লিয়োনেল মেসি। ফাইল চিত্র।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তার পর চিরতরে পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির নীল-সাদা জার্সিতে জড়ানো শরীরটা হারিয়ে যাবে টানেলের মধ্যে। পিঠে লেখা ১০ নম্বর। দিয়েগো মারাদোনা উত্তর ফুটবল দুনিয়ায় সব চেয়ে বিখ্যাত ১০ নম্বর!
তিনি— লিয়োনেল মেসি আর কখনও বল পায়ে জাদু দেখাতে নামবেন না বিশ্বকাপের মঞ্চে। এই শেষ বার! অলিম্পিক সার্কাসের শেষ দিনের মতোই মন খারাপ করে দেওয়া রাত আসন্ন। অদ্যই যে শেষ রজনী!
কাতারের স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনীয় ভক্তরা তাঁদের দেশের ভাষায় মেসির নামে গান গাইছেন। আমরা নিজেদের গান ধরতেই পারি— রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও, যাও গো এ বার যাবার আগে। মেসি যাচ্ছেনও রাঙিয়ে দিয়ে। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে কোমরের দুলুনিতে তাঁর অবিশ্বাস্য ড্রিবল, তার পরে আলভারেসের পায়ে সাজিয়ে দেওয়া গোলের পাস। যত দিন ফুটবল থাকবে, যত দিন বিশ্বকাপ থাকবে, তত দিন থেকে যাবে এই বলের ব্যালে! পাশাপাশি যত সময় এগিয়ে আসছে ফাইনালের মাহেন্দ্রক্ষণের, ততই বাড়ছে এক ধরনের শূন্যতা। আর তো কিছু ক্ষণ। তার পরে বিশ্বকাপের মতো মহাযজ্ঞের মঞ্চে চিরকালের মতো অতীত হয়ে যাবেন তিনি!
এর পরেও ক্লাব ফুটবলের দুনিয়া তাঁর দর্শন পাবে। মেসি-ম্যাজিক দেখতে পাবে। সারাবছর ধরে এখন ক্লাব ফুটবল চলে। ফরাসি লিগে মেসি, নেমার, এমবাপে মিলে তৈরি হয়েছে দুর্ধর্ষ এমএনএম জুটি। বার্সেলোনায় খেলার সময় যেমন ছিল এমএসএন। মেসি, সুয়ারেস, নেমার। নতুন ক্লাব প্যারিস সঁ জরমঁ-কে ফরাসি লিগ জেতাতে পারেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিতে পারেন। দিয়েগো মারাদোনা যখন নাপোলির মতো নীচের দিকে পড়ে থাকা একটা দলকে ইটালির লিগে চ্যাম্পিয়ন করছেন, এত দূরের দেশ ভারতে বসে সরাসরি টিভিতে দেখার সুযোগ ছিল না। এখন আছে। টিভির স্পোর্টস চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার তো হচ্ছেই। সঙ্গে ইউটিউব, ফেসবুক বা ইন্টারনেটে লাইভ স্ট্রিমিংও এসে গিয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে স্পেনের লা লিগা, ফ্রান্সের লিগ ওয়ান, ইটালির সেরি আ— সব কিছু হাতের মুঠোয়। সারা বছরের সেই ফুটবল প্যাকেজে ডুবে থাকে নব প্রজন্ম। আর্লিং হালান্ড কে, নব্যযুগের ফুটবল অডিয়েন্সের কাছে এটা কোনও প্রশ্নই নয়। লাইভ টিভি কভারেজের দুনিয়ায় রোজ ড্রয়িংরুমে বসেই দেখে নেওয়া যাচ্ছে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির নতুন তারকাকে। গুগ্ল করার দরকার পড়বে না।
তাই লিয়োনেল মেসি সম্পূর্ণ ভাবে ফুটবল সন্ন্যাস নিয়ে ফেলছেন না। তাঁর ফুটবল দেখার সুযোগ এর পরেও থাকবে। কিন্তু বিশ্বকাপ হচ্ছে বিশ্বকাপ। রাহুল দ্রাবিড় যেমন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘অফসাইডে প্রথমে ঈশ্বর, তার পর সৌরভ,’’ তেমনই এক বিখ্যাত উক্তি আছে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে। ‘‘এক নম্বরে বিশ্বকাপ ফুটবল। দ্বিতীয় স্থানে বিশ্বকাপকে ঘিরে আবেগ। তার পরে দুনিয়ার বাকি সব কিছু।’’ বিশ্বকাপ হল সেই আকাশ, যেখানে নানা আবেগের রামধনু তৈরি হয়। যা অন্য কোনও ফুটবল প্রতিযোগিতায় দেখা যায় না।
ক্লাবের সেরা মানে তুমি নিজের দেশে সেরা। একটা শহরের প্রতিনিধি তুমি, দেশের নয়। ইপিএল জয়ী দল ইংল্যান্ডের সেরা দল। লা লিগা মানে স্পেনের সেরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী বড়জোর ইউরোপের সেরা ক্লাব। কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী মানে চার বছরের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের রত্নখচিত মুকুট তাদের মাথায়। ক্লাব বা একটা-দু’টো শহরের নয়, সারা দেশের আবেগ যুক্ত থাকে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দল হলে সারা পৃথিবীতে তৈরি হয়ে যায় ভক্তকুল। ক্লাব ফুটবলে ঝড় তোলা হালান্ডকে এ বারের বিশ্বকাপে দেখা যায়নি। কারণ তাঁর দেশ নরওয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ক্লাব ফুটবল যদি আইপিএল হয়, তা হলে বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে দেশের পবিত্র সাদা জার্সিতে টেস্ট খেলতে নামা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিসমহল হলে বিশ্বকাপ হচ্ছে তাজমহল। আর বিশ্বকাপ ফাইনাল মানে চাঁদনি রাতের তাজমহল। যার অবর্ণনীয় শোভা দেখতে সারা দুনিয়ার লোক ছুটে আসে। সেই মায়াবী রাতে শেষ বারের মতো দেখা যাবে বিখ্যাত আর্জেন্টিনীয় ব্যালে। মন খারাপ হবে না! মনে হবে না, এই লোকটা এত দিন ধরে আনন্দ দিয়ে গেল, মাতিয়ে দিয়ে গেল! তার সঙ্গে আমরা হাসলাম, কাঁদলাম, শিহরিত হলাম, রোমাঞ্চিত হলাম।সেই তিনি— সার্কাসের সেরা মাস্টার আজকের পরে আর খেলা দেখাবেন না! মঞ্চ থাকবে, সরোদ-তবলা সাজানো থাকবে। কিন্তু ওস্তাদেরা আর বাজাবেন না। শ্রোতাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে, ভাবুন।
সময়-সময় অবশ্য ২০২২ বিশ্বকাপের দিকে ফিরে তাকাতে বসে মনে হচ্ছে, একা মেসি কোথায়? একের পর এক, অনেক মহাতারকারই তো বিদায়মঞ্চ হয়ে থাকল কাতার। এই বিশ্বকাপ যেমন নবীন বরণের বিশ্বকাপ, তেমনই তারকা-হরণেরও বিশ্বকাপ। যেমন সৌদি আরব, জাপান বা মরক্কোর ঘটানো অঘটনের বিশ্বকাপ, তেমনই মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনার প্রত্যাবর্তনের বিশ্বকাপ। এমন এলোপাথাড়ি, ঝোড়ো হাওয়া আর কোনও বিশ্বকাপে বইতে দেখা গিয়েছে? যার দাপটে ভূপতিত হল অনেক বটবৃক্ষও। কাতারের বিভিন্ন মাঠের টানেলগুলো কী সব উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে থাকল! উথালপাতাল করা কত সব ছবি! কোনওটা ভূকম্পনের, একেবারে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে। কোনওটা আলোড়নের, সমুদ্রস্রোতের মতো আছড়ে পড়েছে। এক-এক জন বিদায় নিয়েছেন এক-এক রকম অভিব্যক্তি রেখে। ওই যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছেন। এইমাত্র মরক্কোর কাছে হেরে বিদায় নিলেন। বিদ্রোহ করে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে চরম সঙ্কটে পড়া তিনি বড় মুখ করে বিশ্বকাপে খেলতে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন, ক্লাব যে অপমান করেছে, তার জবাব দেবেন দেশের জার্সিতে। কে জানত, পর্তুগাল কোচ ফের্নান্দো স্যান্টোসও একই রকম নির্মম বিধান তৈরি রেখেছেন— যাও, বেঞ্চে গিয়ে বোসো। ব্রুটাস, তুমিও! অভিমানী রোনাল্ডো কি অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন, ‘‘পর্তুগাল, তুমিও? এক দিন কি না বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও সৎকার করতে যাইনি দেশের এই লাল জার্সিটা পরে সার্ভিস দেব বলে!
সেপ্টেম্বর ৭, ২০০৫। তোমরা দেখছিলে জার্সি। আসলে বাবার মৃত্যুশোকে অদৃশ্য ধড়াচুড়ো পরে, চোখের কোণে জল নিয়ে সে দিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিলাম। ভুলে গেলে পর্তুগাল!’’
গণমাধ্যম যদি কোনও সূচক হয়, তা হলে জনপ্রিয়তায় বিশ্বে এক নম্বর সি আর সেভেন। শুধু ফুটবল নয়, সব জগতের তারকাদের সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে জিতবেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফলোয়ার-সংখ্যা জাস্টিন বিবারের দ্বিগুণ। রিহানার তিন গুণ। দ্বিতীয় স্থানে মেসি। তাঁর যা ফলোয়ার-সংখ্যা, কেটি পেরি এবং কোর্টনি কার্দাশিয়ান মিলিয়েও হবে না। মেসি, রোনাল্ডো এবং নেমার— আধুনিক ফুটবলের মোৎজ়ার্ট, বিঠোফেন, বাখ। তাঁরা এক সঙ্গে চলে যাওয়া মানে ফুটবলের সিম্ফনিটাই হারিয়ে গেল। দু’জনের নিশ্চিত বিদায়মঞ্চ হয়ে থাকল কাতার। রোনাল্ডোর এখনই বয়স সাঁইত্রিশ। ক্লাব ফুটবলে বেকার হয়ে পড়েছেন। চার বছর পরে আমেরিকায় যখন বিশ্বকাপের আসর বসবে, তিনি হবেন একচল্লিশ। ফেরার প্রশ্নই নেই। কান্নার ওই ছবিটাই শেষ দৃশ্য হয়ে থাকল। মেসি তো নিজেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, আজ, রবিবারের ফাইনালে শেষ বার আর্জেন্টিনার জার্সিতে নামছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। সম্ভবত, দেশের হয়ে আর কোথাওই দেখা যাবে না তাঁকে। নীল-সাদা জার্সিতে শেষ ব্যালে।
তিনি, নেমারও কি ফিরবেন? এখনই তো তিরিশ। এই বয়সে পেলে তিন বার বিশ্বকাপ জিতে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। চার বছর পরে চৌত্রিশ হয়ে যাবেন। পঁয়ত্রিশের মেসি যদি আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলতে পারেন, নেমার কেন পারবেন না— এমন তর্ক উঠতেই পারে। আবার এটাও ভুললে চলবে না যে, বিশ্বমঞ্চে ব্রাজিলীয় তারকাকে দেখে বারবার মনে হয়েছে যেন কাঁধে অ্যাটলাসের বোঝা নিয়ে চলছেন। বলা হচ্ছিল, এত সব নতুন তারকা এসে গিয়েছে ব্রাজিলে। ভিনিসিয়াস, রিচার্লিসন, রাফিনিয়া, রদ্রিগোরা চাপ কমিয়ে দেবেন নেমারের। তাতেও কান্নার ছবি তো পাল্টাল না। মাঝেমধ্যে তাই আশঙ্কাই হচ্ছে। ইভান পেরিসিচের বাচ্চা ছেলেটাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করছেন তিনি, দু’চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসছে অশ্রুধারা— ওই ছবিটাই বিশ্বকাপে নেমারের বিদায়ী দৃশ্য হয়ে থাকল না তো? বাবার দলের বিজয়োৎসব ভুলে ছোট্ট ছেলে ছুটছে প্রতিপক্ষ শিবিরের প্রিয় তারকার কাছে— ছবিটা এমনিতেই কালজয়ী। এই বিশ্বকাপের সেরা ফ্রেমের পুরস্কার পেতে পারে। তার সঙ্গে আবার নেমারের বিদায়ী আবেগ যুক্ত হলে তো কথাই নেই। বিশ্বকাপের চিরকালীন আর্কাইভে ঢুকে পড়বে।
রিওয়াইন্ড করতে বসে কাতারের মাঠের টানেলগুলোকে রাজাদের আমলের গুপ্ত সুড়ঙ্গের মতো মনে হতে পারে। অপছন্দের কাজ ঘটালেই যেখানে নিয়ে যাওয়া হত অনেককে। আর তারা ফিরত না। রবার্ট লেয়নডস্কি কোনও দোষ করেননি। শেষ ম্যাচেও গোল করেছিলেন। তবু হারিয়ে গেলেন ওই অভিশপ্ত সুড়ঙ্গে। আধুনিক যুগে ক্লাব ফুটবলে খুব বড় নাম লেয়নডস্কি। বার্সেলোনায় মেসির পরিবর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। ক্লাবের দুনিয়ায় থাকবেন, কিন্তু চার বছর পরের বিশ্বকাপে আর পোল্যান্ডের জার্সিতে দেখা যাবে না তাঁকে। লুইস সুয়ারেসের কপালে সেই সুযোগটুকুও জুটল না। বেঞ্চে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দেখলেন, বিশ্বকাপের পুরনো ফাইলে ঢুকে পড়ছেন। আরও আছে। বেলজিয়ামের সোনার প্রজন্ম। রোমেলু লুকাকু, কেভিন দ্য ব্রুইন, এডেন অ্যাজ়ারদেরও আর দেখা যাবে না। কাপ না জেতার যন্ত্রণা নিয়েই কাটাতে হবে বাকি জীবন। ক্রোয়েশিয়ার সোনার ছেলে লুকা মদ্রিচ। স্পেনের সের্খিয়ো বুস্কেৎস। জার্মানির টমাস মুলার, ম্যানুয়েল নয়্যার। ক্রিকেটে যেমন উইকেটকিপারের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, তেমনই ফুটবলে এক বিপ্লবীর নাম নয়্যার। গোলকিপারকে আগে বলা হত ‘লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স’। নয়্যার পাল্টে দিয়ে করে দিয়েছেন, ‘ফার্স্ট লাইন অব অ্যাটাক’। সেই তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও বিশ্বকাপের মঞ্চে লড়তে এসেছিলেন। জার্মানির অকাল বিদায়ে সুড়ঙ্গে হারিয়ে গেলেন। ব্রাজিলের দানি আলভেস, থিয়াগো সিলভা। পর্তুগালে রোনাল্ডোর সঙ্গে পেপে। আর্জেন্টিনায় মেসির মতোই রবিবার বিদায়ী ম্যাচ অ্যাঙ্খেল দি’মারিয়ার। একের পর এক স্বজন হারানোর যন্ত্রণা আরও গভীরে নিক্ষিপ্ত। মেসি, রোনাল্ডো দু’জনের কেউ থাকবেন না, এটা একটা দিক। অন্য দিকটা হচ্ছে, বিশ্বকাপের মঞ্চে আর কখনও দেখা যাবে না তাঁদের মহাকাব্যিক দ্বৈরথও। ক্লাব ফুটবলেও যা শেষের মুখে। প্রায় দেড় দশক ধরে চলা ফুটবলের সেরা ক্লাসিকো— সেটাও তো কেড়ে নিল নির্দয় কাতার। এত চোখের জল আর কোনও বিশ্বকাপ ঝরিয়েছে? মনে পড়ছে না।
কাতার কার্নিভাল শুরুর সময় মনে হয়েছিল, এত বিতর্কিত বিশ্বকাপ আর কখনও আসেনি। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে তুলকালাম, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তরজা, সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে পাশ্চাত্য মিডিয়ার বাণ। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। কতটুকুই বা ফুটবল খেলেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি? কী পরিকাঠামো আছে? স্টেডিয়ামগুলোও তো সব বানাতে হচ্ছে। একের পর এক তোপধ্বনি করে গিয়েছে পাশ্চাত্যের মিডিয়া। সঙ্গে সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ আয়োজনের বরাত বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ। বোধনের ঠিক আগে কাজিয়া চরম আকার নিল। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল, লাগাতার ধেয়ে আসা তিরে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম বিশ্বকাপের না শরশয্যাপ্রাপ্তি ঘটে! এই চাপ তো ইটালির বিখ্যাত কাতানেচ্চিয়ো ডিফেন্সও সামলাতে পারত না!
যত এগিয়েছে বিশ্বকাপ, ততই সব প্রশ্নকে ছাপিয়ে মঞ্চের দখল নিয়েছে ফুটবল। বলে না, পৃথিবীর মতো ফুটবলও গোলাকৃতি। কোনওটাই স্থির নয়। আবর্তিত হতে থাকে। তার সঙ্গে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে সারা দুনিয়ার আবেগের নানা রং। ভালবাসা, দুঃখ, উৎসব, হতাশা। জীবনের মতোই গড়িয়ে চলে ফুটবল। কোথাও দিনের আলো তো কোথাও রাতের অন্ধকার। কাতার বিশ্বকাপও সেই কক্ষপথ ধরেই ঘুরল। মধ্যপ্রাচ্যের ফুটবল যোগ্যতা নিয়ে হেলাফেলার জবাব শুরুতেই দিয়ে দিল সৌদি আরব। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটন ঘটিয়ে দিল তারা। তখন মনে হচ্ছিল, কাতার একা বিশ্বকাপ সংগঠন করছে না। দলগত ভাবে করছে গোটা আরব দুনিয়া। পুরো মধ্যপ্রাচ্য যেন এককাট্টা হয়ে গিয়েছে পাশ্চাত্যের আক্রমণের সামনে সোনালি কাপকে রক্ষার জন্য। নিজেদের মধ্যে যতই রেষারেষি আর মতপার্থক্য থাকুক না কেন, বিশ্বকাপকে ঘিরে নতুন আরব্য রজনী উপহার দেওয়ার মিলিত শপথ নিয়েছে তারা।
মেসির কাপ-স্বপ্নকে তখন শুরুতেই ক্ষতবিক্ষত দেখাচ্ছিল। নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিরতিতে দলকে দেওয়া সৌদি কোচের ফুটন্ত বক্তৃতার ভিডিয়ো। ড্রেসিংরুমে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে চিৎকার করে যিনি বলছেন, ‘‘তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে, মেসির ফ্যান। মাঠের মধ্যেই ওর সঙ্গে সেলফি তুলে নিতে পারতে তো। ওটা আর বাদ দিলে কেন?’’ বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের সেই ভিডিয়ো দেখে নিশ্চয়ই মনে পড়ে গিয়েছিল পিকের বিখ্যাত ভোকাল টনিকের কথা। ১৯৭৩-এ ডিসিএম ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিখ্যাত ডোক রো গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। কোরিয়ার দলে ছ’সাত জন ফুটবলার ছিলেন, যাঁরা ১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেলে এসেছিলেন। দরিয়াগঞ্জের হোটেলের ছাদে থিয়োরি ক্লাস নিতে এসে অভিনব কাণ্ড ঘটালেন পিকে। চুড়ি কিনে এনে হাবিব, আকবরদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘‘মাঠে গিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তোমাদের যা চোখমুখের অবস্থা দেখছি, এগুলো পরে ঘরেই বসে থাকো।’’
কারও কারও মনে পড়বে প্রয়াত ডিন জোন্সকে তাতানোর জন্য অ্যালান বর্ডারের উক্তি। চেন্নাইয়ে টাই টেস্টে জোন্সকে তাঁর অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘‘তোমার দ্বারা এ সব লড়াই-টড়াই হবে না। দ্রুত ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে আরাম করো।’’ জোন্স এর পর ডাবল সেঞ্চুরি করে দলের লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি করে দেন। মাঠের মধ্যে বমি করতে থাকেন, তবু বাইশ গজ ছেড়ে যাননি। অধিনায়কের কথার জবাব তিনি ব্যাটেই দেবেন বলে ঠিক করেন। পিকের কথা শুনে ফুঁসে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল। এই বিশ্বকাপে হাফটাইমে কোচের বক্তৃতা তেমনই ঠুকরে বার করে এনেছিল সৌদির আত্মগর্ব।
তখন কে জানত, এমন আলোড়ন ফেলা ভিডিয়োও দ্রুতই বিশ্বকাপের টপ টেন থেকে হারিয়ে যাবে। সৌদির মধুচন্দ্রিমা টিকবে না। বরং ফাইনালের আগে ভাইরাল হয়ে ঘুরবে অন্য একটি ভিডিয়ো। যেখানে আর্জেন্টিনার এক মহিলা সাংবাদিক মেসির টিভি সাক্ষাৎকার নিতে এসে প্রশ্ন করতে ভুলে গেলেন। ভিজে আসা চোখে বললেন, ‘‘লিয়ো, ফাইনালে যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের সকলকে আনন্দ দিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’’ কে বলে, মারাদোনার আর্জেন্টিনায় পরদেশি মেসি! এই বিশ্বকাপ তাঁকে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে আর্জেন্টিনার রোসারিয়োও ফেরত দিয়ে গেল।
কে জানত, জাপান আর মরক্কো এমন চমক দেখিয়ে যাবে! কে ভেবেছিল নতুন সূর্যোদয়ের দেশ ডুবিয়ে দেবে জার্মানি, স্পেনের সূর্যকে। সঙ্গে জীবনের শিক্ষাও দিয়ে গেল জাপান। কী সেই শিক্ষা? উৎসব করো, তবে অন্যদের ভোগান্তি না ঘটিয়ে। প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়েও উৎসবে মেতে না উঠে জাপানি দর্শকদের গ্যালারি সাফ অভিযানের ছবি স্কুলে-স্কুলে দেখানো যেতে পারে। আর দেশের রাস্তায় বিজয়োৎসব করবে বলে জাপানি জনতার সিগন্যাল লাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার ভিডিয়ো তো বিশ্ববাসীর মন জিতে নিয়েছে।
মরক্কো তেমনই কাতার বিশ্বকাপের সিন্ডারেলা রূপকথা। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে যাদের রাস্তা আপাতত শেষ হয়ে গেল হয়তো। কিন্তু ফিকে হয়নি তাদের আলো। বিশ্বকাপ আকাশে চিরদিনের মতো জ্বলজ্বল করবে মরক্কো। নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স থেকে অনেক ফুটবলার খেলছে মরক্কোয়। তারা আবার গোটা আরব দুনিয়ার প্রতিনিধিও হয়ে উঠল। ওদিকে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা। বিশ্বকাপের মঞ্চে একটা দল আর কখনও এতগুলো দেশের আবেগকে এক করে দিতে পারেনি। কাছাকাছি থাকতে পারে রজার মিল্লার ক্যামেরুন। আল বায়েত স্টেডিয়ামে এমবাপে, গ্রিজ়ম্যানদের সামনে হার মানলেও তাদের হার-না-মানা লড়াই উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিশ্বকাপ শুরুর সময় যাদের জেতার সম্ভাবনা ছিল ০.০১ শতাংশ। রানি শেহেরজাদের মতোই প্রত্যেক রাতে নতুন রূপকথা শুনিয়ে সহস্র এক আরব্য রজনী উপহার দিয়ে গেল মরক্কো। আরব দেশে প্রত্যেক রাত ছিল তাদের কাছে মৃত্যুর রাত। ফুটবল রাজাদের হাতে কোতল হওয়ার রাত। কিন্তু শেহেরজাদের মতোই সাহস আর বুদ্ধির জোরে বেঁচে থাকত তারা। দোহা থেকে দিল্লি, কায়রো থেকে কেপ টাউন, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতা— সর্বত্র ভক্তকুল তৈরি হয়ে গেল তাদের। ফ্রান্সের কাছে অবশেষে হার মেনে এ বারের মতো বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ করতে হলেও আদৌ শেষ হয়নি মরক্কো। বরং সূচনা করেছে এক নতুন বিশ্বাসের যে, প্রতিপক্ষ তুমি যত বড়ই হও না কেন, আমরাও ছাড়ব না। জানপ্রাণ লড়িয়ে তোমাদের হারিয়ে দিতে পারি। শুধু ফুটবল কেন, মরক্কো-মন্ত্র টেমপ্লেট হয়ে থাকল সমাজের সব স্তরের, সব পেশার মানুষের জন্য। জীবনের রাস্তায় আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক জন আন্ডারডগ থাকে। যারা হয়তো ফেভারিটদের সামনে উচ্চকিত স্বরে জয়গান গাইতে ভয় পায়। আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসে। তাদের সকলের সামনে উদাহরণ তৈরি হয়ে গেল। বিশ্বকাপে অ্যাটলাস লায়ন্সের গর্জনের ছবিটা দেখব আর বলব, মরক্কো পেরেছে, আমরা পারব না কেন?
ফিরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, হিচককের থ্রিলারের মতোই টানটান গতিতে এগিয়েছে কাতার বিশ্বকাপ। প্রতিযোগিতা শুরুর সময় কেউ যদি বলত, মরক্কো সেমিফাইনাল খেলবে! পর্তুগালকে উড়িয়ে দেবে! বেলজিয়ামকে ছিটকে দেবে! স্পেনকে হারাবে! কেউ বিশ্বাস করত? যদি কেউ বলত, জাপান কাতারে আসছে অতীতের দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি আর স্পেনকে হারাতে, কেউ মানতে চাইত? যদি কেউ ইঙ্গিত দিত, নেমার-ভিনিসিয়াস-রিচার্লিসনদের দুরন্ত ব্রাজিলকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে দেবে লুকা মদ্রিচের ক্রোয়েশিয়া, নিশ্চয়ই কলকাতায় পুরনো দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসের সঙ্গে তুলনা করা হত। যখন ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকা মানে নিশ্চিত ভাবে ধরে নেওয়া হত, ঝকঝকে রোদ উঠছে। আর পূর্বাভাসে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ মানে সঙ্গে ছাতা রাখো। বৃষ্টি নামবেই।
বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই তো এই অনিশ্চয়তা। স্বপ্নপূরণের তোরণ সাজিয়ে দেখতে হতে পারে স্বপ্নভঙ্গের চাঁদোয়ায় সব ঢেকে গিয়েছে। সব চেয়ে বড় উদাহরণ মারাকানাজ়ো। ১৯৫০-এ নিজেদের দেশে উরুগুয়ের কাছে ফাইনাল হেরে যায় ব্রাজিল। গোটা জাতিকে এমন ভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছিল সেই হার, যা ২০১৪-তে জার্মানির কাছে ১-৭ হারের সময়েও হয়নি। মারাকানা স্টেডিয়াম বিশেষ ভাবে তৈরিই করা হয়েছিল এই ফাইনালের জন্য। ম্যাচের ফল কী হতে পারে, তা নিয়ে সকলে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে শুধু ব্রাজিলের নাম রেখেই ভিকট্রি স্পিচ তৈরি করে রেখেছিলেন। উরুগুয়ে জিতে যাওয়ায় তড়িঘড়ি পাল্টে তাদের নাম ঢোকানো হয়। সেই পরাজয়ের ধারাবিবরণী শুনতে থাকা এক বাচ্চা ছেলে বাবা এবং জাতিকে কাঁদতে দেখে শপথ নেয়, এক দিন বিশ্বকাপ জিতে দেশের চোখের জল মুছে দেবে। সেদিনের সেই বাচ্চার নাম? পেলে! ২০২২ বিশ্বকাপে পরাজিত কোনও দেশের কান্না দেখে কোথাও কি জন্ম নিল আগামী দিনের এক মহাতারকা? সময় সে কথা বলবে।
আপাতত অন্য আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে। যে ভাবে একের পর এক তারা খসে পড়ছে, শুধু বিশ্বকাপ কেন, খেলাধুলোর জগতেই না বিরাট শূন্যতা তৈরি করে দিয়ে যায়! রজার ফেডেরার অবসর নিয়ে ফেলেছেন, রাফায়েল নাদালই বা আর কত দিন? সেরিনা উইলিয়ামসের লড়াই থেমে গিয়েছে। সচিন তেন্ডুলকর আর ব্যাটের ঝংকার তোলেন না। উসেইন বোল্ট আর ১০০ মিটার দৌড়ন না। টাইগার উড্সকে শেষ কবে গল্ফ ক্লাব হাতে দেখা গিয়েছিল? চিরকোমায় শায়িত ফর্মুলা ওয়ান কিংবদন্তি শুমাখার। দশকটাই তো শাইলকের মতো নির্মম। সুদের টাকা ফেরত না পেয়ে সে ক্রীড়াপ্রেমীদের মাংস জবাই করতে হাজির হয়েছে। আরও একটা প্রশ্ন— চলে যাওয়া এই সব মহরথীদের যথেষ্ট যোগ্য পরিবর্ত পাওয়া যাবে তো? ফেডেরার, নাদালের বদলি খুঁজে যাচ্ছে টেনিস। উডসের বিকল্প খুঁজে পায়নি গল্ফ। ফুটবলে কী হবে? মেসি, রোনাল্ডো চলে যাচ্ছেন। দেড় দশক ধরে ফুটবলের মশালবাহক। তাঁদের উত্তরসূরি কারা?
আর্লিং হালান্ড ক্লাব ফুটবলে নতুন রাজা হিসেবে এগিয়ে থাকলেও বিশ্বকাপে তাঁর দেশই তো নেই। জার্মানির জামাল মুসিয়ালা নজর কেড়েছেন। স্পেনের গাভি, পেদ্রি। ইংল্যান্ডের জুডে বেলিংহ্যাম, বুকায়ো সাকা। মেসির আর্জেন্টিনা থেকে পাওয়া গেল দু’টো নাম। এনজ়ো ফার্নান্দেস, ইউলিয়ান আলভারেস। ব্রাজিলের রদ্রিগো, রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াস। পর্তুগালে রোনাল্ডোকে বেঞ্চে বসিয়ে হ্যাটট্রিক করা গনসালো র্যামোস। কিন্তু সব চেয়ে জনপ্রিয় নাম এক জনই। রবিবার ফাইনালে মেসি যাঁর বিরুদ্ধে নামছেন। ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপে। পিএসজি-তে মেসিরই সতীর্থ। কাতারের লুসেল স্টেডিয়ামে রবিবার যিনিই জিতুন, অদৃশ্য ব্যাটন হস্তান্তর আসন্ন। লিয়োনেল মেসি বিশ্বকাপের পূতাগ্নি তুলে দিয়ে যাবেন এমবাপের হাতে।
আবার মনে হচ্ছে, যতই মশাল হস্তান্তর হোক, সেই তো চোখের জলে শেষ হবে। তিনি লিয়োনেল মেসি— এত কাছাকাছি এসেও কাপ হারালে আর্জেন্টিনার ইতিহাসে এসে পড়বে ব্রাজিলের ট্র্যাজেডি— মারাকানাজ়ো। প্রয়াত মহাতারকাকে স্মরণ করে নীল-সাদার দেশ নামকরণ করতে পারে— মারাদোনাজ়ো। এত করেও যে ছিয়াশির দিয়েগো হয়ে ওঠা হল না লিয়োর! আর ফ্রান্সকে হারিয়ে দিতে পারলে? মেসি জিতবেন বিশ্বকাপ, কিন্তু বিশ্বকাপ হারাবে মেসিকে। উৎসবের তুবড়ি আলোর ফোয়ারা ছুটিয়েও নিভে যেতে পারে বাঁধ না মানা চোখের জলে।
বিদায়ের বিশ্বকাপ! কান্নার কাতার!
শেষ দিনেও তো সেই কাঁদিয়েই চলে যাচ্ছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy