শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
এক বন্ধু বাড়ি এসে ম্লানমুখে একটি সান্ধ্য দৈনিক হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রথম পাতার শিরোনাম অনেকটা এ রকম, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান’। শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে আসা হয়েছে কলকাতায়। এর পর কথা বিশেষ হয়নি, এর পর কথা বিশেষ থাকে না।
পরের দিন ছিল ঝাঁঝালো রোদের এক আশ্চর্য বসন্ত। তাঁর প্রিয় বর্ষা বা কোদালে মেঘের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না কোথাও, তবু সবার মুখ যেন বরষাপীড়িত ফুলের মতো। কবির মৃত্যুতে বিধ্বস্ত কলকাতা সে দিন। রবীন্দ্রসদন আর নন্দন লাগোয়া চত্বরে ভিড় বাড়ছে। বিচিত্র, শ্রেণিহীন সেই ভিড়। বহু ট্যাক্সি ড্রাইভার, সর্বস্বান্ত চেহারার বিভিন্ন পেশার মানুষ, সকাল সকালই দু’পাত্র চড়িয়ে আসা কবিকুল, আমলা, অভিনেতা, গায়ক, পুলিশকর্তা— কে নেই! তখনও এত চ্যানেলের সমাগম হয়নি, কিন্তু দূরে একা এবং অস্থির, একের পর এক সিগারেট ধরানো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সামনে এক জন চ্যানেল-সাংবাদিক। বোধহয় বাংলা দূরদর্শন। ধীরে ধীরে আত্মগত ভাবে বলছিলেন সৌমিত্র তাঁদের বন্ধুজীবনের কথা। পরের দিন যিনি লিখবেন, “সকলের চেয়ে বেশি নিয়ে ওর একা থাকার অহঙ্কার ছিল বোধহয়। কতকাল আগে লিখেছিল— ‘চতুর্দোলা নিয়ে যম/ অপমান লাগে/… মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি।’”
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যখন গাড়ি রওনা হল কেওড়াতলার দিকে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সেই গাড়িতে লাফিয়ে উঠেছিলেন কিছু অনুজ কবি। আমরা, অর্থাৎ তাঁর অগণ্য সাধারণ পাঠকরা, সঙ্গে হাঁটতে থাকলাম। কবির মৃত্যুতে এত দীর্ঘ এবং স্বতঃস্ফূর্ত গান-কবিতার শোকযাত্রা তার আগে কলকাতা খুব বেশি দেখেনি। আমরা হাঁটছি, পল্লব কীর্তনীয়া ভেঙে পড়তে পড়তেও আপ্রাণ গান গেয়ে চলেছিলেন মনে পড়ে। ‘ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে..।’ হাফহাতা হাওয়াই শার্ট পরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পাশেই হাঁটছেন। শক্তির বিভিন্ন সময়কার পদ্যের পঙ্ক্তি গর্জে উঠছে শোকমিছিল থেকে। গর্জে উঠছে প্লাতেরো। গর্জে উঠছে রুপোর পাহাড়, পোড়োবাড়ির স্মৃতি। চৈতন্যে উড়ে পড়ছে তাঁরই কবিতা থেকে ধার নেওয়া মার্চ মাসের শিমুল। ‘দূর সমুদ্রে পাড়ি দেবোই, পাহাড়চূড়োয় থাকবো বসে/ চিরটা কাল চলবো ছুটে— পিছনে নেই পশ্চাতে নেই/ তদন্তে ক্রূর পায়ের শব্দ ওরা আমায় ছেড়ে দিয়েছে’... যাবার সময় বোলো কেমন করে এমন হলো পালিয়ে যেতে চাও/ পেতেও পারো পথের পাশে নুড়ি/ আমার কাছে ছিল না মুখপুড়ি/ ভালবাসার কম্পমান ফুল/ তোমায় দেবো বাগান দ্যাখো ফাঁকা/ তোমায় নিয়ে যাবো রোরোর ধার/ তোমায় দেখে সবার অন্ধকার মুছতে গেল সময় আমার সময়’... ‘প্লাতেরো তোমারে প্রিয় ঈর্ষা করি,/ তুমি বহুদিন আমার বুকের পাশে ঘুমায়েছো, পিঠের উপরে।/ আমার গোলাপগুলি খেয়ে গেছো/ ভবিষ্যত ভরা কবিতার খাতাগুলি— স্মরণীয় রুমালের ঝাঁক...।’ ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে একের পর এক পঙ্ক্তি কলকাতার রাজপথে। এমন রাজকীয় শবানুগমন আমি তো করিনি কখনও এর আগে।
এমন সময়েই এক জন পড়তে শুরু করল, ‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো’... চতুর্দশপদী সিরিজ়ের বিখ্যাত সেই কবিতা। পাশ থেকে অননুকরণীয় নাসিকাভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতেই কবির বন্ধু সন্দীপন বললেন, ‘ওরে ওটা পড়িস না, ওতে খারাপ একটা কথা আছে! অন্য পদ্য পড়!’ টকটকে লাল চোখ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখলাম একদম শেষে (বহু বছর পরে, দিল্লির সাহিত্য অকাদেমিতে ওঁর অফিসে বসে সেই দিনটি নিয়ে কথা হয়েছিল এক বিকেলে) সিগারেট খেতে খেতে চুল্লির প্রশস্ত চাতালে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেলেন। এর পর গান স্যালুট ইত্যাদি। অনেক রাত পর্যন্ত কালীঘাট শ্মশান চত্বরে উড়েছিল কবিতার ছাই। জাহাজ ছেড়ে গিয়েছিল বন্দর থেকে। কলকাতা জেনেছিল, অকূল পারাবারের অজানা অন্ধকারে দরবারি কানাড়ার হাতছানিতে কূল ছেড়ে ভেসে গেলেন সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও কাঙাল। আমার এক বন্ধু সে দিন বাড়ি ফিরে গভীর রাতে লিখেছিল, ‘কবির এসবেতন ছুটি।’
*****
আঠাশ বছর কেটে গেল তার পর। সে দিন কবিতায় গানে শোকযাত্রা ভরিয়ে দেওয়া সেই সব অনুজ কবি, পাঠক, যুবক যুবতীরা আজ অনেকটা আয়ু পার করে এসে ধূসর স্টেশনে। এই প্রবাসের গোধূলিতেশক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুমাসের স্কাইলাইনে স্পষ্ট পড়া যায়— ‘...অন্ধকারের দেশ/ আছো বলে, তুমি আজো এ-নির্নিমেষ/ খুঁজে— আছে পুরাতন রাজবাড়ি/ মুহূর্তকাল দাঁড়ায় আমার গাড়ি/ ব্রিজ— যমুনার জল/ স্মৃতির ভিতরে মৌরলা-চঞ্চল/এনেছিলে পরিবেশ/ যেতে হবে বহুদূর— দিল্লি রাজবাড়ি হলো শেষ।’
আঠাশ বছর কেটে যাওয়ার পর এই কবিকে নানা গালগল্প, ডবলডেকার বাসে বাড়ি ফেরা, খালাসিটোলার প্রমত্ততা, ‘এই আসছি’ বলে বেরিয়ে চাইবাসা-র মতো অতি ব্যবহারে জীর্ণ ক্লিশেগুলি থেকে বার করে এনে বহু দূরের, অন্য প্রজন্মের, অন্য সময়ের পাঠকের সামনে খুলে ধরার সময় এসেছে মনে হয়। শিশুকালে পিতার মৃত্যু, মামাবাড়িতে মানুষ হওয়া, গণ্ডগ্রামে কাটানো শৈশব পেরিয়ে কলকাতা এসে প্রথমে বাগবাজারের মাতুলালয়ে, তার পর উল্টোডাঙার ঘিঞ্জিতে বেড়ে ওঠা শক্তি চট্টোপাধ্যায় কী ভাবে অজস্র মানুষের শ্রদ্ধা পেয়ে জীবিত অবস্থাতেই পরিণত হলেন কিংবদন্তিতে, কিন্তু আগাগোড়া থেকে গেলেন রহস্যময়, তা বিবেচনা করে দেখারও প্রয়োজন রয়ে গিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে কী আশ্চর্য রসায়নে একাকার হয়ে গেলেন কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা, শুঁড়িখানার মালিক, গবেষক, পণ্ডিত, অভিনেতারা— তার সূত্র খুঁড়তে গিয়ে ‘আমার বন্ধু শক্তি’ গ্রন্থে সমীর সেনগুপ্তের একটি চমৎকার ব্যাখ্যা পাচ্ছি, যা আসলে ব্যাখ্যাতীত। সমীরবাবু লিখছেন, “বড়ো কোম্পানিতে চাকরিও পেয়েছিল বার দুই, কিন্তু নিস্তরঙ্গ মধ্যবিত্ত জীবনে প্রমোশন পেয়েও নিল না। কবিতা লিখল। সামান্য কিছুদিন গ্রিনরুমে টলমল করে হাঁটা— তারপরই রাজার মুকুট পরে মঞ্চে প্রবেশ। প্রায় চল্লিশ বছর সেই মুকুট মাথায় নিয়ে ঘুরেছে শক্তি, ওকে দেখলে মনে হত না মুকুটটার ওজন একটা পালকের চেয়ে বেশি।… বহুদিন লাগবে শক্তির চরিত্রের এই রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করতে, কারণগুলি বিশ্লেষণ করে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে।... রহস্যের চাবি হয়তো পাব না, কিন্তু সেই রহস্যটিকেই তো আমরা পেয়েছি। হেমন্তের অরণ্যের সেই হরকরা, যিনি মানুষে মানুষে ব্যবধান কমিয়ে আনতে চালাচালি করেন অপ্রাকৃত চিঠি, মানুষকে ভয় পেয়ে অরণ্যে প্রবেশ করে ইতস্তত ছড়ানো বাঘের পায়ের দাগকে যাঁর উঠোনময় লক্ষ্মীঠাকরুনের পদচ্ছাপের আলপনার মতো শ্রীময় ও সুষমামণ্ডিত মনে হত, সেই কবির সঙ্গে এক পৃথিবীতে একই মায়ের স্তন্যপানের মতো— এই রহস্য বুকে নিয়েই বেঁচে যাওয়া যাবে বাকি জীবন...”
পঞ্চাশের দশকের মুখপত্র হিসেবে যদি ‘কৃত্তিবাস’ এবং ‘শতভিষা’ এই দুই পত্রিকাকে সামনে নিয়ে আসা যায়, তা হলে দু’টি মূল-শব্দের সন্ধান পাই। প্রথমটির অর্থাৎ ‘কৃত্তিবাস’-এর সম্পাদকীয়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “এ সময় আগের দশকের কবিতাভাবনার বদলে নিজেদের মধ্যে কোনওরকম পরামর্শ না করেই নতুন কবিরা লিখছেন স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা।” আর ‘শতভিষা’ বলছে, “তিরিশের দশকের কবিদের যৌন কাতরতা, মূল্যবোধে অনাস্থা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ অতিরিক্ত সমাজভাবনা তরল কাব্যময়তা ইত্যাদি আপাত লক্ষণগুলো যে আর ব্যবহৃত হবার নয় এ সত্য অভ্রান্ত জেনে কবিতার মুক্তির জন্য শতভিষা প্রয়োজন অনুভব করছে নতুন পথ সন্ধানের।” অর্থাৎ ‘স্বীকারোক্তি’ এবং ‘নতুন পথ’— এই দু’টি ভাবনা সঙ্গে নিয়ে পঞ্চাশের দশক জোর দিচ্ছে ব্যক্তির কথনে। অতিরিক্ত সমাজভাবনার প্রতি তার অনীহা। দুর্বোধ্যতা থেকে কিছুটা মুক্তি, কবিতাকে যাপনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে এক ধরনের বোহেমিয়ান জীবন— এই সব মিলিয়ে এই সময়খণ্ডই সম্ভবত প্রথম তৈরি করতে পারল বাংলা কবিতার জন্য বহু ধরনের পাঠককে। বাড়তে লাগল বাংলা কবিতার সর্বগ্রাহ্য জনপ্রিয়তা। কবিতার মধ্যে এল বিবিধ স্বরের সমাহার। শঙ্খ ঘোষ ধারণ করলেন সমসময়ের উদ্বাস্তু আগমনের ক্ষত, স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে তৈরি হল আলোক সরকারের উতল নির্জন।
কিন্তু সে সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাকে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না একমুখী আত্মস্বীকারোক্তি বা সমকাল-নির্ভরতায়। মাটির ভিতরের নানা অজানা আলো-অন্ধকার স্তরে চারিয়ে যাচ্ছে তাঁর পদ্য। তৈরি হচ্ছে কবিতার গাছ, অরণ্য। এরই মধ্যে ’৫৬-র খাদ্য সঙ্কট, দুর্ভিক্ষ, দু’-দু’টি সীমান্ত যুদ্ধ। ফ্রান্স, আমেরিকা, তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে আন্দোলন। ভিয়েতনামের যুদ্ধ, কেনেডির হত্যার মধ্যেই বাংলা কবিতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছ আমেরিকার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারত তথা কলকাতা সফর।
কিন্তু এই সময়েও শক্তির কবিতা পড়তে পড়তে শেলির সেই প্রাচীন উক্তি মনে পড়ছে গবেষক সমালোচকদের। তা হল, কবি হচ্ছেন সেই অ্যাকোলিয়ান হার্প অর্থাৎ গ্রিস দেশের তারে বাঁধা বাদ্যযন্ত্র, যার মধ্যে হাওয়া যাতায়াত করলে সুর নির্গত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সার্বিক নরকস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোথায় সুর আর লিরিকের ব্যঞ্জনা?
*****
তুমুল জনপ্রিয়তা, জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া, পুরস্কার, স্বেচ্ছাচার, এডিশনের পর এডিশন, পর্যটন ও পাগলামির মধ্যেও বার বার এবং হয়তো এখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের রেখে যাওয়া বিপুল পদ্যসংগ্রহের সামনে একটি বা দু’টি মূল প্রশ্নকে জাগিয়ে রাখা হয়। কখনও সমালোচনায়, কখনও আড়ে বিভঙ্গে, আবার হয়তো বা তুলনামূলক সাহিত্যের ক্ষুরধার কবিতা-বিতর্কে বলা হয়ে থাকে, সোনার মাছি খুন এর আগে বাংলা কবিতায় করা হয়নি এটা হয়তো সত্যি। চিঠি পাওয়ার লোভে দূরে সরে যেতে যেতে হেমন্তের পাতাঝরা অরণ্যে পোস্টম্যানকেও সে ভাবে ঘুরতে দেখা যায়নি শক্তি-পূর্ব এবং পরবর্তী কবিতায়।
কিন্তু সত্যিই কি বছর বছর নতুন কথা বলতে পেরেছেন বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তি? তিনি কি শব্দের মোহে, ছন্দের জাদুতে, লিরিকের সম্মোহনে আচ্ছন্ন হয়ে ক্রমশই উড়ে যাননি প্রকৃত পাঠকের কাছ থেকে সারসের মতো? শেষের কয়েক বছর যখন তাঁর হাত ও কাঁধ থেকে গাণ্ডীব ও তূণীর পড়ে গিয়েছে মাটিতে, তার আগেও ষাট, সত্তর এবং আশির দশকের উত্তাল কবিতা-জীবনের সেই মধ্যাহ্নেও এই প্রশ্ন আমরা কিন্তু উঠতে দেখেছি বার বার। আজও সোশ্যাল মিডিয়া অথবা বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে আলোচনায় এই সংশয়চিহ্ন ফিরে আসতে দেখি। অথচ, পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে, গভীর মন্দ্রকণ্ঠে পড়া তাঁর নিজেরই লেখা পঙ্ক্তি— ‘যে কথা বলোনি আগে এ বছর সেই কথা বলো।’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত, ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ থেকে ১৯৯৯ সালে (তাঁর মৃত্যুর চার বছর পরে) ‘সকলে প্রত্যেকে একা’ পর্যন্ত এই দীর্ঘ পদ্যজন্মের এটি কি এক সিগনেচার লাইন নয়? আমরা, শক্তির দূরের মগ্ন পাঠকরা কি তাঁর রুদ্ধশ্বাস বাঁকবদলগুলি পড়তে পড়তেই এগোইনি এতগুলো বছর?
অথচ নতুন কথা বছর বছর কী বললেন তিনি, অথবা যা বললেন তাকে যথেষ্ট নতুন বলা যায় কি না তা নিয়ে সংশয় বাংলা কবিতা-পাঠকের একটি গণসংশয়েরই রূপ। যা আকারে শক্তিকে ঘিরে জনপ্রিয়তারই সমান। ১৩৯৪ সালের পৌষে, অর্থাৎ, সেই কবে, ‘সংবেদ’ পত্রিকায় সমালোচক গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেই জাতের কবি যিনি জীবন-ভাবনার যে কোনো দৃশ্যকে জীবিত কবিদের মধ্যে সর্বোত্তম রূপদানে সক্ষম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা কবির কাছ থেকে মায়াবাদ ও মৃত্যুচেতনার মতো একটি উজ্জ্বল উপজীব্যকেন্দ্রিক কিছু অনুজ্জ্বল কবিতায় সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছি।” এরই সূত্র নিয়ে জহর সেনমজুমদার তাঁর ‘বাংলা কবিতার মেজাজ ও মনোবীজ’ গ্রন্থে বলেন, “বৃষ্টিভরা বাংলায় শক্তির দুটি পা রয়েছে দু দিকে। একটি আঁতুড়ঘরে। অন্যটি অবশ্যই নিমতলায়। ছাইয়ের উপর।” শক্তি-সাহিত্যের এই অমোঘ দুটি মেরু চিহ্নিত করার পর (পাঠক পাশাপাশি স্মরণ করুন শক্তির দুটি পঙ্ক্তি, ‘সবার বয়স বাড়ে আমার বালক বয়স বাড়ে না কেন’ এবং ‘পুড়তে আমি চাইছি কোনও নদীর ধারে’) জহরবাবুর প্রশ্ন, “তবু পরবর্তী বাংলা কবিতায় শক্তির স্থান কোথায় এই আমূল প্রশ্নটি দ্বারা তাড়িত না হয়ে আমরা পারি না। দুটি ভয় তাঁর বিশিষ্ট স্থান গ্রহণের পক্ষে ক্রমে অন্তরায় হয়ে উঠেছে। ভয় দুটি হল যথাক্রমে ক. অত্যধিক লিরিক প্রবণতা খ. অত্যধিক জীবনানন্দ-আসক্তি। অক্ষয়কুমার-দেবেন্দ্রনাথরা আজকের আধুনিক সময়সংকটে যেভাবে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছেন, লিরিক বাহুল্যের কারণে, ঠিক সেইভাবে শক্তিও নিষ্প্রভ হয়ে যাবেন না তো?”
আনখশির শক্তিপাঠে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, যাঁরা টের পেয়েছেন নিজের ভিতরে ‘মর্মছেঁড়া গাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে’, আমরা যারা ‘লাটাই-ঘুড়ির যোগাযোগকারী সুতোও ছিঁড়েছি/ জীবনে অসংখ্যবার’, আমরা যারা জানি, ‘প্রেম কিছু দেয়, কিন্তু প্রেমের হীনতা দেয় খুব/ বিরহ, গোপন মেঘ, হিংস্র থাবা জিহ্বা যন্ত্রণা’ তারা জেনে গিয়েছি, শব্দের মোহে, প্রেমে, কামে, বিরহে পড়া ছাড়া কবির তাঁর জন্মজীবনে আর করার কিছু থাকে না বিশেষ। শরীরময় আধুনিক ও তাঁর সমসময়ের জটিল ব্যাধি নিয়ে কেবল নিজের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। যেখানকার আলো অন্ধকারে রয়েছে ব্রিজ, রেলপথ, শুঁড়িপথ, সমতল রাস্তা, মোরাম, জলে গলে যাওয়ার পাতাপুতোর পথ। অর্থাৎ জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে অনায়াস যাতায়াতের আশ্চর্য এবং বিবিধ পথের কম্বিনেশন। সমালোচক সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলেন, “এ পূর্ণচ্ছেদের দিকে এক অনিবার্য যাত্রা, আর সে যাত্রায় বিকীর্ণ হয়ে আছে দূরবিস্তারী অনেক পথ।” এই সাঁকো বা পথ— যা-ই বলি না কেন, তৈরি হয়েছে শব্দের অলীক, অভাবনীয় এবং উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) সব সম্ভাবনাকে ভিতর থেকে ফাটিয়ে (ইমপ্লোশন)। যা শক্তির পদ্যসমগ্রের আগে বাংলা কবিতায় কোথাও ছিল না। আজও প্রতিদিন চিতা থেকে উঠে আসছে যে সব কবিতা, তার সর্বাঙ্গে দহনের চিহ্ন।
*****
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি জীবনানন্দ এবং শক্তির প্রতিতুলনার। এ ক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘নিজেকে নিয়ে শক্তি’ প্রবন্ধটি পাঠককে এক বার উল্টে নিতে অনুরোধ করব। বিস্তারিত উদ্ধৃতি দেওয়ার এখানে অবকাশ নেই, শুধু এটুকুই বলার, জীবনানন্দের দেওয়া লাইন থেকে লাইনের মধ্যে কিছু গোপন ঝাঁপ, তাঁর স্বরবহুল সাধুক্রিয়ার প্রয়োগে তৈরি করা আচ্ছন্নতার মুদ্রা, আপাত বক্তব্যের ভার সরিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আস্বাদের প্রতি শক্তির কবিজন্মের প্রথম দিকের টান ও প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন শঙ্খবাবু। পাশাপাশি এটাও অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, জীবনানন্দের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ বহুকালীন ইতিহাস চেতনা, মানুষের সর্বকালীন বিপন্নতার স্বর, দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক সময়কে এক মুঠোয় ধরার যে কৌশল, তা কখনওই টানেনি শক্তিকে। বরং বলা ভাল শক্তি তখন বাংলা কবিতায় স্বরাট এবং একাকী হয়ে গিয়েছেন নিজস্ব মুদ্রাদোষে। শক্তির প্রথম পর্যায়ের ধ্বনিপ্রধান, ছন্দনির্ভর গভীর রহস্যের আবহ (যাকে প্রাবন্ধিক অরুণকুমার সরকার বলেছেন, ‘গানের সুরের মতো মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, ভাবায় না আচ্ছন্ন করে’) থেকে চলে গিয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় পর্বে। যেখানে তিনি অনেক প্রত্যক্ষ, সরাসরি, অপেক্ষাকৃত ঘোরহীন, হৃদয়পুরের অর্থময়তায় (এবং অনর্থেও!) ভরপুর। ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ থেকে ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’-র সে এক অনিঃশেষ যাত্রাবিশেষ। তিনি ক্রমশ সহজ ও প্রসন্ন হয়েছেন। জীবনানন্দ থেকে ক্রমশই তিনি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, তারও দূরে চলে গিয়েছেন।
আসলে জীবননানন্দের কাছে হাত পাতার প্রয়োজন হয়নি অজ গাঁ-র রূপকথাকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্চাশের বিক্ষুব্ধ পটভূমির শহরে পা দেওয়া শক্তির। তাঁর ভাঁড়ারে ঐশ্বর্য কিছু কম ছিল না। বাকিটা তিনি আহরণ করেছেন। কলকাতার স্টেশন থেকে আঠাশ মাইল দূরে উধাও মাঠে, খিড়কির পুকুরে, চার পাশে নারকেল সুপুরির বাগানে (সুপুরি বড় অনুপস্থিত গাছ— প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’য় লিখবেন তিনি) দাদুর কাছে গল্প শুনে আর তাঁর হোমিয়োপ্যাথি চেম্বারের শিশির ভিতর জল ভরে পেঁপে পাতা দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে এই বালকের রহস্যবোধের শুরু। গাছের শিকড়বাকড়ে জড়িয়ে থাকার শুরু। বছরে দু’চার বার কলকাতায় যাওয়া দাদুর সঙ্গে, শিয়ালদায় নেমে ঘোড়ার গাড়িতে টানা বাগবাজার। নিজেই লিখছেন, “দাদুর হাতে থাকত লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে জানলা দুটো খুলে দিয়ে বলতেন, দু’দিক দেখতে দেখতে চল। কত তাগড়াই তাগড়াই ইমারত দেখতে পাবি। আমাদের মতো পুকুর বাগান পাবি না।” ভিতরের চোখ খুলে এক স্পঞ্জের ধর্মে সব কিছু শুষে নিতে থাকত সেই কিশোর। পেট্রলের গন্ধে যার বমি আসত তখন!
*****
এই অমল শৈশব-কৈশোরের প্রেক্ষাপটে বিক্ষুব্ধ সময়ের কলকাতায় তাঁর কবিজন্মের আত্মপ্রকাশকে আমাদের দেখে নিতে হবে এ বার। ভূতুড়ে পুকুর, গা-ছমছমে মাঠ, অস্পষ্ট আলো-আঁধার থেকে নিয়ন টিউবে ঝলসানো কঠিন কলকাতার ঘোরালো জীবন, নাগরিক প্রথাপরায়ণতার মধ্যে পা দিয়ে বহড়ুর সেই কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠা শক্তি বুঝতে পারলেন, এখানে তিনি অনেকটাই বেখাপ্পা, বেঢপ। পরে এটাও বুঝলেন যে, এটা তাঁর বিরুদ্ধে জীবনের ষড়যন্ত্র নয়, এটা আসলে মৃত্যুর এক মহান ষড়যন্ত্র। পদ্যজীবনের আদিপর্বে, অল্পবয়সেই শক্তি লিখলেন, ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’-র মতো পরবর্তী কালে মিথ হয়ে যাওয়া লাইন। চ্যালেঞ্জ নিয়ে লেখা প্রথম পদ্যের (সনেট) নাম দিলেন, ‘যম’। বিভ্রান্তির জগতে তাঁকে মৃত্যু অনুসরণ করতে লাগল সেই অল্প বয়স থেকেই, তৈরি হল এক নির্বাসিতের বোধ। কিন্তু তিনি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সেই নির্বাসনের বিরুদ্ধে, অপরিবর্তনীয় নেমেসিস-এর বিরুদ্ধে ফেটে পড়লেন প্রবল বিক্ষোভে, ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে। জানালেন, ‘আমি স্বেচ্ছাচারী।’ এক মহাসর্বনাশের নেশায় ডুবে বললেন, ‘তোমারে শাসাতে আমি বাদে/ এগিয়ে আসে না কেউ।’
এর পর আমরা ক্রমশ দেখলাম বিদ্রোহের চূড়ায় বসে থাকা কবির এই ‘পোয়েটিক ভায়োলেন্স’ তাঁর হাতেই গলে গিয়েছে, তৈরি হয়েছে অবসাদ এবং তার দু’কূল ছাপিয়ে পাহাড়ি নদীর মতো বইতে শুরু করেছে প্রগাঢ় অভিমান। এই তীব্র অভিমান হয়ে উঠছে তাঁর সত্তার অন্যতম আশ্রয়। তিনি বলছেন, ‘যাব না আর ঘরের মধ্যে যাব না আর ঘরে’। কখনও উচ্চারণ করছেন, ‘বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো দেবতা আমার’, অথবা নিজেকে পরম অভিমানে প্রশ্ন করছেন, ‘দূরের জানালাখানি হতে ফেলে দাও পত্ররাশি/ তোমার অটুট হাত যেন লিখে যায় পরিণাম/ হে মৃত কিশোর, আজি ভোরবেলা জাগিবে না কেন?’ পরিণাম-আতুর তার কিশোর মন তো জানে, ‘এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা’।
আর সেই প্রবাহিত পাহাড়ি নদীর জলের মধ্যে অঞ্জলিবদ্ধ মুঠি নামিয়েছেন কবি। তাঁর কবিতার ঈশ্বর তো থাকেন জলে, নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এই কবিতার। সেই জলের মুহূর্তের সঙ্গে আঙুলের মুহূর্তের এই যে যোগাযোগ, চিরকালের জল থেকে ক্ষণকালের অভিমানকে আলাদা করে নেওয়ার এই যে মন— বিস্ময় ছাড়া আর কী আছে তার পাওয়ার ও দেওয়ার? প্রচুর তর্কের শেষে, যুক্তি ও অযুক্তির খরশান বেলা পেরিয়ে আমরা শক্তির পদ্যের সামনে, অনন্ত নক্ষত্রবীথির অন্ধকারের সামনে তাই একা ও সম্মেহিত হয়ে যাই। আর শুধু অন্ধকার নয়। পরিব্যাপ্ত আঁধারের অনন্ত নকশার মধ্যে দুরূহ, তেরছা, কুয়াশাময় একটি আলোও আমরা খুঁজে নিতে পারি। যেখানে দাঁড়িয়ে কবি ঝাঁঝিয়ে এত্তেলা দেন ক্ষণস্থায়ী জীবনরূপী পোকাকে। বলেন, ‘ধুলোতে ওই ঘূর্ণি ওড়ে সুদর্শন পোকা/ দূরের চিঠি কাছে আনাও সুদর্শন পোকা/ শুভ খবর কাছে আনাও, দাবার চালে দোলা বানাও/ হা পিত্যেশ নোলা বানাও সুদর্শন পোকা।’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্যে’-র প্রকাশকালের যুগব্যবধানে প্রকাশিত তাঁর অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই’-এ শক্তি বলছেন, ‘বড়ো ধরণের যন্ত্রণা পাই...।’ পরের পঙ্ক্তিতে আক্ষেপ, ‘কিসের জন্য নিজে জানি না।’ তখন বোঝা যায় তিনি তাঁর অন্তঃস্রোতের অভিমানকে খুঁজছেন, যন্ত্রণার উৎসসন্ধান করছেন একর পর এক কাব্যগ্রন্থে। কলরবে নয়, উচ্ছৃঙ্খলতায় নয়, তাঁকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা অনেকানেক মিথ-এ নয়, অস্থিরতায় নয়— শেষ পর্যন্ত এই কবিকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে এক চির অন্বেষণরত নাবিকের বেশেই। মৃত্যুর এই প্রায় তিন দশক পার হয়েও যাঁর খুঁজে চলা এবং যাঁকে খুঁজে চলা বাড়ছে বই কমছে না।
একটি কালখণ্ডের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপে কাব্য বা শিল্পসংক্রান্ত স্বাধীনতা থাকা সম্ভব। সেই মাপ কেউ লাফ দিয়ে পেরোতে পারেন না। যা পারেন তা প্রতিভা বা প্রয়াসে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মাপদণ্ডকে একটু বাড়ানোর চেষ্টা করা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এসে এই সীমারেখা পরাভূত হয়ে যায়, এতটাই সময় ধারণ করে রয়েছে তাঁর পদ্য। তাঁর মৃত্যুদিনে জন্মানো সেই কবিতা পাঠক, যে আজ আঠাশ বছরের বয়সি, সে খুঁজে নেয় ‘অঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল’। সেই জলে এখনও একই ভাবে চমকাচ্ছে হিরের দ্যুতি। সেই পাঠকের অপর-সত্তা, পঙ্ক্তিগুলিকে বহন করে স্থায়ী অসুখের মতো। শক্তির কবিতা উচ্চারণ করে সে নিজের মৃত্যুপরোয়ানা ঘোষণা করতে পারে। আবার তাঁরই কবিতা উচ্চারণ করে ফিরে আসতে পারে সর্বনাশ থেকে। ‘নিবিড় ভালবাসার দিনগুলো তোমার কাছে মেলে ধরতে’ হবে তো তাঁকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy