মীনক্ষেত্র: খুঁটি পুঁতে মাছ ধরা থেকে মাছ শুকোনোর এলাকা— এই সবটা নিয়ে ‘খটি’ নির্মাণ হয়।
বকখালি চিরকালই পর্যটকদের খুব প্রিয় জায়গা। আর যেখানে বাইরের লোক বেশি, সেখানেই টোটো কিংবা ভ্যানওয়ালাদের ভিড়। আর সঙ্গে নব্য ইউটিউবারের দল। নানা রকমের ভিডিয়ো তাদের চাই। এলাকার টোটো ও ভ্যানওয়ালারা এই সবের ভরপুর ফায়দা তোলেন। নানা উদ্ভট গল্প তৈরি করেন তাঁরা। যেমন বকখালির এক জায়গার নাম কালীস্থান।
“স্থানীয় এক টোটোচালক এক ইউটিউবারকে বললেন, ‘বহু দিন আগে এখানে কালী ঠাকুরকে নদী থেকে উঠে এসে গাছের মধ্যে মিলিয়ে যেতে দেখেছিলেন এক বৃদ্ধ মানুষ। গাছটা নদীতে ভেঙে পড়ে গেছে। তবে স্থানটার নাম এখনও আছে। আর ওই যেখানে গভীর জল আছে, সেখানে গাছটা ছিল।’ ইউটিউবার বাচ্চা ছেলেটি মনের আনন্দে সেই সব কথা হাঁ করে গিলছিল আর রেকর্ড করছিল। কী আর বলি!” এই বলতে বলতে একটা বিড়ি ধরালেন শিশুরঞ্জন দাস। বালিয়ারা ফ্রেজারগঞ্জের খটির মালিক। এক নামে ‘শিশুবাবু’কে সবাই চেনেন। ধার্মিক মানুষ। তা ছাড়াও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়েছিলেন, যখন বন দফতর তাঁদেরকে জম্বু দ্বীপ থেকে উৎখাত করে। তার পর তিনি আসেন এই বালিয়ারাতে। আজ শিশুবাবুর খটিতে রাতের খাওয়ার নিমন্ত্রণ। খটির লোকেদের বিশ্বাস, বাইরে থেকে যে-ই আসুক না কেন, খালি মুখে খটি থেকে ফেরা যাবে না। কিছু না কিছু খেতেই হবে। শুঁটকি মাছের গন্ধ নাকে আসছে। মেনুতে ভাতের সঙ্গে রয়েছে টাটকা ইলিশ মাছ ভাজা। আর তার সঙ্গে ‘নোনা মাছের ঝাল ঝুলুই’। সমস্ত মশলা বেটে মাছের সঙ্গে মাখিয়ে খুব ঢিমে আঁচে তৈরি হয় এই পদ। তবে এই রান্নাতে মাছটা ধোওয়া হবে সমুদ্রের নোনা জলে। কাজেই রান্না করা এই মাছের একটা অদ্ভুদ ‘ঝাল নোনতা’ স্বাদ হয়।
পরের দিন দুপুরে আমরা কালীস্থানের লয়ালগঞ্জে। পায়ে হেঁটে নদী পেরোতে হল। এখানে নৌকোর কোনও ব্যবস্থা নেই। জোয়ারের জলের সময় ডোঙা নৌকো চলে। বাকি সময় হাঁটু পর্যন্ত পা ভিজিয়ে পৌঁছতে হয় এই লয়ালগঞ্জের দ্বীপে। আজকের দুপুরের নিমন্ত্রণ অমল সেন দাসের খটিতে। সুন্দরবন এলাকার খটিগুলো পরিচিত ‘শাবার’ নামে। আর খটির মালিকরা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘বহরদার’ নামে। বহরদারেরা একটা গামছাকে পাগড়ির মতো করে পরে থাকেন বেশির ভাগ সময়। যাতে তাঁদের খটির মালিক হিসেবে চেনা যায় খুব সহজে। অগভীর সমুদ্রের ভিতর দুটো খুঁটি পুঁতে জাল পেতে মাছ ধরা হয়। এই খুঁটিটাকে মৎস্যজীবীরা বলেন ‘ফারা’। আর যেটা দিয়ে খুঁটিটাকে গাঁথা হয়, তাকে বলে ‘দুম’। সমুদ্রের বসানো জাল থেকে ধরা মাছ আনা হয় একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। তার পর সেই মাছগুলোকে হুকে গেঁথে রোদে শুকনো হয়। খুঁটি পুঁতে মাছ ধরা থেকে মাছ শুকোনোর এলাকা— এই সবটা নিয়ে ‘খটি’ নির্মিত হয়। শুঁটকি মাছ তৈরি করার এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি। প্রতিটি শাবারে মালিকের অধীনে থাকে বেশ কয়েকটা নৌকো, মাঝি, মৎস্যজীবীরা। আর মাছ বাছাইয়ের জন্য থাকে ‘বাছুনি’। মাছ শুকোনোর জন্য থাকে ‘শুকুনি’। এই দুটো কাজ দিনের নির্দিষ্ট সময়ে খটিতে এসে আশপাশের এলাকার স্থানীয় মেয়েরা করেন। খটিগুলো সমুদ্রের ধারে বসে অক্টোবর মাসের শেষ থেকে। আর তা চলে জানুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত। এই সাড়ে তিন মাস খটিগুলোর মরসুম।
খটিগুলোয় টানা থাকতে হয় বলে, খটিতে তৈরি হয় ছোট্ট একটা অস্থায়ী সংসার। সেখানে যেমন শোওয়ার, বসার, জাল রাখার ঘর থাকে, তেমনই থাকে রান্নাঘর আর ঠাকুরঘর। হোগলার ডাল, বাঁশ আর বিচুলি দিয়ে বানানো হয় ঘরগুলো। বড় খটিগুলোতে রান্নাঘরে রান্না করার জন্য থাকেন এক জন রাঁধুনি ঠাকুর। খটির রান্নাঘরকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় ‘রানন ঘর’। রাঁধুনি নানা রকম পদ রান্না করেন, তবে প্রতিদিন কম করে দু’রকম মাছের পদ তো থাকবেই। খটিতে মাছের একটি বিশেষ পদ হল ‘টবকা’। পেঁয়াজ, টমেটো, আদা, রসুন, গোলমরিচ, লঙ্কাবাটা, সর্ষের তেল কাঁচা মাছে ভাল করে মাখিয়ে কিছুটা জল দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় উনুনে। তার পর ভাল করে কষিয়ে নিয়ে তৈরি হয় টবকা। রান্না শেষ হলে উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ধনেপাতা। খটিতে কাঠের উনুনেও রান্না হয়, আবার গ্যাসের উনুনের ব্যবস্থাও রয়েছে। টবকাতে ঝাল হয় মারাত্মক। কাঁচা মাছ রান্না করা হয় তেঁতুলগোলা টক দিয়ে। এর নাম মাছের টক। সঙ্গে সামান্য কাঁচা পেঁয়াজও থাকে। মাছের মধ্যে রুই-কাতলা মাছ তো থাকেই। তা ছাড়াও নিহারি মাছ, গোলমা মাছ, আমোদি মাছ, ভোলা মাছ, চাকলে মাছ রান্না হয় খটির রান্নাঘরে। আর শুঁটকির মধ্যে লাল পাতা ও বোমলা (বা লোটে) মাছের শুঁটকির কোনও তুলনা হয় না। ভাল করে গরম জল দিয়ে ধুয়ে নিলে এই শুঁটকির স্বাদ অপূর্ব। তবে এই রান্নাতে ঝাল আর তেলটা থাকে চড়া।
রান্নাঘরের সঙ্গে ঠাকুরঘরের কথাও বলতে হয়। খটির ঠাকুরঘরটি দেখার মতো। প্রতিটি খটিতে ঠাকুরঘর তৈরি করা হয় খটির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। ঠাকুরঘরে মা গঙ্গা, ভগীরথ, নারায়ণ, লক্ষ্মী, কপিলমুনি, মনসা সকলেই পুজো পান। ঠাকুরঘরের পাশে আর একটা ছোট্ট ঘর থাকে। সেখানে একটা কলাপাতায় পান, ফুল, খই, হাঁসের ডিম, সিঁদুর দিয়ে ধূপ-প্রদীপ জ্বেলে মা গঙ্গা ও তাঁর মীনসন্তানদের উদ্দেশে পুজো দেওয়া হয়। সমুদ্রে জাল নিয়ে যাওয়ার আগে দেওয়া হয় এই পুজো। সমুদ্রে জাল দিয়ে মাছ ধরাকে খটির মৎস্যজীবীরা বলেন ‘জাল মারা’। আর জাল সমুদ্রে ছিঁড়ে ফেটে গেলে সারানোকে বলে ‘মালি দেওয়া’। আবার মাছ ধরা শেষ করে যখন সমুদ্র থেকে ফিরে আসা হয়, তখন সাগরের জলে কলাপাতায় ধরা পান, ফুল, খই, হাঁসের ডিম, সিঁদুর ভাসিয়ে দিয়ে আসা হয়।
খটির মৎস্যজীবীদের নানা রকমের বিশ্বাস রয়েছে। নবমীর দিন কেউ মাছ ধরতে বেরোবেন না। তবে চট্টগ্রামের যে সব মৎস্যজীবী আছেন, তাঁরা নবমীর দিন পুজো করেন। আবার সেই দিন যাত্রা করে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করেন, বিন্দি জাল যে হেতু প্রথম চট্টগ্রামে তৈরি হয়েছে, তাই তাদের নবমীর দিন মাছ ধরতে যেতে কোনও দোষ নেই। মাকাল ঠাকুরের পুজো করে বাড়ি থেকে যখন খটির দিকে মৎস্যজীবীরা রওনা হন, তখন পথে যতগুলো বট ও অশ্বত্থ গাছ পড়বে, সবগুলোকে তাঁরা পুজো করবেন। আর নদী বা সমুদ্রের ধারে গিয়ে করবেন গঙ্গা পুজো।
খটির ‘বহরদার’ যখন ফেরেন তখনও কিছু নিয়ম পালন করা হয়। মরসুম শেষে মাছ ধরা শেষ করে যখন নৌকোগুলো সমুদ্র থেকে ফেরে, কুলো ও টাকা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নৌকোকে। কাকদ্বীপের অক্ষয়নগরের মাঝবয়সি বহরদার কার্তিক দাস বলেন, “নৌকো হল সওদাগরি ব্যবসার প্রতীক। একের বেশি নৌকো থাকাকে বলে বহর। তাই আমরা বহরদার।” সব সময় একটা বাক্স থাকে বহরদারের সঙ্গে। সেই বাক্সের নাম ‘সওদাগরি বাক্স’। খটির এক জন মাঝি মাথায় করে ‘সওদাগরি বাক্স’ খটি থেকে পৌঁছে দেন বহরদারের বাড়িতে। মাঝি ও বাক্সকে বরণ করে ঘরে তোলে বহরদারের বাড়ির মেয়ে-বৌ। তার পর খটি থেকে একে একে সব কিছু ফেরে। মা গঙ্গাকে তাঁরা কানে কানে বলে যান, তিনি যেন তার মাছ সন্তানদের বুকে করে আগলে রাখেন, যাতে সামনের বছর অনেক মাছ ওঠে। তবে তা আর হচ্ছে কোথায়! সমুদ্রের দূষণ, ছোট ফাঁসের জালের ব্যবহার, আর ট্রলিং-এর ফলে মাছ ক্রমশ কমে যাচ্ছে সমুদ্র থেকে। দ্রুত মীনসন্তানদের হারিয়ে দিনে দিনে রিক্ত হচ্ছেন মা গঙ্গা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy