Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

পশুপাখিই তাঁর শিল্পগুরু

বানরের লাফ, ময়ূরের চাহনি, বাঘের চলন লক্ষ করতেন মন দিয়ে। পরে ছৌ নৃত্যে সেগুলি ব্যবহার করেন গম্ভীর সিংহ মুড়া।

Picture of a man.
অলোক মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৭
Share: Save:

যাঁরা ছৌ বা ছো নৃত্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন গম্ভীর সিংহ মুড়া। গম্ভীর সিংহ মুড়াকে ছৌ নৃত্যগুরু বা ছৌ-সম্রাট বলা হয়। ছৌ নৃত্যকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিখ্যাত করে তোলার পিছনে গম্ভীর সিংহের নিরলস প্রচেষ্টা অনস্বীকার্য।

গম্ভীর সিংহের পিতৃদত্ত নাম বাবু সিংহ। জন্ম মামার বাড়িতে, অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে এক প্রত্যন্ত গ্রামে, ১৯২৯ সালে (মতান্তরে ১৯৩০)। খুব অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগের পর মায়ের হাত ধরে পুরুলিয়ায় গ্রামের বাড়ি চড়িদায় ফিরে আসে বালক বাবু সিংহ। জীবিকানির্বাহের জন্য মা বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি, আর বাবু শুরু করে প্রায় একশোটি গরু নিয়ে গরু-বাগালি। বাবুর বাবা জিপা সিংহ ছিলেন ছৌ শিল্পী, তাই বাবুর ভিতরে তার বীজ নিহিত ছিল। জনশ্রুতি, গরু-বাগালি করার সময় বাবু বাঁশি বাজাত আর একটা কালো গাই শিং নাড়িয়ে বাবুর বাজনার সঙ্গে তাল দিত। গাছে বসে বানরের লাফ, ময়ূরের চাহনি, বাঘের চলন লক্ষ করত বাবু। পরবর্তী কালে ছৌ নৃত্যে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে এই সব কাজে লেগেছিল। বনের পশুপাখিই তার শিল্পগুরু।

সালটা ১৯৪৬। ছৌ নাচের আসর বসেছে। বাবু সিংহের ডাক পড়ল। বয়স ষোলো-সতেরো। মহিষাসুরের সাজপোশাকে অভিনব ছৌ নৃত্যে বাঘমুণ্ডির রাজা খুব খুশি হলেন। সেই দিন থেকেই তার নাম হল গম্ভীর সিংহ মুড়া। এর পর থেকে তাকে আর পিছন ফিরতে হয়নি। মোটামুটি ১৯৭১ সালে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে ছৌ নাচ পরিবেশন করলেন গম্ভীর। এর পরের বছর দিল্লি। গম্ভীর এবং ছৌ নাচ, দুই-ই জনপ্রিয় হল সারা দেশে। ওই বছরই আশুতোষ ভট্টাচার্য ও ফরাসি মহিলা সালভিনির উদ্যোগে গম্ভীরের দল পাড়ি দিল লন্ডনে। তার পর ফ্রান্স, প্যারিস, হল্যান্ড, স্পেন, আমেরিকা। ১৯৯১ সালে জাপানে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ পরিবেশন করে ভারতীয় নৃত্যকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন গম্ভীর। ইতিমধ্যে ১৯৮১ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’। পরে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি সম্মানও পেয়েছিলেন এই শ্রদ্ধেয় শিল্পী।

ছৌ নাচে প্রায় ৪৫টি মুদ্রা আছে। যেমন— ময়ূর চাইল, বাঘ চাইল, শুয়োর চাইল, বাঘ চাইল ইত্যাদি। এ ছাড়া শিল্পীরা নিজস্ব কিছু মুদ্রাও প্রদর্শন করেন। এই নৃত্যের মূল বাদ্যযন্ত্র ঢোল, ধামসা, বাঁশি, ঝুনঝুনি, হারমোনিয়াম, করতাল, সানাই। ছৌ শুরু হয় গণেশ বন্দনা দিয়ে। ধূপ ও মালা দিয়ে গণেশ বন্দনা শুরু হয়— ‘প্রথমে বন্দনা করি গণেশ চরণ/ সিঁদুর বরণ অঙ্গ মূষিক বাহন/ সকল দেবের সিদ্ধিদাতা হরগৌরী নন্দন’— সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে আসেন গণেশ। ধামসা আর অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে চলে তুমুল নাচ। এর পরেই শুরু হয় মূল কাহিনি।

গম্ভীর জীবনে পেয়েছেন অনেক খেতাব আর সম্মান। কিন্তু জীবনের উপান্তে দারিদ্রই ছিল সঙ্গী। মাটির বাড়ির চালটাও ঠিক মতো ছাওয়াতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর নানা স্থানে তাঁর নামে অনেক অনুষ্ঠানমঞ্চ তৈরি হয়েছে, চড়িদা গ্রামে মূর্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে তো স্মৃতিরক্ষা মাত্র।

ছৌ শিল্পীরা নৃত্যের সময় চরিত্র অনুযায়ী মুখোশ আর পোশাক ব্যবহার করেন। মুখোশ তৈরি এখন পুরুলিয়ার অনেক মানুষের জীবিকা। মুখোশ শিল্পীরা সারা বছরই মুখোশ তৈরি করেন কিন্তু কেনাকাটা হয় মূলত চৈত্র মাসে।

২০০০ সাল নাগাদ, কাছ থেকে গম্ভীর সিংহকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে দুপুর নাগাদ ইডেন গার্ডেনে ঢুকেছি, দেখছি, একটা টিভি চ্যানেল ক্যামেরার সামনে বসিয়ে এক জন বয়স্ক মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করা জানলাম, ইনিই ছৌ নৃত্যসম্রাট গম্ভীর সিংহ মুড়া। এর মধ্যেই দেখি, উনি হঠাৎ লাফ দিয়ে মহিষাসুরের মুদ্রা দেখালেন। আমি তো অবাক, এই বয়সে এটাও সম্ভব! ইন্টারভিউ শেষে আমাদের সঙ্গে খোশমেজাজে কথাও বললেন।

২০০২ সালের ১০ নভেম্বর ছৌ গুরু পদ্মশ্রী গম্ভীর সিংহ মুড়া এক বুক ব্যথা নিয়ে নীরবে চলে গেলেন। পুরুলিয়ার ছৌ নাচে হয়তো বদলে গিয়েছে পরম্পরা, রং লেগেছে আধুনিকতার। কিন্তু এই নাচকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে স্থান দেওয়ার পিছনে গম্ভীর সিংহের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy