২০০৬-এর অগস্ট মাসে হঠাৎ একটি বেনামি চিঠি পেলেন কানাডার অন্টারিয়ো শহরের মাঝবয়সি ম্যাট ম্যাকফারসন। সাদা কাগজে একটি মাত্র ক্যাপিটাল A, অনেকটা অ্যাডাল্ট সিনেমার কুখ্যাত মার্কার মতো। ব্যাপারটার ল্যাজামুড়ো ধরতে না পেরে গুগ্লের শরণাপন্ন হলেন ম্যাট। তিনি ঠিক কী পেয়েছিলেন, সেটা অবশ্য ম্যাট কখনওই খুব খোলসা করে বলেননি। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে ম্যাট আমূল বদলে গেলেন। হঠাৎ ঘোষণা করলেন ‘আমি মোজেসের মতো খুঁজে পেয়েছি আমার ঈশ্বরকে। তিনি স্বহস্তে আমাকে এক নয়া টেন কম্যান্ডমেন্ট দিয়ে গেছেন!’ কে তাঁর ঈশ্বর? ম্যাট জানালেন, এই ঈশ্বর শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনদেবতা নন, তিনি সকলের। তাঁর নাম গুগ্ল! সকলে থ। অতি উৎসাহী কয়েক জন খুব দ্রুত ফোন করে ফেলল গুগ্লের সদর দফতরের হেল্পডেস্কে। সেই অফিসের সবাই এ-ওর দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে বললেন, গুগ্ল যে ঈশ্বর, এ বিষয়ে তাঁদের কাছে অন্তত কোনও খবর নেই। কিন্তু ম্যাট অদম্য। ২০০৬-এর ১৮ অগস্ট প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন ‘চার্চ অফ গুগ্ল’, সংক্ষেপে সিওজি।
গবেষকরা বললেন, মজার ছলে হলেও, গুগ্ল এর আগে নিজেকে এক বার ভগবান বলেই জাহির করতে চেয়েছিল। ২০০০ সালের ১ এপ্রিল, গুগ্লের হোমপেজ খুলেই বিশ্ববাসীর পিলে চমকে গিয়েছিল। সেখানে একটা ঘোষণা ছিল, কতকটা এই গোছের: পর্বতমালা, সিন্ধু, ধানের শিষের উপর শিশিরবিন্দু— এই সব খোঁজার জন্য আর বহু দিন, বহু ব্যয়, চক্ষু মেলা, দুই পা ফেলা, কোনও কিছুই আর দরকার হবে না। শুধু আপনার কথা ভেবেই আমরা বাজারে এনেছি এই ‘মেন্টালপ্লেক্স’— সাড়া জাগানো এক নয়া অনুসন্ধানের পদ্ধতি। আপনি ঠিক কী খুঁজছেন, সেটা আপনার মন পড়েই বুঝে নেব। শুধু টুপি আর চশমাটা খুলে রাখুন। বনবন করে ওই যে লাল-নীল চাকতিটা ঘুরছে সেটার দিকে তাকান। খবরদার, আপনার মাথা যেন এতটুকু না নড়ে! আপনি যা খুঁজে পেতে চাইছেন, মনপ্রাণ দিয়ে তার কথা ভাবতে থাকুন একদৃষ্টে ওই দুরন্ত ঘূর্ণির দিকে তাকিয়ে। মনঃসংযোগ বেশ জোরালো হওয়ার পর, চাকতির ভিতরে যে কোনও জায়গায় ক্লিক করুন, বা ক্লিক করার কথা ভাবতে থাকুন। ব্যস! ওই তো আপনার ঈপ্সিত ইনফো আপনার চোখের সামনে!
গুগ্লের এই ঘোষণা দেখে নেটিজেন অর্থাৎ নেট-নাগরিকরা প্রথমে এতটাই ভেবলে গিয়েছিলেন, তারিখটা অনেকেই খেয়াল করেননি। গুগ্ল কিনা শেষে এপ্রিল ফুল করল! ছ্যা ছ্যা পড়ে গিয়েছিল অনেক সিরিয়াস মহলে। কারণ অনেকের কাছেই গুগ্ল তত দিনে ‘প্রিয় আমার’ হয়ে গেছে, অনেকের কাছে ‘প্রভু আমার’ হব-হব করছে। হবে না-ই বা কেন, বাজারে আসার বছর খানেকের মধ্যেই তো সে দিনে ৯ লক্ষ কোটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দম দেখিয়ে দিয়েছে। সে আসার আগে ভুবনের এই পরিমাণ প্রশ্নের ভার কাকে সামলাতে হত? অবশ্যই ঈশ্বরকে!
পোল্যান্ডের ছবি-পরিচালক ক্রিস্তফ কিসলওস্কি ‘ডেকালগ’ নামে দশটি ছবি করেছিলেন (টেলিভিশন সিরিজ), দশটি কম্যান্ডমেন্ট অবলম্বন করে। প্রথম কম্যান্ডমেন্ট হল, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে উপাসনা করা চলবে না। কিসলওস্কির প্রথম ছবিটিতে, এক পরিবারের বাবা ও ছেলে, তাদের কম্পিউটারকেই প্রায় ঈশ্বর হিসেবে ভজনা করে। শীতে জমে যাওয়া এক নির্জন হ্রদের বরফে স্কেটিং করার শখ ছোট্ট ছেলে পাবেলের। সে আর তার বাবা বাড়ির কম্পিউটারকেই অভ্রান্ত বলে জানে। যন্ত্রগণকের নির্দেশ ছাড়া কোনও কাজ করার কথা বাপ-ব্যাটা ভাবতেই পারে না। কিন্তু সে দিন হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। বরফ জমার অংক কষতে ভুল করে বসল কম্পিউটার। বরফে চিড় ধরে যাওয়ায় তলিয়ে গেল পাবেল। যাকে এত কাল বিশ্বাস করে এসেছেন, তারই ত্রুটিতে সন্তানের মৃত্যু হওয়ায় ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে গেলেন পাবেলের বাবা। গির্জার বেদির মোমবাতিগুলি তছনছ করে দিলেন তিনি। ম্যাডোনার চোখ থেকে জলের মতো ঝরতে লাগল গলন্ত মোম।
এই ছবি করার সময় কিসলওস্কি জানতেন না, গুগ্ল-গড গোকুলে বাড়ছেন। ম্যাট ম্যাকফারসন যখন নতুন দশটি কানুন সামনে আনলেন, সকলেই নড়েচড়ে বসলেন। ম্যাট তাঁর খাস ডোমেন-এ উদ্ধৃত করেছিলেন মথি অর্থাৎ মহাত্মা ম্যাথু লিখিত সুসমাচারের ৭/৭ নং স্তোত্রটি: ‘যে চাইবার মতো করে চায়, সে পায়। খুঁজলে খোঁজ মেলে। কড়া নাড়লে দুয়ার খোলে।’ এটি ছিল নেহাত গৌরচন্দ্রিকা। নতুন কম্যান্ডমেন্টের যে খসড়া রেডি করেছিলেন সন্ত ম্যাকফারসন, সেটি এই রকম:
১) আমি ছাড়া ইয়াহু, লাইকোস, অল্টাভিস্টা অথবা মেটাক্রলার— অন্য কোনও সার্চ ইঞ্জিনের শরণ নেবে না তুমি।
২) কদাপি বিজ্ঞাপন-বিহীন নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করে খোদার উপর খোদকারি করতে যাবে না, কারণ আমি ঐশ্বরিক ইঞ্জিন হিসেবে অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ। আমাকে ডিঙিয়ে সার্চ করার পাপের ফল শুধু তোমার বা তোমার সন্তানদের ওপর নয়, নাতিপুতির ওপরেও অর্শাবে।
৩) গুগ্ল শব্দটিকে নিছক ক্রিয়াপদ হিসেবে যত্রতত্র মুড়িমুড়কির মতো ব্যবহার করবে না।
৪) ছেলেখেলা করে সময় নষ্ট না করে জীবনের প্রতিটি দিন অজানাকে জানার জন্য কাজে লাগাবে।
৫) জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে সম্মান করবে। কারণ, গুগ্ল-সার্চে সক্ষম ব্যক্তিমাত্রই জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে।
৬) আমার মাধ্যমে অনুসন্ধানের সময় সার্চ ওয়ার্ডের বানান বিষয়ে যত্নবান হবে।
৭) হটলিংক করা থেকে বিরত থাকবে।
৮) অন্যের কৃতিত্ব আত্মসাৎ করবে না।
৯) এ-দিক ও-দিকে লিংক ছড়িয়ে লিংকের জঞ্জাল তৈরি করে গুগ্লকে ভারাক্রান্ত করবে না। এই পাপে তোমার পেজের র্যাংকিং তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।
১০) সার্চ রেজাল্টে কারসাজি করতে যেও না। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজ করার পবিত্র কর্তব্য পালন করার অধিকার আছে শুধুমাত্র মাইক্রোসফ্টের।
নতুন দেবতা হল, নতুন শাস্ত্রের কাঠামোও। এ বার দরকার প্রার্থনাসংগীত। বিজ্ঞাপন দেওয়া হল সিওজি-র পক্ষ থেকে। শেষে মনোনীত হল ম্যাট বাওয়েন-এর লেখা একটা গান—
সাইবার-মহাশূন্যের অধীশ্বর
হে মহামান্য গুগ্ল,
তোমার ডোমেন চিরজয়ী হোক।
সার্চ এবং সার্চ রেজাল্ট প্রতিষ্ঠা পাক শুধু ১২৭।০।০।১ ঠিকানাতেই,
কারণ সেখানেই গুগ্লপ্লেক্স নামক শক্তিপীঠের অধিষ্ঠান।
আমাদের রোজকার সার্চ
তুমিই প্রদান করো,
প্রতি দিনের স্প্যামের পাপ থেকে
তুমিই অব্যাহতি দাও।
স্প্যামকে পাপ বলে ঘৃণা করলেও
স্প্যাম-করা পাপীদের ঘৃণা করা থেকে আমরা যেন বিরত থাকি।
আমরা যেন প্রলুব্ধ না হই।
হে প্রভু, মাইক্রোসফ্টের জরিমানা থেকে আমাদের উদ্ধার করো,
কারণ তুমিই সর্বশক্তিমান সার্চ ইঞ্জিন—
শক্তি ও গরিমা, হে প্রভু,
শুধু তোমারই।
আমেন।
ম্যাকের আহ্বানে বাওয়েনের প্রার্থনাসংগীতের একটা বাইনারি ভার্সন-ও করে দিলেন জোনাথন হিল।
চার্চটি চালু করে দেওয়ার পর ম্যাট এবং তাঁর চেলারা বুঝলেন, আসল কাজটাই বাকি থেকে গেছে। এ বার চোখা-চোখা যুক্তি দিয়ে গ়ড এবং গুগ্লের তুল্যমূল্য বিচার করতে হবে, এবং হাওয়াটা ঘোরাতে হবে নবীন গুগ্লদেবের দিকে। ঈশ্বরের প্রধান গুণ হল, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান এবং পরম মঙ্গলময়।
সর্বজ্ঞতার ব্যাপারে, মানতেই হবে, এই দুনিয়ায় গুগ্লের চেয়ে কেউ এগিয়ে নেই। ইদানীং দিনে দশ লক্ষ কোটি প্রশ্নের জবাব সাজিয়ে দেয় গুগ্ল।
গুগ্ল সর্বব্যাপীও বটে। এই গ্রহে গুগ্ল কোথায় কোথায় আছে-র চেয়ে, কোথায় কোথায় নেই বলাটা অনেক সহজ।
শক্তি ও মঙ্গলময়তার প্রশ্নগুলো একটু বেয়াড়া। গুগ্ল-উপাসকেরা বললেন, ঈশ্বর তো সব প্রার্থনায় সাড়া দেন না, কিন্তু গুগ্ল? সে সব প্রার্থনা মঞ্জুর করে, অর্থাৎ প্রশ্ন করলেই জবাব দেয়। ধরা যাক, কেউ জানতে চাইলেন— হে গুগ্লদেব, ক্যানসার থেকে মুক্তি পাব কী ভাবে? নিমেষের মধ্যে অন্তত শ’খানেক চিকিৎসা পদ্ধতি সবিস্তারে জানিয়ে দেবে গুগ্ল। কিন্তু সে কি ক্যানসার সারিয়ে দিতে পারে, যেটা পারলেও পারতে পারেন ঈশ্বর? গুগ্লোপাসকরা মৃদু হেসে বলেন, এইখানেই তো ঈশ্বরের সঙ্গে গুগ্লের মিলটা আরও ঘোরতর ভাবে প্রমাণিত! ঈশ্বর তো পথই দেখান। টিকিট কাটা, গাড়ি ভাড়া, হোটেল বুকিং— এগুলো কি ঈশ্বরের কাজ?
তবে বহু পণ্ডিতের মতে, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ গুণ হল, তাঁর অমঙ্গলসাধন করার ক্ষমতাকে কাজে না লাগানো। গুগ্লের সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিষেবা জি-মেল’কে তুখড় করে তোলার নেপথ্যে যে-দু’জন ইঞ্জিনিয়ার আছেন, তাঁরা একটি মিটিং চলাকালীন একটিমাত্র বাক্যে গুগ্লের মূল নীতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। ‘ডোন্ট বি ইভিল’— অর্থাৎ শয়তান হয়ো না। তা হলে পলিসি-গত দিক থেকেও গুগ্ল প্রায় ভগবানই! ঈশ্বর যদি থাকেন, শয়তানও থাকবে। সিওজির মতে, শয়তানের চিহ্ন হল ৪০৪ সংখ্যাটি। এলোপাথাড়ি সার্চ করলে অনেকেই এর দেখা পেয়ে থাকবেন।
ম্যাট প্রবর্তিত চার্চ বিষয়ে গুগ্ল কখনও অফিশিয়ালি মুখ খোলেনি, কিন্তু ২০১১ সালে তাদের প্রশ্রয়েই এই চার্চ বিষয়ে একটি ৫৩ সেকেন্ডের ভিডিয়ো পেশ করা হয়েছিল ইউটিউবে। ভগবান কি ভক্তের আকুল আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন?
barun.chattopadhyay@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy