সাময়িকী: ‘অচলপত্র’-এ প্রকাশিত দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের প্রতিকৃতি। বাঁ দিকে, ওই পত্রিকারই কোনও সংখ্যার প্রচ্ছদ
বাংলায় এমন অনেক লেখকের কথাই আমরা জানি, যাঁদের লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকত ব্যঙ্গের চড়া ঝাঁঝ। কোনও লেখক বা কোনও লেখার বিরুদ্ধে লিখতে গেলে তাঁদের ভাষার আগল থাকত না। সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’-র কথা আমরা জানি। এই রকমই আর একটি আক্রমণাত্মক পত্রিকা ছিল ‘অচলপত্র’, যে পত্রিকা ‘বড়োদের পড়বার, ছোটদের দুধ গরম করবার একমাত্র মাসিক’ হিসেবে আত্মপরিচয় ঘোষণা করেই বিশুদ্ধবাদীদের ভুরু কুঁচকে দিয়েছিল। দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের এই পত্রিকায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নানা লেখক ও বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে মারাত্মক সব লেখা ছাপা হত। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়— কেউ ছাড় পাননি তাঁর চাঁছাছোলা মন্তব্য থেকে। কয়েকটির কথা মনে করলেই আমরা বুঝতে পারব কেন ‘অচলপত্র’ ও তাঁর সম্পাদক আমাদের মনোযোগের বাইরেই থেকে গেলেন। এত চরমপন্থী ভাষা ও ভঙ্গি সহ্য করা সত্যিই মুশকিল! বক্তব্য সত্যি হোক বা না হোক, দুর্মুখ মানুষকে সকলেই এড়িয়ে চলেন।
‘অচলপত্র’ সম্পর্কে আশাপূর্ণা দেবীর একটি সরল মন্তব্য— ‘ছেলেমানুষী হলেও উপভোগ্য’—এর জবাবে পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতেই সম্পাদক লিখেছিলেন, “ছেলেমানুষী যেন আমাদের জীবন থেকে কখনও ছুটি না নেয়। মজে, ধ্বসে ও বুজে যাওয়া প্রাচীনদের কাছে আমরা যেন চিরকাল ছেলেমানুষই থাকি আর ‘অচলপত্র’ যেন প্রাণ-রস বঞ্চিত এই রামগরুড়ের ছানাদের দেশে অতি সিরিয়াসদের কাছে চিরদিনই অচল থাকে।”
কয়েকজন লেখক ছিলেন ‘অচলপত্র’-সম্পাদকের চির-অপছন্দের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস। তারাশঙ্কর সম্পর্কে কোনও কথাই বলতে বাধত না দীপ্তেন্দ্রকুমারের! এমনও লিখেছেন যে “পাইকারী দরে তিনি লেখা শুরু করেছেন। সারা করবার দশ বছরের মধ্যে তিনি দেখতে পাবেন বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় কি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কিঞ্চিৎ উপরে মাত্র।” তারাশঙ্কর ‘অস্বাভাবিকরকম খ্যাতি-পাগল’, লিখে গাড়ি-বাড়ি করাই তাঁর লক্ষ্য— এই অভিযোগগুলি থেকে বোঝা যায়, মানুষ এবং লেখক তারাশঙ্করের মধ্যে বিরোধ দেখতে পাচ্ছেন তিনি এবং তা সহ্য করতে পারছেন না। ‘কেনে’ লিখলেই যে লোকে এখন বই কেনে, এটাও তাঁরই কথা!
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক বার ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় তারাশঙ্কর সম্পর্কে আরও অনেক কথার মধ্যে লিখেছিলেন “...এই কংগ্রেস কর্মীটি রাঢ়ের খররৌদ্রে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে দেশকে দেখবার সুযোগ পেয়েছেন, মেলার বটগাছতলায় খড়ের বিছানায় শুয়ে জীবনকে বুঝতে চেয়েছেন।” দীপ্তেন্দ্রকুমার জবাব দেওয়ার সুযোগ লুফে নিলেন। লিখলেন, “খররৌদ্রে মাইলের পর মাইল ঘুরলেই যদি সাহিত্যিক হওয়া যেত, তাহলে তো প্রত্যেক জীবন-বীমার দালালরাই তা হত।... সৃষ্টির জন্য যা প্রয়োজন তা প্রতিভা, নর্দমার ধারে শুয়ে থাকা নয়। কোল-ভিল সাঁওতালদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েও তাদের সম্বন্ধে কিছু জানে না, এমন লোকের অভাব নেই; ওদের সঙ্গে কোলাকুলি না করেও ওদের জীবন একেকজনের চোখে ধরা পড়ে।” হয়তো বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে রেখেই এ কথা লিখেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে ক’জন সম্পর্কে খোলা গলায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি, তাঁদের এক জন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ কথাও বলেছেন যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যিক হিসেবে “...কোনো দিন প্রেমেন্দ্র মিত্র কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারবেন না।” কিন্তু একটি লেখায় দীপ্তেন্দ্রকুমার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ছেড়ে কথা বলেননি। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ফিল্ম হয়েছিল। সেটা দেখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমার মনের কুসুমকে কেউ এভাবে ফোটাতে পারবে, এটা অন্তত আমার কল্পনাতীত ছিল।” দীপ্তেন্দ্রকুমার সটান লিখে দিলেন, “একটা ছবি তৈরি করতে অনেক টাকা লাগে।... অর্থকরী না হোক, রসিক লোকের চিত্তহরণকারী কিছুটা তাকে হতে হবেই। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছবির পর্দায় তা হয়নি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যে তা জানেন না, তা নয়।... না কি সত্যিই তাঁর বিশ্বাস যে, তাঁর মনের কুসুমকে কেউ এভাবে ফোটাতে পারবে, এ তিনি আশা করেন নি। যদি সত্যিই নিজের জ্ঞানে এবং বিশ্বাসে একথা বলে থাকেন, তাহলে বলব, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ তাঁর কনসাস সৃষ্টি নয়; তিনি না জেনে লিখেছেন।”
দীপ্তেন্দ্রকুমার মনে করতেন ‘সাহিত্য মানেই গণসাহিত্য’, যে সাহিত্য “পরামর্শ দেয় আবহাওয়া বদলাও, সমাজব্যবস্থা বদলাও, অর্থনৈতিক সাম্য আনো— পাপ এবং পাপী, গুণ এবং গুণীতে রূপান্তরিত হবে।” সাহিত্যের নামে অশালীনতা তাঁর অসহ্য ছিল। একটি ঘটনার কথা খুলে বলা দরকার। ক্যালকাটা কেমিক্যাল-এর পক্ষে এক বার একটি অবিশ্বাস্য প্ল্যান ফাঁদা হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কয়েক জন লেখকের লেখা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করার ফন্দিতে নরেন্দ্র দেবকে সম্পাদক করে একটি গল্প সঙ্কলন বার করেছিলেন কর্তৃপক্ষ। বিভূতিভূষণের ‘বুড়ো হাজরা কথা কয়’ গল্পটি কী ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁরা দেখা যাক— “ঐ গল্পটিতে যে করুণ কাহিনীটি ব্যক্ত হয়েছে, সেই শোচনীয় অবস্থা এ দেশের বহু পরিবারকেই নিরানন্দ করে রেখেছে।... আমরা নিজেদের নিরুপায় মনে করে অবশেষে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দৈবের শরণাপন্ন হই, যেমন হয়েছিল উপরোক্ত কাহিনীর গ্রাম্য বধূটি।... কয়েকটি বিশেষ স্ত্রীরোগ অনেকসময় নারীর বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে ওঠে। এই সব দুরারোগ্য ও কষ্টদায়ক স্ত্রীব্যাধি নিরসনের জন্য উলটকম্বল, অশোক এবং আরো কয়েকটি স্ত্রীরোগের প্রতিষেধক ভেষজ সংমিশ্রণে দুটি মহৌষধ প্রস্তুত হয়েছে: ক্যাল কেমিকোর অশোকার ও অশোকিনা।” একই রকম ভাবে অন্য গল্পগুলি থেকেও, দীপ্তেন্দ্রকুমারের ভাষায় বলা যায় “শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রতি দরদী ব্যবসায়ীরা নিংড়ে টেনে বার করেছেন এমন কিছু যার জন্যে ক্যালকাটা কেমিকেলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
এমন বিকট উদ্যোগের তুলোধোনা করবেন না দীপ্তেন্দ্রকুমার, তা কি হয়! লিখলেন, “পৃথিবীর কোথাও নিজের দেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিককে কেউ এভাবে অপমান করতে সক্ষম হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই। ‘বুড়ো হাজরা কথা কয়’-এর মত গল্পের এই লেজুড় যিনি জুড়তে পেরেছেন, তার নিজের লেজ থাকা এমন কিছু অসম্ভব নয়। সেই লেজের মুখে আগুন লাগিয়ে তিনি কাদের মুখ পোড়াচ্ছেন— এটা একবার ভেবে দেখবেন কি?”
‘বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাস’ নামে মজার ছড়ায় সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যের চেহারা ধরিয়ে দিয়েছিলেন দীপ্তেন্দ্রকুমার, তাঁর চেনা ভঙ্গিতেই: “সুধীন্দ্রনাথ ডট. সজনীকান্ত ড্যাস—/ বনফুল স্টপ, তারাশঙ্কর ব্যাস!/ রিলকেতে দাঁড়ি। বুদ্ধদেব সেমি;/ বিষ্ণু দে শুধু কমা, ঊৰ্দ্ধকমা আমি/ ‘পরশুরাম চন্দ্রবিন্দু; প্রশ্নচিহ্ন খোদ—/ দেবতাত্মা হিমালয়, সান্যাল প্ৰবোধ!/ বিসর্গের শূন্য দ্বন্দ্ব মুখার্জি শৈলজানন্দ/ কোলনের দুটি ফুটকি:/ মুজতবা আলির চুটকি।”
সজনীকান্ত কেন ‘ড্যাস’— এটা নিয়ে তলে তলে মশকরা কি চলেনি তখন!
সজনীকান্তের মতোই দীপ্তেন্দ্রকুমারও মজার ঝোঁকে অনেক সময় রাখঢাক রাখতে পারেননি। এক বার কবি চিত্ত ঘোষের ‘দেবযানী’ নামের একটি কবিতায় দু’টি লাইন ছিল এ রকম, “তোমার বাহুর উপাধানে শুয়ে/ পেয়েছি পরম শান্তি।” দীপ্তেন্দ্রকুমারের ব্যাখ্যা, “এ-সমস্ত কথা চিত্রাভিনেত্রী দেবযানীকে লক্ষ করে কি না আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, উপাধান নরম না হলে তাতে শুয়ে শান্তি পাওয়া যায় না এবং যে-কোনো মেয়ের বাহুতেই হাড়ের পরিমাণ যথেষ্ট। হাড়ের বালিশে শুয়ে যে শান্তি পায় তার মাথায় নিশ্চয়ই গবেট পাথরের গুদোম আছে। কিন্তু উঁহু, চিত্ত ঘোষের মাথা সে-রকম নয়; যেহেতু ঐ কবিতার মধ্যেই আছে: ভ্রান্তি আমার ক্ষমা কর দেবযানী। তার মানে বাহুর উপাধানের কথাটা একটা ভ্রান্তি। শক্ত বাহুর বদলে নরম কোন্ জায়গাটাকে উপাধান বানিয়ে শুয়ে উনি পরম শান্তি পেয়েছিলেন এই আসল কথাটা কিন্তু চিত্ত ঘোষ বেমালুম চেপে যাচ্ছেন।”
একমাত্র রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই দীপ্তেন্দ্রকুমার ধারাবাহিক ভাবে অনুরাগ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও রকম কাটাছেঁড়া তাঁর অপছন্দ ছিল। সত্যজিৎ রায়ও ছাড় পাননি। ‘তিন কন্যা’, ‘চারুলতা’ বা ‘রবীন্দ্রনাথ’— সত্যজিতের কোনও ছবিই তাঁর অনুমোদন পায়নি। “রবীন্দ্রনাথের গল্পের পান থেকে চুন খসাবার অধিকার রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি নিতে পারতেন কি?”— জাতীয় মন্তব্য পড়ে খটকা লাগলেও মনে রাখার, ফিল্ম নিয়ে তাঁর পড়াশোনা কম ছিল না। ‘পাঁচটা ছটা নটায়’ নামে নিয়মিত একটি বিভাগ লিখতেন, সেখানে সেই সময়ের নানা ছবি নিয়ে তাঁর আলোচনা এখনও ভাবায়। ‘মহানগর’ নিয়ে চিদানন্দ দাশগুপ্তের অনবদ্য একটি লেখা তিনি ছেপেছিলেন ‘অচলপত্র’ পত্রিকায়। শুধু রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস তাঁর পছন্দ হত না। লিখেছিলেন এক বার, “রবীন্দ্রনাথের সক্ষম উপন্যাস লেখবার ক্ষমতার উপর তাঁর সহচরদের যেরকম আস্থা আর বিশ্বাস ছিল, তার থেকে হয়ত কিছু কম ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজের— কারণ, তিনি যত ভালো কবিতা আর যত ভালো ছোটগল্প লিখেছেন, তত ভালো উপন্যাস তিনি লেখেননি।”
রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভক্তিই তাঁকে বাধ্য করেছিল বুদ্ধদেব বসুকে ভুল বুঝে তাঁকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখতে। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে বাংলায় একটি কুখ্যাত ঘটনা ঘটেছিল। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর একটি বক্তৃতা বিকৃত হয়ে প্রচারিত হল বাংলায়। লোকজনের ধারণা হল, বুদ্ধদেব বিদেশে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ হয়ে গেছে। সবাই খেপে উঠলেন বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে। সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ এখানে ছাপিয়েও লাভ হয়নি। সেই সময় ‘বঙ্গভাষা’ নামে একটি কবিতা ছাপা হল ‘অচলপত্র’ কাগজে। নীচে লেখা: বু. ব.। কবিতাটির একটি অংশ তুলে দিলেই তার ঝাঁঝ মালুম হবে:
“স্বপনে রবীন্দ্রনাথ কয়ে দিলা পরে,— / “ওরে বাছা খ্যাতিমান হতে চাস যদি/ বাহিরে খ্যাতিতে মোর কালি ঢেলে ঘরে/ আপনারে বল্ শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-দরদী।”/ পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম হালে/ সুধীভোগ্যা বোদ্লেয়ার র্যাঁবো বৃদ্ধকালে॥’
মধুসূদন দত্ত সম্পর্কেও উঁচু ধারণা ছিল না দীপ্তেন্দ্রকুমারের। তিনি মনে করতেন, “শ্রীমধুসূদন বাংলা ভাষাকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্তই করতে পারেননি।” ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তাঁর কাছে ‘কৃত্রিম’ মনে হয়েছিল। মধুসূদন ‘চরিত্র’ সৃষ্টি করতে পারেননি বলেই তাঁর মত, কাব্যটি “শেষ করবার পর মনে কিছু দাগ কাটে না।”
প্রসঙ্গত, প্রায় এই রকমের মতই মধুসূদন সম্পর্কেলেখা প্রবন্ধ ‘মাইকেল’-এ প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসুও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy