Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Story

‘রবিকা’র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য

প্রতিষ্ঠাতার শিক্ষানীতি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন আজীবন। সব সময় চেষ্টা করেছেন দুঃস্থ বিধবা ও অনাথাদের আত্মনির্ভর করার জন্য । আগামী ২৯ ডিসেম্বর ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর সার্ধশতবর্ষের সূচনা।

রিম্পি
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:০০
Share: Save:

রবিকার সুরে আর কথায় বাঁধা ছিল প্রিয় ইন্দিরার মনের তান, তাই তিনি যে রবিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তাল-লয় বুঝতে পারবেন ঠিক, তা নিয়ে নিঃসংশয় ছিলেন আশ্রমিকরা। বস্তুতপক্ষে সঙ্গীত ভবনের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ মনোযোগ। সঙ্গীত ভবন আর কলাভবন যে রবিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের থেকে আলাদা করেছে, তা তিনি বুঝতেন। রবিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা উপাচার্য। স্থায়ী নন, অস্থায়ী।

রবিকার প্রিয় ইন্দিরা স্মৃতিতে আগলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বহু গানের সুর। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যেই বড় হয়ে ওঠা তাঁর। কখনও তাঁর গানে বাজিয়েছেন হারমোনিয়াম, কখনও পিয়ানো। স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে তাঁর মনে পড়েছে পুরনো দিনগুলির কথা। আদি ব্রাহ্মমাজের মাসিক উপাসনায় ইন্দিরা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, আর গাইছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গানের ধারায় যে নানা সুর এসে মিশেছে, জানতেন ইন্দিরা। তবু তাঁর মনে হয়েছে, রবিকার গান স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। রবীন্দ্রনাথ মানুষটাও তো ছিলেন সকলের থেকে আলাদা... ভাবনায়, কর্মে, সৃষ্টিতে।

সেই রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন ১৯৪১-এ। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী চলে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। এ জায়গা প্রকৃতির সঙ্গে তৈরি করেছে তাঁর সংযোগ। বৃষ্টিদিনে উদয়ন বাড়ির দোতলার জানলায় বসে তাঁর মনে হয়েছে, ‘যেন বর্ষার ধারা সার বাঁধা সেনাবাহিনীর মতো মাঠের উপর দিয়ে দৌড়ে আসছে।’ শান্তিনিকেতনের দিনগুলোয় নানা কাজে ডুবে থাকতেন ইন্দিরা। দুপুরবেলায় ছুঁচ-সুতো নিয়ে বসে পড়তেন রিফু করতে। দৈনিক কাজের একটা তালিকাও প্রস্তুত করেছিলেন। তাতে লেখাপড়ার সঙ্গে দুপুরে শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ার পরিকল্পনাটিও বাদ যায়নি। কখনও কখনও আবার তাঁকে কোলাহলবিমুখ হতে দেখা যেত। রোজনামচায় লিখেছেন, ‘আজ শ্রীনিকেতনের মেলায় লোকে যাচ্ছে আসছে, কিন্তু আমি আর গেলুম না। চুপ ক’রে বাড়ি ব’সে লেখাপড়া ও নিত্যকর্ম ছাড়া আর কিছু পোষায় না। কর্মেরও অভাব নেই।’

জীবনের শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের জন্য নিজেকে নানা কর্মে নিয়োজিত করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। রবীন্দ্রনাথের যাওয়ার পর যখন তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে অনেকেই ‘গেল গেল’ রব তুললেন, তখন ইন্দিরা ভাবতেন অন্য কথা। ভাবতেন, পরিবর্তন তো হবেই, তবু রবিকার শিক্ষানীতির মূল দিকটিকে বাঁচিয়ে রাখা চাই। সে ভাবনা বাস্তবায়িত হয়েছিল তাঁর সঙ্গীত ভবনে শিক্ষকতা-কালে। সেখানে সঙ্গীতশিক্ষার উন্নতির চেষ্টা করে গেছেন সর্বদা। এক বার সঙ্গীত ভবনের প্রথম-বার্ষিক শ্রেণির বীরেন্দ্রনাথ পালিত, প্রফুল্লকুমার দাস প্রমুখ এসে তাঁর কাছে অভিযোগ করে গেলেন। জানালেন, ক্লাস তাঁদের ‘ইন্টারেস্টিং’ লাগছে না। গানের সুর কোথায় কী লাগছে, ক্লাসে বোঝা যায় না ঠিক করে। তাঁরা আরও শিখতে চায়। শিখবার সুযোগটুকু যেন তাঁদের দেওয়া হয়। সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী। নিজেই ওঁদের গান শেখানোর ভার নিলেন— ‘আমি বলেছি ওদের, বৃহস্পতিবার ও রবিবার সন্ধ্যায় শিখতে আসতে, গত রবিবারে এসেছিল। ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’ আরম্ভ হল। শান্তি খাস্তগীরও এসে যোগ দিলে।’

প্রবাসে ইন্দিরা দেবী ও সুরেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর অভিভাবকত্বে যেভাবে বড় হয়ে উঠেছিলেন তাতে বাধা-নিষেধের তেমন বাড়াবাড়ি ছিল না। পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা। তাই তাঁর বিশ্বভারতী ভাবনায় দেখা যায় বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান। ঠাকুরবাড়ির অনেক রীতি ইন্দিরা দেবী শান্তিনিকেতনে চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। মেয়েদের স্বাধীনতার বিষয়টি তাঁকে খুব ভাবাত। চেয়েছিলেন সমাজের দুঃস্থ বিধবা ও অনাথাদের আত্মনির্ভর করে তুলতে। শান্তিনিকেতনে এসেও মেয়েদের কথা বিশেষ করে ভাবতেন। খেয়াল রাখতেন তাদের সুবিধে-অসুবিধেগুলো। আশ্রমিক মহিলাদের নিয়ে ‘আলাপিনী’ মহিলা সমিতিকে যেন আবার জাগিয়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা দেবী।

১৯৫৬ সাল তখন। ইন্দিরা দেবী বিশ্বভারতীতে বছর খানেকের জন্য অস্থায়ী উপাচার্যের কার্যভার গ্রহণ করলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতিমোহন সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচীর পর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহিলা উপাচার্য। আশ্রমিকরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। আশ্রমিকদের প্রিয় বিবিদিকে নিয়ে রথীন্দ্রনাথের মতো তৈরি হয়নি কোনও অবাঞ্ছিত বিতর্ক। বিবিদিও তাঁর কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। শুধু কর্তব্যই নয়, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। ‘স্মৃতিসম্পুট’-এ লিখেছেন সে-কথা, ‘৪ঠা ইস্কুল খুললে। ...সংগীত ভবনের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ফিরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। সেটা ভালো লাগে, কারণ আমার ইচ্ছে যে, শুধু শিক্ষকতার সম্বন্ধ ছাড়া ওদের সঙ্গে একটা হৃদ্যতার সম্পর্কও থাকে।’ রবীন্দ্রনাথও তেমনটাই চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, বিদ্যাদানের জন্য গুরুশিষ্যের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠা আবশ্যক।

রবিকাকে ছেলেবেলা থেকেই নানা সহজ চেহারায় দেখেছিলেন ইন্দিরা দেবী। তাঁর স্মৃতিকথায় সেই সব ঐকান্তিক মুহূর্তের ছবি আছে। ৪৯ নম্বর বাড়ির তেতলার ঘরে রবিকা খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে শ্লেট পেন্সিল হাতে নিয়ে ‘মায়ার খেলা’ রচনা করছেন, আর গুনগুন করে সুর দিচ্ছেন। কখনও রবিকার সঙ্গে চলে যাচ্ছেন নানা সভায়। একবার রবিকার সঙ্গে গিয়েছিলেন বঙ্কিমবাবুর বাড়ি— ‘তাঁর উপন্যাস তখন টাটকা টাটকা খোলা থেকে সবে নাবছে, আর মেয়েরা নতুন নতুন বই পড়বার জন্য আঁকুবাঁকু করছে।’ এই সব স্মৃতি ইন্দিরা দেবীর লেখায় এসেছে ফিরে ফিরে।

ইন্দিরা দেবীর ইচ্ছে হত, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের পীঠস্থানে সঙ্গীতশিক্ষার উন্নতি করতে। ‘স্মৃতিসম্পুট’-এ লিখেছেন, সেই কাজে হাত দিয়ে তিনি ক্রমশই বুঝতে পারছিলেন, ‘খুব কম মেয়েই গলা খুলে গায়, ভালো মিষ্টি দরদী অথচ জোরালো গলা নেই বললেই হয়।’ ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা নিতে গিয়েও তাঁর মনে হয়েছে, তানপুরার সঙ্গে সকলে সুর মেলাতে পারে না। স্বরলিপিও পড়তে পারে না ঠিক করে। অথচ স্বরলিপির চাবি যদি হাতে থাকে, তা হলে সব গানই করতলগত হতে পারে। শৈলজাবাবুকেও বলেছিলেন, ক্লাসে যেন তানপুরার সঙ্গে অবশ্যই গান শেখানো হয়। অন্য দিকে তাঁর মতে, ‘ছেলেদের সকলেরই গলা ভালো, শুনে সুখ হয়।’ কিন্তু শান্তিনিকেতনে যে ভাবে বছরভর নানা অনুষ্ঠানের জন্য ছেলেমেয়েরা গান অভ্যাস করে, এতে ইন্দিরার মনে হত, এত অভ্যাসের ফলে আসল দিনের জন্য তাদের গলা আর অবশিষ্ট থাকে না। এর প্রতিকার দরকার।

শুধু গানের অভিযোগই নয়, শান্তিনিকেতনের আরও টুকরো টুকরো অসুবিধেগুলি ইন্দিরা দেবীকে ভাবিয়ে তুলত। সঙ্গীত ভবনে শিক্ষকতার সময় এক বার ইন্দিরার উদ্যোগে রাখীপূর্ণিমায় বর্ষামঙ্গলের আয়োজন করা হল। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নন্দিতা দেবী, সুবিনয় রায় সহ আরও অনেকে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানও মন্দ হল না। কিন্তু সিংহসদনে যেভাবে ভিড় উপচে পড়েছিল তাতে অনুষ্ঠান উপভোগ করার পরিস্থিতি ছিল না বললেই চলে। সেই দেখে ইন্দিরার মনে হয় যে, সিংহসদন বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এখনকার শান্তিনিকেতনেও এই ভিড় এক বালাই। মানুষের ভিড়ে সিংহসদনই শুধু নয়, বাইরে গৌরপ্রাঙ্গণের মাঠও ছাপিয়ে যায় আজকাল। তাতে যেন অনুষ্ঠানের প্রাণ হারিয়ে যায়! মানুষের কলরবে চাপা পড়ে যায় গানগুলি। ইন্দিরা দেবীরও মনে হত, সঙ্গীতের মতো সুকুমার কলা এমন পাইকেরি ভিড়ে কি সত্যিই উপভোগ করা সম্ভব! আবার কাউকে বঞ্চিত করতেও মন সায় দিত না তাঁর। বিলেতে তো ছেলেবেলায় স্বচক্ষে দেখেছিলেন সেখানকার সঙ্গীতসভায় মানুষের ভিড় কী ভাবে উপচে ওঠে। অথচ সেখানে নিয়মপালন বেশি বলে তৈরি হয় না কোনও বিশৃঙ্খলা।

সঙ্গীত ভবনে রবিকার একটা ছবি রাখতে সাধ হয়েছিল ইন্দিরার। চারকোলে আঁকা সেই ছবি রবীন্দ্রভবন থেকে এনে বাঁধিয়ে দেন রথীন্দ্রনাথ। সরস্বতী পুজোয় শ্রীপঞ্চমী তিথিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটা, ‘ঘরের একদিকের দেয়ালের মানুষ-সমান উঁচু অংশ, আর ছবির মঞ্চ হলদে কাপড় দিয়ে ঢাকা ও ছবিতে একটা মোটা মালা এবং তলায় ফুল ও ধূপকাঠি দেওয়া হয়েছিল। আমরাও এখান থেকে একটা পলাশের মালা জুগিয়েছিলুম। ছবিটা সকলেই পছন্দ করলে।’ শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতার দিকটি ইন্দিরাকে বিশেষ করে ভাবাত। অনুষ্ঠানের দিনে, উত্তরায়ণের সিঁড়ির ধাপগুলো আলপনায় ভরে উঠলে বড় খুশি হতেন ইন্দিরা। নন্দলাল বসুর উপাধি লাভের অনুষ্ঠানে কলাভবনের আলপনায় সাজানো গাছতলার উল্লেখ আছে তাঁর স্মৃতিকথায়। অনুষ্ঠানে গিয়ে অন্য কোথাও না বসে, সেই আলপনাঘেরা খোলা জায়গার গাছতলাটিতেই বসেছিলেন তিনি। এ ভাবেই শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিতে, আলপনায়, গানে মিলেমিশে থাকতেন আশ্রমের বিবিদি। কিন্তু ১৯৬০, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের এক বছর আগে চলে গেলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। তার পরের বছর, অর্থাৎ জন্মশতবর্ষের বছরেই চলে যাবেন রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। পর-পর দু’বছরে তাঁদের এই প্রয়াণ কবিগুরুর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে যে বিশেষ ভাবে রিক্ত করেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে শান্তিনিকেতনের গান থেমে যায়নি।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy