গল্পকার: আঁতোয়ান দ্য সন্ত্-এগজ়ুপেরি-র শিশুসাহিত্যে ছিল আশ্চর্য মায়া(উইকিমিডিয়া কমন্স)। ডান দিকে, ‘দ্য লিটল প্রিন্স’ বইটির প্রচ্ছদ।
গল্পের যে কথক, তার ছ’বছর বয়সে সে একটা ছবি এঁকেছিল। একটা অজগর সাপ একটা হাতি গিলে ফেলেছে। বড়রা সেটার মানে বুঝতে পারেনি। সবাই ওকে পরামর্শ দিল, আঁকাআঁকি ছেড়ে লেখাপড়ায় মন দিতে। ছেলেটা মেনে নিল। বড় হয়ে পাইলট হল। সারা পৃথিবী উড়ে বেড়াতে লাগল। কিন্তু এক দিন তার প্লেন ভেঙে পড়ল সাহারা মরুভূমিতে। জনমানবহীন মরুপ্রান্তর, জলের ভীষণ অভাব। এক সময় রাত নামল, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কথক। ভোরের দিকে কারও গলার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙল। উঠে দেখল, ছোট্ট এক রাজপুত্র তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজপুত্রের আবদার, তাকে একটা ভেড়া এঁকে দিতে হবে…
এ ভাবেই শুরু হয় ‘দ্য লিটল প্রিন্স’, আঁতোয়ান দ্য সন্ত্-এগজ়ুপেরি-র বিশ্ববিখ্যাত শিশুপাঠ্য ফ্যান্টাসি। ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে জন্ম নেওয়া, অভিজাত সন্ত্-এগজ়ুপেরি’র জীবন তাঁর কাহিনির সেই কথকের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর ছিল না। যুবক বয়সে ডাক বিভাগের হয়ে নিয়মিত প্লেন ওড়াতেন তিনি। বিভিন্ন দেশে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। এক জন পাইলটের আকাশভ্রমণের বৃত্তান্ত নিয়ে লেখা তাঁর দুটো উপন্যাস— ‘নাইট ফ্লাইট’ (১৯৩১) ও ‘উইন্ড, স্যান্ড অ্যান্ড স্টারস’ (১৯৩৯) পাঠকমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তার পর আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশের হয়ে লড়তে অকুতোভয় সন্ত্-এগজ়ুপেরি যোগ দেন ফরাসি বিমানবাহিনীতে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ফ্রান্স। ভাঙা মনে মাতৃভূমি ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি দেন তিনি, সেখানেই সৃষ্টি করেন তাঁর অমর কীর্তি।
১৯৩৫ সালে এক বার বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন সন্ত্-এগজ়ুপেরি, তাঁর এরোপ্লেন বিকল হয়েছিল লিবিয়া মরুভূমি অঞ্চলে। খাদ্য-পানীয়-আশ্রয়ের অভাবে প্রাণ যায়-যায় অবস্থা, এমন সময় এক দল বেদুইনের সহায়তায় তিনি উদ্ধার পান। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা গভীর ভাবে রেখাপাত করেছিল লেখকের মনে। সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিটোল এক গল্প আর অনেকখানি মানবিক অনুভূতির মিশেল ঘটালেন তিনি, রচনা করলেন ছোট্ট রাজপুত্রের মর্মস্পর্শী আখ্যান। ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় প্রকাশ পেল ‘দ্য লিটল প্রিন্স’ (ফরাসি নাম ‘লা পেতিত প্রিন্স’)। বাকিটা ইতিহাস!
মহাকাশের এক গ্রহাণু বি ৬১২। সেখানেই ছোট্ট রাজপুত্রের বাস। রাজপুত্রের মতোই আকারে ছোট সেই গ্রহাণু। তিনটে খুদে আগ্নেয়গিরি নিজের হাতে পরিষ্কার করা, আগাছার মতো বাওবাব গাছ উপড়ে ফেলা— এই সব কাজেই দিন কাটে রাজপুত্রের। হঠাৎ এক দিন এক নতুন ফুল ফুটল সেখানে— একটা গোলাপ। তার সৌন্দর্য, তার সুগন্ধ রাজপুত্রকে অদ্ভুত মায়ায় বাঁধল। ফুলটার যত্নে ত্রুটি রাখল না সে; নিয়ম করে জল দিল, কাচের গোলক দিয়ে ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করল। কিন্তু রাজপুত্র বুঝতে পারল না, কেমন করে গোলাপের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবে। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গ্রহান্তরে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। বেরিয়ে পড়ল এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখির সঙ্গী হয়ে। একের পর এক গ্রহাণু-সফর সেরে পৃথিবীর মাটিতে পা দিল ছোট্ট রাজপুত্র। শিশুরা কল্পনাপ্রবণ। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ তাদের কাছে পাল-তোলা জাহাজ হয়ে ধরা দেয়, পুরনো জ্যামিতি বাক্সে তারা পায় গুপ্তধনের ঠিকানা। ছোট্ট রাজপুত্র শৈশবেরই প্রতীক, তার হৃদয় জুড়ে সারল্য। তাই তো কথকের আঁকা হাতি গিলে ফেলা সাপের ছবি— যা বড়দের কাছে দুর্বোধ্য— দেখামাত্র বুঝে ফেলে সে। কাগজে আঁকা বাক্সের ভিতর অদৃশ্য ভেড়া খুঁজে নেয় অনায়াসে। রাজপুত্রের দু’চোখে বিস্ময়ের কাজল। অস্তগামী সূর্যের রূপ তাকে মুগ্ধ করে। কাহিনি যত এগোয়, ছোট্ট রাজপুত্রের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ততই বদল আনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আশপাশের আপাত-তুচ্ছ জিনিসকেও উপভোগ করতে শিখি। এক সময় সম্মুখীন হই সেই চরম সত্যের— যা খালি চোখে দেখা যায় না, তাকে একমাত্র অন্তর দিয়েই উপলব্ধি করা সম্ভব।
পৃথিবীতে এসে ঝোপভর্তি গোলাপ দেখতে পায় রাজপুত্র। তার ধারণা হয়, বি ৬১২ গ্রহাণুতে ফেলে আসা গোলাপটা বোধহয় সামান্য, গুরুত্বহীন। কিন্তু এক শেয়াল এসে তার সেই ভুল ভাঙায়। বুদ্ধিমান শেয়াল রাজপুত্রকে বোঝায়, তার গ্রহের গোলাপ তার পোষ মেনেছে, তাই সেটার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যাকে ভালবাসি, যাকে নিজের মতো করে পেতে চাই, তা সব সময়ই অনন্য, সবচেয়ে দামি। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় ছোট্ট রাজপুত্র, এর পর শুধু বাকি থাকে তার নিজের দুনিয়ায় ফিরে যাওয়া। বিদায় নেওয়ার আগে কথককে আকাশের তারাদের দিকে চোখ রাখতে বলে সে, কথা দেয়, তারাদের জ্বলা-নেভার মধ্যে সে রয়ে যাবে চিরতরে। গল্পের শেষে একটা সাপ এসে রাজপুত্রকে কামড়ায়। লুটিয়ে পড়ে তার প্রাণহীন দেহ, আর তার সূক্ষ্ম শরীর ফিরে যায় তার প্রিয় ফুলের কাছে। রয়ে যায় কথক, ছোট্ট রাজপুত্রের স্মৃতি আর অনেকখানি মনখারাপ বুকে নিয়ে।
একটা বই কচিকাঁচাদের মন জিতে নিচ্ছে, আবার প্রাপ্তমনস্ক পাঠকদেরও ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছে— এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। এখানেই আঁতোয়ান দ্য সন্ত্-এগজ়ুপেরি’র সাড়ে ষোলো হাজার শব্দের উপন্যাসের মাহাত্ম্য। রূপকের সুচারু ব্যবহার ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-কে সাধারণ শিশুপাঠ্য রূপকথার স্তর থেকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। তারাদের প্রতি রাজপুত্রের আগ্রহ যেমন প্রকৃতির নানা রহস্যের প্রতি শিশুদের স্বাভাবিক কৌতূহলকে চিহ্নিত করে, তেমনই গোলাপের প্রতি তার টান বন্ধুত্বের, ভালবাসার দ্যোতনা জাগায়। গল্পে বর্ণিত দুই পশুচরিত্র— শেয়াল ও সাপ— আদর্শ ‘গাইড’ আর্কেটাইপ হিসাবে আমাদের সামনে আসে। শেয়াল রাজপুত্রের পোষ মানে, সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করে তাকে প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান দেয়, আর সাপ মৃত্যুর আভাস বয়ে আনলেও প্রকৃতপক্ষে মুক্তিদূতের ভূমিকাই পালন করে, রাজপুত্রের জাগতিক অস্তিত্বের ইতি টেনে তার চেতনাকে উত্তরণের পথে এগিয়ে দেয়। কাহিনিতে ক্ষমতার দম্ভ, নিত্যনতুন আবিষ্কারের লোভ প্রভৃতি মানবতার নানা ভুলভ্রান্তিকে ‘ক্যারিকেচার’-এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক।
১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই অন্তিম বার আকাশে উড়ান দিয়েছিলেন সন্ত্-এগজ়ুপেরি। দক্ষিণ ফ্রান্সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তাঁর উড়োজাহাজ। তাঁর উপন্যাসের আকাশছোঁয়া সাফল্য তিনি দেখে যেতে পারেননি। প্রকাশের পর পেরিয়েছে সত্তর বছর, তবু এতটুকু ম্লান হয়নি ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-এর ঔজ্জ্বল্য। বাইবেলের পরেই সবচেয়ে বেশি ভাষায় (৫০৫টি) অনূদিত হওয়ার গৌরব, পৃথিবীতে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় একেবারে উপরের দিকে স্থান অর্জনের সম্মান পেয়েছে এই উপন্যাস। বড় পর্দা, ছোট পর্দা, নাটকের মঞ্চ মাতিয়েছে ছোট্ট রাজপুত্র। কখনও কার্টুন, কখনও কমিক্সের বাগানে ফুল ফুটিয়েছে।
আজকের দিনে বাচ্চাদের নিজস্ব জগৎ বলে কিছু নেই। এমন পরিস্থিতিতে ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-ই হয়ে উঠতে পারে সেই অমূল্য পরশপাথর, যা আলোর সেতু হয়ে ছোটদের পৌঁছে দেবে কল্পলোকের অচিন দেশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy