ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: সভার কাজ শেষ করে যখন বিপ্লবীরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন, তখন তাঁদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন এক মাঝবয়সি শিখ। ভাল করে দেখায় প্রকাশ পেল, তিনি ছদ্মবেশী নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, আগের দিন আলোচনার মাঝে ঢুকে পড়া সেই পাগলটিও আর-এক ছদ্মবেশে নীলমণি। অন্য দিকে, বাড়িতে দুর্গাপুজো করার ইচ্ছে রমানাথের। পিতা বনমালীকে সে কথা জানালে তিনি দ্বিধায় পড়েন। কারণ ওঁদের বাড়ি থেকে মুখুজ্যেদের দুর্গাবাড়িতে অনেকখানি অনুদান যায়। রমানাথ নিজে পুজো করলে যদি তা বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে বনমালীর বন্ধু, মুখুজ্যেবাড়ির কর্তা হরিপদ মুখুজ্যে ক্ষুণ্ণ হতে পারেন। সে কথা শুনে রমানাথ পুজো করলেও অনুদান বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আশ্বস্ত বনমালী হরিপদকে সব জানিয়ে রাজি করিয়ে নেন। এরই মধ্যে এক দিন,শশিকান্তর দিদি কনকবালার পাকাদেখার জন্য ওদের বাড়িতে পাত্রপক্ষের লোকজনের সমাগম ঘটে।
শশিকান্ত চলে আসছিল। ডাকলেন ভদ্রলোক। বললেন, “তোমার হাতের লেখা কেমন?”
শশিকান্ত কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। তার হাতের লেখার প্রশংসা সবাই করে। স্কুলের মাস্টারমশাইরাও অন্য ছাত্রদের শশিকান্তর মতো হাতের লেখা লিখতে বলেন। কিন্তু সে নিজে মুখে সে কথা কী করে বলে!
ভদ্রলোক পকেট থেকে পেন ও একটি কাগজ বার করে শশিকান্তর হাতে দিয়ে বলেন, “এখানে যা খুশি চার পাঁচ লাইন লেখো।”
শশিকান্ত কাগজ ও কলমটা নিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তার পর মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে লিখল—‘উই লুক বিফোর অ্যান্ড আফটার,/ অ্যান্ড পাইন ফর হোয়াট ইজ় নট:/ আওয়ার সিনসিয়ারেস্ট লাফটার/ উইথ সাম পেন ইজ় ফ্রট;/ আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ়/ দ্যাট টেল অব স্যাডেস্ট থট।’
লেখা হয়ে গেলে কাগজটা ভদ্রলোককে ভয়ে ভয়ে ফেরত দিল শশিকান্ত।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কাগজটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক। বললেন, “অপূর্ব! সুন্দর তোমার হাতের লেখা। আমি এমন হাতের লেখা কমই দেখেছি।”
অন্যরাও দেখতে চাইলেন কাগজটা। তাঁদেরও একই অভিমত। প্রত্যেকেই প্রশংসা করলেন শশিকান্তর হাতের লেখার।
শশিকান্তর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। সে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছিল। তার হাতে তখনও ধরা ভদ্রলোকের সেফার্স কলমটি। সেটি ফেরত দিতে গেলে, ভদ্রলোক বললেন, “ওই কলমটি এখন থেকে তোমার। এটা আমার তরফ থেকে তোমাকে পুরস্কার। যত্ন করে রেখো। কলমের নিবটি সোনার।”
শশিকান্ত ভীষণ লজ্জিত হল। ওই মুহূর্তে তার ঠিক কী করা উচিত, ভেবে পেল না। নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। হাতে ধরা কলমটিকে তার ভীষণ ভারী বোধ হল। ভীষণ।
ভদ্রলোক বললেন, “কোনও কারণে কলেজে ভর্তি না হলে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমি তোমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। সাহেবরা ভাল হাতের লেখার খুব কদর করে।”
ঘর থেকে বেরিয়ে শশিকান্ত কলমটা দেখল। নিতান্তই সাদামাটা দেখতে। কলমটার ঢাকা খুলে নিবটা দেখার চেষ্টা করে শশিকান্ত। তখনই পিছনে এসে দাঁড়ায় কনকবালা। বলে, “কী দেখছিস রে?”
চমকে পিছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় শশিকান্ত। কী সুন্দর লাগছে তার দিদিকে! কনকবালাকে সে কথা বলতে, সে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বলল, “যাঃ!’’
শশিকান্ত বলল, “সত্যি তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে দিদি।”
“সে আমি সেজেছি বলে। এমনিতে তো আমি কালো,” কনকবালা হাসতে হাসতে বলে।
“সাজিস না কেন? তোর বন্ধু লাবণ্য তো কত সাজে!” বলে শশিকান্ত।
“আমার বন্ধু? সে তো এখন দিব্যি তোর বন্ধু হয়ে উঠেছে। কী ব্যাপার?”
“কী আবার ব্যাপার হবে? তোর বন্ধু বলেই কথা বলি। না হলে আমার বয়েই গেছিল কথা বলতে।”
“তাই নাকি? ঠিক আছে, লাবণ্যর সঙ্গে আড়ি করে দেব। তখন আর নিশ্চয়ই দিদির বন্ধু বলে কথা বলবি না?”
শশিকান্ত চুপ করে থাকে। উত্তর দেয় না।
কনকবালা প্রসঙ্গ বদলায়। বলে, “কী নাকি হয়েছে ও ঘরে?”
“আড়ি পেতে শুনছিলি?” হাসতে হাসতে শশিকান্ত বলে।
“আমি কেন শুনতে যাব? পিসি শুনে এসে আমাকে বলল।”
“আমার হাতের লেখার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন তোর হবু শ্বশুরমশাই। তার পর হাতের লেখা দেখে ভাল লাগায়, এই কলমটা আমাকে পুরস্কার দিলেন।”
“দেখি কলমটা।”
শশিকান্ত কলমটা কনকবালার হাতে দেয়। কনকবালা উল্টে পাল্টে দেখে কলমটাকে। তার পর বলে, “তোর নাকি চাকরিও করে দেবেন।”
“চাকরি এখন করলে তো! আমি কলেজে পড়ব দিদি,” শশিকান্ত বলে।
কনকবালা একটু চুপ করে থেকে বলে, “হ্যাঁ, বাবাও তাই চায়। সে দিন পিসিকে বলছিল। বাবা চায়, তুই অনেক লেখাপড়া করে বড় হবি। মামার মতো ব্যারিস্টার হবি।”
রান্নাঘর থেকে পিসির ডাক শুনে উঠে পড়ে কনকবালা। বলে, “যাই, এ বার ওঁদের খেতে দিতে হবে। ওই জন্য পিসি ডাকছে বোধহয়।”
কনকবালা উঠে যায়। হঠাৎ বিষাদে মনটা ভরে যায় শশিকান্তর। দিদি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে ভাবলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠছে। কার সঙ্গে ঝগড়া করবে সে? চোখের কোণটা সিক্ত হয়ে উঠছে দেখে, শশিকান্ত উঠে জানালার কাছে যায়। পশ্চিম দিকের ঘর। সূর্যদেব বিদায় নিচ্ছেন। যাওয়ার সময়ও আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। সে দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সদ্য পড়া উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল শশিকান্তর— ইট ইজ আ বিউটিয়াস ইভনিং, কাম অ্যান্ড ফ্রি,/ দ্য হোলি টাইম ইজ় কোয়ায়েট অ্যাজ় আ নান/ ব্রেথলেস উইথ অ্যাডোরেশন; দ্য ব্রড সান/ ইজ় সিঙ্কিং ডাউন ইন ইটস ট্রাঙ্কুইলিটি...
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল কনকবালার। পাত্রপক্ষের যৌতুকের দাবি যথেষ্ট বেশি থাকায় রমানাথ প্রথমটা বেঁকে বসেছিলেন। শেষে রাজি হয়ে গেলেন পাত্রের বাবা টাকার অঙ্ক একটু কম করায়। আসলে টাকাটা কথা নয়। পাটের কারবারে রমানাথের আয় অনেক। তাঁর আপত্তি যৌতুকে। ব্রাহ্ম সমাজের অনেকেই তাঁর বন্ধু। তাঁদের কাছে রমানাথ শুনেছেন, বিবাহে যৌতুক প্রদানে তাঁরা ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু রমানাথ দেখেছেন, হিন্দু পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ হলে তাঁরাও যৌতুক দিতে বাধ্য হন।
নভেম্বরে বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। আর মাত্র কয়েক মাস। দুর্গাপুজোর ঠিক পরেই। একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই আর এক অনুষ্ঠান।
১৬
আজ মহালয়া। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার দিন। রমানাথ প্রত্যুষেই গঙ্গার ঘাটে চলে গেছেন। মাতৃদেবীর উদ্দেশ্যে তর্পণ করেই তাঁকে ফিরে আসতে হবে। আজ বড়বাজারে না গেলেও বাড়িতে অনেক কাজ। চারু স্যাকরার আসার কথা আছে। কনকের চুড়ির মাপ নেবে। এ ছাড়া ম্যারাপের লোকেরা আসবে। তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। ঠাকুর দালানের সামনে ম্যারাপ বাঁধা না হলে গ্রামের লোকজনকে বসতে দেওয়া যাবে না। রমানাথের মাথায় এখন দুর্গাপুজো ও মেয়ের বিয়ে। কনকের বিয়েটা পরের বছর দিলেই ভাল হত। কিন্তু পাত্রপক্ষ রাজি নয়। নভেম্বরেই বিয়ের দিন ঠিক করলেন।
গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরে এসে রমানাথ দেখেন চারু স্যাকরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন। শরীর খুব ক্লান্ত। তাও একটু চা-জলখাবার খেয়ে চারু স্যাকরার সঙ্গে কথা বলতে বসে গেলেন।
চারু স্যাকরাকেও চা-জলখাবার দেওয়া হয়েছে। রমানাথ গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার পথে হরি ময়রার দোকান থেকে মিষ্টি এনেছেন। সেই মিষ্টিই গোটাচারেক দেওয়া হয়েছে চারু স্যাকরাকে। চারু চা আগে শেষ করে মিষ্টিতে হাত দিয়েছে। একটা করে মিষ্টি মুখে পুরছে আর প্রশস্তিসূচক মাথা নাড়ছে।
“আর কয়েকটা মিষ্টি দিক?” রমানাথ বলেন।
“খেতে তো ইচ্ছে করে, তবে কী জানো ভাই, এগুলো দৃষ্টিখিদে। এই বয়সে এত খাওয়া উচিত নয়। তোমাদের মতো বয়স হলে...’’
“আপনার আর কত বয়স! এই তো গণেশকাকা, সেদিনও নেমন্তন্ন বাড়িতে পঞ্চাশ-ষাটটা রসগোল্লা, এক হাঁড়ি দই অনায়াসে খেয়ে ফেললেন।”
“বলো কী! গণেশ তো আমার থেকেও দু’-এক বছরের বড়। না না, এটা গণেশ ঠিক করে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই কমিয়ে দিতে হয়। আমিই কি আরও খানকতক মিষ্টি খেতে পারতাম না? পারতাম। লোভ সংবরণ করলাম।”
“তা হলে, দুটো দিতে বলি?”
“তুমি যখন এত করে বলছ, না বলি কী করে? কিন্তু ওই দু’টোই... আর নয়।”
আরও দুটো মিষ্টি উদরস্থ করে, একঘটি জল খেয়ে কনকবালার জন্য চুড়ি, বালার মাপ ও অন্যান্য গয়নার বায়না নিয়ে চারু স্যাকরা যখন বিদায় হল, তখন বারোটা বাজে। ম্যারাপের লোকরা উমানাথের সঙ্গে কথা বলে ম্যারাপ বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। রমানাথ তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য যাচ্ছিলেন, এমন সময় নিভাননী এসে বললেন, “বাবার জ্বরটা আবার বেড়েছে। এক বার দেখে আয়।”
রমানাথ চিন্তিত মুখে বললেন, “জ্বর তো কমে গেছিল। আবার বাড়ল?”
বনমালীর শিয়রে এসে রমানাথ বাবাকে ডাকলেন। প্রথমে আস্তে। তার পর গলায় বেশ খানিকটা জোর দিয়ে।
কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চিন্তিত হলেন রমানাথ। ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে উমানাথকে ডাকলেন। উমানাথ পুকুরে মাছ ধরছিল। মেজদার চিৎকারে দৌড়ে এল। রমানাথ বললেন, “এখুনি কবরেজ মশাইকে ডেকে নিয়ে আয়। বাবার অবস্থা ভাল নয়।”
উমানাথ ছুটল কবিরাজকে ডাকতে। রমানাথ লম্বা দালানে পায়চারি করতে লাগলেন। বিভাবতী এক বার এসে বলেছেন, “ঠাকুরপো, চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কালীঘাটে থাকতে আমিও মাসখানেক আগে এ রকম জ্বরে ভুগেছি। ওষুধ তো পড়েনি এখনও। পড়লেই উনি সেরে উঠবেন।”
রমানাথ কোনও উত্তর দেননি। নিঃশব্দে পায়চারি করে গেছেন।
কবিরাজ মশাই এলেন আধঘণ্টা পর, “কী হল আবার বনমালী কাকার? এই তো সে দিন আমার সঙ্গে কত কথা কইলেন,” বলতে বলতে লম্বা দালান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পিছনে রমানাথ ও উমানাথ।
বনমালীর শয্যার পাশেই একটি চেয়ার দেওয়া হয়েছে অবিনাশ কবিরাজের বসার জন্য।
অবিনাশ কবিরাজ বনমালীর একটা হাত নিজের হাতে নিলেন। নাড়ির গতি বোঝার চেষ্টা করলেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। তার পর ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “এক ঘণ্টা পর আমার বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ো। আমি ওষুধ তৈরি করে দেব। এখন মাথায় জলপট্টি দাও।”
রমানাথ কবিরাজ মশাইয়ের পিছন পিছন আসছিলেন। বললেন, “কী মনে হয় আপনার?”
কবিরাজ মশাই দাঁড়ালেন। বললেন, “ভাল নয়। নাড়ির গতি খুব ক্ষীণ। যে কোনও মুহূর্তে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। তবু আমাকে চেষ্টা করতে হবে।”
হনহন করে চলে গেলেন অবিনাশ কবিরাজ।
রমানাথ বিমূঢ় ভাবে সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি অন্য ডাক্তার দেখাব।”
কাছেই দাঁড়িয়েছিল উমানাথ। বলল, “অবিনাশ কবিরাজ তো ওষুধ দিচ্ছে। দেখা যাক না।”
“অবিনাশের ওষুধ শশী গিয়ে নিয়ে আসবে। তুই কলকাতায় চলে যা। প্রতাপ ডাক্তারকে কল দে...” রমানাথ বললেন। তাঁর মুখে চিন্তার ছাপ।
“উনি তো খুব বড় ডাক্তার। এত দূর আসবেন?”
“তুই গিয়ে বড়দার নাম করবি। ওঁর বয়স হয়েছে। টানা মোটর গাড়িতে নিয়ে আসবি।”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy