স্রোতস্বিনী: মধ্য ভারতের অন্যতম প্রধান নদী নর্মদাকে প্রচলিত আছে নানা লোককথা
সূর্য থেকে আগুন-ঝরা তাপে ধরণী যখন উত্তপ্ত হয়, পৃথিবীর ফসলভরা মাঠ তখন রিক্ত। আষাঢ়ে সেই শুকিয়ে যাওয়া জীবনে করুণাধারায় নেমে আসে বৃষ্টি। মেঘ যেন এক কৃষ্ণবর্ণ বিশালদেহী গম্ভীর পুরুষ। তার বৃষ্টি-ঔরসে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টির বীজ বপন হয়। নদী-নালা ভরে ওঠে। গাছপালা সজীব হয়। আমাদের পৃথিবী-মা যেন সত্যি ঋতুমতী হয়ে ওঠেন।
এই সময় আমাদের বাংলায় পালন হয় অম্বুবাচী। ভারতের নানা প্রান্তেও এই রীতি পালিত হয়। ভারতের অনেক জায়গায় অম্বুবাচী ‘রজ উৎসব’ নামেও পরিচিত, যেমন ওড়িশায়। অসমে এই সময় ‘তুলি বিবাহ’ নামে একটি লোকানুষ্ঠান হয়। পৃথিবী থেকে সূর্য তার তাপ দিয়ে জল চুরি করে বাষ্পের আকারে। রাজস্থানের মানুষেরা তাই সূর্যকে বলে ‘অম্বুতস্কর’। অম্বুবাচী কথাটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘অম্বু’ থেকে। ‘অম্বু’ শব্দের অর্থ হল জল। আর ‘বাচী’ শব্দের অর্থ হল বৃদ্ধি। পৃথিবীর শরীরে জল বৃদ্ধি হয় অম্বুবাচীর সময়। অম্বুবাচী আসলে কৃষির উৎসব। নব ফসলের জন্ম দেওয়ার সূচনা।
সূর্য আষাঢ় মাসে যে দিন মিথুন রাশিতে আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে গমন করে, সেই সময় থেকে মাতৃস্বরূপা পৃথিবী ঋতুমতী হন। ‘অষ্টবিংশতি তত্ত্ব’ নামের রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের গ্রন্থে অম্বুবাচী সম্পর্কে এমন বর্ণনাই দেওয়া হয়। এক সময় বাংলার ঘরে ঘরে বিধবা মা-ঠাকুমারা অম্বুবাচীর দিনক্ষণমনে রাখার জন্য এক প্রবাদের জন্ম দিয়েছিলেন— ‘কিবা বার কিবা তিথি, আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী তিথি’।
পৃথিবী ঋতুমতী হল। কাজেই সেই সময় ‘রজস্বলা’ পৃথিবীর সব নদীরা। তাই অম্বুবাচীর সময় নদীর জল কোনও কাজে ব্যবহার করা হয় না। পৃথিবীর বুকে হাল চালানো হয় না। এমন বিশ্বাস বহু যুগ ধরে মানুষ নিয়ে বেঁচে আছে। তবে ভারতভূমিতে সব নদী ঋতুমতী হলেও দু’টি নদী রজস্বলা হয় না। একটা নদীর নাম নর্মদা, আর অন্য নদীটির নাম আত্রেয়ী।
নর্মদা নিয়ে এক আশ্চর্য লোকবিশ্বাস মানুষের মধ্যে আছে। অমরকণ্টক পাহাড় থেকে এই নদীর জন্ম। তার পর জঙ্গল আর পাহাড়ের পথ পেরিয়ে গুজরাতের ভারুচ শহর থেকে একটু দূরে আরব সাগরের খাম্বাত উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। প্রচলিত কাহিনি, কুমারী নর্মদার বিয়ে ঠিক হয়েছিল রাজকুমার শোনভদ্রের সঙ্গে। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক। নর্মদা শোনভদ্রকে কখনও দেখেনি। বিয়ের আগে শোনভদ্রকে দেখার জন্য নর্মদার মন ছটফট করে ওঠে। নর্মদার সেবিকা ছিল জোহিলা। নর্মদা তার সেবিকা জোহিলাকে অনুরোধ করে, যেন সে তার বস্ত্র-অলঙ্কার পরিধান করে শোনভদ্রের কাছে যায়, আর শোনভদ্রকে তার প্রেরিত বার্তা দিয়ে আসে। নর্মদার কথামতো জোহিলা যায় শোনভদ্রের সঙ্গে দেখা করতে। নর্মদার বস্ত্র ও গহনা পরিহিতা জোহিলাকে দেখে রাজকুমার শোনভদ্র চিনতে পারে না। সে জোহিলাকে ভেবে নেয় নর্মদা। জোহিলাও দেখে শোনভদ্র এক অপরূপ সুদর্শন পুরুষ। বলিষ্ঠ তার বাহুযুগল। সুঠাম দেহকাণ্ড। প্রশস্ত বক্ষ। সুন্দর মুখশ্রী। শোনের প্রেমে পড়ে যায় জোহিলা।
জোহিলার ফিরে আসতে অনেক দেরি হচ্ছিল। অপেক্ষা করতে করতে অধীরা নর্মদা নিজেই খোঁজ করতে গেল জোহিলার। সেখানে গিয়ে নর্মদা জোহিলার সঙ্গে শোনভদ্রকে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আবিষ্কার করে। পলকে সমস্ত ঘটনাটা নর্মদার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। নর্মদা জোহিলাকে অপবিত্র জলের নদী হওয়ার অভিশাপ দেয়। আর প্রতিজ্ঞা করে, নিজে সারা জীবন কুমারী অবস্থায় থাকবে। এর পর জোহিলার বিপরীত দিকে নদীর রূপ ধরে নর্মদা বয়ে যায় আরব সাগরের দিকে। আর শোনভদ্র শোন নদের রূপ ধরে নর্মদার বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। কুমারী নদী বলে অম্বুবাচীতেও নর্মদার জল পবিত্র থাকে— এটাই প্রচলিত লোকবিশ্বাস।
বাংলার এই রকমই আর এক নদী বালুরঘাটের আত্রেয়ী। তাকে নিয়েও প্রচলিত এক আশ্চর্য লোককথা। ‘সদানীরা’ বা তিস্তা নদীর কন্যা আত্রেয়ী। আত্রেয়ী ছিল লাবণ্যময়ী। খুব সুন্দরী। হাজার হিরের ছটার মতো ঔজ্জ্বল্য ছিল তার শরীরে। এমন রূপ দেখে মোহিত হয়ে আত্রেয়ীকে এক দৈত্য অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল পাতালের দিকে। এই অবস্থা দেখে মা গঙ্গা তিন জন দেবদূতকে মর্ত্যে পাঠান দৈত্যের হাত থেকে আত্রেয়ীকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু মর্ত্যে এসে তিন দেবদূত আত্রেয়ীর রূপ দেখে আত্রেয়ীর প্রেমে পড়ে যায়। তড়িঘড়ি দৈত্য বধ করে তিন দেবদূতই সমবেত ভাবে প্রেম নিবেদন করে আত্রেয়ীকে। আত্রেয়ী সম্মত না হওয়ায় তিন জনই তার হাত ধরে নিজের দিকে টানতে যায়। গঙ্গা সবই জানতে পারেন। অন্তরাল থেকে তিনি অভিশাপ দেন, তিন দেবদূত তিন রকম ফুল হয়ে যায়। এক জন হয় লোধ্র ফুল, দ্বিতীয় জন করবী ফুল আর শেষ জন হয় কুসুমটুলি ফুল।
এর পর দৈববাণী হয়— মা গঙ্গার অভিশাপে তিন দেবদূত তিনটি ফুলে রূপান্তরিত হয়েছে। আর সেই ফুল দিয়ে সারা জীবন আত্রেয়ীকে পুজো করতে হবে। খারাপ মনে দেবদূতরা আত্রেয়ীকে ছুঁয়েছিল বলে, আত্রেয়ী নদীর রূপ ধরে বয়ে চলে। বিয়ে না করে আত্রেয়ী চিরকাল কুমারী থেকে যায়। আত্রেয়ী কুমারী নদী হওয়ায় অম্বুবাচীর দিনে এই নদী ঋতুমতী হয় না।
মানুষ কি নদী হয়ে যায়? না কি নদীর স্মৃতিতে জড়িয়ে বেঁচে থাকে আসলে মানুষেরই গল্প? সব গল্পই আসলে নদীমাতৃক সভ্যতায় নদীর অপমানের গল্প। শুধু নদী নয়, বৃক্ষ, অরণ্য-সহ সমস্ত পরিবেশের প্রতি অকৃতজ্ঞতার গল্প। মানুষ যে নদীর জল পান করে, যার আশ্রয়ে শস্য ফলিয়ে জীবনধারণ করে, তাকেই কলুষিত করতে দ্বিধা করে না। একা বয়ে চলা দুঃখী নদী যখন অশ্রুমতী হয়, দু’কূল ছাপিয়ে ভাসিয়ে নেয় চরভূমির সাজানো ঝুলন-সভ্যতা।
কুমারী নদীর নিঃসঙ্গতার গল্প আসলে প্রকৃতির নিজস্ব একাকিত্বের কথাই বলে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy