠে দাঁড়াল। হাতজোড় করে নিজের অক্ষমতা জানাল। কী সেন্টিমেন্টাল ছেলে রে
বাবা! চোখ ছলোছলো হয়ে এল, মুখ কাঁদোকাঁদো। বলল, আমি যেন তাকে ক্ষমা করে দিই। মাথায় কিছুই ঢুকল না। ওই কাজে সে নাকি উপযুক্ত নয়, ইত্যাদি বলেটলে চলে গেল। চিরশ্রীকে বকাঝকা করলাম খুব।”
“কেন?”
“বকব না? বললাম, কার জন্য সুপারিশ করতে বলেছিলে? যে কি না নিজেই কাজে আগ্রহী নয়। টার্গেট আর সেল্সের কঠিন দুনিয়া ওই সব শখের শিল্পীদের নয়, বোঝো না? এই সব নাটুকে, সেন্টিমেন্টাল ছেলেরা বেসিকালি ওয়ার্থলেস হয়। শুনে সে মাথা নিচু করে থাকল। বাই দ্য ওয়ে, তুমি আগ্রহী, অনেক আগে থেকে বলে রেখেছিলে, কয়েক দিন আগেও নক করেছিলে। তোমার নাম রেকমেন্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি আবার বন্ধুটির মতো উল্টো গাওয়া শুরু করবে নাকি?”
অভ্র বিব্রত গলায় বলল, “কী যে বলো, প্রমিতদা! এ তো মেঘ না চাইতেই জল।”
“আড়াই বছর এই লাইনে ছিলে। প্রসেস তুমি জানো। প্রথমে রিজিয়োনাল ম্যানেজার ইন্টারভিউ নেবে। পরের রাউন্ডে কলকাতার হেড অফিসে ইন্টারভিউ। তুমি এক্সপিরিয়েন্সড, স্ট্রং রেকমেন্ডেশন আছে, হয়ে যাবে।”
“আমাকে কি ফ্রেশ হিসেবেই কনসিডার
করা হবে?”
প্রমিতদা হাসল, “তুমি এত দিনে বেশ চালাকচতুর হয়ে গেছ। না, তোমার অভিজ্ঞতা দেখা হবে। তা দেখা হবে বলেই শিয়োর হবে তোমার। কেন এত গ্যাপ, কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করলে পরিষ্কার বলবে, ফ্যামিলি মিসহ্যাপ। রিজিয়োনাল ম্যানেজারকেও তাই বলে রেখেছি। যা হয়েছে তা বরং শাপে বর হয়েছে। এই জবটা তুমিই পাচ্ছ ধরে নাও। এখন আর বেশি কথা বলার টাইম নেই। বুঝতেই পারছ লটবহর গুছিয়ে কাল সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। কোম্পানি থেকে মেল পেয়ে যাবে। রাখছি।”
অভ্র বিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকল। মল্লার প্রত্যাখ্যান না করলে চাকরি পাওয়ার কোনও আশাই তার ছিল না। সারা বিশ্বে সরকারি চাকরির সঙ্কোচন হচ্ছে, এ-দেশেও প্রাইভেট কোম্পানির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়াটাই অধিকাংশ শিক্ষিত বেকারের ভবিতব্য। এ-দেশে সমস্ত সরকার দায় ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া, ‘চাকুরীজীবী’ মানেই ‘বোঝা’। সেটা বুঝেই আবার এই চাপবহুল জবের জন্য মরিয়া হয়ে প্রমিতদাকে কাতর অনুরোধ করেছিল সে। কিন্তু কোথাও যেন এক অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছে। মল্লারকে ফোনে পাওয়া গেল না। এখনও তার ফোন বন্ধ।
বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি মল্লার ফিরবে না। এখনই তার মল্লারের সঙ্গে দেখা করা দরকার। যে-বারে মল্লার মাঝেমধ্যে যায় সেখানে উঁকি দিয়ে দেখল অভ্র। মল্লার নেই। অভ্রর মনে ভীষণ আলোড়ন, রক্তে দোলা। একটা সন্ধে, একটা ফোন আচমকাই তার জীবনে দিশা বদলে দেওয়ার সঙ্কেত জানিয়েছে। যদিও নিশ্চয়তা বলে আপাতত কিছুই নেই। বিশ্বের অন্যতম ধনী কর্পোরেট সংস্থাগুলোয় কাজ করা ঈর্ষণীয় বেতনের সুদক্ষ, পরিশ্রমী কর্মচারীরাও জানে না যে আগামী কাল সকালে তার ‘জব’ থাকবে কি না!
ফ্লাইওভার দিয়েই এগোল অভ্র। শহর ছাড়িয়ে আলো-অন্ধকারের পথে খানিকটা যেতে ইচ্ছে করছে। একটা বাইক স্ট্যান্ড করা রয়েছে এককোণে। বাইকের মালিক ফ্লাইওভারের ফুটব্রিজে দাঁড়িয়ে স্টেশনের দিকে এক মনে তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টি তার সুদূরে, আশপাশের কোনও কিছুতেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই, খুব উদাসীন দেখাচ্ছে তাকে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy