Sourced by the ABP
দুয়ার কাঁপছিল। তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে। চুম্বনে ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখি, সর্বাঙ্গ ভিজেছে। মাথা চুঁইয়েবিন্দু বিন্দু ঝরে জল। ঠোঁটে লেগে ভেজা মেঘ। এ কি স্বপ্ন, এ কি মায়া! পুব হাওয়াতে দেয় দোলা। জানালার ধারে বসে রইলাম করতলে রাখি মাথা। বহু যুগের ওপার হতে হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু। ভেজা চোখে-মুখে বোলালাম ভেজা হাত। বাদল ছোঁয়া লেগে খসে পড়ল আমার দু’চোখ। তালুর আঠায় উঠে এল তারা! ধ্বনি তরঙ্গিল নিবিড় সঙ্গীতে। মুহূর্তে বোধোদয়— এখন আমার তালুতে চরাচর, ক্ষণকালের ব্রহ্মাণ্ড! নিজেকে ঈশ্বর মনে হল! অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা! আঁখিতারা আজ মায়াদর্পণ! সেখানে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি! সেখানে আকাশ কাঁদে হতাশসম। সেখানে কূজনহীন কাননভূমি। সেখানে দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে। সেই দুয়ারই খুলে তাকাই বারেবার। সুদূর কোন নদীর ধারে, গহন কোন বনের ধারে, গভীর কোন অন্ধকারে ওই আমার একাকী সখা, ওই আমার একার সখা পথিক হয়ে এসেছে ফিরে আজ। জাগালে আজি, নাথ!
ভীতিখণ্ড
জাগরণের কথা বলতে গেলে আগুনের কথা বলতে হয়। বলতে হয় আট হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের সদ্যোজাত পৃথিবীর কথা। বলতে হয় তারও আগের ভয়ার্ত সৃজনমঙ্গল কাব্যের কথা। সে আমার জন্মের বহু-কোটি বছর আগের কাহিনি।
রাত জেগে ফুলের ফুটে ওঠা দেখেছ কখনও? পদ্ম-শাপলা যেমন আস্তে-আস্তে পাপড়ি মেলে ফুটে ওঠে, তেমনই হাজার কোটি বছর ধরে নিজের প্রস্ফুটন ঘটাচ্ছিল এই ব্রহ্মাণ্ড। তার মধ্যেই এক দিন তৈরি হয়েছিল অতি-সামান্য দানবাণবিক মেঘ। প্রজ্বলিত পালকের মতো সে মেঘ কেলাসিত হওয়ার কামনায় পুঞ্জিত হয়েছিল রেণুদানায়। অগ্নিময় সেই রেণুকে ভরকেন্দ্রে রেখে অগ্নিমেঘের বাকি সব আস্তর, বাকি সব ধুলোঝড়-কণাকাঠিন্য-হিমবাষ্প মিলে তৈরি করেছিল এক চারুজগৎ। ভিন্ন-ভিন্ন কক্ষপথে তৈরি হচ্ছিল দানাগ্রহ। সেই জ্বলন্ত রেণুর নাম, ধরে নাও, সূর্য। তখনও তার দিকে ছুটে যাচ্ছিল ধুলোঝড়-কণাকাঠিন্য— ব্যক্তিত্বহীন কত কিছু।
চারশো সাতান্ন কোটি বছর আগের জাতক সেই জবাকুসুমসঙ্কাশের কাছে আমি ঋণী। ঋণী সেই অগ্নিপিণ্ডের কাছে। সেই রেণু আমার জন্মদাত্রী নয়। কিন্তু তার প্রতি পরোক্ষেই আমার পিতৃঋণ। সূর্যম্পশ্যা কুন্তীর সন্তান কর্ণের যেমন।
আজকের সূর্যের চেয়েও তখন ঢের বেশি তপ্ত মা-পৃথিবী। সর্বাঙ্গে জ্বালা, কল্পনরকের ফুটন্ত কড়া যেন। পর্বতকঙ্কালে, ধূলিনিলয়ে সংগোপনে জমে ছিল যে জলীয় অশরীরীরা— মুক্তিকামী তারা বেরিয়ে আসতে লাগল, ঊর্ধ্বমুখী হল। ক্রমে আকাশ-খোলসের অবয়ব তৈরি হল। তারই মধ্যে কত ঝড়ঝাপটা। কত বস্তুপুঞ্জের সঙ্গে সংঘর্ষে কত বার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আকাশি চাঁদোয়া। মহাশূন্যে বিলীন হল যাপিত কামনার শ্রমবাষ্প। এমনই এক সংঘর্ষে মাতৃ-অমরা ছিন্ন হয়ে ছিটকে গেল এক খণ্ড পৃথিবী— চন্দ্রমা।
এ সবের মধ্যেই বাষ্প জমানোর খেলা চলতে লাগল। প্রতি সংঘর্ষে প্রাপ্তিও ছিল। বস্তুপিণ্ডেরা বস্তুকণারা আছড়ে পড়ে, ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে পৃথিবীতে রেখে গেল ঘর্ষণস্পর্শ। সে স্পর্শেও ধরা রইল জলভ্রূণ, জলের কঠিন-তরল-উদ্বায়ী ত্রিবিভূতি। চক্রবৃদ্ধি ঘটল বাষ্পের। আকাশি খাঁচা গাঢ়তর হল। বাড়ল বাষ্পসঞ্চয়। এক সময় বাষ্পেরা অঙ্গজ লীলায় মত্ত হল। পরস্পরকে ছুঁয়ে দেখল, মিলিত হল, একে অন্যে লীন হল। জন্ম নিল অতি-ক্ষুদ্র নগণ্য জলকণা, অগণ্য জলবিন্দু। সেই সব কণাবিন্দু এক সময় মিলনভারে উড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা হারাল। তৃষিত পৃথিবী ডাকল তাদের। তারা নেমে আসতে লাগল অঝোর ধারে। মাঝপথে শুকিয়েও গেল কত! ফিরে গেল পূর্বাশ্রমে, বাষ্পজীবনে। ওই যারা মেঘ হয়ে জমে ছিল, তারা আমি। এই যারা বৃষ্টি হয়ে নেমে এল, তারা আমি।
তবে অমিয় ছিল না সে বারিধারা। দীর্ঘ পতনপথে অম্ল-ধুলো কত কিছু নিয়ে নেমে এসেছিলাম প্রথমে! ধীরে জল সজল হল। প্রথম সেই যে ঝরতে শুরু করেছিলাম, তার পরে ধরো টানা ষাট হাজার বছর নাওয়া-খাওয়ার সময় পাইনি! ধারাবর্ষণে ধীরে ধীরে শান্ত করে তুলেছিলাম পৃথিবীকে। আমি ভিজিয়ে দিলাম। চরাচরে ছড়িয়ে পড়লাম। মাটির আধারে পুষ্করিণী হলাম। তাতে ছায়া দেখলাম পতনোন্মুখ আমার সত্তার। আমি জমতে শুরু করলাম উঁচু-উঁচু পাহাড়ের তীক্ষ্ণ-গম্ভীর জটায়। গলতে শুরু করলাম হিমবাহের ধমনিতে। আমি নদী হলাম। সমুদ্র-মহাসমুদ্র হলাম আমি।
প্রথম যখন নেমে এসেছিলাম, গোলকের সর্বাঙ্গ থেকে সে কী বাষ্পধোঁয়ার উদ্গীরণ! মনে হয়েছিল, অনন্ত কড়াইয়ে মহাকালের রান্না হচ্ছে যেন! যেন কোনও সুবিশাল মাছ ছাড়া হয়েছে অপরিমেয় আহ্লাদী ফুটন্ত তেলে! যেন প্রস্ফুটিত ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দিয়েছেন অন্নপূর্ণা! তারই অন্নবাষ্পে সমাচ্ছন্ন দিগ্বিদিক!
না! অন্ন অনেক পরে কথা। তখনও আমার ঢের কাজ বাকি। তখনও তো কী ভাবে কোথা হতে প্রাণ কেড়ে আনি, সে জাদুটাই দেখানো হয়নি!
ঋতিখণ্ড
বিরহে প্রাণ কেঁদে ওঠায় রাজি হলাম, এমন নয়। কে কুবের, কে তার চাকুরে যক্ষ আর কোন সে প্রোষিতভর্তৃকা— এ সব নয় কারণ। রাজি হয়েছিলাম ড্রোন ক্যামেরা দেখে! কবিতা-নিকুঞ্জে ‘পিককুল-পতি’র মস্তিষ্কে ডোবানো কলম দেখে! কত অযুত-লক্ষ, নিযুত-কোটি, অর্বুদ-পদ্ম, খর্ব-নিখর্ব, মহাপদ্ম-শঙ্কু, জলধি-অন্ত্য, মধ্য-পরার্ধেরও বেশি বার ভেসে গিয়েছি ওই সব মানচিত্রের উপর দিয়ে! নাহ! ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’! সে কলম দেখিয়েছিল! তাই যক্ষের বায়না পূর্বোত্তর শুনেছি। নতুন করে দেখেছি মাটির পৃথিবীকে, সুন্দরকে!
কী অদ্ভুত! কী করণীয়, তা বলার সঙ্গেই কী আমার ভাল লাগবে, তা জানাতেও ভোলেনি কামার্ত যক্ষ!— যেতে যেতে একলা পথে ক্লান্ত হলে শিখরে-শিখরে বিশ্রাম নিয়ো। জল ঝরিয়ে শ্রান্ত হলে খেয়ে নিয়ো জল।— কল্পনা করা যায়! জলকে জল খেতে বলছে! কিন্তু রামগিরি থেকে যাব কোথায়? ‘যক্ষপুরে যাবে, অলকা নাম’— ‘গন্তব্যা তে বসতিরলকা নাম’। পথে পড়বে আম্রকূটকুঞ্জ, সেখানে যেন কিছু-সামান্য হলেও বর্ষণ করি, তাতে নাকি হালকা হয়ে দ্রুতগতিতে উড়তে পারব! বিন্ধ্যপাদদেশে দেখা মিলবে রেবা নদীর, হাতির গাত্রাভরণের মতো! ‘ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি’। রেবার জলও আঁজলা ভরে পান করতে হবে আমায়! যাত্রাপথে ভুঁইচাঁপা মাথা তুলবে, মধুগন্ধের উৎসার ঘটাবে মাটি, সানন্দ হরিণেরা এ দিক-ও দিক ছুটে জানিয়ে দেবে, কোন পথে যাচ্ছি! যখন দশার্ণ দেশে পৌঁছব, কেতকী-কুঁড়ি চোখ মেলবে, আরও কিছু ক্ষণ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে মানসযাত্রী রাজহংসের দল।
দশার্ণের রাজধানী বিদিশায় পৌঁছে ফের আমায় খেয়ে নিতে হবে ঊর্মিচঞ্চল বেত্রবতীর মিষ্টি জল। বিদিশারই কোলে এক বিমূর্ত পাহাড়, যার গুহা সম্ভোগসুগন্ধে, মিলনপরিমলে আমোদিত। সে সুবাস নিতে হবে। যেতে হবে উজ্জয়িনীর দিকে। সেখানকার মেয়েদের অপাঙ্গ-চাহনি বিদ্যুৎপ্রতিম। সে বিদ্যুৎ না দেখলে আমার নাকি জীবনই বৃথা! ভাবো, মায়ের কাছে কী অভিনব মাসির গল্প! এর পরে নির্ব্বিন্ধ্যার তরঙ্গমালা, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে যাওয়া হাঁসের দল। জলশব্দ, হংসরবের মেখলা! নদীর আবর্তেরা যেন নারীনাভিকূপ। সে কূপে অবগাহনও কর্তব্য আমার!
মাঝে মধ্যে ভাবি, এই যক্ষটা কে! বিরহী, না কি কন্ডাকটেড ট্যুরের ম্যানেজার! কোথায় আমায় তাড়া দেবে! তার বদলে যৌন পর্যটনের স্পট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে! তবে খুবই মিষ্টি! কেউ আমায় এত আদর দেয়নি কখনও!
তবে আমায় যেতেই হবে অবন্তীতে, যেখানে গ্রামবৃদ্ধেরা ‘উদয়ন এবং বাসবদত্তার গল্প’ বলে। যেতে হবে মহাকালের দেউলে, দেবগিরিতে, গঙ্গার উৎসতীর্থে। কৈলাসে অতিথি হতে হবে। মানসের জলপান করতে হবে। এ সবের পরে যখন পৌঁছব অলকায়, চোখ ধাঁধিয়ে যাবে আমার! ‘যদিও দূরে নয় মানস, তবু সেই সলিলবাসী সব হংস/ তোমার উদয়েও অনুৎকণ্ঠিত, হবে না যাত্রায় তৎপর’। ‘অবিস্মরণীয় এ-সব লক্ষণ’ আমারই মনে নাকি নিহিত। দ্বারের পাশে থাকা শঙ্খপদ্মের ছবি চিনিয়ে দেবে গৃহটি, ‘অধুনা যে-ভবন’ যক্ষ-বিচ্ছেদে ‘মলিন হয়ে আছে নিশ্চয়’। ‘সেথায় আছে সে-ই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা’— ‘যা তত্র স্যাদ যুবতিবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ’!
প্রীতিখণ্ড
‘কেমন বৃষ্টি ঝরে— মধুর বৃষ্টি ঝরে— ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে— রোদে যে বৃষ্টি ঝরে’! কথাগুলো নিজেকেই বলি, যখন একা লাগে খুব! গোপনে বলছি, বহু-বহু বার প্রেমে পড়েছি আমি। তার প্রমাণ, এই দ্যাখো, আমি চিরজন্মের অন্তঃসত্ত্বা। অন্তরে আমার, আমার অন্দরে বহন করে বেড়াই চিরন্তন আগামীর সত্তা। তবে প্রেম আমার চিরকালই গলে জল হয়ে যায়! টেকে না! কত বার ‘ভালবাসা পিঁড়ি পেতে রেখেছিল উঠোনের কোণে’। কত বার বলেছি, ‘গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে/জলমণ্ডলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে’! সেই আমিই আবার কানে কানে বলেছি— ‘আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেব চন্দনজলে’! কারণ, পাহাড় বলেছিল— ‘আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে’!
গীতিখণ্ড
ও আমায় ডাকল। ‘আপনি বলেছিলেন, বর্ষা গাঁথলে ডেকে নিতে। ডাকলাম। ব্যস্ত?’
বললাম— ছিল একটু কাজ। সে অবশ্য আফ্রিকায়। কাজ নষ্ট হবে না। জানোই তো, আমার আঁচল-উত্তরীয় সারাক্ষণ নানা ভাবে ছেয়ে থাকে তোমাদের। আসলে, এখানে আজ আমার ঠিক ঝরার কথা নয়। একটু গর্জে দু’ফোঁটা ফেলে বিশ্রাম নেব ভেবেছিলাম। একটু না কাঁদলে মান থাকে না। যাই হোক, বলুন, কবিবর!
বলল, ‘আমার মনখারাপ। তাই ডাকলাম।’
খানিক চুপ থেকে বললাম— বুঝলাম। বর্ষায় কী বিঁধলে, দেখাও দেখাও! একটু হেসে, ইশারায় আমায় দাঁড়াতে বলে, ক্লান্ত-অসুস্থ-বৃদ্ধ দেহটাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মনে-মনে জানলা দিয়ে উড়ে গেল। পারুল পেরিয়ে, বট পেরিয়ে সরু রাস্তার উপর দিয়ে উঠে আকাশে আমার ডানার খোঁজে-খাঁজে খানিক চক্কর মেরে ফের-আবার জানলা দিয়ে এসে সেঁধিয়ে গেল দেহে। দম নিয়ে বলল, ‘আপনি আমায় মিথ্যে বলেন কেন!’
কী মিথ্যে বললাম!
‘বললেন, এখানে তেমন কাজ নেই! আমি তো দেখে এলাম! সদ্য ঝরে এসেছেন দু’পা দূরেই! দেখলাম, সেখানে ইন্দ্রধনুর আরামকেদারায় গা এলিয়ে মেঘদূত পড়ছেন!
হেসে বললাম— না গো! মেঘদূত পড়ছিলাম তোমাদের জন্য নয়! রাজস্থানের দু’টো ব্যাঙের জন্য। ওরা শ্রাবণী পাঁকের মেলায় হারিয়ে গিয়েছে। নিজেদের খুঁজে পাচ্ছে না। একটু ভিজিয়ে দিলেই ওদের মিলনের বাঁশিটি ফের বাজে!
নিজেদের খুঁজে পায়, বংশরক্ষাও হয়। বুঝলে কবিবর, আমায় চাদ্দিকে নজর রাখতে হয়!
ও হেসে বলল, ‘বেশ, বুঝলাম। আমিও তো ব্যাঙ। বিশ্বনিখিলের কুয়োর ব্যাঙ! আমার উপরও আপনার প্রেম বর্ষিত হউক, সখা!’
হেসে বললাম, তথাস্তু! মন ভাল হল তো! চলো, দেখাও, কী লিখেছ!
খাতাটা এগিয়ে দিল— ‘আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি/ মম জল-ছলো-ছলো আঁখিমেঘে মেঘে’।
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। ঘরের সিলিং ভিজে গেল! বললাম— উত্তম! অতি-উত্তম! আরে, তুমি তো আমাকেও কাঁদিয়ে ছাড়বে!
ও বলল, ‘ধুস, আপনি তো আগেই কাঁদছিলেন। এখনই দেখে এলাম তো।’
আমি অপ্রস্তুত। আমি কাঁদাই। আমার কান্না দেখে ফেললে রক্ষা রবে না! এমন ক্ষতি বিধাতা সবে না! বললাম— ও কিছু না। দেবভাষার ঝঙ্কারের কারণে হয়তো। যাই হোক, সুর কী ভাবলে?
বলল, ‘যেটুকু হয়েছে, শোনাই?’
ধরল— ‘আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই...’! জলভার কাঁধে নিয়ে প্রান্তর-প্রান্তিক কোনও ভিস্তিঅলা যেন ক্ষণমাত্র শ্বাস নিয়ে মধ্যমার মধুগন্তব্যে এগিয়ে গেল! ‘দিয়েছি পাতি’তে পেতে দিল আমার এত যুগের গোপন রাখা ডায়েরি— ‘জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে’! মেঘ-ক্যালেন্ডারের হিসেবে কয়েক মুহূর্ত পরেই চালতা বাগানের মল্লিক বাড়ির গায়ক-নায়ক যে ভাবে গাইবে, ঠিক সে ভাবে! আমি নিশ্চিত, নিজেই ও ছোঁড়াটাকে গানটাতুলিয়ে দিয়েছিল!
আমি বললাম— কেয়া বাত, কেয়া বাত! এ তো আমার গান! আমার আলস্যের গর্জন! পরে, পরে কেমন যাবে সুরটা? লোভ সামলাতে না পেরে আরও বললাম— শোনো, এটা মল্লারেই নাও বরং। কাফি ঠাটই যখন পছন্দ, হাতে তো আছেও ঢের জাদুমাদুর— মিয়াঁ মল্লার, মেঘমল্লার, রামদাসী মল্লার, গৌড়মল্লার! আর খাম্বাজ-কাফি ঝগড়ায় না গিয়ে জয়জয়ন্তীও রাখতে পারো।
খানিক চুপ করে থেকে ও বলল— ‘আচ্ছা, মল্লার বা জয়জয়ন্তীর কাছে আমরা কী এমন ঋণে ঋণী যে তাদের দাস্যবৃত্তি করতে হবে! ও সব আপনার ঘরগোছানোর অছিলা!’
একটু লজ্জিতই হলাম। মুখে বললাম— সে কি আর জানি না! তুমি ব্যাকরণ শিখেছ, তাকে ভেঙেচুরে ভাবের রামধনু তৈরি করবে বলে! না হলে কেউ বসন্তের গান ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়’ ছায়ানটে বা ‘নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা’ কল্যাণী ইমনে বাঁধে! কিংবা ওই তোমার ভেজা গানটা— ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’— বেহাগে! তবে আমার রাগ-রাগিণীতেও তো বেঁধেছ কত বিস্ময়-অনুপম! তাই বললাম!
আসলে, ভয় পেলাম। মাহাত্ম্য হারানোর ভয়। ও আগেও বহু বার ঠকিয়েছে আমায়। ‘বন্ধু রহো রহো’ লিখে দেখাল। শুনে আনন্দিত মন আমার কূলে-অকূলে ভেসে বেড়াল! আমার মিলনভুক গন্ধরাগ সে গানের জন্য জলশয্যা পেতে রাখল। অনেক কাল পরে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটকে স্নান করাচ্ছিলাম। পুরনো বইয়ের দোকানে কোনও উন্মাদের বেচে দেওয়া কাকভেজা স্বরবিতান আমার বুক ভেঙে দিল! ব্যাটা ওটা ভৈরবীতে বেঁধেছে! আবিষ্কারের সে বেদন যখন সপাট ঘা দিল, তত দিনে ও প্রয়াত। সুবিধেই হল। পেয়ে গেলাম এক বার ওকে সাতাশ-কুড়ি রেণুলোক দূরের গন্ধবিধুর অমৃতবিতানে! জাপটে ধরে বললাম— বাছা! এটা খুবখারাপ করেছ!
পুরোটা শুনে বলল, ‘আমি কিছুই করিনি। যা করার আপনিই করছেন! ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে— এটা লিখেছি দেখেই আপনি আমায় এক ভেজা ভোরবেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন! মনে নেই? তাই ভৈরবী এল! কিন্তু বর্ষাও বাদ গেল কি?’
আমতা-আমতা করে বলেছিলাম— না, সেটা নয়। বরং গোটা গানটাই বৃষ্টি! তোমার গান ছেড়েছে সত্যিই সকল অলঙ্কার!
এ সব কারণেই আর কিছু না বলে বললাম— আজ তবে শ্রাবণ-আকাশে কোন ভৈরব, কোন কানাড়া আমদানি করেন কবিবর, দেখি!
ফের হেসে ও বলল, ‘আপনি রাগী রাগেই পড়ে আছেন! কেন বলুন তো! আপনি যেমন বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা, তেমন ইলশেগুঁড়িও তো!’
বললাম— মজা করছ তো আমায় নিয়ে! তোমাদের ওই গ্লোব থিয়েটারের কবির মতো! ভালবাসার দার্ঢ্য বোঝতে গিয়ে আমায় টেনেছিল, মনে আছে? ভালবাসা নাকি আমারই মতো শান্তিময় স্নিগ্ধতায় ঝরে পড়ে! আরে, পতনের যে কী বেদনা, যে পড়ে, সেই বোঝে...!
কথা কেড়ে নিয়ে ও বলল, ‘ভুল করছেন! ভালবাসা নয়, ওটা ক্ষমা-কারুণ্যের কথা! আপনার তো গর্বিত হওয়া উচিত! উল্টে সমালোচনা করছেন! আপনার এই পল্লবগ্রাহিতা আর অমনোযোগের কারণেই বন্যা হয়, খরা হয়! জীবনে লিখতে পারবেন অমন একটা পঙ্ক্তি?’
হেসে বললাম— রোসো, রোসো বৎস! এ সবই তোমারে জাগাবার অভীষ্টে অনুঘটকালি, অনৃতভাষণ! এতটা অশিক্ষিত ভেবো না! শাইলকের মধ্যেও যে কুসুমতা, আমি না থাকলে হত? লেখার সময় অঝোর ঝরেছিলাম কবির চোখ উপচে!
ও শান্ত হল। বলল, ‘বেশ। শুনুন। আজ সঙ্গেই আছেন আপনি। তাই আলাদা ভাবে জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু বলার প্রয়োজন নেই। এই বর্ষাকে সাহানায় গাঁথলাম— সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া ছায়ায় রয়েছে লেগে।’
স্মৃতিখণ্ড
সারেঙ্গিতে মেঘ জমাচ্ছিল বালক। উড়তে উড়তে থমকে গিয়েছিলাম। সে কিছু-ক্ষণকাল আগের কথা। তা ধরো তোমাদের ১৮৮০-৮২ জিশুসাল হবে। তোমাদেরই উত্তর প্রদেশের কিরানায়। চুম্বকে টেনেছিল। নেমে এসেছিলাম। জানলা দিয়ে ঢুকে বালকের সাধনা-শতরঞ্চিতে বসে পড়েছিলাম। নিজের অজান্তে গলতে শুরু করেছিলাম কখন, কে জানে! যা তা করে ফেললাম! কনকনে শীতে আচমকা বৃষ্টি! জল-থইথই শতরঞ্চি, ঘর। সারেঙ্গি থামায়নি বালক। লজ্জিত আমি ধীরে বেরিয়ে এসে উড়ে গিয়েছিলাম। সেই খানবাবা পরে সারেঙ্গি, বীণা ছেড়ে গানে এসেছিল। ওর মিয়াঁ মল্লারের পেশকারিটা শুনে দেখো। ছোট্ট। জগতের বেশি সময় ‘নষ্ট’ হবে না! খালি পায়ের বিলম্বিত পথচলা—‘করিম নাম তেরো’ থেকে লৌহনালের অশ্বগতি দ্রুতি— ‘বরষন লাগি বাদরিয়া’। আমায় পাবে। আমার ঘনিয়ে ওঠার, আমার ছড়িয়ে পড়ার, আমার গর্জে ওঠার, আমার ককিয়ে ওঠার, আমার অবরুদ্ধ কামনার গন্ধ আঁকা সে গানে!
নিতিখণ্ড
এমন দিনে সব বলা যায়। ‘এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে’ মঙ্গলকাব্য তৈয়ার করে। এক আষাঢ় পূর্ণিমায় আঁচল উড়িয়ে খুনসুটি করছিলাম চাঁদের সঙ্গে। নীচের রাজপুরী তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দীপ নিবে গিয়েছে। প্রাসাদের এক কক্ষে এসে দাঁড়াল বছর-ঊনত্রিশের এক কান্তিময়। বিছানায় স্ত্রী-পুত্র ঘুমন্ত। সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে দিল তাদের মাথায়। তার পর পা-টিপে পা-টিপে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে, প্রাসাদ থেকে। যাওয়ার পথে মাথা তুলে আকাশে তাকাল। জানতাম, কেন গেল। জানতাম না, কোথায় যাচ্ছে। আমার শুভেচ্ছা নিয়ে যাবে না? কয়েক বিন্দু ঝরিয়ে দিলাম ওর মাথায়। অস্ফুটে বলল, ‘পথ ঠিক হলে বৃষ্টি এ ভাবেই ঝরে।’ বহু পরে আর এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় ফিরে এসে জগৎকে বলেছিল—‘নিব্বানং পরমং সুখং’।
এমন দিনে সব বলা যায়। ‘আ ড্রপ ফেল অন দ্য অ্যাপল ট্রি’— গ্রীষ্মবর্ষণের এই পঙ্ক্তিরই মতো উদাস বিজ্ঞানীর সামনে পতিত আপেলেও ছিলাম আমি। অভিমানই হয়েছিল। নিত্যদিন যে কারণে আমি ঝরে মরছি, তার দিকে নজর গেল না তার! অপেক্ষা করে রইল অন্য কোনও পতনের জন্য! ‘পবন খসায় কার নীবি-বন্ধন’! আমি খসাই! মায়াবশতই তাই পাকা আপেলের শ্লথনীবি বৃন্তে ফেলেছিলাম এক বিন্দু নয়নের জল। মুহূর্তে খসে পড়েছিল মহাকর্ষের গোপন শ্লাঘা!
এমন দিনে সব বলা যায়। চিতচোর কিশোর যখন স্নানার্থী কিশোরীদের পোশাক লুকিয়ে রেখে গাছের ডালে পা দুলিয়ে ধর্মতত্ত্বের ভাগবত-আখর আগাম তৈরি করে রাখছিল, আমিই ধারাবর্ষণে মেয়েগুলোকে জলের পোশাক বুনে দিয়েছিলাম। আবার রাধামাধবের মিলনকুঞ্জে আড়াল তৈরি করতে সটান নেমেছিলাম জলের পর্দা হয়ে।
এমন দিনে সব বলা যায়। যুগে যুগে আমায় নানা জন নানা রকম ভেবেছে। কেউ ভেবেছে, আমি ঈশ্বরের বীর্য। কেউ আমায় লাঙলে এঁকেছে, কেউ ঐরাবতে। কেউ আমায় হিংস্র ভেবেছে, কেউ করুণাঘন। কেউ আমায় প্রার্থনা করে মরেছে, কেউ তুষ্ট করার তাড়নায় মেরেছে অন্য প্রাণ। নানা নামে ডেকেছে আমায় তারা। আমি তাদের আর প্রাচীন সব ঈশ্বরের কাছে গর্বিত ভাবে বলেছি— আমি মেঘ! আমি ‘ধরণীর ’পরে বিরাট ছায়ার ছত্র’!
আমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকা যে জল, তার পরিমাণ পৃথিবীর সারা দেহের শিরা-উপশিরা সব নদীর সব জলের চেয়েও বেশি! আবার, উতল ধারায় ঝরে পড়ার সময় মেঘত্ব নস্যাৎ করে সেলুলয়েডের সেই ভিজে যাওয়া চার ঘোড়াকে বলেছি, বলেছি গাছের নীচে আশ্রয় নেওয়া কাকভেজা অপু-দুর্গাকে, বলেছি কবিকে— ‘এখন আমি/ মেঘ নই আর, সবাই এখন/বৃষ্টি বলেডাকে আমায়’।
এমন দিনে সব বলা যায়। রামচন্দ্র বিরহবৃষ্টিবিহ্বল। ‘গীতগোবিন্দম্’ শুরু আমাতেই— ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ’। পদাবলির হৃদয়পদ্মপাতে টলোমলো জলবিন্দু আমিই।
তবে সিক্ত আমায় আশিরনখ ভিজিয়েছে যক্ষের চিত্রকর আর শিলাইদহের মাঝি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy