চিকিৎসক: কবিরাজ শিবকালী ভট্টাচার্য। ডান দিকে, ভেষজ চিকিৎসা সম্বন্ধে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’র প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছদ। —ফাইল চিত্র।
একলা দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। মানিকতলা থেকে দীনেন্দ্র স্ট্রিট হয়ে শিমলা রোড। বিবর্ণ ধূসর নেমপ্লেটটার কাছে গেলে পড়া যায়, পাথরে লেখা নাম— শিবকালী ভট্টাচার্য। গাছগাছালির ভেষজ গন্ধ আর আসে না এ বাড়ি থেকে। একটা সময় ছিল, যখন ছাদের ওপর পর পর রাখা নানা মাপের উনুন জ্বলে উঠত। কোনওটায় হালকা আগুন, কোনওটায় গনগনে। কোনওটায় নরম, নিবু-নিবু টিকের আগুনের মতো আঁচ। বড় বড় ডেকচিতে ফুটত নানা লতা-পাতা-গুল্ম-বাকল। এক পাশে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক আয়ুর্বেদজ্ঞ বসে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া তদারক করতেন। তাঁর হাতে থাকত খাতা-কলম। ওষধি ভেষজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত এলাকা জুড়ে। কখনও রাতের আঁধার, কখনও সূর্যতপ্ত মধ্যগগন— আলো, হাওয়া, তাপের নানা সময় নির্দিষ্ট নানা ওষুধ তৈরির ক্ষণ হিসেবে। তৈরি হত মহার্ঘ ওষুধ— বেদ, চরক-সংহিতা আর আধুনিক রসায়নের মিশ্রণে তৈরি কবিরাজের মুষ্টিযোগ। সকাল থেকে রোগীর ভিড়— কলকাতা থেকে, রাজ্য কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন এই রোগীরা। প্রবীণ কবিরাজ তাঁর অধীত বিদ্যায় আশা জাগিয়েছেন তাঁদের বুকে।
শিমলা রোডে এখন সব অলীক। সাত দশক আগে এমনই এক কবিরাজখানার অসহায় বিলুপ্তির কথা শুনিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়ুর্বেদাচার্য জীবন মশায়। তাঁর কবিরাজখানাও (আরোগ্য-নিকেতন) এক দিন বন্ধ হয়ে গেল। নতুন কালের অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক প্রদ্যোৎ ডাক্তারের কাছে বার বার অপমানিত জীবন মশায় সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয়। এ বার থামতে হবে। তাঁদের তিন পুরুষের কোবরেজখানা এক দিন নিঃস্ব হয়ে গেল— “আরোগ্য-নিকেতনে আজ আর ওষুধ নাই; ও ব্যবস্থা ডাক্তার উঠিয়ে দিয়েছেন।… এখনও ওই ভাঙা আলমারি তিনটের মাথায় ওষুধের হিসেবের খাতা স্তূপীকৃত হয়ে জমা হয়ে রয়েছে। খেরো-মলাটগুলো আরসোলায় কেটেছে। ভিতরের পাতাগুলি পোকায় কেটে চালুনির মতো শতছিদ্র করে তুলেছে।… ডাক্তারের দুর্ভাগ্য— উই নেই; অথবা কোনোদিন অগ্নিকাণ্ড হয় নি! ওগুলোর দিকে তাকিয়ে জীবন দত্ত হাসেন। ওর মধ্যে অন্তত বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা পাওনার হিসেব আছে। বেশী, আরও বেশী।”
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের খেরোর খাতার হদিস আমরা জানি না। শুধু জানা যায়, তাঁর সংগৃহীত অনেক ‘র-স্পেসিমেন’ (গাছের শিকড়, পাতা, নানা ওষুধ, ভেষজচূর্ণ) পরিবারের তরফ থেকে কাঁথি আয়ুর্বেদ কলেজে দান করা হয়েছিল। এ সব জানা যাচ্ছে শিবকালীবাবুর কনিষ্ঠ পুত্রবধূ চিত্রলেখা ভট্টাচার্যের থেকে। চিত্রলেখাদেবীই ছিলেন শিবকালী ভট্টাচার্যের শেষ বারো বছরের অন্যতম সহকারী। ১৯৫৩ সালে, শিবকালীর যখন উজ্জ্বল উত্থানপর্ব, ‘আরোগ্য নিকেতন’ প্রকাশিত হয়েছে সেই সময়েই।
শিবকালী ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমান বাংলাদেশের খুলনায়। পিতা পণ্ডিত চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য। ছোটবেলা থেকেই গাছপালার প্রতি প্রবল টান ছিল শিবকালীর। ছাত্রজীবনে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে ঘটনাচক্রে এসে পড়লেন কলকাতায়। উঠলেন বৌবাজার এলাকায় ভাড়া বাড়িতে। দাদা বিজয়কালী ভট্টাচার্য তখন কবিরাজি বিদ্যায় বিখ্যাত। তাঁর হাত ধরে এলেন আয়ুর্বেদের জগতে। তার পর আয়ুর্বেদই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। শচীন্দ্র বিদ্যাভূষণ, হারাণ চক্রবর্তী, গণনাথ সেন সরস্বতী, নলিনীরঞ্জন সেন প্রমুখ দেশের বিশিষ্ট আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞের কাছে পৌঁছে গেলেন এই প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষালাভের জন্য। শুধু প্রাচীন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরাই নন, আয়ুর্বেদকে সর্বজনীন ও আধুনিক করে তুলতে শিবকালীবাবু নিজের উদ্যোগে যোগাযোগ করেছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. পি কে বসু, রসায়নবিদ ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণুপদ মুখোপাধ্যায়, বি সি কুণ্ডু, আর এন চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে। নানা বিষয়ে নিয়েছেন তাঁদের মতামত। তীব্র অনুসন্ধিৎসাই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
শিবকালী ভট্টাচার্য কলকাতায় এসেছিলেন ১৯৩৬ সালে, ২৮ বছর বয়সে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০, এই চার বছরের মধ্যে আয়ুর্বেদ ভেষজের তিনটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা এবং পরিচালনার দায়িত্ব সফল ভাবে পালন করেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ রসায়নশাস্ত্রের নিবিড় অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৯-এ স্টেট আয়ুর্বেদ ফ্যাকাল্টি তাঁকে ‘আয়ুর্বেদাচার্য’ উপাধি দান করে। তত দিনে
কবিরাজ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ভেষজবিদ্যা বিষয়ক একাধিক লেখা প্রশংসিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে।
ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনলেন পাইকপাড়া ইন্দ্রলোক হাউজ়িং-এ। কিন্তু গবেষণার কাজে আরও জায়গা দরকার। তাই কিনলেন শিমলা রোডের বাড়িটি। সেখানে বড় চেম্বার। সকাল থেকে রোগীর ভিড়। সকাল ন’টায় বসতেন চেম্বারে, রোগী দেখতে দেখতে এক-এক দিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। এর মাঝেই দেখা করতে আসতেন দেশের নানা প্রান্তের বিশিষ্টজনেরা। প্রধান সহকারী ছিলেন পুত্রবধূ চিত্রলেখা। কাজ করতেন আরও দশ-বারো জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী।
চেম্বারের নানা অভিজ্ঞতা আজও মনে আছে চিত্রলেখার। এক বার বছর ষোলোর একটি সরল নিষ্পাপ মেয়েকে নিয়ে সে দিন চেম্বারে এসেছেন তাঁর অভিভাবকরা। এক বার সাপে কেটেছিল তাকে। অনেক পথ পেরিয়ে ক্লান্ত সে। বড় বিবর্ণ, মলিন মুখখানি! কী হয়েছে তার? জানা গেল, এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত সে। শরীরের নানা অংশে চামড়া ফুলে উঠছে, আর সেখান থেকে চুঁইয়ে পড়ছে তরল রস। গ্রামের হাতুড়ে থেকে কলকাতার হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে এসেছেন মানিকতলা এলাকার ১৬ নম্বর শিমলা রোডের কোবরেজখানায়। প্রবীণ কবিরাজমশায় দীর্ঘ ক্ষণ কথা বললেন রোগীর সঙ্গে। ভাবলেন অনেক ক্ষণ। তার পর পাশে বসা চিত্রলেখাকে বললেন, একটু গরম জল আনতে। গরম জলে ওই তরল রস ফেলতেই দেখা গেল জল লাল হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে ওই তরল দিয়ে।
“বাবা প্রমাদ গণলেন। মেয়েটিকে প্রাথমিক ওষুধ দিয়ে তিনি ছুটলেন পুরুলিয়ায়, লাক্ষার খোঁজে। লাক্ষা আসলে বড় বৃক্ষের শাখায় পুঞ্জীভূত কীটবিশেষের দেহজ আঠা। গালা তৈরি হয় লাক্ষা থেকে। সেই লাক্ষার সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করলেন ওষুধ। প্রয়োগে অব্যর্থ ফল। বাবা সে দিন চিকিৎসা করেছিলেন শুধু অভিজ্ঞতা আর তীব্র পর্যবেক্ষণ গুণে।” পরে জানা গিয়েছিল, শরীরে বিষক্রিয়ার ফলেই হয়েছিল এই সমস্যা। চিত্রলেখার মুখে এ কাহিনি শুনতে-শুনতে বার বার মনে পড়ছিল জীবন মশায়ের কথা। তাঁর কাছেও তো এমন সব অব্যর্থ ওষুধ ছিল! গ্রামের হেডমাস্টার রতনবাবুর ছেলে বিপিন। কলকাতায় বড় ডাক্তার রক্তের চাপ কমানোর জন্য রক্ত মোক্ষণ করেছিল। মূত্রাশয়ে দোষ পাওয়া গেছে। ভালই ছিল অ্যালোপাথি চিকিৎসায়। গ্রামে ফিরে হঠাৎই এক উপসর্গ— হিক্কা। পাঁচ দিন ধরে কোনও ডাক্তার, কোনও ওষুধে কাজ হচ্ছে না। অবশেষে ডাক পড়েছে জীবন মশায়ের— “ডাক্তার হাঁটছিলেন বেশ একটু জোরে জোরে। মনের মধ্যে উত্তাপ যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওষুধ ঠিক হয়ে গিয়েছে, সে ওষুধ তিনি নিজে তৈরি করে দেবেন। এ দেশেরই সুলভ কয়েকটা জিনিস দিয়ে তৈরী মুষ্টিযোগ। সে কিন্তু ওদের বলবেন না। সংসারে যা সুলভ তার উপর মানুষের আস্থা হয় না। তা ছাড়া এ বলেও দেবেন না। কখনই বলবেন না। এবং একদিনে এই হিক্কা থামিয়ে দিয়ে ওদের দেখিয়ে দেবেন, কী বিচিত্র চিকিৎসা এবং ওষুধ তাঁর আছে।”
এক সময় নিজেই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গাছগাছালি থেকে ওষুধ সংগ্রহ করতেন শিবকালী ভট্টাচার্য। গবেষণা চলত দিনের পর দিন। তার পর প্রয়োগ। দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করতেন প্রাচীন গ্রন্থ পড়ে। নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে পরামর্শ চলত আধুনিক রসায়নবিদদের সঙ্গে। তার পর এগোতেন ওষুধ তৈরির কাজে। কেউটে সাপের বিষ থেকে তৈরি হত অস্টিয়ো-আরথ্রাইটিস, গেঁটে বাত ইত্যাদির অব্যর্থ ওষুধ। কেউটের বিষ সংগ্রহ করতে শিবকালী নিজে চলে যেতেন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত কোনও দ্বীপে। নৌকার উপর সাপুড়েদের থেকে সংগ্রহ করতেন সেই বিষ। একই গাছ, নানা উচ্চতায় নানা ওষুধের উৎস— সে সব নখদর্পণে ছিল তাঁর। চিৎপুর অঞ্চলে কিছু সাপ্লায়ার ছিল। নিজে বেরোতে না পারলে তাঁদের বলে দিতেন, কোন এলাকার, কোন উচ্চতার, কোন গাছ লাগবে। তাঁরা এনে দিতেন। শেষ দিকে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছিলেন, সেই সূত্রে সন্ধান করছিলেন কৃষ্ণমৃত্তিকা দিয়ে তৈরি উইপোকার কালো ঢিবি। ১৯৯২-এর ২৮ আগস্ট তিনি চলে না গেলে হয়তো, এ বিষয়ে নতুন কোনও দিশা পেতাম আমরা।
গরিব দেশ আমাদের। চিকিৎসার করানোর সামর্থ্য নেই অধিকাংশ মানুষের। ডাক্তার অপ্রতুল। তাই সাধারণ্যে আয়ুর্বেদ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আজীবন নিরলস ছিলেন। তাঁর অধিকাংশ লেখালিখিতে এর প্রমাণ আছে। ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বইটির পাতা ওল্টালে বোঝা যায়, কী নিবিড় নিষ্ঠায় গোটা মানবজাতির কল্যাণে ব্রতী ছিলেন শিবকালী। বেদ, সুশ্রুত, চরকে বর্ণিত ভেষজের গুণাগুণ, প্রয়োগ যেমন নিবিড় নিষ্ঠায় অনুধাবন করেছেন, তেমনই তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন আধুনিক রসায়ন। ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ তাই নিছক কবিরাজি বই হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে আয়ুর্বেদ-বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়। অসাধারণ বৈঠকি মেজাজ ছড়িয়ে আছে বইটির ভাষায়। ফলে তা ভারাক্রান্ত করে না পাঠককে। লিখেছেন— “আমার বৈদ্যক জীবনের এক একটি স্তরে ধাক্কা খেয়ে এক একটি ক্রমের অভিজ্ঞতা এসেছে।”
এক বার দিল্লি থেকে সন্দিগ্ধ ভেষজ কমিটি এসেছে কলকাতায়। গোটা দেশের বাছাই করা বিদগ্ধ বৈদ্য শুধু নন, কমিটিতে ছিলেন অন্য শাস্ত্রে পণ্ডিতরাও। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হল শিবকালীর, তারিফ করলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর মনে তৈরি হল হীনম্মন্যতাবোধ। কারণ, পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিদ্যা তখনও তাঁর অধিগত হয়নি। শিখতেই হবে সেটা— “নতুন করে ছাত্রজীবন শুরু হল আমার— শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে। সকালে রুটি নিয়ে কলকাতা থেকে যাত্রা করতাম, সমস্ত দিন গাছতলায় ঘুরি, নাম মুখস্থ করি, নতুন নতুন গাছের সঙ্গে পরিচিত হই।” তাঁর মনে হত, এক জন বয়স্ক মানুষের এ হেন উৎসাহ ও আগ্রহ অনুকম্পার সঙ্গে দেখতেন ওখানকার কর্তাব্যক্তিরা।
বড়বাজারে মশলার দোকানে এক বাঙালি ভদ্রলোক মশলার ফর্দ দিচ্ছেন। উদ্ভট সব নাম। কানে লাগল শিবকালীর। জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী! ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না। দোকানদারের থেকে পরে জানলেন, “এসব হেকিমি জিনিষ। সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করলাম— না; এটা আমাকে জানতেই হবে। তিন বৎসর হেকিম রেখে ওদের কী কী আছে, বনৌষধি এবং ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে কতগুলি তারা গ্রহণ করে ওই শাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেটার হিসাবও এই সঙ্গে হয়ে গেল।” উত্তরাখণ্ডের পরিব্রাজক অফিসার ছিলেন এ সি দে। ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি সন্ধান দিলেন নানা ভেষজ ও তাদের কার্যকারিতার। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলল গভীর অনুসন্ধান। এ ভাবেই প্রতিনিয়ত নিজেকে বাড়িয়ে চলতেন। থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। কী আছে এগারো খণ্ডের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বইয়ে? বিভিন্ন গাছগাছড়া, বৈদিক যুগে তাদের নাম ও ব্যবহার, বৈজ্ঞানিক নাম, কেমিক্যাল কম্পোজ়িশন, কোন রোগের জন্য কী ভাবে তা ব্যবহার করা যায়— এই ভাবে বিস্তারিত আলোচনা। অসংখ্য গাছ-পাতার সাহায্যে অগণন ব্যাধিমুক্তির পথ আছে বইটিতে। দু’-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক— উদুম্বর বা ডুমুর। ঋগ্বেদে এরই নাম উম্বর। ব্যবহার পাপ-রোগ-অর্শাদির নাশক হিসেবে। এটি অন্তঃপুষ্প ফল। অর্শে ব্যবহার তো চলেই, শিবকালী এর কেমিক্যাল কম্পোজ়িশন বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন, এই গাছের ওষধি গুণ যেমন রক্ত বন্ধ করে, তেমন বিড়াল, ইঁদুর, বোলতা বা কোনও বিষাক্ত পোকার কামড়ে লাগালেও উপশম হয় এবং বিষক্রিয়া হয় না।
এখন বাংলা জুড়ে লাল-চোখের প্রাবল্য। যাকে ‘জয়বাংলা’ বলে অনেকে। রাঢ় বাংলার একটি সাধারণ গাছ ভেরেন্ডা, লোকায়ত নাম রেড়ি। বৈদিক নাম এরণ্ড। এই পাতার রস জয়বাংলা রোগের অব্যর্থ ওষুধ। রাতকানা রোগেও প্রয়োগ করা যায়। গ্রামবাংলার কত মানুষকে যে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে এই বইটি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চিত্রলেখা আফসোস করছিলেন, “বাবার মৃত্যুর পর আরও সতেরো বছর চেম্বার চালু রেখেছিলাম। ২০০৯-এর পর থেকে আর পারলাম না। খুব কষ্ট হয় জানেন, এখনও কেউ কেউ ফোন করেন, চিকিৎসা বিষয়ে খোঁজ নেন, ওষুধ চান!”
শিবকালী ভট্টাচার্যের প্রয়াণের ত্রিশ বছর পেরিয়েছে ২৮ অগস্ট। হয়তো কেউ জানেন, কেউ জানেন না। প্রতিবারই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে যায় কিছু ভুল তথ্য। বলা হয়, ২৮ অগস্টই তাঁর জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন। চিত্রলেখা বরাবরের মতো প্রতিবাদ করেন। বলেন, ২৮ তারিখ তাঁর জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিন (জন্মদিনটি তাঁদের অজানা)। এমন ব্যস্ত একটা যুগ আমরা তৈরি করে ফেলেছি এখন যে, মহান হলেও একজন আয়ুর্বেদাচার্যকে নিয়ে ভাববার সময় আর নেই!
ঋণ: চিরঞ্জীব বনৌষধি: শিবকালী ভট্টাচার্য; চিত্রলেখা ভট্টাচার্য, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য,
অমরেশ মণ্ডল, দীপঙ্কর সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy