রাগ ভৈরব। ফাঁক ও সম মেলাতে পারছিলেন না ছাত্র। বার বার চেষ্টাতেও বিফল। উস্তাদ ভীষণ রেগে জোড়া পায়ে লাথি মারলেন ছাত্রকে, ছাত্রটি ছিটকে পড়লেন সবার সামনে। লজ্জায় বেশ কিছু দিন গেলেন না আর উস্তাদের বাড়ি। পরে এক দিন উস্তাদ খবর পাঠালেন, “গিয়া কইবেন, না আইলে কানে ধইরা লইয়া আমু।”
ছাত্র এলেন।
উনি ছাত্রকে বললেন, “অন্যায় করলে বাবা-মা কি বকেন না? তাতে কি রাগ করে কেউ?”
ঘটনাটা উনিশশো তেতাল্লিশ কি চুয়াল্লিশের। সে দিনের সেই ওস্তাদ ছিলেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ও সুরবাহার বাদক উস্তাদ আয়াত আলিখান। উস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের ভাই।
আর সে দিনের সেই ছাত্র পরে লোকসঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র— অমর পাল।
মা দুর্গাসুন্দরীর কাছেই লোকসঙ্গীতের প্রথম পাঠ। দশ বছর বয়সে পিতৃহীন হয়ে সংসারের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতাতেও ছাড়েননি গানের হাত। দশকের পর দশক রেকর্ড-ক্যাসেট থেকে আজ অবধি ইন্টারনেট পরিষেবার বিভিন্ন মাধ্যমে সঙ্গীতরসিক মানুষের কানে সুধা ঢেলে গিয়েছেন তাঁর লোকগান দিয়ে। গত ১৯ মে কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল।
মাটির সুরে অমর পাল জয় করেছেন বাংলা গানের মস্ত ভুবন, সেতু বেঁধেছেন প্রবাহ থেকে প্রবাহে, ভালবাসায়, পরম্পরায়, সুরে সুরে।
বাল্যকাল থেকেই বৈষ্ণব প্রভাতী সঙ্গীত, চৈতন্যলীলা, রামায়ণের গান, পদ্মপুরাণের গান ঘণ্টার পর ঘণ্টা অক্লান্ত গেয়ে যেতে পারতেন। প্রবল সাংসারিক আর্থিক অনিশ্চয়তায় দিশেহারা অবস্থা তখন। এ দিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উচ্চমার্গে উঠতে না পারলে উপার্জনও অনিশ্চিত। তাই কলকাতায় গান শেখার দুর্নিবার টান আর থিতু হওয়ার বাসনায় মাত্র ষোলো বছর বয়সে অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মায়ের গয়না সম্বল করে কলকাতায় চলে এসেছিলেন তিনি সঙ্গীতের খোঁজে। সেখানে সুরলোকের রাজপ্রাসাদে অধিষ্ঠিত তাঁর প্রাণপ্রিয় শিল্পী শচীন দেব বর্মণ, অনন্তবালা বৈষ্ণবী, পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কানন দেবীরা।
প্রথমে গান শেখা শুরু করলেন মণি চক্রবর্তীর কাছে। পল্লিগীতির দিকপাল সুরেন চক্রবর্তী তখন এক বিরাট প্রতিষ্ঠান। তাঁর কাছেও তালিম নিয়েছেন তিনি। সঙ্গীতগুরু মণি চক্রবর্তী ও সুরেন চক্রবর্তী তাঁকে সঙ্গীতের সুরলোকে প্রবেশের চাবিকাঠি হাতে তুলে দিয়েছেন। আবার আব্বাসউদ্দিন ও শচীন দেব বর্মণ, এই দুই শিল্পীর কাছে তিনি ঋণী, এ কথা বার বার উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলতেন, “গান আমার ছেলেবেলার জীবনসঙ্গী। কখন গানকে ভালবেসেছি তা জানি না, যেমন জানি না মাকে ভালবাসার প্রথম দিনটি। বাংলার প্রকৃতিতে যে সুর নিত্য বাজে তাই আমাকে পথের পাঁচালীর অপুর মতো বারবার ঘর ছাড়া করেছে।”
১৯৫১ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অনুমোদন পান এবং পরবর্তী কালে সর্বোচ্চ গ্রেডও অর্জন করেন তিনি। তৎকালীন রেডিয়ো-শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী বললেন, “আরে অমরবাবু আপনার গলা তো চমৎকার, রেকর্ড করবেন?” সিনোলা কোম্পানির ম্যানেজারের পছন্দ হল তাঁর গান। দুটো গানের রেকর্ডিং হল। এক পিঠে ‘কোন গেরামের কন্যা’, অন্য পিঠে সুরেন চক্রবর্তীর কথা ও সুরে ‘গারো পাহাড়ের গেরুয়া মাটিতে’। কিন্তু গানের শ্রোতা কই!
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পল্লিগীতি বিশেষ ধরনের শ্রোতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নদীনালার ভাটিয়ালি গান তাঁদের কাছে ফেলে আসা জীবনের বেদনাবিধুর স্মৃতি। সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের কাছে পল্লিগীতি ছিল ব্রাত্য।
বাংলা আধুনিক গানের তখন স্বর্ণযুগ। জনপ্রিয় অসাধারণ সব গানের সুরকার গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে একটা সুরের প্লাবন চলছে তখন। গুণী শিল্পীদেরপ্রতিভার ঝলকে বাংলার সঙ্গীতাকাশ আলোয় ঝলমলে।
সে বার দিল্লিতে ভাটিয়ালি গানের উপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। নির্দেশ আসে কলকাতা রেডিয়োতে, ভাটিয়ালি গানের বিশিষ্ট শিল্পীদের নিয়ে একটি রেকর্ডিং করার। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, অমর পালকে ডেকে নিলেন গান রেকর্ডিং করার জন্য।
তিনি গাইলেন ‘এ ভবসাগর রে কেমনে দিমু পাড়ি রে...’ গান শুনে সবাই মুগ্ধ ও আপ্লুত। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বলেছিলেন, “কোথায় লাগে বাঁশি, এস্রাজ, এই গলাই তো মোহনবাঁশি গো!”
অমর পালের মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর গুরু উস্তাদ আয়াত আলি সাহেবেরর কথা। তিনি বলতেন, “শুধু সা ধইরা বইয়া থাকো, ওই ‘সা’-টারে মর্মে গিয়া চেনো, ওইটা তোমার কানে ঠিক ঠিক বারোটা পোষা পাখির মতো আয়ত্তে আসবে। বাইশটা শ্রুতিনাদ হৃদয়ের অলিগলি দিয়ে তোমায় মনে রাখবে আর তুমি মনে রাখবে তাদের।”
‘রাই জাগো রাই জাগো, শুকসারী বলে...’, ‘প্রভাতসময়ে শচীর আঙিনার মাঝে...’ এই সব প্রভাতী সঙ্গীত পরিবেশন করে অমর পাল মায়াকাজল পরিয়ে দিলেন শহুরে নাগরিক শ্রোতাদের। হয়ে উঠলেন প্রভাতী পল্লিগীতির জীবন্ত প্রতিমূর্তি।
এরই মাঝে বেশ কিছু ছায়াছবিতেও গান গাওয়ার সুযোগ হল তাঁর। গানগুলো মানুষের ভাল লাগল। তার মধ্যে একটি ‘ধান কাটি, কাটি ধান’ লোকের মুখে মুখে ফিরল। গীতিকার শৈলেন রায় এক দিন তাঁকে নিয়ে গেলেন রাইচাঁদ বড়ালের কাছে। দেবকী বসু একটি ছবি করছেন, নাম ‘সাগর সঙ্গমে’। অমর পালের গান শুনে দেবকী বসু মুগ্ধ, বললেন, “আপনি অভিনয় করবেন ছবিতে? কালাচাঁদ বাউলের পার্টটা!” ‘সাগর সঙ্গমে’ বাণিজ্যসফল হয়ে দর্শকদের মনে গেঁথে গেল। কালাচাঁদ বাউলের ভূমিকায় স্মরণীয় হয়ে রইলেন অমর পাল। ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘সোনার মানুষ’, ‘শকুন্তলা’, ‘বেহুলা লখীন্দর’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘তাহাদের কথা’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এর মতো বহু ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে লোকসঙ্গীত-সমাজে সর্বজনবিদিত নাম হয়ে উঠলেন অমর পাল। এক দিন তাঁর গানের ক্লাসে অনুপ ঘোষাল এলেন। বললেন, নতুন ছবি করছেন সত্যজিৎ রায়। একটি গান গাওয়ার জন্য অমর পালকে ডেকেছেন। অমর পাল প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলেন না, ভাবলেন নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।
পরদিন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে গেলেন অনুপ ঘোষাল। সত্যজিৎ রায় নিজেই দরজা খুলে ভিতরে ডাকলেন। গান শুনতে চাইলেন। ওই বিশাল মাপের মানুষের সামনে গিয়ে জড়সড় হয়ে গাইলেন। গান শুনে বললেন, “বাহ। আমার নতুন ছবিতে একটা গান আছে, আপনাকে গাইতে হবে।”
প্রোডাকশন থেকে ফোন পেয়ে নির্দিষ্ট দিনে এইচএমভি স্টুডিয়োয় হাজির তিনি। সকাল এগারোটায়। চারটে নাগাদ স্টুডিয়োর দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে অলোকনাথ দে বললেন, “শিগগির ঢোকো।” ভিতরে ছিলেন মানিকদা, অনুপ ঘোষাল, বিজয়া রায়। গানটার দু’বার রিহার্সাল হল। চরণদাসকে ধরে এনেছে রাজার পেয়াদা। চরণদাস সাদাসিধে গেঁয়ো মানুষ। হাতে দোতারা। রাজপেয়াদা ধরে এনেছে তাকে। রাজার নির্দেশে চরণদাস গাইবে সেই গান, ‘আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়...’। চরণদাসের পার্ট করবেন একদা বাংলা সিনেমার ডাকসাইটে গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদার।
গান রেকর্ডিং হল। বিজয়া রায় এক গাল হেসে বললেন, “খুব ভাল হয়েছে আপনার গান।” ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই গান তাঁকে বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা অমর পাল প্রায়ই বলতেন। দিল্লি রেডিয়ো স্টেশন থেকে ডাক এসেছে। রেডিয়ো প্রোগ্রামের পর আরও কয়েকটা স্টেজ প্রোগ্রামও হল। সবই ঠিকমতো হল। কিন্তু গোল বাধল ‘আমার গোসাঁইরে নি দেখ্স খাজুর গাছতলায়’ গানটি নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে দিল্লি কালীবাড়িতে সকলে ফিরে এসেছেন। সন্ধে বেলায় ডাকাবুকো গোছের কিছু লোক এসে বলে, “কলকাত্তার গানাওয়ালা বাবুকো বুলাইয়ে।”
তারা রেগে আগুন, এত বড় স্পর্ধা। বলে কি না, গোসাঁই গাছতলায় থাকে লেজ নাড়ে আর খেজুর খায়! এ রকম গান কে লিখেছে! তারা একটা হেস্তনেস্ত করতে এসেছে। যাই হোক তাদের অনেক কষ্টে বোঝানো হল যে, এটা নিছকই গ্রাম্য বিনোদনগীতি। গানের কথাগুলো নেহাতই মজার। ওতে কারও অপমান করা হয়নি। সে যাত্রা প্রথমে ভয় পেলেও, পরে অমর পাল ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেই লোকগুলোকে শান্ত করেন।
রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে হোলি উৎসবে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দূত পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। অমর পাল যেখানে বসেছিলেন, তার অল্প দূরেই বসেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, তাঁর কন্যা ইন্দিরা এবং সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন। আর অবশ্যই রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। এই অনুষ্ঠানে গান গেয়ে অমর পাল অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিলেন।
২০০৭ সালে তিনি ‘সঙ্গীত নাটক অকাদেমি’ পুরস্কারেও সম্মানিত হন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সঙ্গীতের মহা সঙ্গীতগুরু’ সম্মানে তিনি সম্মানিত হন ২০১২ সালে। ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন।
তিনি দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে, গানের আন্তর্জাতিকতার শক্তিতে চির কাল প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তিনি আমাকে সঙ্গীতশিক্ষা দিয়েছেন, এ আমার অসীম সৌভাগ্য। গুরুজির আদর্শ, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা আমাদের সকলের পাথেয়। আজ তিনি বহু দূরে, তবু তাঁর উদ্দেশেই মন যেন বার বার বলে ওঠে, “গুরুকই রইলা ও বাঁচি না প্রাণে/দিল-দরিয়ায় ঢেউ উইঠাছে,/ পাড়ি দিই কেমনে...”
তথ্যঋণ: সুজন রসিক নাইয়া- সঞ্জয় মিত্র; বাংলার লোকসঙ্গীত- (সম্পা) অমর পাল ও দুলাল চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy