ছবি: কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: নির্দিষ্ট দিনে কংগ্রেসের অধিবেশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হরপার্বতীর সঙ্গে আলাপ হল হরিকুমার চক্রবর্তীর। তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন। দু’হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও পাঁচশো স্বেচ্ছাসেবিকার মিছিলের প্রথমে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু। অশ্বারোহী সুভাষচন্দ্রকে দেখে ছত্রপতি শিবাজির কথা মনে পড়ছিল হরপার্বতীর। অশ্বারোহী বাহিনীর ঠিক পিছনেই একটি ঘোড়ার গাড়িতে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে ছিলেন মোতিলাল নেহরু। তিন দিন যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেল হরপার্বতীর। তৃতীয় দিন এসেছিলেন কাজী নজরুল। তাঁর গান গাওয়ার সময় হঠাৎই চুরি হয়ে যায় প্রবেশমূল্যের বাক্স। হইচইয়ে গান থামিয়ে বিদায় নেন কবি। অন্য দিকে বালিগঞ্জে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সভার সভাপতি অমরেন্দ্রনাথ সেখানকার কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা করছিলেন। আজকাল কংগ্রেসের সভাগুলিতে বাক্বিতণ্ডা লেগেই থাকে। এমন সময় মন্মথনাথ বিশ্বাস এসে নীচে নামতে বলেন অমরেন্দ্রনাথকে। মন্মথনাথ ফাঁসিতে মৃত বসন্ত বিশ্বাসের খুড়তুতো ভাই। তিনি এখন অমরেন্দ্রনাথের বাড়িতেই থাকেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অমরেন্দ্রনাথ শুনলেন, এক যুবক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বাড়ির লোকের সন্দেহ, ছোকরা পুলিশের চর।
অমরেন্দ্রনাথের ভুরু কুঞ্চিত হওয়ার বদলে, মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গেল। স্বগতোক্তি করলেন, “বুঝেছি...” তার পর মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে, পুজোর দালান অতিক্রম করে সদর দরজায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন, এক যুবক দাঁড়িয়ে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের মধ্যে। যুবকের বলিষ্ঠ গঠন, কিন্তু খুবই ক্লান্ত ও শ্রান্ত। পরনে ধুতি ও পিরান। চুল উস্কোখুস্কো।
অমরেন্দ্রনাথ যুবককে বললেন, “কাকে চাই?”
“আমি অমরদাকে খুঁজছি। তাকে গিয়ে বলুন, আমার নাম দীনেশ মজুমদার,” যুবক বলল।
অমরেন্দ্রনাথ জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তুমি ভিতরে এসো।”
“আপনি?”
“তুমি আমার খোঁজেই এসেছ। তবে এই আশ্রয় তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়। আমাকে বিশেষ কাজে এক বার কলকাতা যেতে হচ্ছে। রাতে বাড়ি ফিরে এসে তোমার ব্যবস্থা করব। আপাতত চান করে এসে আমার সঙ্গে দুটো মুখে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।”
অমরেন্দ্রনাথ দীনেশকে নিয়ে তাঁর বসার ঘরে এসে উপস্থিত হন। ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে যুবকটির মুখোমুখি বসে থাকেন খানিক ক্ষণ। তার পর বলেন, “তোমার কথা আমি শুনেছি। জেল থেকে পালিয়ে, এ দিক-সে দিক ঘুরে, চন্দননগরে তো ছিলে বেশ। হঠাৎ কী হল?”
দীনেশ মুখে হাসি এনে বলল, “হ্যাঁ, চন্দননগরে প্রথম দিকে ছিলাম ভালই। আশ্রয় নিয়েছিলাম ডাক্তার হীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ওখানে কয়েক জন প্রতিবেশীর সন্দেহ হওয়ায় স্থান বদলালাম। উঠলাম দাশরথি ঘোষের বাড়িতে। সে বাড়িও নিরাপদ হল না। কারণ, ফরাসি পুলিশ কমিশনার মঁসিয়ে কুইন আমাদের খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন।”
“বলো কী, এমন তো হওয়ার কথা নয়! আমরা তো ফরাসি পুলিশের ভরসায় চন্দননগরকে বেছে নিতাম আশ্রয়ের জন্য। ফরাসি পুলিশই বিপদের খবর আমাদের আগেভাগে জানিয়ে দিত!” অমরেন্দ্রনাথের কথায় বিস্ময়।
দীনেশ কিছু বলতে যাচ্ছিল। থেমে গেল। মনে হল ঘরের দরজায় কেউ যেন মৃদু আঘাত করছে। উঠে দাঁড়াল সে। তার হাত চলে গেল পিরানের পকেটে, যেখানে একটি ধাতব অস্ত্র ঘুমিয়ে আছে। অমরেন্দ্রনাথ একটু ঝুঁকে দীনেশের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললেন, “বোসো, পকেটের বস্তুটাকে ব্যবহার করার অনেক সময় পাবে। আপাতত চা খেয়ে ক্লান্তি দূর করো।”
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন অমরেন্দ্রনাথ। দু’-কাপ চা ও খানকতক বিস্কুট নিয়ে প্রবেশ করলেন অমরেন্দ্রনাথের স্ত্রী। কাপ দু’টি রেখে চলে যাচ্ছিলেন তিনি, স্বামীর ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “এই ছেলেটি তোমার ভাই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, মুঙ্গের থেকে এসেছে।”
মহিলা মাথা নেড়ে চলে যেতে, অমরেন্দ্রনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, যা বলছিলে...”
দীনেশও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, “দিব্যি ছিলাম চন্দননগরে। সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল অটুট। অস্ত্রের আদান-প্রদানও চলত নিরাপদে।”
“তা হলে?”
“ফরাসি পুলিশ কমিশনার কুইন এসে সব ওলটপালট করে দিল। ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে আমাদের আস্তানাগুলোর উপর নজর রাখতে শুরু করল। নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি বন্ধ করে দিল। আমরা ঠিক করলাম, কুইনকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। সুযোগ এসে গেল গত পরশু। কুইন নিজে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী নিয়ে আমাদের ধরতে এল। সামনাসামনি লড়াই হল। খুব কাছ থেকে গুলি চালালাম। টেগার্ট, ওয়াটসনকে মারতে পারিনি বলে দুঃখ ছিল। কুইনকে মেরে সেই দুঃখ খানিকটা হলেও ভুললাম। আমাদের মধ্যে দু’-এক জনকে ওরা ধরলেও, আমাকে ধরতে পারল না। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এক দিন কাটিয়ে দিলাম। তার পর আপনার কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, আপনি একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। ট্রেন ধরে চলে এলাম উত্তরপাড়া। কিন্তু আপনার বাড়ি তো চিনি না। তবে তাতে অসুবিধে হল না। উত্তরপাড়ায় এমন কেউ নেই, যে আপনাকে চেনে না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে চলে এলাম।”
“সব ঠিক আছে ভাই। তবে এ বাড়ির গন্ধ পুলিশের নাকে আগে যায়। তাই আমি তোমার অন্য ব্যবস্থা করব।”
অমরেন্দ্রনাথ দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সকাল আটটা বেজে পাঁচ। তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি কলতলায় চান সেরে এসো। আমার খুব সকালেই ওই পর্বটি সমাপ্ত হয়েছে। তোমার চান হলে, খেতে বসব।”
অমরেন্দ্রনাথ দীনেশের হাতে একটি গামছা দেন ও কলতলাটি দেখিয়ে দেন।
খুব দ্রুত আহারপর্ব সমাপ্ত করে, দীনেশের কাঁধে আর এক বার হাত রেখে বললেন, “ওবেলা ফিরে এসে একটা ব্যবস্থা করব। চিন্তা কোরো না। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার ঘুম দরকার। মোটাদা তোমাকে ঘর দেখিয়ে দেবে।”
একটা অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে, দীনেশ মোটরযানের আওয়াজ পেল। সে বুঝল, অমরদা কলকাতার উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন।
সাধারণত খুব ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি চোখের পাতা জুড়ে এলেও, অনেক সময় আসেও না। দীনেশের চোখেও ঘুম এল না। চোখের সামনে ছেঁড়া ছেঁড়া কতকগুলো দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল। অনুজাচরণের রক্তাক্ত মৃতদেহটা পড়ে রয়েছে... স্প্লিন্টারের আঘাতে সে-ও রক্তাপ্লুত... চার্লস টেগার্ট-সহ একটা গোটা পুলিশ দল ছুটে আসছে তাকে ধরতে... সে আর দৌড়তে পারছে না... এ বার সে পড়ে যাবে... ধরা পড়বে পুলিশের হাতে... তাতে তার দুঃখ নেই, দুঃখ হত যদি, গোপীনাথের মতো সে-ও ব্যর্থ হত টেগার্টকে মারতে... এ বার সে ব্যর্থ হয়নি... স্পষ্ট দেখেছে, কুইনের দেহটাকে লুটিয়ে পড়তে... আবার শুরু হল দৌড়... চোখের পাতা ভারী হচ্ছে তার... ঘুম নেমে আসছে চোখে... ঘুম, পরম কাঙ্ক্ষিত ঘুম।
ঘুম ভাঙল একটা ভারী কণ্ঠস্বরে। তড়বড় করে বিছানায় উঠে বসল দীনেশ। দেখল, সামনে অমরেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। অমরেন্দ্রনাথ নিদ্রোত্থিত দীনেশের দিকে তাকিয়ে খানিক ক্ষণ সময় নিলেন। তার পর বললেন, “এ বার প্রস্তুত হয়ে নাও ভাই, বেরোতে হবে। মোটাদা, মানে মন্মথ বিশ্বাস নিয়ে যাবে তোমাকে।”
“কোথায় যাব, অমরদা?” ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরে বলল দীনেশ। অমরেন্দ্রনাথের কেমন মায়া হল। মনে মনে ভাবলেন, যদি উপায় থাকত, তা হলে আজকের রাতটা এ বাড়িতেই রেখে দিতেন ছেলেটিকে। কিন্তু সে উপায় নেই। পুলিশের কানে যে কেউ পৌঁছে দিতে পারে খবরটা যে, একটি অপরিচিত যুবক এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জ্ঞাতিগুষ্টি ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সবাই যে তাঁর খুব হিতৈষী, এমন নয়। পুলিশ যখন তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, এমনকি টেগার্ট নিজে যখন এই বাড়িতে তাঁর খোঁজে এসেছিল, তখনও অনেকের নোংরা ভূমিকার কথা তাঁর কানে এসেছে। তাই তিনি সতর্ক। একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “এমন জায়গায়, যেখানে তুমি নিশ্চিন্তে দু’-চার দিন থাকতে পারবে। নাও, আর দেরি কোরো না। এখনই রাত ন’টা বাজে। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার মোটাদাকে ফিরে আসতে হবে।”
দীনেশকে নিয়ে মন্মথ বিশ্বাস যখন রওনা দিল, তখন রাত দশটা। শুনশান জি টি রোড। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকে দীনেশের চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল। তাই দেখে মন্মথনাথ একটু ঝুঁকে জানালার কাচ তুলে দিল। গাড়ি বি টি রোডে উঠলে দীনেশ প্রথম কথা বলল, খানিকটা স্বগতোক্তি যেন, “সতেরো বছরের সেই ছেলেটির নাম ছিল বিশে...”
চমকে উঠে মন্মথনাথ বলে, “কার নাম করলে?”
“বসন্তকুমার বিশ্বাস, যার পবিত্র রক্ত আপনার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে...” গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দীনেশ বলল।
মন্মথনাথের চোখে জল। বলল, “ওই নামে রাসবিহারী বসু ওকে ডাকতেন। ভাইয়ের অস্ত্রশিক্ষা তাঁর কাছেই।”
“জানি দাদা। রাসদার কাছে ওর সাহসের অনেক কাহিনি শুনেছি।”
“তোমার সঙ্গে রাসবিহারী বসুর পরিচয় আছে?”
“হ্যাঁ দাদা, গত বছর মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে পালিয়ে যখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছি, তখন এক দিন আসানসোল কোলিয়ারির কাছে একটি আস্তানায় রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা হল। সঙ্গে ছিল বিজয় মোদক বলে আমার এক বন্ধু। রাসবিহারী বসু আমার কথা আগেই জানতেন। তিনি আমাকে জাপানে নিয়ে যেতে চাইলেন।”
“ভালই তো হত! তুমি গেলে না কেন?”
দীনেশ মজুমদার চুপ করে রইল খানিক ক্ষণ। অন্ধকার ভেদ করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে সামনে। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে বলে উঠল, “এ দিকে যে অনেক কাজ বাকি, দাদা। কিছুই তো প্রায় করতে পারলাম না।”
মন্মথনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বসন্তকেও আগলে আগলে রেখেছিলেন রাসবিহারী। দেরাদুনে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে পুলিশের সন্দেহ হওয়াতে, রাসবিহারীর পরামর্শ মতো এক দিন বড়লাট হার্ডিঞ্জের উপর বোমা নিক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে সভা করে ফেলল বসন্ত। পুলিশের লোকেরা তো অবাক। ভাবল, এ কাকে সন্দেহ করছে তারা! যে ছেলে সরকারের হয়ে কথা বলে, তাকেই কি না তারা সরকারের বিরোধী হিসেবে সন্দেহ করে! ব্যস, ওখানেই সব সন্দেহের অবসান।”
“এর অনেক পরে বসন্ত ধরা পড়ে, না?” দীনেশ প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ,” উত্তর দিল মন্মথনাথ। বলল, “প্রায় দু’বছর বাদে। বাবা মারা যাওয়ার সংবাদে বাড়ি এসেছিল। আমাদের এক আত্মীয় পুলিশের কাছে খবরটা দিয়ে এসেছিল। বসন্তের মাথার দাম তখন এক লক্ষ টাকা।”
দীনেশ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার চোখ তখন বাইরে। গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। সে বলল, “আমাদের রক্তে আছে বিশ্বাসঘাতকতা। এদের শাস্তি মৃত্যু। যাক, আমরা বোধ হয় কালীঘাটে ঢুকছি। এই জায়গাটা আমার কেমন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, কালীঘাটে অশ্বিনী গাঙ্গুলি লেনে অমরদার পিসির বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে আপাতত,” ড্রাইভারকে একটা গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল মন্মথনাথ।
ড্রাইভার সুখবিন্দর সিং অমরেন্দ্রনাথের পুরনো ড্রাইভার। অনেক লড়াইয়ের সঙ্গীও। মন্মথনাথের কথামতো একটা গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করতেই দু’জন নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। তার পর একটু হেঁটে একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে কড়া নাড়ল মন্মথনাথ। দোতলা বাড়ি। সারা বাড়ি অন্ধকার। শুধু একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
অনেক ক্ষণ কড়া নাড়ার পর সেই ঘরের জানালায় এক যুবকের মুখ দেখা গেল। সে জিজ্ঞেস করল, “কে... কাকে চাই?”
নীচ থেকে মন্মথনাথ নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “দরজা খোলো, সুকুমার। আমরা উত্তরপাড়া থেকে আসছি।”
খানিক ক্ষণের মধ্যে নীচের দরজা খুলে গেল। মন্মথনাথ দীনেশকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই যুবক বলে উঠল, “এত রাতে... কারও কোনও বিপদ?”
মন্মথনাথ নিজেই দরজার খিল আটকে দিয়ে বলল, “বিপদ তো বটেই। এই ছেলেটির খুব বিপদ। পুলিশ খুঁজছে। অমরদা তোমাদের বাড়িতে পাঠাল ওর আশ্রয়ের জন্য।”
যুবক হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, “অমরদার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমাদের বাড়ির আশপাশে সব সময় পুলিশ ঘোরাফেরা করে।”
মন্মথনাথ হাত উল্টে বলল, “তার আমি কী জানি! দু’-এক দিনের মধ্যে অমরদা আসবে, তখন তাকে এ কথা বোলো। আপাতত ওর একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করো।”
“ঠিক আছে, সে আমি করছি। আমাদের এতগুলো ঘরের একটিতে থাকবে, এ আর কী এমন কথা। তবে অমরদা যেন দু’-এক দিনের মধ্যেই অন্য ব্যবস্থা করেন। সত্যি বলছি, এ বাড়ি বিপ্লবীদের পক্ষে নিরাপদ নয়,” বলে দীনেশকে একটি ঘর দেখিয়ে দিল যুবক।
মন্মথনাথ বলল, “আমি তবে আসি সুকুমার?”
“আসুন দাদা,” বলে সে মন্মথনাথকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।
বাড়িটি থেকে বেরিয়ে মন্মথনাথ ফিরে আসে গাড়ির কাছে। গাড়ি আবার উত্তরপাড়া অভিমুখে যাত্রা করে।
৪১
কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই আশ্রয়টি মন্দ নয়। জনবহুল রাস্তার উপর প্রকাণ্ড বাড়ি। অশ্বিনী গাঙ্গুলি লেনের পর এখানে একটি ঘরে দীনেশের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। দীনেশের পাশের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে আরও দু’জন। দু’জনেই জেল পলাতক। পুলিশ তাদেরও হন্যে হয়ে খুঁজছে। দু’জনেই দীনেশের পূর্বপরিচিত। বিশেষ করে নলিনী দাস। হিজলি জেল থেকে পালিয়ে চন্দননগরে তার সঙ্গে একই ঘরে থাকত নলিনী। আর এক জন জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়।
এই বাড়িটি ভাড়া পেতে কম সমস্যা হয়নি অমরেন্দ্রনাথের। বাড়ির মালিকের সাফ কথা— অবিবাহিত কাউকে তিনি ভাড়া দেবেন না।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy