শারদীয়া: বহিরগাছির টোলবাড়িতে অন্যতম ভোগ ইলিশের তেলমাছ।
গঙ্গা এখান দিয়ে বয়ে যেত। এখন সরে গিয়েছে অনেক দূরে। রেখে গিয়েছে তার ছেড়ে যাওয়া পথ। এই পথ আজ গুড়গুড়ে খাল নামে পরিচিত। এই স্থান এক প্রাচীন জনপদ, নাম মুড়াগাছা। এর পাশেই বহিরগাছি গ্রাম। এখানেই ভট্টাচার্য বাড়ি। এক বাড়িতে এখানে ছ’টি দুর্গা এক সঙ্গে পূজিতা হন। বাংলার কোথাও এমন পুজোর সচরাচর দেখা মেলে না। এই ভট্টাচার্য পরিবার যশোর জেলার সারল গ্রামের ছান্দর বংশোদ্ভূত। এই বংশের রঘুরাম সিদ্ধান্তবাগীশ ছিলেন নদিয়ার রাজা রুদ্র রায়ের গুরুদেব।
এই বংশের পণ্ডিত রামভদ্র ন্যায়ালঙ্কার ছিলেন নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গুরুদেব। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গঙ্গার ধারে বহিরগাছি গ্রামে গুরুদেবের জন্য তিনি নির্মাণ করে দেন বসবাসের ঘর, পুজোর দালান, বারোটি শিবমন্দির ও একটি সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। রামভদ্র ন্যায়ালঙ্কার এই পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন।
রামভদ্রের ছয় পুত্র— রামরাজ, রাজেশ্বর, রামকান্ত, রামহরি, রামগোবিন্দ ও রামানন্দ। প্রত্যেকেই ছিলেন পণ্ডিত। ছয় ভাই এক বার ছ’টি দুর্গামূর্তি তৈরি করেন। সেই ছ’টি মূর্তি এক সঙ্গে পূজিত হয়। এই ঘটনা ঘটে রামভদ্রের মৃত্যুর পর। তখন থেকেই শুরু ভট্টাচার্য বাড়ির ছয় দুর্গা পুজো। এই বংশে স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র বিশারদ বহু পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করেছেন। যেমন ‘দত্তকচন্দ্রিকা’-কার পণ্ডিত রঘুমণি বিদ্যাভূষণ, ‘বিচারদর্পণ’ প্রণেতা সংস্কৃত কবি ও বর্ধমান রাজের সভাপণ্ডিত মধুসূদন তর্কপঞ্চানন এই বংশের সন্তান।
মধুসূদনের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। নদিয়া রাজবংশ ছাড়াও তিনি সেই সময় বর্ধমানরাজের মহাতাব চাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁর পুত্রবধূ বিন্দুবাসিনী দেবী বলতেন, বহিরগাছি গ্রাম থেকে বর্ধমান যাতায়াতের সুবিধার জন্য মহাতাব চাঁদ তাঁকে একটি হাতি দিয়েছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই সেই হাতির খোরাক জোগানো এত কঠিন হয়ে গেল যে রাজাকে হাতি ফেরত দেন মধুসূদন। মহাতাব চাঁদ তখন হাতির মূল্যস্বরূপ এককালীন অনেক টাকা মধুসূদনকে দান করেন।
মধুসূদন তর্কপঞ্চানন সমাজ সংস্কারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। সম্ভবত মহাতাব চাঁদের দরবারেই প্রথম বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মধুসূদনের যোগাযোগ। গবেষক হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর ও মধুসূদনের বন্ধুত্ব সম্পর্কে লিখছেন, “মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। জীবনে বোধহয় শতাধিক বার বিদ্যাসাগর বহিরগাছি গ্রামে শুভাগমন করিয়াছিলেন। এক এক বার আসিয়া অন্ততঃ দুইটা দিনও বন্ধুর বাড়ীতে থাকিয়া যাইতেন তিনি।”
বিদ্যাসাগর সে সময় দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয়গুলির সহকারী পরিদর্শক ছিলেন। ১৮৫৫ সাল, সেই সময় তিনি নদিয়াতে বেশ কয়েকটি মডেল স্কুলও স্থাপন করেন। শোনা যায়, দুর্গাপুজোর আগে নদিয়ায় বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য তিনি এসেছিলেন। সে বার কয়েক দিনে কাজকর্ম সারা হয়ে গেলেও তিনি কলকাতা ফিরলেন না। নৌকোয় গুড়গুড়ে নদী পেরিয়ে পৌঁছলেন বহিরগাছি গ্রামে, মধুসূদন তর্কপঞ্চাননের বাড়িতে। ও দিকে দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মধুসূদন তর্কপঞ্চানন। সে দিন মহাষ্টমী। পুজোর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সবাই চিন্তায়, তা হলে কি এ বার আর পুজো হবে না? চণ্ডীমণ্ডপে তখন উপস্থিত বিদ্যাসাগর। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে পুজো শুরু হল। সকলে দেখলেন, পুরোহিতের আসনে তখন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। লোকমুখে শোনা যায়, এই পুজোয় তিনি এক দিনের জন্যই পুরোহিত হয়েছিলেন।
এক বাড়িতে ছয় পুজো। পুজো হয় শাক্ত মতে। এই পরিবারের সদস্য মিলন ভট্টাচার্যের কাছ থেকে জানা গেল, অষ্টমীর দিন মায়ের জন্য হয় ইলিশ ভোগ। ইলিশ মাছ কাঁচা অবস্থায় সর্ষের তেলে ফোটানো হয়। এক ফোঁটা জলও ব্যবহার করা হয় না রান্নাতে। এই রান্নাকে পরিবারের লোকেরা বলেন ‘তেলমাছ’। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে যোগাযোগ ছিল কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির। সেখানকার পুজোর বৈশিষ্ট্য আবার রুই মাছের বলি।
১৭৪০ সাল। বর্গি আক্রমণে বাংলা তখন কাঁপছে। সেই সময় একটা উপায় খুঁজছিলেন দীনবন্ধু রায়। তিনি থাকতেন পদ্মাপাড়ের এক গ্রামে, পরে সেই জায়গা ছেড়ে চলে আসেন কাশিমবাজারে। সাহেবরা সেই সময় ভাগীরথী নদীটাকে এই এলাকায় বলত ‘কাশিমবাজার রিভার’। এই নদীর পাড়েই দীনবন্ধু বানালেন বসতবাড়ি। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবার ছিলেন এই রায় পরিবারের আত্মীয়।
১৭৫৭ সাল। পলাশির প্রান্তরে সেই যুদ্ধের পরেই ইংরেজদের দেওয়ান নিযুক্ত হলেন দীনবন্ধু রায়। তিনি রংপুর ও সরাইল পরগনার জমিদারি কেনেন। পরে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হলে এই পরিবারের জমিদারি পোক্ত হয়। তখন থেকে এই পরিবার কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়।
কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির পাশেই ছিল কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি ছিল কৃষ্ণকান্ত নন্দীর বাড়ি। এখানে পুজো বহু দিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দীনবন্ধু রায় যখন কাশিমবাজারে বাড়ি করলেন, তখন থেকে দুর্গাপুজো করে আসছেন। প্রায় একশো বছর আগে এখানে দুর্গাপুজো করার জন্য বড় বড় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের দিয়ে লেখানো হয় ‘শ্রীদুর্গার্চ্চনতত্ত্বকৌমুদী’। এই কৌমুদী সম্পর্কে পুঁথিটির উপরে লেখা আছে “পুস্তিকারূপিণী দুর্গা রাজকণ্ঠ বিলম্বিতা/ স্রগিব শোভিতা পাতু রাজানং সান্বয়ংসদা।”
বর্তমান ছোট বাজবাড়ির পুরোহিত সোমেশ্বর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাছ থেকেই শোনা গেল একটা ঘটনা। বহু দিন ধরে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির পুজোর বিসর্জনে দুটো নৌকো এক সঙ্গে বেঁধে মাঝে তোলা হয় প্রতিমাকে। তার পর দুই নৌকা দু’পাশে সরে গেলে মাঝে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমাকে গঙ্গার বুকে। প্রতি বছর বিসর্জনের পর একটা নোলক-পরা মাছ উঠত নৌকোয়। সেই মাছ পরে আবার জলে ছেড়ে দেওয়া হত। এক বার দেবীর বিসর্জনের পর এই রকম একটি মাছ ওঠে। মাছটি সে বার নৌকার মাঝি জলে ছেড়ে না দিয়ে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। কেটেকুটে রান্না করে খায় সকলে। সেই রাতেই মাঝির এক ছেলে মুখে রক্ত উঠে ছটফট করে মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে আর কখনও বিসর্জনের সময় মাছ ওঠে না।
এই পুজোতে আগে ছাগ বলি হত। মাঝে এ প্রথা উঠে যায়। শোনা যায়, ছাগের পরিবর্তে কুমড়ো বলি দেওয়া হত। দু’বার সে বলি আটকে গিয়েছিল। তাঁর পর শাস্ত্রজ্ঞদের মতামত নিয়ে পুরোহিত সোমেশ্বর চট্টোপাধ্যায় তাঁর গুরুদেব গৌর শাস্ত্রীর আদেশ অনুসরণ করে ছাগ বলির অনুকল্পে রোহিত মৎস্য বা রুই মাছ বলির অনুকল্প ব্যবস্থা শুরু করেন ও সেই বিষয়ে মন্ত্র নির্মাণ করেন। সেই বলি অনুকল্প ব্যবস্থায় যে মন্ত্রটি পাঠ করা হয় তা হল, ‘...শ্রী ভগবদ্দুর্গায়া প্রীতিকাম ইদং ছাগবল্যনুকল্প সোপকরণ রোহিত মৎস্য’ ভগবতী দুর্গাকে উৎসর্গ করা হল।
রুই আর ইলিশে লড়াই থাকলেও দেবী দুর্গা দুই মাছকেই গ্রহণ করেন। সেখানে কোনও লড়াই নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy