বিদ্রোহ: খাঁপুরে আন্দোলনকারীদের জমায়েত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
তির চালানো নিয়ে সে দিন সাঁওতাল কৃষক শিবরামের মনে একটুও দ্বিধা ছিল না। তাঁর ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ শরটি সেই শীতের ভোরে পুলিশের মোটা ওভারকোট ভেদ করে বুকে গেঁথে গিয়েছিল। মৃত্যু নিশ্চিত। ঘটনার শুরু হয়েছিল ১৯৪৭-এর ৪ জানুয়ারি, উত্তরবঙ্গের চিরির বন্দর থানার বাজিতপুর গ্রাম। বঙ্গদেশ চালাচ্ছে মুসলিম লীগ সরকার। বলা-কওয়া নেই, কাকভোরে পুলিশ ঢুকে পড়ল গরিব খেতমজুর সমিরুদ্দিনের বাড়ি। সেই ভোরবেলায় তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল সামনের মাঠে। তীব্র হইচই, বেজে উঠল শাঁখ ও ঘণ্টার শব্দ— তার মানে পুলিশ এসেছে! এটাই সঙ্কেত। ভিড় জমে গেল মাঠে। কিন্তু কেউ কিছু বোঝার আগে সমিরুদ্দিন লুটিয়ে পড়লেন পুলিশের গুলিতে। শিবরামের তির আঘাত করেছিল যাকে, সেই পুলিশটি মারা গেল। ফলে পুলিশের বুলেট ছাড়েনি শিবরামকেও। রক্তাক্ত মাঠের কুয়াশামাখা সবুজে পড়ে ছিল অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত এক মুসলমান এবং এক সাঁওতাল কৃষকের শহিদ-দেহ। কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছিল সে সময়, অথচ তেভাগার নাছোড় দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষকের দুই বীর প্রতিনিধির মৃতদেহ ঘিরে অটল প্রতিজ্ঞায় বজ্রমুষ্টি হল অসংখ্য মানুষ। ধর্ম নয়, তাঁদের একটাই পরিচয় পরস্পরকে মিলিয়ে দিয়েছিল সে দিন— তাঁরা দরিদ্র এবং নিপীড়িত।
‘বাপের জমি চাষা হারায়,/ দাপের জমি জমিদার বাড়ায়’— এই প্রবাদের গায়ে লেগে আছে শতাব্দীপ্রাচীন কালিমা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সঙ্গে পঞ্চাশের মন্বন্তরের দূরত্ব প্রায় পৌনে দুশো বছরের, অথচ বাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের রক্ত-ঘাম-অশ্রুতে লেখা ইতিহাসে বরাবর দাপিয়ে থেকেছে জমিদার-জোতদার-মহাজন। একাধিক বার এদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, কিন্তু তার আঞ্চলিকতা তাকে সর্বাত্মক করে তুলতে পারেনি। তিরিশের দশক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নিবিড় আন্তরিক প্রচেষ্টার সুফল ফলেছিল পঁচাত্তর বছর আগে— অবিভক্ত বাংলার উনিশটি জেলার ষাট লক্ষ কৃষক ফসলের তেভাগা দাবিতে জমিদার-জোতদারের বিরুদ্ধে রক্তস্নাত যে বিদ্রোহ গড়ে তোলে ইতিহাস তাকে দিয়েছে ‘তেভাগা আন্দোলন’ শিরোনাম। পঁচাত্তুরে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের আড়ম্বরে তেভাগার সাড়ে-সাত দশকের অমলিন ঐতিহ্যকে বিস্মৃত হওয়া অপরাধ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, তার অনিবার্য নিয়তি সামন্তপ্রথা বাংলাদেশের কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করেছে ক্রমান্বয়ে। সম্বৎসরের ছবিটি ছিল এ রকম: নিজভূমে পরবাসী কৃষক নিজের লাঙল-গরু দিয়ে নিজের খরচায় অন্যের জমি চাষ করে ফসল ফলাবে। কয়েক মাস পরে পাকা ফসল কেটে লেঠেল বাহিনীর পাহারায় তা তুলতে হবে জমিদারের খোলানে। সেখানে মাপামাপি হবে। উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক জমির মালিকের প্রাপ্য। শ্রম বা অর্থ কিছুই দেয়নি সে, শুধুমাত্র মালিক বলে তার প্রাপ্য ফসলের অর্ধেক! অর্ধ বা আধা থেকে তৈরি হয়েছে ‘আধিপ্রথা’, তাই ভাগচাষিদের বলা হত ‘আধিয়ার’। তবে অন্যায় দাবির এখানেই শেষ নয়, বলা ভাল সবে শুরু। জমিদারের কাছারিঘর থেকে প্রাপ্য অর্ধাংশ নিতে গিয়ে কৃষক দেখল নায়েবমশাইয়ের খাতায় তার নামে নানাবিধ পাওনাগণ্ডার হিসাব: গদি-সেলামি, খোলান ঝাড়ানি, সালা, মাওলা, রাখনি, ভাতখাওয়ানি, খামারছিলা, দারোয়ানি, ঈশ্বরবৃত্তি, কয়ালি ইত্যাদি হাজারও বাজে আদায়। নায়েব রক্ষিতা রেখেছে তার জন্যও ট্যাক্স দিতে হত! এর সঙ্গে অতীতে ঋণ হিসেবে নেওয়া ধানের দুশো থেকে তিনশো শতাংশ সুদ! সব দেনা মিটিয়ে হতভাগ্য আধিয়ার বাড়ি ফিরত কখনও দু’-এক ধামা ধান নিয়ে, কখনও বা খালি হাতে। ঘরে তার অপেক্ষায় একাধিক ক্ষুধার্ত মুখ। সারা বছর তাদের নিয়ে এই সামান্য আয়ে চলবে কী করে? মহাজনের কাছে টাকা ধার নিয়ে সাদা কাগজে টিপছাপ দিয়ে আসতে হত। পরে সুদে-আসলে খেসারত দেওয়াকে সে মনে করত ললাটলিখন। এ ছাড়াও ছিল ভাগচাষিদের সঙ্গে নানা কারণে অপমানজনক ব্যবহার, কথায় কথায় পাশবিক অত্যাচার, বেগার খাটানো, তাদের ঘরের মেয়ে বা তরুণী বধূর উপর লালসার নখরাঘাত! কোনও চাষি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলে কাছারি বাড়িতে নায়েবের কাছে সেই মেয়েকে এক রাতের জন্য পাঠিয়ে তার পর বিয়ের অনুমতি মিলত! দুই শতক জুড়ে চলা এই ক্ষমাহীন অপরাধ ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে একযোগে চালিত করেছিল তেভাগা আন্দোলনের পথে।
ভারত ভেঙে স্বাধীনতা নিয়ে আসার আলাপচারিতায় যখন নেতারা মশগুল, ঠিক সেই স্বাধীনতার বছরে, ফেব্রুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে ১২১ রাউন্ড গুলি চালাল পুলিশ! বালুরঘাটের খাঁপুর গ্রামে। বাইশ জন কৃষক মারা গেলেন। আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে বালুরঘাট হাসপাতালে। এক জন মেডিক্যাল অফিসার এক মৃত্যুপথযাত্রী কৃষককে জিজ্ঞাসা করলেন: “আপনি কী চান?” ক্ষীণকণ্ঠে কৃষকটি কী বলছেন বোঝা যাচ্ছে না। চিকিৎসক মাথা নামিয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। সংগ্রামী কৃষক বার বার একই কথা বলে যাচ্ছেন: “তেভাগা চাই, তেভাগা চাই!”
কিন্তু তেভাগা আসলে কী? সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সমিতি মনে করেছিল, জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিতেই ঘটবে কৃষকের মুক্তি। সেই আন্দোলনের প্রথম ধাপ তেভাগা, অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে কৃষক, এক ভাগ জমির মালিক। ১৯৪০-এ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার ভূমি রাজস্ব কমিশন এই মর্মে খাজনা দেওয়ার সুপারিশ করলেও ক্ষমতাবান জমিদার-জোতদারেরা এর বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে ময়দানে নেমেছিল। ফলে তেভাগার সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকল বছরের পর বছর। ভয়াবহ মন্বন্তর পেরিয়ে গেল। কিছুই আর হবে না বুঝতে পেরে লাল নিশানধারী ষাট লক্ষ কৃষকের মরিয়া আন্দোলন সে দিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাবৃত্তের ভিত। ১৯৪৬-৪৭ সালের ক্রান্তিলগ্নে।
“হয় ধান নয় প্রাণ’ এ শব্দে/ সারাদেশ দিশাহারা,/ একবার মরে ভুলে গেছে আজ/ মৃত্যুর ভয় তারা”— লিখেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। অসংখ্য ছবি আঁকার পাশাপাশি পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন একাধিক অমর পঙ্ক্তি, “ফসলের তেভাগা চাই/ জান দুবো— ধান দুবোনি ভাই।”
এখন যাঁর কথা আসবে তাঁর নাম রাসমণি। তবে ‘রানি’ নন, ‘ডাইনি’! সুসং পরগনার হাজং সমাজে এই বিশেষণ তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে বিধবা হয়েছিলেন বলে। তেভাগার দিনে ইনিই আবার সশস্ত্র নারীবাহিনী তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শোনাতেন প্রতিরোধের কথা।
বহেরাতলি গ্রামে ১৯৪৬-এর এক শীতের বিকেলে প্রায় পঁচিশ জন সেনা বন্দুক-সহ ঢুকে পড়ল। পুরুষশূন্য সেই গ্রামে মেয়েদের উপর নিদারুণ অত্যাচারের খবর পৌঁছে গিয়েছে ‘ডাইনিবুড়ি’র কাছে। সোমেশ্বরী নদীর তীরে অতি সাধারণ অস্ত্রধারিণীদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রধারী সেনাপুঙ্গবদের অসম লড়াই শুরু হল। সেই যুদ্ধের বিবরণে ফুটে উঠেছে বীরাঙ্গনা রাসমণির অন্তিম প্রতিরোধের কথা: “রাসমণি সমস্ত শক্তি সংহত করে এক সিপাহীর উপর দায়ের কোপ বসিয়ে দিলেন। ঐ আঘাতেই সিপাহীর মুণ্ড দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।… সৈন্যেরা উন্মত্তের মত তাঁর দিকে গুলিবর্ষণ করতে লাগল। দশটি বুলেটে রাসমণির দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল।”
আন্দোলন চলতে চলতে তেভাগা-বিস্তৃত প্রত্যন্ত গ্রামেও এই সংবাদ পৌঁছল। দেশ এখন স্বাধীন। তেরঙ্গা উড়ছে। ভারতমাতার জয়ধ্বনি, বন্দে মাতরম্! আশায় বুক বেঁধেছে তেভাগার চাষিরা: এ বার তাদের সুখের দিন আসবে। কোথায় এল তা? ১৯৪৮ সালের ৬ নভেম্বর। স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের বুলেটে ঝলসে গেল কাকদ্বীপের গর্ভবতী চাষিবৌ অহল্যার পেটের সন্তান। তেভাগার দাবি জানিয়ে অহল্যা নেমেছিল পথে, মিছিলে পা মিলিয়েছিল। স্বাধীন বেয়নেটের খোঁচায় তাঁর চিরে যাওয়া পেট থেকে বেরিয়ে এসেছিল শিশুটির ছোট্ট হাত! এর অভিঘাতে সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘কাকদ্বীপ’ কবিতাটি: “পায়নি যে শিশু জন্মের ছাড়পত্র/ তারি দাবি নিয়ে সারা কাকদ্বীপে/ কোনো গাছে কোনো কুঁড়িরা ফোটেনি।”
নাচোলের রাজমাতা ইলা মিত্র আজ কিংবদন্তি। গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর উপর যে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ, তার বিবরণ আছে ইলার জবানবন্দিতে: “... চার অথবা পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক মাটিতে চিত করিয়ে শুইয়ে রাখে এবং একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেয়। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি আগুনে পুড়ে যাচ্ছি।... তার পর একটি লোহার পেরেক আমার ডান পায়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, আমি তখনো কিছু স্বীকার করিনি।” বুধনি ওরাওঁনি, ফকো বর্মণী, সাবেরা খাতুন, সুরধনী বাজ, লক্ষ্মীবালা সাউট্যা, জৈবন বিবি, দুলি কিস্কুর মতো হাজার হাজার নারী সংগ্রামী সে দিন এই ধানের লড়াইয়ে পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মণিকুন্তলা সেন লিখেছেন, “মেয়েদের সঙ্গে পুলিশের মুখোমুখি লড়াই হয়েছে।... তারা মার খেত, অত্যাচারে জর্জরিত হত, আবার যা পেত তাই দিয়ে মারত— তবু পুরুষদের সামনে আসতে দিত না।” ইতিহাসে কোনও দিন আসবে না এঁদের ‘বিকল্প স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এর কথা। নারীর আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াই ইতিহাসে লেখা না থাকুক, তাকে সোনার অক্ষরে অমর করে রেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘হারাণের নাতজামাই’ গল্পে। গত বছরই আমরা পেরিয়ে এলাম আজীবন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী শিল্পী সোমনাথ হোরের শতবর্ষ। তাঁর বহু লেখায় ও শিল্পকর্মে তিনি কৃষকদের আন্দোলনের কথা লিখেছেন। সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন দরিদ্র হতভাগ্য চাষিদের উপর জমিদারশ্রেণিরনিষ্ঠুর অত্যাচার এবং দুর্নীতির কথা।
‘নিজ খোলানে ধান তোল’, ‘আধি নাই, তেভাগা চাই’, ‘কর্জা ধানের সুদ নাই’— ভবানী সেন রচিত এই তিন স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা, ডিমলা, জলঢাকা, রানীশংকাইল, নন্দীগ্রাম, সন্দেশখালি, নড়াইল-সহ বিস্তৃত অঞ্চল। লুঠতরাজ আর ডাকাতির কাল্পনিক অভিযোগে তেভাগা চাষিদের জীবন বিপর্যস্ত করে দিতে দ্বিধা করেনি শাসক। পুলিশ যেন খুনের নেশায় মেতে উঠেছিল আন্দোলন দমনের জন্য। তেভাগার প্রথম সারির নেতা সুশীল সেন লিখেছেন: “তেভাগার দাবি সেদিন আদায় করা যায় নাই। শাসকশ্রেণি কৃষকদের রক্তের বন্যায় ঐ সংগ্রাম ডুবাইয়া দেয়।” তা ছাড়া পরাজয়ের কারণ হিসেবে এই আন্দোলনের কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি, কিছু দুর্বলতাকেও দায়ী করতে হবে। কিন্তু লাল ঝান্ডার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ লক্ষ লক্ষ কৃষকের এই আন্দোলন নারীজাগৃতির পাশাপাশি আরও একটি মন্ত্র গ্রামসমাজকে দিয়েছিল। তার গুরুত্ব আজও এতটুকু ম্লান হয়নি: “দাড়ি টিকি ভাই ভাই,/ লড়াইয়ের ময়দানে জাতিভেদ নাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy