Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

মৃত্যুদূতকে পরাস্ত করেছিলেন এক বার

তখন তাঁর বয়স ছিয়াত্তর। হঠাৎ এক সন্ধেয় হারালেন চৈতন্য। প্রায় পঞ্চাশ ঘণ্টা ফেরেনি জ্ঞান। সঙ্গে জ্বর। কলকাতা থেকে ছুটে গিয়েছিলেন নামী চিকিৎসকরা। প্রায় যমে-মানুষে টানাটানি। সুস্থ হওয়ার পর লিখেছিলেন, মৃত্যুদূত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন। সে যাত্রা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন কবি। রবীন্দ্রনাথের কোনও জীবনীকারই এই ঘটনাটি উল্লেখ করেননি বিশদে।

মনস্বী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বাস্থ্যহানির জন্য কষ্ট পেলেও সামলে উঠেছিলেন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

মনস্বী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বাস্থ্যহানির জন্য কষ্ট পেলেও সামলে উঠেছিলেন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১৪
Share: Save:

কবি যথার্থই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৩৭-এর ১০ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ পঞ্চাশ ঘণ্টা সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন। ছিয়াশি বছর আগের সেই আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন ভয়ঙ্কর দিনগুলোর ইতিহাস আমাদের কাছে আজ অনেকটাই অজানা। এর দুটো কারণ। এক, এ বিষয়ে সে ভাবে কেউ কোনও স্মৃতিচারণ করে যাননি। দুই, রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার তাঁর রচনার চতুর্থ খণ্ডে বলতে গেলে, দু’টি মাত্র বাক্যে এই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ করেছেন। অধ্যায়ের শিরোনামেও সেই ভয়াবহ চৈতন্যহীন অবস্থার কোনও ইঙ্গিত নেই। কবির একটি বইয়ের নামে অধ্যায়টির শীর্ষনাম ‘প্রান্তিক’। রবীন্দ্রজীবনীতে শুধু পাই: “একদিন সন্ধ্যার পর সকলের সহিত কথাবার্তার মধ্যে কবি হঠাৎ হতচৈতন্য হইলেন (২৫ ভাদ্র। ১০ সেপ)।” এবং “পরদিন ডাক্তার নীলরতন সরকার আসিয়া কবির রোগ নির্ণয় করিলেন ও তাঁহার চিকিৎসায় অচিরকালের মধ্যে কবি সুস্থ হইয়া উঠিলেন।” মুখ্যত সেই দিনের অসুস্থতা সম্পর্কে আমরা এটুকুই জানতে পাই রবীন্দ্রজীবনী থেকে। বিষয়টি আমাদের প্রায় অজানা, তার আর একটি কারণ, ১৯২৬-এ এসে ‘রবিজীবনী’ দুর্ভাগ্যক্রমে অসমাপ্ত থেকে যায়।

কবি সুস্থ হয়ে কত চিঠিতে, কত গদ্যে-পদ্যেই না বলেছেন ‘মৃত্যুদূত’, ‘যমদূত’ এসে তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করে গেছেন। মৃত্যুর ডাক প্রত্যাখ্যান করে এক মাস পর ৯ অক্টোবর হেমন্তবালা দেবীকে কবি লিখলেন, “বারান্দায় বসে সন্ধ্যার সময় সুনন্দা সুধাকান্ত ও ক্ষিতিমোহন বাবুর স্ত্রীকে মুখে মুখে বানিয়ে একটা দীর্ঘ গল্প শুনিয়ে তার পরে বাদলা বাতাস ঠান্ডা বোধ হওয়াতে ঘরে গিয়ে কেদারায় বসেছিলুম, শরীরের কোনো প্রকার কষ্ট বোধ করি নি, অন্তত মনে নেই; কখন মূর্ছা এসে আক্রমণ করল কিছুই জানি নে। রাত নটার সময় সুধাকান্ত আমার খবর নিতে এসে আবিষ্কার করলে আমার অচেতন দশা। পঞ্চাশ ঘণ্টা কেটেছে অজ্ঞান অবস্থায়।”

সেই রাতেই শান্তিনিকেতনের ডাক্তারবাবু শচীন মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠানো হল। শচীনবাবু তড়িঘড়ি এসে গুরুদেবকে পরীক্ষা করলেন। রবীন্দ্রনাথের তিনি গৃহচিকিৎসক। প্রাথমিক ওষুধ দেওয়া হল। রাত কেটে যাবে, চিকিৎসক এটুকু নিশ্চয়তা দিলেন।

সেই রাতে আর বিশেষ কাউকে ডাকাডাকি করা হল না। তবে সেই রাতেই বিশেষ ব্যবস্থা করে জরুরি বার্তা পাঠানো হল— গুরুদেব গুরুতর অসুস্থ। রাত থেকে অচৈতন্য। ১০ তারিখ রাতেই কলকাতা খবর পেল ‘রবীন্দ্রনাথ সিরিয়াসলি ইল। আনকনশাস।’

১১ তারিখ ভোরেই ডাক্তার নীলরতন সরকার আরও চার জন ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতনের ট্রেন ধরলেন। প্রভাতী কাগজে ছাপা হল কবির অসুস্থতা ও সংজ্ঞাহীনতার খবর। প্রচারিত হল বেতার-মাধ্যমেও। মুহূর্তে দেশের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল অনন্ত উদ্বেগের কালো মেঘ।

সূর্য মধ্যগগনে আসার আগেই ডাক্তাররা এসে পড়লেন। আসামাত্র শুরু হয়ে গেল চিকিৎসা। নীলরতন সরকার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন কবির বিছানার পাশে। ঘণ্টা চলে যায়, জ্ঞান ফেরে না। ডাক্তারদের চোখে-মুখে থমথমে উদ্বেগ। কবি চৈতন্যহীন, সবাই নির্বাক, স্তব্ধ, গম্ভীর— দেখে মনে হয়, উচ্ছ্বসিত সমুদ্র যেন তীরে এসে তরঙ্গহীন হয়ে পড়েছে। ডাক্তার সরকার জানালেন, কবির জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাঁরা শান্তিনিকেতন ছাড়বেন না।

১১ তারিখ বিকেলবেলায় নীলরতনবাবুর প্রথম বুলেটিন বেরোল। কবির অবস্থা অপরিবর্তিত। জ্বর ১০২.৭ ডিগ্রি। কিডনি বিশেষ সক্রিয় নয়। ভিড় না করার অনুরোধ।

নীলরতনবাবুরা সারা রাত বিনিদ্র। ১১ তারিখ সকাল আটটা থেকে দল করে কবির নার্সিং-এর কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর এক-একটি দলের দায়িত্ব। ১১ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ প্রতিদিন ঘন ঘন কবির শরীরের অবস্থা বিষয়ে ঘন ঘন বুলেটিন বেরোতে লাগল।

সমস্ত সংবাদমাধ্যম কবির স্বাস্থ্য-সংবাদ পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগজনক। দূর থেকে খবর নিচ্ছেন উদ্বিগ্ন গান্ধী, চিন্তিত জওহরলাল। এসে পৌঁছচ্ছে শত শত টেলিগ্রাম, শত শত পোস্টকার্ড ভরা শুভেচ্ছাবার্তা।

কবির শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-আশঙ্কা এতটাই মারাত্মক হয়েছিল, যাকে বলে ‘যমে-মানুষে টানাটানি’। ডক্টর সরকার টানা প্রায় সাত দিনের মতো থেকে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কবিকে ছেড়ে আসা যায় না। কখন কী হয়ে যায়!

শেষ পর্যন্ত সে যাত্রা মানুষের টানই জয়ী হল। ‘বিলুপ্তির অন্ধকার হতে মরণের ছাড়পত্র নিয়ে’ কবি পুনরায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলেন। তখন তাঁর বয়স ছিয়াত্তর বছর চার মাস। বলতে গেলে পুনর্জন্ম। কবি নিজেও তেমনটাই বিশ্বাস করেন।

অসুস্থ হয়েছিলেন ১০ তারিখ, অনেকটাই সুস্থ হয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে ২০ সেপ্টেম্বর স্বহস্তে লিখে একটি বিবৃতি প্রকাশ করলেন কবি—

“যখন মৃত্যুর নিবিড় ছায়া আমাকে অভিভূত করেছিল তখন আমার বিলুপ্ত চৈতন্যের অন্ধকার দ্বারে আমার জন্য প্রীতিপূর্ণ উৎকণ্ঠা চারিদিক থেকে নিরন্তর আঘাত করেছে এই সংবাদ যখন আমার কাছে সুস্পষ্ট হলো তখন আমি নিজেকে ধন্য মনে করেছি। এই উপলক্ষে মৃত্যুর ছদ্মবেশে জীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার আমার হাতে এসেছে, রোগের কঠোর দুঃখ সার্থক হয়েছে। আমার যে চিকিৎসক বন্ধুরা রোগশয্যাপার্শ্বে রাত্রিদিন উপস্থিত থেকে অক্লান্ত প্রয়াসে ও নিপুণ চিকিৎসায় আমাকে রোগের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন তাঁদের সে ঋণ শোধ হবার নয়। আমার নিমজ্জমান আয়ুর কয়েকটা দিন তাঁরা যে বাড়িয়ে দিয়েছেন, আমার এই ৭৭ বছর বয়সে সেটা খুব বেশি কথা নয়— কিন্তু অক্লান্ত সতর্ক সেবার মধ্য দিয়ে যে অজস্র প্রীতির দানে তাঁরা আমাকে সমাদৃত করেছেন, সে আমার
কাছে বহুমূল্য।”

২০। ৯। ৩৭, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ওই সেপ্টেম্বরেই রানীকে একটি তারিখহীন পত্র দেন। মৃত্যু যে কবির খুব কাছে এসে কবিকে স্পর্শ করে গেছে, সে বিষয়ে কবির মনে কোনও অস্পষ্টতা নেই। সে সময় বহু পরিচিতজনকে চিঠিতে তিনি প্রায় মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসার কথা লিখেছিলেন। রানীকে লিখছেন, “এখন উদ্বেগের কোনো কারণ নেই কিন্তু মৃত্যুর ধাক্কা খেয়ে দেহের কলকব্জা নড়বড়ে হয়ে রয়েছে। এতকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে ক্ষোভ বোধ করিনি, এখন নিজের প্রতিবিম্ব দেখা বন্ধ করে অবারিত কুশ্রীতা ভুলে থাকতে চেষ্টা করি— নরসমাজে এরকম রূপবিকৃতি অভদ্রতা। এই দুই কারণে আমি এই ক্ষণভঙ্গুর শরীরটাকে নিয়ে কারও দুঃখ উৎপাদন করতে ইচ্ছা করিনে। দেহটাকে ছেড়ে নিজের নিরাসক্ত মনটা নিয়ে আছি।”

এমন একটা চিঠি লিখে নিজেই পরে মনে মনে লজ্জা পেলেন। তার কলম থেকে এমন লেখা বেরোবে কেন!

২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে রানীকে আবার লিখলেন, “শরীরের অবসাদের সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে মাঝে মাঝে কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে। সেই রকমের একটা দুর্বল ঝাপসা মুহূর্তে একটা চিঠি লিখেছিলুম সেটা মুছে ফেলবার যোগ্য। মনে পড়চে তাতে আমার চেহারার বিকার নিয়ে আক্ষেপ করেছিলুম, ওটা একটা প্রলাপ। বাস্তবিক পদ্য ছাড়া খাঁটি সত্য লেখা যায় না— গদ্যে আমরা বানিয়ে বানিয়ে বকি, রাবিশ জমা হয়। ২৫ তারিখে একটা অপেক্ষাকৃত বড়ো কবিতা লিখেছি— তার কথাগুলো সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা চলে। কপি করতে অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ হয় তাই সেটা আজ খাতায় অবগুণ্ঠিত রইল।”

সেই কবিতাটি ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থে সঙ্কলিত প্রথম কবিতা। আঠাশ চরণ। প্রথম পাঁচ ছত্র—

“বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল

মৃত্যুদূত চুপে চুপে; জীবনের দিগন্ত-আকাশে

যত ছিল সূক্ষ্ম ধূলি স্তরে স্তরে, দিল ধৌত করি

ব্যথার দ্রাবক রসে, দারুণ স্বপ্নের তলে তলে

চলেছিল পলে পলে দৃঢ় হস্তে নিঃশব্দে মার্জনা।...”

কালো মৃত্যুর সেই ক্রূর কঠিন সুস্পষ্ট হাতছানি কবি কিছুতেই বিস্মৃত হতে পারছেন না। মৃত্যুদূত এসে তাঁর জীবনকে সম্পূর্ণ অবিন্যস্ত করে দিয়ে গেছে; অত সুন্দর শরীরটাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেছে। কবি নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারেন না। ভিতরে ভিতরে নিজের এই জীর্ণ ভঙ্গুর দেহটার দিকে তাকিয়ে অসম্ভব কুণ্ঠা বোধ করেন, অস্থির ও বিচলিত হয়ে পড়েন।

আবার পরক্ষণেই ভাবেন কার কাছে, কিসের স‌ঙ্কোচ, কিসের লজ্জা! ২ অক্টোবর রানীকে চিঠিতে জানান— “যমদূত যা অর্ধসমাপ্ত করে গিয়েছিল, আজ সকালে তা আমি স্বহস্তে সমাপ্ত করেছি। কাল রাত্রিতে ভাবছিলুম, যে পর্যন্ত না চুল ওঠে টুপি পরে কান ঢেকে জনসমাজে সঞ্চরণ করব। অবশেষে এই সংকোচের জন্য মনে মনে ধিক্কার জন্মাল— আজ ৭৭ বছরে মাথার আবরণ মোচন করলুম— তারই ছিন্ন শেষ তোমাকে পাঠাচ্ছি।... মোহমুক্তির স্মরণচিহ্ন। মনে খুব আরাম পেয়েছি আজ হতে আমার মাথার উপর থেকে চিরুনি ব্রাশ টুপি পাগড়ির আধিপত্য সম্পূর্ণ নির্বাসিত।”

পুরো অক্টোবর নভেম্বর, যত জনকে চিঠি লিখেছেন, তাঁদের অনেককেই ওই পঞ্চাশ ঘণ্টা অচৈতন্য থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। কবির এই ৭৭ বছরের জীবনে এমন কোনও ঘটনা কখনও ঘটেনি, যা তাকে এমন ভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল।

বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু মারা গেলেন ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭। পরের দিনই বন্ধুপত্নী অবলা বসুকে পত্র দিলেন কবি। আশ্চর্যের বিষয়, ছোট্ট সত্তরটি শব্দের একটি চিঠি, তার মধ্যে প্রথম কুড়ি শব্দ নিজের নিজের অসুস্থতার কথা— “মৃত্যুর দ্বার থেকে সেদিন ফিরে এসেছি— তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে, মনে কোনো আশঙ্কা নেই। শেষ যাত্রারও দেরি নেই তা জানি।” হয়তো বা এ ভাবেই অবলা বসুকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছেন— আমিও তাঁরই পথের পথিক— আর দেরি নেই।

ডিসেম্বর থেকে মৃত্যু-বিভীষিকা আর তেমন ভাবে তাঁকে পীড়িত করেনি। কবি আবার নতুন করে কাজের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

১৯৩৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে কবি আবার তাঁর এক নতুন জন্মদিনে পৌঁছলেন। সে দিন কালিম্পং-এ বসে লিখলেন ‘জন্মদিন’ কবিতাটি—

“আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে

ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে

মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।”

কবি বলছেন—

“আজ আসিয়াছে কাছে

জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোঁহে বসিয়াছে,

দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবনপ্রান্তে মম

রজনীর চন্দ্র আর প্রত্যুষের শুকতারা সম—

এক মন্ত্রে দোঁহে অভ্যর্থনা।”

কবিতাটি ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন, যিনি সংবাদ পাওয়ামাত্র কলকাতা থেকে ছুটে এসে রাত দিন তাঁর সেবা-চিকিৎসা করে তাঁকে পুনর্জন্ম
ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই বন্ধুবর ডাক্তার নীলরতন সরকারকে। কুড়ি চরণের সেই উৎসর্গ-র প্রথম চারটি চরণ—

অন্ধতামস গহ্বর হতে

→→ফিরিনু সূর্যালোকে।

বিস্মিত হয়ে আপনার পানে

→→হেরিনু নূতন চোখে।’

মৃত্যু (৭ অগস্ট ১৯৪১) এবং মৃত্যুদূত এসে ফিরে যাওয়া (১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭)। এর মাঝে কবি সময় পেয়েছেন চার বছর।

এই পর্বে রোগ থেকে তিনি যে সবটুকু মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন, তা নয়। অসুস্থতাকে সঙ্গী করেই তাঁর কাজের সংগ্রাম চলছিল বিরামহীন।

এই চার বছরে তাঁর লেখা চিঠির সংখ্যা ১৪৫০ (যা পাওয়া গেছে) এবং প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কুড়ি। এর মধ্যে শুধু কাব্যগ্রন্থই দশটি। এরই মধ্যে বিশ্বভারতী থেকে খণ্ডে খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ শুরু হয়। মূল তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দীর্ঘ ভূমিকা লিখলেন প্রথম খণ্ডে। কবির জীবদ্দশায় পর পর সাতটি খণ্ড প্রকাশিত হয়ে যায়।

মাঝের এই চার বছরে কবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কর্মপ্রবাহের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। বাইরের সব আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা যায় না, ফলে কবিকে বেরোতেই হয় শান্তিনিকেতনের মায়া ছেড়ে। তা ছাড়া চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাওয়া তো আছেই। আর আছে পাহাড়ের আকর্ষণ। কখনও কালিম্পং, কখনও বা মংপু। ১৯৩৮-এর এপ্রিলে কালিম্পং, মে-তে ম‌ংপু। জুলাইয়ের গোড়ায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৩৯-এর এপ্রিলে ওড়িশার পুরীতে। সেপ্টেম্বরে মংপু, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর। ১৯৪০-এ নানা উপলক্ষে এক বার সিউড়ি, এক বার বাঁকুড়া। ২০ এপ্রিল চললেন আবার কালিম্পং ও মংপু এবং ১৯ সেপ্টেম্বর পুনরায় কালিম্পং। ডাক্তারদের নিষেধ অগ্রাহ্য করেই কবি যাত্রা করলেন পাহাড়ে। ক’দিন যেতে না যেতে কবি আবার সংজ্ঞা হারালেন পাহাড়ি প্রদেশে। প্রতিমা দেবী সংবাদ পেয়েই প্রশান্তচন্দ্রকে জানালেন। চার বছর আগের সেই দুঃস্বপ্নের মতো দিনগুলি তাঁরা তখনও বিস্মৃত হতে পারেননি। অবিলম্বে মহলানবিশ তিন ডাক্তার-সহ কালিম্পং পৌঁছলেন। পৌঁছে গেলেন সুরেন কর, অনিল চন্দ এবং সুধাকান্ত। ২৯ সেপ্টেম্বর কবিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। সেখানে চিকিৎসায় খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলে শান্তিনিকেতনে ফিরলেন ১৮ নভেম্বর।

লেখালিখি কাজকর্ম ইত্যাদি সব কিছুই আবার আগের মতো শুরু হয়ে গেল। সেই সঙ্গে পত্রের পর পত্রলিখন। এই সময়ের চিঠিপত্রে অসুস্থতার তেমন কোনও উল্লেখ দেখা যায় না। কবিতা রচনা বেশি করে চলতেই থাকে।

এত ব্যস্ত কর্মপ্রবাহের মধ্যেও সকলের অগোচরে কবির প্রাণশক্তিতে ভাটা পড়তে থাকে। তাঁর দুর্বলতা লোকের চোখে তেমন ধরা পড়ে না, কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যভঙ্গের কথা তাঁরই লেখা কোনও কোনও চিঠিতে প্রকাশ পায়। পারুল দেবীকে ১৯৪১-এর মে মাসে কবি লেখেন, “আশি বছরের প্রান্তে এসে আমার দেহমন অচলপ্রায় হয়ে এসেছে। আমার লেখনী গতিহীন হয়ে পড়েছে।”

সে বছর কবির জন্মদিনের দিন দশেক পরেই শান্তিনিকেতন এসে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন বুদ্ধদেব বসু।

যে অসুস্থতা থেকে সদ্য আরোগ্যপ্রাপ্ত দীর্ণ ধ্বস্ত রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে অনীহা বোধ করেছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলির পর এই প্রথম বুদ্ধদেব বসু শান্তিনিকেতনে এসে
তাঁকে দেখলেন।

“কবি তখন অল্প দিন রোগশয্যা ছেড়ে উঠেছেন, কিন্তু রোগের কোনো গ্লানি আর নেই। সেই চিরপরিচিত উজ্জ্বল মহান মুখশ্রী, সেই তীক্ষ্ণ আরক্ত-অপাঙ্গ চোখ, সেই উদার গম্ভীর স্বচ্ছ ললাট।”

এর পর মাঝে কেটে গেল আরও দু’টি মাস। জুন আর জুলাই। এর মধ্যেও লিখিত পত্রের সংখ্যা পঁচিশ। উল্লেখযোগ্য পত্রপ্রাপক রামানন্দ, সজনীকান্ত, বুদ্ধদেব, মৈত্রেয়ী দেবী, নির্মলকুমারী, অবনীন্দ্রনাথ, কিশোরীমোহন সাঁতরা এবং সর্বশেষ পত্র ৩০ জুলাই ১৯৪১-এ কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। রানী চন্দ লেখেন, “কোনো রকমে কম্পিত কলমে সই করেন বাবামশায়। এই তাঁর কলমের শেষ লিপি শেষ স্বাক্ষর। নীল খাতা লেট্স্ ডায়ারি দিয়ে যে জার্নি শুরু হয়েছিল এই শেষ স্বাক্ষরে দীর্ঘ আট দশকের লিপিভ্রমণের সমাপ্তি।”

এই জুন-জুলাইয়ের মধ্যে তাঁর একটিমাত্র বই বেরোয়— আশ্রমের রূপ ও বিকাশ।

এই দু’টি মাসে অসুস্থ কবি মাত্র চারটি ছোট কবিতা রচনা করেন। জুনে কোনও কবিতা নেই, কিন্তু এই জুনে কবির লেখা বিশ-বাইশটা চিঠিপত্রের হদিস মেলে।

এ দিকে শরীর প্রতিদিন আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। শান্তিনিকেতনে ডাক্তার শচীন মুখোপাধ্যায় তো আছেনই, তা ছাড়া কলকাতা থেকে কখনও এসে পৌঁছচ্ছেন বিধানচন্দ্র রায়, কখনও নীলরতন সরকার এবং তখনকার আরও সব নামী ডাক্তার। এ দিকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কবির রোগ নির্ণয়ে অনেকটা নিশ্চয়তা এসেছে। তাঁর শারীরিক মূল অসুবিধে হল মূত্রনালীর বিঘ্ন। অসম্ভব কষ্টকর এবং যন্ত্রণাদায়ক পীড়া। এই বাধার মুখ্য কারণ তার প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বৃদ্ধি। আবার তাঁর কিডনিও তেমন সক্রিয় নয়। তা ছাড়া বার্ধক্যজনিত দৌর্বল্যও দ্রুত তাঁকে ঘিরে ধরছে।

তাঁকে সুস্থ করে তোলার পথ খুঁজছেন চিকিৎসকরা। কেউ অপারেশনের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। এই বিরোধের মধ্যে শেষ পর্যন্ত এফআরসিএস বিধান রায়ের সিদ্ধান্তকেই সকলে মেনে নিতে এক রকম বাধ্য হলেন। অপারেশনে কবির তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিপুত্র রথীবাবুকে সম্মতি জানাতে হল। নিরুপায় কবি আর বিতর্ক না বাড়িয়ে বললেন— তবে তাই হোক।

১৯৪০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কবি কালিম্পং-এ পৌঁছান। ২৬-এ গুরুতর অসুস্থতা এবং চৈতন্যলুপ্তি। ২৯-এ কলকাতায় নিয়ে আসা।

অসুস্থতার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে কবির স্বাস্থ্য-সংবাদ প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলি ‘রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় সঙ্কলিত হয়েছে। ১৮ নভেম্বর কবি শান্তিনিকেতনে
ফিরে আসেন।

২৫ জুলাই সকালের কাগজে জানা গেল, “আগামী কল্য বিকালে কবিকে কলিকাতায় লইয়া আসা হইবে।” আমার সৌভাগ্য সেই ২৫ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে কবির শেষ বিদায়ের বিবরণ, আজও শান্তিনিকেতনে বসে কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শোনার অবকাশ আমার ঘটে। শান্তিনিকেতন হাসপাতালের পাশেই তাঁর বাড়ি, আজও সস্ত্রীক আছেন। তিনি দীপেশদা। কবিই তাঁর নাম রেখেছিলেন। সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র। ১৯৩২-এর ২০ অক্টোবর জন্ম। ১৯৪১-এ বালকের বয়স ছিল নয়। বিরাশি বছর আগের স্মৃতি, আজও তাঁর কাছে কবির শেষ যাত্রার ছবি জীবন্ত। আজও সে দিনের কথা বলতে বলতে তাঁর মনে হয় কবি যেন এই গতকালই নীল গাড়ি করে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় চলে গেলেন।

আমি ২৫ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে কবির শেষ চলে যাওয়ার বিবরণ পাই সে দিনের তিন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে। এক, ভুনুদা— রবীন্দ্রজীবনীকারের বড় ছেলে সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, দুই, কৌশিকজি— দিনকর কৌশিক তখন কলাভবনের ছাত্র এবং তিন দীপেশ রায়চৌধুরী— সুধাকান্তবাবুর ছোট ছেলে। প্রথম দু’জন আজ আর নেই। ভুনুদা আর দীপেশবাবুরা এবং আরও অনেক বালক যুবক বৃদ্ধ কবির গাড়ি অনুগমন করে শান্তিনিকেতন থেকে বোলপুর স্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। প্রায় ৩৫-৪০ জনের জমায়েত হয়েছিল, ছিলেন কিছু মাস্টারমশাই, হস্টেলের কিছু ছাত্র আর শান্তিনিকেতনবাসীদের কেউ কেউ। ভুনুদা ছবি আঁকতে পারতেন, কবির গাড়ির পিছনে পিছনে ছেলেরা দৌড়োচ্ছে, সেই ছবি এঁকেছিলেন,
আমি দেখেছি।

দীপেশবাবু বললেন— ‘বাবা রাত্রে বাড়িতে ফিরে মাকে বললেন, গুরুদেবকে কালকে সকালেই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মা নিভা বললেন— আমরা তা হলে কালকে সকালে গুরুদেবকে দেখতে যাব। বাবা আপত্তি করলেন না; বললেন ভোর ভোর সকলে তা হলে উঠে পড়বে। শান্তিনিকেতনের অনেকেই ভোর থেকে উদয়নে চলে গিয়েছিলেন। কৌশিকজি, সত্যজিৎ রায়ও ছিলেন।

‘আগের দিনের নীল বাসটি বোলপুরে নিয়ে গিয়ে তার পিছনের অংশটা কাটিয়ে আনা হয়েছিল। সেই বাস ভোর থেকেই উদয়নের বারান্দার সম্মুখে প্রস্তুত। গাড়ির রং নীল, গাড়ির চালক নীলমণি গায়েন শান্তিনিকেতনের পুরনো ড্রাইভার, কবির পরনে কালচে নীল জোব্বা। মাথায় কালো উঁচু টুপি, চোখে কালো চশমা। কবিকে তাঁর সেই ইজ়িচেয়ারে বসা অবস্থাতেই গাড়িতে পিছন দিক দিয়ে তোলা হল। সকলেরই মনের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক পাথরের মতো চেপে বসেছে, এটিই বুঝি গুরুদেবের শেষ যাত্রা শান্তিনিকেতন থেকে। কবির নিজের মনের মধ্যেও তেমন একটা ধারণা যেন বাসা বেঁধেছিল। কাউকে কাউকে সে কথা বলেওছিলেন। ওই অপারেশনটা তিনি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তবু সবার মত মেনে নিয়েছিলেন নিরুপায় হয়েই।

‘যাত্রা শুরু হল। খুব মন্থর গতিতে গাড়ি এগোতে শুরু করল। কবির উত্থিত ডান হাতের মুদ্রায় আশীর্বাদের ইঙ্গিত। সমবেত মানুষ কবিকে যুক্তকরে নমস্কার জানাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ ছাত্রছাত্রীরা গেয়ে উঠল, ‘সে যে সব হতে আপন আমাদের শান্তিনিকেতন’।

‘গাড়ি উত্তরায়ণ থেকে সোজা আশ্রমের ভিতরের রাস্তায় ঢুকে গৌরপ্রাঙ্গণকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে চীনা ভবনকে ডান পাশে রেখে বোলপুর-শান্তিনিকেতন মেন রাস্তায় নামল। সদর রাস্তায় আরও বেশি লোক সঙ্গী হল। সকলেই কবিকে বিদায়-অভিবাদন জানাতে বোলপুর-অভিমুখী। স্টেশনের সাইডিং-এ কবির সেলুন গতকাল থেকেই অপেক্ষারত। কে বলবে ট্রেনের কামরা! যেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে বিলাসবহুল একটা আধুনিক ফ্ল্যাট। রয়েছে চারটি ঘর, দুই শয্যার একটি শয়নকক্ষ, একটি ড্রয়িংরুম, একটি খাবার ঘর ও একটি কিচেন। তা ছাড়া দু’টি স্নানের ঘর ও একটি ভৃত্যদের ঘর। প্রতিটি ঘরে দু’টি করে ফ্যান, তাপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তখনও রেলগাড়িতে বসেনি।

‘সকাল-সকালই পাকুড় প্যাসেঞ্জার বোলপুর স্টেশনে এসে পৌঁছল। তার ইঞ্জিন এসে সেলুন কারটিকে নিয়ে পুনরায় পাকুড় প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে যুক্ত করল। ঘণ্টা বাজল। আকাশে এক রাশ কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বোলপুরের মাটি ছেড়ে এগিয়ে গেল ট্রেন। যত দূর দেখা যায়, লোকে নীরবে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।’

কবির অনুভব, তাঁকে নিয়ে যেতে সত্যি সত্যিই মৃত্যু এক দিন এসেছিল; সেটা চার বছর আগে, ১৯৩৭-এ। এ বার যদি তাঁর তীব্র আপত্তি ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসন্ন অপারেশনের পর তাঁর মৃত্যু আসে, সে জন্য বুঝি তিনি এ বার যমরাজকে দায়ী করতে সম্মত হবেন না; ওই অস্ত্রোপচারকেই এই পৃথিবী ছেড়ে বাধ্য হয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত
করে যাবেন।

২৫ জুলাই থেকে ৭ অগস্ট ১৯৪১, ১০ শ্রাবণ থেকে ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮, যাঁরা তাঁর সেবারতা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেই আচ্ছন্ন দু’সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনকার বিবরণ লিখে গেছেন। সে আমরা সকলেই জানি। তবু তারই মধ্যে অর্ধ-অচৈতন্য কবির কয়েকটি কবিতা রচনার প্রসঙ্গটুকু উত্থাপন করে শেষ করতে চাই। তাঁর সেই সাধনা পত্রিকা-পর্বে কবি বলেছিলেন— “আমার সরস্বতীকে আমি কোনো অবস্থাতেই অবহেলা করতে পারিনে”; তাঁর মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাঁর যে সতর্ক যত্ন সজাগ ঐকাগ্র্য— তা আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে তোলে। সেই মালতী-পুঁথির শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্তের সৃষ্টি, কোথাও কোনও দিন কখনও কোনও ফাঁকি নেই। অবহেলা ঔদাসীন্য নেই। কাব্য-কবিতার পাঠ নির্বাচনে এবং যথাযথ উপযুক্ত সেরা শব্দটি প্রয়োগে তাঁর ভাবনা-মনস্কতা শেষ মুহূর্তেও অব্যাহত। হোক না শেষ লেখা; তবু তাকে সুন্দর থেকে সুন্দরতর করে তুলতে হবে। মৃত্যুর দশ দিন আগে, অপারেশনের তিন দিন আগে রচিত হল ‘প্রথম দিনের সূর্য’। ছোট কবিতা, এগারো চরণ। সকালে মুখে মুখে বললেন, রানী চন্দ লিখে নিলেন। রানী জানিয়েছেন, কবি কবিতার “কয়েকটি জায়গায় বলে বলে কাটাকুটি করালেন। ফিরে আর একটা কাগজে তা লিখে দিলাম গুরুদেবকে। গুরুদেব শুয়ে শুয়েই বুকের উপরে কবিতার কাগজটি ধরে আরও তিন জায়গায় নিজের হাতে কেটে অন্য কথা বসালেন।”

২৯ তারিখ বিকেলে রচিত হল ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে’। কবি মুখে মুখে বললেন, এটিও রানী চন্দ কাগজ-কলমে লিখে নিলেন। “গুরুদেব মুখে বলে বলে কবিতা সংশোধন করালেন।” রানীর মুখে কবিতাটি শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে রানীকে আবার বকুনিও দিলেন। “এ কী লিখেছ তুমি, ছন্দ মিলল কোথায়?”

যে মানুষটার বড় একটা অপারেশন পরের দিন, যে মানুষটা কলম ধরতে পারেন না, নিজে হাতে লিখতে পারেন না, শ্রবণশক্তি ক্ষীণতম, সেই মানুষটার ছন্দের কান তখনও পরিষ্কার। একটা মাত্রার কম-বেশিও প্রায়-বধির এই মানুষটার কান এড়িয়ে যেতে পারে না।

কবি মৃত্যুশয্যায়। প্রতীক্ষার রাত্রি অবসানে আবার একটা সকাল এল। কবির এখনও অজানা, আজই তাঁর সেই সাংঘাতিক যন্ত্রণার, অনিচ্ছার অপারেশন। ডাক্তাররা যতই সান্ত্বনা দিন, যতই বলুন ‘আপনি বুঝতেও পারবেন না কখন অপারেশন হল, আপনি সে সময় কবিতাও পড়তে পারেন...’ তথাপি কবি সুনিশ্চিত তাঁর শরীরে ছুরিকাঘাত হলে তাঁকে সে-আঘাতের কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্ট পেতেই হবে।

সেই আতঙ্কগ্রস্ত অপারেশনের দু’-তিন ঘণ্টা আগেও তাঁর কবিহৃদয়ে আবার একটি নতুন কবিতা জন্ম নিতে চাইল। সে কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি।’

রানী কাগজ-কলম নিয়ে বসলে কবি একটি পর একটি চরণ মুখে মুখে বলে গেলেন। ২১টি চরণ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, যেন চোখের সামনে কোনও বড় পর্দায় সে কবিতার লাইনগুলো ভেসে উঠছে। রানী দ্রুত লিখতে পারেন, কবিকে অনুসরণ করে যেতে তাঁর অসুবিধে হয় না। অপেক্ষাকৃত বড় কবিতা। নির্মাণের পরই ক্লান্তিতে চোখ বুজলেন। বেশ খানিক পরে চোখ খুলে আবার রানীকে ডাকলেন, বললেন, যেখানে কবিতাটা শেষ হয়েছে, তার পরে আরও তিনটে লাইন যুক্ত হবে। “অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে/ শান্তির অক্ষয় অধিকার।”

রানী কবিতার সঙ্গে যুক্ত করে নিলেন এই অংশ।

অপারেশনের সব কিছু প্রস্তুতির পর সাড়ে দশটা নাগাদ ডাক্তার ললিতমোহন ঘরে খোশমেজাজে ঢুকে কবিকে বললেন— আজকের দিনটা তো বেশ ভালই, তা হলে আজই সেরে ফেলা যাক—
কী বলেন?

আর কয়েক মুহূর্ত পর অপারেশন। স্তব্ধ হয়ে রইলেন কবি কিছুটা সময়। তার পর রানীকে সদ্য রচিত কবিতাটি আর এক বার পড়ে শোনাতে বললেন। শুনে বললেন, গোলমাল আছে কিছু। তার পর বললেন, আছে থাক। ডাক্তাররা তো বলছে অপারেশনের পর মাথাটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন ভাল করে সংশোধন করা যাবে।

হায়! সে সংশোধনের সুযোগ তিনি আর পেলেন কোথায়?

মৃত্যুদূত নয়, চিকিৎসার নামে শল্যাঘাতেই যেন এই মহামানবের প্রয়াণ।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Bengali Feature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy