Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
God

বিপদসঙ্কুল নদী-সমুদ্র ও মৎস্যজীবীদের দেবদেবী

আছেন মাকাল দেবতা, বদর পীর, খোয়াজ খিজির, অজু গোসাঁই, কৈমারী ঠাকুরের মতো অনেকে। এই সব লৌকিক দেবদেবীর স্মরণে জলে আপদ-বিপদ হয় না, ধরা পড়ে প্রচুর মাছও।

বিগ্রহ: মৎস্যবাহন ঝুলেলাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

বিগ্রহ: মৎস্যবাহন ঝুলেলাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

সুপ্রতিম কর্মকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:১২
Share: Save:

মর্ত্যলোকে জলের অধিপতি, সাগরের অধীশ্বর বরুণ দেবতা। পুরাণের বিবরণ অনুযায়ী বরুণদেব পাশহস্ত, মহাবলশালী, শঙ্খ ও স্ফটিকের মতো শুভ্রবর্ণ, শুভ্রহার ও বস্ত্র পরিহিত, মৎস্য-আসনে উপবিষ্ট শান্ত এবং কিরীট ও অঙ্গদধারী।

সিন্ধিদের এক দেবতার সঙ্গে বরুণদেবের অদ্ভুত মিল। সিন্ধিরা বিশ্বাস করেন, বরুণ দেবতার অবতার তাঁদের ঝুলেলাল। সিন্ধিদের বিশ্বাস, একমনে ঝুলেলালকে ডাকলে তীরে পৌঁছে যাবে নৌকো, অর্থাৎ বিপদ থেকে উদ্ধার মিলবে। ঝুলেলালের বাহন ইলিশ। সিন্ধিরা ইলিশকে ‘পাল্লা’ বলে। তাদের বিশ্বাস, পাল্লা যখন আরব সাগরে থাকে, তাদের গায়ের রং থাকে কুচকুচে কালো। উজান বেয়ে যত তারা মুর্শিদ ঝুলেলালের থানের দিকে এগোয়, তত তার গায়ের রং উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সিন্ধু নদ বেয়ে পাকিস্তানে সিন্ধদের বাসস্থান থাট্টাতে পৌঁছে যায় ইলিশ। তার পর ঝুলেলাল গুরুর থানে মাথা ঠেকিয়ে সে আবার যাত্রা করে আরও উজানে। পঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত পাল্লা ছুটে যায় নদীর পথ ধরে। সিন্ধদের কাছে ইলিশ দেবতুল্য। ইলিশকে তাই কাটে না সিন্ধরা। আস্ত ইলিশ মশলা মাখিয়ে কড়াইতে রান্না হয়।

বরুণ এবং ঝুলেলাল ছাড়াও জল ও মাছের জন্য রয়েছেন আরও অনেক লৌকিক দেবদেবী। তাঁদের অন্যতম, মাকাল দেবতা। এঁর পুজো দেখা যায় হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর ও সুন্দরবনে, জলাশয়ের ধারে। মাটির তিনটি ছোট ঢিপি তৈরি করা হয়। তার পর তিরকাঠি ও লাল সুতো দিয়ে চার দিক ঘিরে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বকরা গাছ কেটে মাকাল ঠাকুরের চার পাশে পুঁতে দেওয়া হয়। হেঁতাল গাছকে মৎস্যজীবীরা বলে বকরা গাছ। ফুল দিয়ে ঢিপিগুলোকে সাজানো হয়। এই ঢিপিগুলোই মাকাল ঠাকুর। মাকাল ঠাকুরের সামনে বানানো হয় কুমিরের মূর্তি। জেলেরা নিজেরাই মাকাল দেবতার পুজো দেন, পুজোয় পুরোহিত লাগে না। মাকাল ঠাকুরের পুজোর পর অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে হয়। মৎস্যজীবীরা শিয়ালের ডাকের অপেক্ষায় থাকেন। শিয়াল ডাকলে তাকে ‘শাঁখ ডাকা’ বলে। শিয়ালের ডাককে শুভ মনে করা হয়। শিয়ালের ডাক শোনার পরেই মৎস্যজীবীরা পুজো করা জালের এক ধারে ফলমূল আর পান-সুপারি বেঁধে দেন। তার পর মাছ ধরতে যাওয়ার জালগুলো নৌকোয় তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়। তাঁদের বিশ্বাস, মাকাল ঠাকুর খুশি হলেই জালে ওঠে অঢেল মাছ। নদী বা সমুদ্রে কোনও বিপদ হয় না।

মাঝিমাল্লারা নদী কিংবা গভীর সমুদ্রে বদর পিরের নাম করেও পাড়ি জমায়। বদর পিরকে নদী ও নৌকোর অভিভাবক বলে ভাবেন মৎস্যজীবীরা। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, “বদর বদর গাজী, মুখে সদা বলে মাঝি।” শাহ বদর জন্মেছিলেন মিরাঠাবাদে। জনশ্রুতি আছে, শাহ বদর একটা পাথরের উপর বসে ভাসতে ভাসতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। ভক্তরা বদর পিরের নামে হাজত, মানত ও শিরনি দেয়। ঢাকার কাছে সোনারগাঁয়ে পাঁচ পিরের যে মাজার আছে, সেখানে বদর পির শায়িত। মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার সময় মাঝদরিয়ায় ঝড়জলে নৌকো আটকে পড়লে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বদর পিরের দোহাই দেওয়া হয়। তিনি জলের বিপদ থেকে বাঁচান। চট্টগ্রামে বদর পিরের দেবত্ব নিয়ে একটি গান পাওয়া যায়— “ওরে নইরে নইরে নইরে ডর/ আল্লা নবী পাঁচ পির বদর বদর। / ওরে ঝড় তুফালে নাইরে ভয়/ সামনে চালাইলাম রে নাও/ আল্লা নবী পাঁচ পির বদর বদর।”

বদর পির ছাড়াও আছেন খোয়াজ খিজির। ইহুদিদের এলিজা ও মুসলিমদের ইলিয়াস নবি পরবর্তী সময়ে রূপক চরিত্র খোয়াজ খিজিরে পরিণত হন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সুফি দরবেশ ইব্রাহিম ইবন আদম প্রথম খোয়াজ খিজিরের অলৌকিকত্ব প্রকাশ করেন। আবার ঢাকার মোগল সুবেদার মুকরম খান খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশে ‘বেরা উৎসব’ চালু করেন। পরে মুর্শিদকুলি খান জাঁকজমক করে পালন করেন বেরা উৎসব। বাংলার গ্রামগঞ্জের মানুষেরা খোয়াজ খিজিরকে ‘দরিয়ার মালিক’ বা নদীর মালিক বলে বিশ্বাস করেন। খোয়াজ খিজিরকে ‘জিন্দা পির’-ও বলা হয়। বিশ্বাস করা হয়, নদী বা গভীর সমুদ্রে টানা চল্লিশ দিন থাকলে খোয়াজ খিজিরের দর্শন পাওয়া যায়।

খোয়াজ খিজির কেন জলে থাকেন, তা নিয়ে একটা গল্প পাওয়া যায়। এই গল্পের প্রচলন মূলত ময়মনসিংহে। খোয়াজ খিজিরের তখন মাত্র দু’মাস বয়স। তখন তাঁর একটা বড় মৃত্যুফাঁড়া ছিল। এ কথা জানিয়েছিলেন এক দরবেশ। জীবনহানির এই ফাঁড়া থেকে বাঁচার উপায়ও জানিয়েছিলেন সেই দরবেশ। সেই মতো দু’মাসের দুধের শিশু খোয়াজ খিজিরকে এক যুবতী কন্যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রীর বয়স বেশি দেখে লোকে নিন্দা করত। সেই শুনে সেই যুবতী স্ত্রী শিশু খোয়াজ খিজিরকে নদীর জলে ফেলে দেয়। ঠিক সেই সময় শিশু খোয়াজ খিজির ভাসতে ভাসতে একটা ভেলার উপর উঠে পড়েন। তার পর তাঁর যুবতী স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আর মাত্র আড়াই দিন অপেক্ষা করলে সে ধনী হয়ে যেত। এই শুনে যুবতী স্ত্রী মনের দুঃখে জলে ঝাঁপ দেয়। সেই দিন থেকে খোয়াজ খিজির ও তাঁর স্ত্রী এক সঙ্গে জলে বাস করে। মাছ ধরতে যাওয়ার সময় মৎস্যজীবীরা খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশে মানত করে, যাতে তাঁরা মাছ পান, নদী বা সমুদ্রে বিপদে না পড়েন।

ভারতের ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে মৎস্যজীবীরা পুজো করেন কানি আম্মিকে। ওড়িশার গঞ্জাম স্টেশন থেকে কিছুটা দূর এগোলেই পড়ে কানি আম্মি দেবীর মন্দির। ইনি মাছেদের দেবতা। খুব রাগী দেবী। অনেক উগ্র আকারের ছোট ছোট পাথরের মুখ মেটেসিঁদুর মাখিয়ে এক সঙ্গে পুজো করা হয়। কানি আম্মির পুজোয় মদ ও মুরগির রক্ত লাগে। কানি আম্মিকে মৎস্যজীবীরাই পুজো করেন। লোকবিশ্বাস, কানি আম্মিকে পুজো করে সন্তুষ্ট করলে সমুদ্রে গিয়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বিপদ-আপদ হয় না মৎস্যজীবীদের।

পুকুর খালবিলে নদীতে ছিপ দিয়ে যাঁরা মাছ মারেন তাঁদের মৎস্যশিকারি বা ‘অ্যাংলার’ বলা হয়। হুগলির সিঙ্গুর, নদিয়ার চাকদহ, হাওড়ার জনাই এলাকার মৎস্যশিকারিরা জলে ছিপ ফেলার আগে অজু গোসাঁই-এর পুজো করেন। অজু গোসাঁইয়ের কোনও ছবি বা মূর্তি নেই। কল্পনা করা হয়, পুকুর-খাল-বিলে থাকা মাছেদের দেবতা তিনি। যে জায়গায় বসে মাছ ধরবেন মৎস্যশিকারিরা, তার ডান দিকে অজু গোসাঁইবাবার স্থান। একটা বিড়ি আর একটু গাঁজা অজু গোসাঁইয়ের নামে নিবেদন করতে হয় পুকুর বা জলাশয়ের পাড়ে। তার পর একটু জল নিয়ে তাঁর বসার জায়গাটি মুছে দিতে হয়। এর পর প্রণাম করে ‘জয় গোসাঁই অজু গোসাঁই, কিলবিলিয়ে মাছ আয়’ বলে জলে ছিপ ফেলতে হয়। লোকবিশ্বাস, অজু গোসাঁইকে সন্তুষ্ট করলে ছিপে বড় মাছ ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

এ ছাড়াও রয়েছেন মাছেদের দেবতা পঠুয়াডাঙি ঠাকুর। এই ঠাকুরের বাহন ঘোড়া। ময়নাগুড়ি থানার চাতরাপাড় গ্রামে এই দেবতার থান। এই থানের পাশে রয়েছে একটা বড় বিল। ইনি মূলত উত্তরবঙ্গের জনজাতিদের দেবতা। এই দেবতার পুজোর জন্য দুধ-কলা ও নৈবেদ্য লাগে। এই দেবতার থানে মানত করলেই নাকি জল থেকে মাছ পাওয়া যায়, এমন লোকবিশ্বাস রয়েছে।

ময়নাগুড়ি এলাকায় কৈমারী ঠাকুর নামে এক দেবতা পুজো পান। ইনিও মাছের দেবতা। কইমাছ এই দেবতার বাহন। লোকবিশ্বাস, এই দেবতার পুজো দিয়ে মাছ ধরতে গেলে প্রচুর মাছ জালে ওঠে।

অগভীর সমুদ্রে জাল পুঁতে মাছ ধরা ও সেই মাছ সমুদ্রসৈকতে শুকোনোর অস্থায়ী ঘাঁটিগুলোকে ‘খটি’ বলে। খটির মৎস্যজীবীরা এক সঙ্গে জড়ো হয়ে টগরিয়া দেবীর পুজো করেন। পুজোর শেষে একটা মুলি বাঁশ আনা হয়। সেই বাঁশকে খটির কাছে স্থানীয় মন্দিরে রাখা হয়। বাঁশটিকে রোজ ধূপ-দীপ দেখিয়ে পুজো করা হয়। লোকবিশ্বাস, টগরিয়া পুজো করলে খটিতে ভাল মাছ ওঠে, আর সমুদ্রে বিপদও হয় না।

তবে জলের দূষণ এবং প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘনজনিত সমস্যা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে আর কত দিন মাছ পাওয়া যাবে, তাতে সন্দেহ আছে।

অন্য বিষয়গুলি:

God Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy