বিস্মৃত: সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরাধীন ভারতের দেশীয় রাজ্য নওয়ানগরের প্রশাসকরা ক্রিকেটে খুব আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা ১৯৩৬-৩৭’এর রঞ্জি ট্রোফিতে দল নামান। প্রশাসকদের লক্ষ্য ছিল, আবির্ভাবেই রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। এর আগে শুধু বম্বে ১৯৩৪-৩৫ সালে প্রথম বারের জন্য রঞ্জিতে খেলতে নেমেই খেতাব জিতেছিল।
ট্রোফি জেতার জন্য মরিয়া এই রাজ্য বুদ্ধি করে দল সাজালেন। তখনকার অন্যতম সেরা ভারতীয় ফাস্ট বোলার অমর সিংহকে দলে নিলেন। দক্ষ অলরাউন্ডার বিনু মানকড়ও দলে ছিলেন। ওই দলে তিন রাজকুমার খেলতেন— ইন্দ্রবিজয় সিংজি, রণবীর সিংজি এবং যাদবেন্দ্র সিংজি। ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলা অ্যালবার্ট ফ্রেডারিক উইন্সলে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেলেন।
নওয়ানগর প্রথম বার রঞ্জি খেলতে নেমে ফাইনালে উঠল। ও দিকে ওই মরসুমেই বাংলাও দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে উঠেছিল। বাংলা এবং নওয়ানগরের মধ্যে ওই ফাইনাল ম্যাচ হয় মুম্বইয়ের ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে। সে বার বাংলাকে যিনি সবচেয়ে ভরসা জুগিয়েছিলেন, তিনি হলেন ক্রিকেটার সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতৃদত্ত নাম শরদিন্দুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও, উনি সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই বেশি পরিচিত। ১৯১১ সালের ৩ অক্টোবর কলকাতায় জন্ম। কঠোর পরিশ্রমী সুঁটে ছিলেন বোলিং-অলরাউন্ডার। চমৎকার মিডিয়াম-ফাস্ট বলে কঠিন পরিস্থিতিতে উইকেট নিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আবার ব্যাট হাতেও দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, জয়ের রাস্তাতেও পৌঁছে দিয়েছেন।
নওয়ানগরের কর্তারা বুঝতে পারলেন, শরদিন্দু ফাইনালে খেললে তাঁদের ট্রোফি জেতা প্রায় অসম্ভব, কারণ সে বার শরদিন্দু দুর্দান্ত ফর্মে। তখনই ওই কর্তারা অন্য একটা খেলা খেললেন। ফাইনালের আগের দিন নওয়ানগরের কর্তারা সুঁটেকে পাকা চাকরির প্রস্তাব দিলেন। সেই চাকরি শর্ত ছিল, সুঁটেকে ওই দিনই চাকরিতে যোগ দিতে হবে এবং উনি আর বাংলার হয়ে ফাইনালে খেলতে পারবেন না! শরদিন্দু দীর্ঘ দিন বেকার ছিলেন এবং ওঁর একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। নওয়ানগরের প্রস্তাব পেয়ে উনি প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু খালিপেটে যে বেশি দিন জোরে বল করা যায় না! শেষ পর্যন্ত উনি চাকরিটাই নিলেন। ওঁর আর সে বার রঞ্জি ট্রোফির ফাইনাল খেলা হল না। এবং এ ভাবেই বাংলার হয়ে ওঁর খেলার সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে গেল! সুঁটের সিদ্ধান্তে বাংলার তৎকালীন ওলন্দাজ অধিনায়ক পল ভ্যান ডার গুস্ট হতভম্ব হয়ে গেলেন। দলের প্রধান অস্ত্র হারিয়ে ফাইনালের জন্য বাংলার যাবতীয় নীলনকশা তছনছ হয়ে গেল। এই সুযোগে নওয়ানগর রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। এই দেশীয় রাজ্যের ক্রিকেটকর্তারা গর্ব করতেন যে, তাঁরা খুবই ন্যায়নিষ্ঠ এবং স্বচ্ছ। তাঁরা যে ভাবে সুঁটেকে বাংলা দল থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তাতে এ কথার ‘সত্যতা’ যথার্থই প্রমাণিত হয়। আসলে সেই সময়ে রঞ্জির নিয়মকানুনে ফাঁকফোকর ছিল বলেই নওয়ানগরের কর্তারা এই ‘মাস্টার স্ট্রোক’ খেলতে পেরেছিলেন। আবার বাংলার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত একাংশের কাছে সুঁটে হয়ে গেলেন স্বার্থপর এবং সুবিধেবাদী। কিন্তু সেই সব সমালোচক কোথায় ছিলেন, যখন শরদিন্দু বাংলার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েও বেকারত্বের জ্বালায় দিনের পর দিন ছটফট করছিলেন?
আরও ন’বছর পরের কথা। সালটা ১৯৪৬। তখনও ভারত ব্রিটিশ শাসনাধীন। এ রকম পরিস্থিতিতে ভারতীয় ক্রিকেট দল ব্রিটিশভূমিতে খেলতে গেল। ওই বছর মে মাসে ভারত ওভাল ক্রিকেট ময়দানে দক্ষিণ পূর্ব ইংল্যান্ডের কাউন্টি ‘সারে’-র মুখোমুখি হয়েছিল। ওভাল হল ‘সারে’-র ঘরের মাঠ। উপস্থিত দর্শকরা ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই বিনোদনের স্বাদ পেতে চাইছিলেন। ও দিকে ভারতীয়রা প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ের কবলে পড়ল। তারা ২০৫ রান তুলতেই ন’টা উইকেট হারাল। শেষ খেলোয়াড় হিসেবে সুঁটে ব্যাট করতে নামলেন। ‘সারে’-র অধিনায়ক নাইজেল বেনেট চোখ ছোট করে সুঁটেকে এক বার মেপে নিলেন। এবং বুঝে গেলেন, সুঁটে দু’-চার বলে খদ্দের! তা ছাড়া অন্য আর এক জন ব্যাটার যিনি ক্রিজ়ে রয়েছেন, তিনিও ব্যাট হাতে কাঁচা, সেই চাঁদু সারওয়াটেই বা কত ক্ষণ টিকবেন! ‘সারে’-র অধিনায়ক তখনই গ্রাউন্ডসম্যানদের পিচটা রোল করতে বললেন। কারণ নাইজেল তো ধরেই নিয়েছেন যে কিছু ক্ষণের মধ্যেই ‘সারে’ ব্যাট করতে নামবে। ও দিকে সুঁটে সারের অধিনায়কের চোখ-মুখে লেগে থাকা তাচ্ছিল্যের ভাষা পড়তে পেরেছিলেন। শাসকগর্বে গর্বিত ইংরেজ শাসিত ভারতীয়কে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সুঁটে ব্যাটিংয়েই মন দিলেন। এবং খুব তাড়াতাড়ি উনি হরেক রকমের স্ট্রোক খেলতে শুরু করলেন। ইংরেজ বোলারদের যাবতীয় কারিকুরি থমকে গেল। সুঁটের ব্যাটিং পার্টনার সারওয়াটেও ব্যাট হাতে পাল্টা আক্রমণ ফিরিয়ে দিলেন। এ দিকে সুঁটের নিখুঁত ব্যাটিং দেখে ‘সারে’-র ক্রিকেটাররা হতবাক হয়ে গেলেন। সবার শেষে ব্যাট করতে নেমে এক জন এত ভাল ব্যাট করতে পারে! আর অধিনায়ক নাইজেল তো রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েন! সারওয়াটে সেঞ্চুরি (অপরাজিত ১২৪) করলেন, কিন্তু সুঁটেও পিছিয়ে রইলেন না। এই বঙ্গসন্তানের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১২১) ইংরেজদের যাবতীয় প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছিল। ওঁর ওই অনবদ্য ব্যাটিং যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল যে এক জন বিজ্ঞানীর নিখুঁত পরিকল্পনার সঙ্গে এক শিল্পীর তুলির টান মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এমনকি যে সব সারের সমর্থক নিজেদের প্রিয় দলের জয় দেখতে এসেছিলেন, তাঁদের একাংশ সুঁটের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সে দিন এই বাঙালি ক্রিকেটারের ব্যাটিংয়ে সাহসিকতা এবং দৃঢ়তা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। চাঁদু এবং সুঁটের যথাক্রমে ১০ এবং ১১ নম্বরে নেমে একই ম্যাচের একই ইনিংসে করা সেঞ্চুরি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক অনন্য রেকর্ড। ওঁদের যুগলবন্দিতে মাত্র তিন ঘণ্টা দশ মিনিটে ২৪৯ রান উঠে গিয়েছিল! চাঁদু-সুঁটের এই আক্রমণে সারে দল দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ভারতীয়রাই অ??????? ?? নায়াসে নয় উইকেটে ম্যাচটা জিতলেন।
১৯৩৬ সালে ভারত যখন বিলেত সফরে গিয়েছিল, তখন সেই দলেও শরদিন্দু ছিলেন। সে বার ওই ওভাল ময়দানেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওঁর টেস্টে অভিষেক হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের লেখা ‘উইকেটস ইন দ্য ইস্ট’ বইটা পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ষড়যন্ত্র করে সুঁটের জায়গায় বাকা জিলানিকে খেলানো হয়েছিল! অথচ যোগ্যতা এবং সেই সময়ের ফর্মের ভিত্তিতে উনি বাকার থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তখন উনি সুযোগ পেলে ওঁর কেরিয়ার আলাদা দিশা পেতে পারত। সেই ওভালেই শরদিন্দু ব্যাট হাতে ‘সারে’-র বিরুদ্ধে ইতিহাস সৃষ্টি করে সেই চক্রান্তের উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর অপেক্ষা করার পর ১৯৪৮-৪৯-এর মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলার সুযোগ পান। উনি পঞ্চম বলেই উইকেট তুলে নেন এবং ওই ম্যাচে পাঁচ উইকেট পান। অথচ এর পরেও ওটাই ওঁর প্রথম এবং শেষ টেস্ট ম্যাচ হয়ে যায়! অর্থাৎ একটি মাত্র টেস্ট খেলেই সুঁটের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ‘ওয়ান-টেস্ট ওয়ান্ডার’ শরদিন্দুর প্রাপ্য উইকেট সংখ্যা ৩৮১। রান ৩৬৭১। উনি বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রেলীয় এবং ব্রিটিশ দলগুলোর বিরুদ্ধে বেসরকারি টেস্টে সাফল্য পেয়েছেন। যখন টিম ইন্ডিয়া ম্যানেজমেন্ট বিভিন্ন সময়ে উপযুক্ত বোলিং-অলরাউন্ডার খুঁজেছে, তখন গত শতাব্দীতেই সুঁটের মতো এক জন বোলিং-অলরাউন্ডারকে জাতীয় দলে কাজে লাগানো হয়নি! যেখানে ওঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ার উপন্যাস-তুল্য হতে পারত, সেখানে তা শুধুই একটা অণুগল্পের মতো সংক্ষিপ্ততায় থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল! ১৯৮০ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতায় প্রয়াত সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভার প্রতি কোনও দিনই সুবিচার হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy