Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

অগ্রিম কিছু টাকা সে দিনই নিয়ে নেয় নিবারণ। সুরা আর নারীতে কোনও কার্পণ্য নেই উমানাথের। এর আগেও নিবারণকে অনেক টাকা দিয়েছে উমানাথ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৮:৫৯
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: পরীক্ষায় ভাল ফল করার খবরের সঙ্গে সঙ্গে জেঠু নীলমণির জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার খবরটাও অবিনাশ কবিরাজের বাড়িতে দেয় শশিকান্ত। নীলমণির খবরে স্পষ্টতই অসন্তোষ প্রকাশ করেন অবিনাশ, যা শশিকান্তর খারাপ লাগে। সে কিছুটা প্রতিবাদ করলেও বেশি বাদানুবাদে যায় না। বাড়ি ফিরে সে দেখে বাড়িতে এসেছেন মামা উষাপতি। নীলমণি আর উষাপতির মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। সেখানে আসেন অবিনাশ কবিরাজও। কথায় কথায় জানা যায়, তিনি নীলমণির গোপন আস্তানার সন্ধানে ছিলেন, যাতে সেই খবরটা পুলিশের কাছে দিয়ে নীলমণির মাথার দামটা আদায় করা যায়। অপ্রস্তুত এবং বিরক্ত অবিনাশ শশিকান্তর পাশের মিষ্টি না খেয়েই তড়িঘড়ি সে বাড়ি থেকে বিদায় নেন।

দুই মাঝির এক জন দাঁড় বাইছে, আর এক জন নিবারণের সঙ্গে খোশগল্পে মশগুল। বজরার ভিতর থেকে গান ভেসে আসছে। সেই গানের সুর যেন ছড়িয়ে পড়ছে
সব জায়গায়।

অনেক দিন থেকেই বজরায় প্রমোদ-ভ্রমণের শখ উমানাথের। কিন্তু কাজের চাপে সেটা আর হয়ে উঠছিল না। এক দিন নিবারণের কাছে কথাটা পাড়তেই, নিবারণ বলে উঠল, “এ আর এমন কী কঠিন, বাবু! আসছে শনিবারই আমি সব ব্যবস্থা
করে ফেলছি।”

উমানাথ নিবারণের কাঁধে হাত রেখে বলেন, “পাপড়িবাইকে এক বার বলে দেখলে হয় না?”

নিবারণ চুপ করে যায়। পাপড়িবাই কি রাজি হবে! এরা ঘরের বাইরে খুব একটা যায় না।

নিবারণকে নীরব থাকতে দেখে উমানাথ বলে, “কী হল, তুই যে একেবারে চুপ মেরে গেলি।”

নিবারণ মাথার চুলে কয়েক বার হাত বুলিয়ে বলল, “আমি অন্য মেয়েছেলে নিয়ে আসব?”

হঠাৎ উমানাথ ক্ষিপ্ত হয়ে যান। বলেন, “আমার পাপড়িবাইকেই চাই। তুমি ব্যবস্থা করো। টাকা বেশি চাইলে, আমি দেব।”

নিবারণ এটাই চাইছিল। এই টাকা থেকে সে-ও একটা ভাল দাঁও মারতে পারবে। সে রকম টাকা পেলে পাপড়িবাই রাজি হবে না মানে, ওর বাপ রাজি হবে। তবু নিবারণ বিরস মুখে উমানাথকে বলল, “দেখি কী করা যায়।”

অগ্রিম কিছু টাকা সে দিনই নিয়ে নেয় নিবারণ। সুরা আর নারীতে কোনও কার্পণ্য নেই উমানাথের। এর আগেও নিবারণকে অনেক টাকা দিয়েছে উমানাথ। সে জানে, ভাল খেতে চাইলে ভাল খরচ করতে হবে। না হলে কপালে খেঁদি-পেঁচি ছাড়া
কিছু জুটবে না।

নিবারণ বজরার মাথায় বসে সিগারেট খেয়ে চলেছে। মাঝি হাঁ করে সিগারেট খাওয়া দেখছিল। দেখে নিবারণ বলল, “কী রে, খাবি নাকি একটা?”

মাঝি লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, “না কত্তা, আমাগো ওই সব চলে না।”

“আরে খা একটা, লজ্জা পাচ্ছিস কেন?” বলে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। মাঝি সিগারেটটা নিয়ে হাসে। তার দাঁতহীন মুখের দিকে চেয়ে থাকে নিবারণ। কেমন একটা মায়া হয় তার। বলে, “তোর বাড়িতে কে আছে রে?”

সিগারেট ধরিয়ে মাঝি বলল, “বৌ
আর পোলা।”

“পোলা কী করে?” নিবারণ জিজ্ঞেস করে।

“পোলা তো ডাগর। ওই তো দাঁড় বাইছে!” বলে ছেলেকে গর্বের সঙ্গে দেখায় মাঝি।

নিবারণ মাঝির ছেলের দিকে তাকায়। বেশ সুঠাম চেহারা। দাঁড় বাওয়ার সময় তার হাতের পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।

“কী নাম তোর ছেলের?” নিবারণ বলে।

“গোপাল, বাবু...” মাঝি বলে।

“তোর মেয়ে নেই?”

“কী যে কন কত্তা! মাইয়া থাকব না? তিন-তিনটা মাইয়া আমার। তবে, সব কডার বিয়া দিয়া দিসি। পোলাটার বিয়া হলে আমি আর আমুনা নদীতে। ঘরে বইয়া আরাম করুম।”

ফোকলা মাড়ি বার করে মাঝি হাসে। সে দিকে তাকিয়ে নিবারণ ভাবে, কত সহজ জীবন
এদের! জীবনে চাওয়া-পাওয়াও কত সীমাবদ্ধ। তাই তো এরা সুখী।

এমন সময় উমানাথের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল নিবারণ। তার নাম ধরেই ডাকছে। নিবারণ শশব্যস্ত হয়ে ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। ঘরে ঢুকে দেখে, লাল ফরাসের উপর তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে উমানাথ বসে আছে। পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পাপড়িবাই। নিবারণকে দেখে উমানাথ বলে, “হ্যাঁ রে নিবারণ, ক’টা বিয়ার এনেছিস আমার জন্য?”

“বাবু, পাঁচটা...” নিবারণ উত্তর দেয়।

“লবেনচুসের মতো একটা হাতে ধরিয়ে, সেই যে গেলি, আর পাত্তা নেই তোর। বলি, নিজেই কি সাবাড় করে দিলি নাকি?” উমানাথের কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ স্পষ্ট হয়।

নিবারণ জিব বার করে বলে, “ছি ছি বাবু, কী যে বলেন আপনি! সব বোতল রাখা আছে। খোলা হাওয়ায় না রাখলে যে বিয়ার গরম হয়ে যাবে। তখন তো নিবারণকে দোষ দেবেন!”

“বেশ, বুঝলাম। এখন যা, আরও দু’বোতল এনে রাখ। অনেক ঠান্ডা করেছিস। এ বার আমি একটু গরম হই,” বলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল উমানাথ।

নিবারণ মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

“নিবারণ বলছিল— আপনার নাকি বিয়ের কথা চলছে?” বোতল থেকে উমানাথের জন্য বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলল পাপড়িবাই।

তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ছিল এত ক্ষণ উমানাথ। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। বলল, “এ কথা নিবারণ তোকে বলেছে নাকি?”

“বলেছে তো। কেন, সে মিথ্যে বলেছে নাকি?”

“না, মিথ্যে বলেনি। তবে, আমার অনুমতি না নিয়ে তোকে এ কথা বলা উচিত হয়নি নিবারণের।”

খিলখিল করে হেসে ওঠে পাপড়িবাই। বলে, “সব কাজেই কি নিবারণ আপনার অনুমতি নেয়?”

উমানাথ অসন্তুষ্ট হয়। বলে, “না, তা সে নেবে কেন? কিন্তু আমার ব্যাপারে কথা বললে আমার অনুমতি নিতে হবে বইকি।”

“খুব রেগে গেছেন দেখছি। বিয়ের পর ভুলে যাবেন পাপড়িবাইকে, তাই না?” পাপড়িবাই বলে।

হেসে ওঠে উমানাথ। বলে, “তোকে কি ভোলা যায় রে? বুঝিস তো সব, বৌও থাকবে, তুইও থাকবি। আমি তোর গানের সমঝদার।”

“শুধু গান?” হাসতে হাসতে বলে পাপড়িবাই।

উমানাথ ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে থাকে পাপড়িবাইয়ের দিকে। যেন দু’চোখ দিয়ে পাপড়িবাইকে গিলে খেয়ে নেবে সে। তা দেখে পাপড়িবাই হাসতে হাসতে বলে, “আ মরণ!”

উমানাথও হাসে। সেও হাসতে হাসতে বলে, “আয়, তোর শরীরের সুরটাও দেখি।”

“ও সব এখানে হবে না। তার জন্য আমার ঘর আছে,” পাপড়িবাই গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়।

“এখানে তবে এলি কেন?”

“আপনি টাকা দিয়েছেন বলে।”

“শুধু টাকার জন্য? আমি যে এত দিন
তোর ঘরে যাচ্ছি, আমার জন্য কি তোর একটুও ভালবাসা নেই?”

খিলখিল করে হেসে উঠল পাপড়িবাই। বলল, “ভাল বলেছেন উমাবাবু... ভালবাসা! ওটা আবার কী বস্তু?”

“সেটা তো তুই বলবি।”

পাপড়িবাই চুপ করে যায়।

উমানাথ গেলাসে চুমুক দিয়ে বলে, “কী রে, চুপ করে গেলি যে!”

পাপড়িবাই মৃদু স্বরে বলে, “বাবু, আপনি প্রজাপতি দেখেছেন?”

উমানাথ বলে, “কী কথা বলিস তুই পাপড়ি? প্রজাপতি দেখব না? গ্রামের ছেলে আমি। ছেলেবেলায় কত ফড়িং, প্রজাপতি ধরেছি। গায়ে প্রজাপতি বসলে, আমাদের দেশের লোকেরা বলে বিয়ে হবে।”

“আপনার গায়ে বুঝি প্রজাপতি বসেছিল?”

“হয়তো বসেছিল!” উমানাথ হাসতে থাকে। তার পর হাসি থামিয়ে বলে, “তুই হঠাৎ প্রজাপতির কথা বললি কেন?”

“আপনি ভালবাসার কথা বললেন বলে।”

“ভালবাসার সঙ্গে প্রজাপতির কী সম্পর্ক?”

“আছে বাবু, খুব সম্পর্ক আছে। আপনাদের কাছে ভালবাসা হল অনেকটা প্রজাপতির মতো সুন্দর। আর আমাদের কাছে ভালবাসা হল প্রজাপতির দুটো ডানা কেটে নেওয়া। নির্মম।”

“তুই তো বেশ দার্শনিকের মতো কথা বলিস। তোর অতীতটা তো জানতে হয়।”

“আমার কোনও অতীত নেই উমাবাবু, ভবিষ্যৎ ভি নেই, শুধু আছে বর্তমান। তা-ও বড় ঠুনকো। একটা টোকায় ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে।”

“বাপ রে! তুই তো খুব বড় বড় কথা বলছিস। নেশাটাই কেমন মাটি হয়ে যাচ্ছে। নে, আমার গেলাসে আর একটু বিয়ার ঢেলে আর একটা গান ধর। সেই সেই গানটা...”

নদীর জলে অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে পাপড়িবাই গেয়ে ওঠে... ‘যাব না করি মনে,/ মন কি মানে বাঁশি শুনে/ বাঁশিতে মন উদাসী/ হই গে দাসী শ্রীচরণে...’

২১

রাত প্রায় দশটা। অন্ধকারে ডুবে আছে চন্দননগর ফেরিঘাট। নৌকো পারাপার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবু লঞ্চঘাটে একটা গ্যাসের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। কারও জন্য যেন প্রতীক্ষা। কে সেই মহাপুরুষ, যার জন্য এত রাতে লঞ্চঘাটে আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে?

অনেক দূরে দাঁড়িয়ে নলিনী ঘোষ। ছোটখাটো চেহারা বলে, তাকে পাঠানো হয়েছে এই লঞ্চঘাটে, খবরটা সত্যি কিনা যাচাই করতে। আত্মগোপনকারীদেরও গোয়েন্দা আছে। তাদের মাধ্যমে খবর এসেছে, আজ রাতেই কলকাতা পুলিশের বিশেষ দল আসছে অমরেন্দ্রনাথ-সহ অন্য বিপ্লবীদের অ্যারেস্ট করতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নলিনী এসেছে তাই লঞ্চঘাটে। জনমানবশূন্য লঞ্চ ঘাটে একটা গাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মিশে আছে সে। এখান থেকে ঘাটের উপর সম্পূর্ণ নজর রাখা যায়।

নলিনী নিজেও আত্মগোপনকারী। জার্মান ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে এক জন। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে ধরলেও ছেড়ে কথা বলবে না। তবু সে এসেছে ফরাসি পুলিশের দেওয়া খবরটা সত্যি কি না, স্বচক্ষে দেখতে ও জানতে। একা আসেনি নলিনী। সঙ্গে এনেছে মতিলালকে। তাকে আনার উদ্দেশ্য হল সে চন্দননগরের ছেলে। চন্দননগরের রাস্তাঘাট তার নখদর্পণে। প্রয়োজনে তা কাজে লাগবে।

অনেক ক্ষণ তারা কথা বলেনি। প্রথম কথা বলল মতিলাল, “চল, ফিরে যাই। খবরটা মিথ্যে।”

মুখে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলল নলিনী। দূরে একটা লঞ্চ তার নজরে এসেছে। সে দিকে দেখিয়ে মতিলালের দৃষ্টি আকর্ষণ করল নলিনী। দু’জনেই তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টে। খানিক ক্ষণের মধ্যেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হল তাদের কাছে। লঞ্চের যান্ত্রিক শব্দও তাদের কানে আসছে।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy