নিদর্শন: পুরুলিয়ার এক প্রাচীন পুঁথি ‘লক্ষ্মীচরিত্র’-এর পৃষ্ঠা
গণ্ডগ্রাম চিরুডি, বান্দোয়ান থেকে ১০ কিমি। আরও ৩ কিমি দূরে বাহাদুরপুর। সেখানকার প্রাচীন গৌরাঙ্গ মন্দিরের নাটবারান্দার বাঁধানো চাতালে সকাল-সন্ধে ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। ডাইনে-বাঁয়ে দেওয়ালে গৌরাঙ্গলীলা আর রাসলীলার অস্পষ্ট ছবি। মন্দিরের ভিতরে অন্ধকারে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আর তাঁদের পায়ের কাছে আরও অন্ধকারে স্তূপীকৃত পুঁথি-সম্ভার। কোনওটা পাটায় বাঁধা, কোনওটা লাল সালুতে মোড়া, কোনওটা একেবারে খোলা। পোকায় কাটা, উইয়ে খাওয়া, ধুলো-মাটি মাখা পাতাগুলি জড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে। প্রায় বাইশ-তেইশটা পুঁথি। রামায়ণের নানা পালা (লঙ্কাকাণ্ড, পাণ্ডব-দিগ্বিজয়, শ্রীরামের দেশাগমন, সুন্দরাকাণ্ড, মহীরাবণ পর্ব) ছাড়াও রয়েছে সত্যনারায়ণ ব্রত, সুলোচনা ব্রত, কপিলামঙ্গল, মনসামঙ্গল, গৌরগণোদ্দেশ দীপিকা, রাধার কলঙ্কভঞ্জন পালা, ভাগবতপুরাণ, লক্ষ্মীচরিত্র, মহাভারতের খণ্ডকাহিনি (ভ্রমরগীতা, অশ্বমেধ পর্ব, কর্ণপালা, বিরাটপর্ব, বিশ্বরূপ পাঠ, ভীষ্মপর্ব, কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদ)। আর আছে গৌরাঙ্গলীলামৃত, ষট্সন্দর্ভ, বিবিধ পূজামন্ত্র— কোনওটার পাতা নেই, কোথাও এক পুঁথির পাতা মিশে গেছে অন্য পুঁথির সঙ্গে। পুরোহিত দূর থেকে ফুল-জল ছিটিয়ে পুজো সারেন।
আজকের খণ্ড-পুরুলিয়া বা পূর্বতন মানভূম কিংবা তৎপূর্বতন জঙ্গলমহল— সীমানা অনেক দূর বাড়িয়ে নিলেও দেখা যাবে কমবেশি একই ছবি। অহঙ্কার করার মতো প্রাচীন পুঁথি-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই ভূখণ্ড পিছিয়ে পড়া অভিধা পেয়েছিল। কারণ বোঝা খুব কঠিন।
২০০৬-০৭ নাগাদ রাষ্ট্রীয় পাণ্ডুলিপি মিশনের তরফে দেশজোড়া পুঁথি-সমীক্ষায় নথিভুক্ত পুরুলিয়ার পুঁথির সংখ্যা ৩২০টি। এখনও যত পুঁথি টিকে আছে, তার কয়েক গুণ হারিয়ে গেছে। বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ এই পুরুলিয়ার ডিমডিহা গ্রাম থেকেই এক সময় আবিষ্কার করেছিলেন কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল। সে পুঁথি বহু কাল ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। কিন্তু তার পরে গত ১০০ বছরে পুরুলিয়ার পুঁথি নিয়ে সে ভাবে চর্চা হয়নি। অথচ খোঁজ নিলেই দেখা যাবে ভূস্বামী বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের গৃহে কিংবা ভাঙা মন্দিরে আজও মুখ ঢেকে আছে অজস্র অজানা পাণ্ডুলিপি।
মৌলিক রচনা, লিপিকরণ, অনুবাদ, টীকাভাষ্য রচনা— সব রকমের পুঁথিই মানভূমে রচিত হয়েছে। কিন্তু যে হেতু এর বেশির ভাগই দেড়শো থেকে সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো, তাই পুরুলিয়ার বর্তমান মানচিত্রে এদের বাঁধা যাবে না। সাবেক মানভূম, যা বর্তমান পূর্ব-সিংভূম, ধানবাদে ছড়িয়ে গেছে, সেগুলিতেও পাওয়া যায় পুরুলিয়ার পুঁথিসম্পদ। জ্ঞানচর্চার বহু বিষয় স্থান পেয়েছিল পুঁথিগুলির পাতায়। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চিকিৎসাবিদ্যা, ঋতুভেদশাস্ত্র, ছন্দশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র, কাব্যশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি। ‘উত্তররামচরিত’, ‘মালতীমাধব’-এর মতো রচনা অনুবাদ করা হয়েছে এই পুরুলিয়াতেই।
পুরুলিয়ার পুঁথির মধ্যে তিন ধরনের স্বকীয়তা স্পষ্টতই চোখে পড়ে। একটি হল ঝুমুর আর বৈষ্ণব পদাবলির মিশ্র সাহিত্য, অন্যটি শাক্ত পদাবলি ও ভাদু গানের মিশ্র রূপ। তৃতীয়টি আধা-শাক্ত এবং আধা-বৈষ্ণব পদাবলি ধরনের গান। এখানে সবচেয়ে বেশি আছে ব্রত-পাঁচালি ও বিবিধ পূজামন্ত্রের পুঁথি। সে সব মন্ত্র পূজারও হতে পারে, আবার ঘট স্থাপন, গৃহ নির্মাণ বা সূর্যস্তবও হতে পারে। ব্রতের মধ্যে সত্যনারায়ণ, সুলোচনা, কার্তিকেয়, জিতাষ্টমী এমনই নানা সৃষ্টি রয়ে গেছে। এগুলির সাহিত্যমূল্য উল্লেখযোগ্য না হতে পারে, কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারতের অনাবিষ্কৃত একাধিক পালাগান ওই মহৎ সৃষ্টির পরিসর আরও বাড়িয়ে দিতে পারে আজও। পুরুলিয়ার অনামী কবিরা অনেকেই কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের ভণিতা ব্যবহার করে রচনা করেছেন ওই সব পালাগান। সে সময়ের সামাজিক ইতিহাসের সুলুক-সন্ধানও পাওয়া যাবে এখান থেকে।
উনিশ শতকে বঙ্গীয় নবজাগরণের ঢেউ কলকাতা ছাড়িয়ে মানভূমে আসে একটু দেরিতে। বিহার রাজ্যের প্রশাসনিক সীমায় আবদ্ধ থাকার জন্য কলকাতা তখন দূরতর হয়ে উঠেছিল পুরুলিয়া থেকে। তাই ছাপার যুগ এসে গেলেও অনেক দিন পর্যন্ত পুঁথির যুগেই আবদ্ধ ছিল পুরুলিয়া। পশ্চিমের বাঘমুন্ডি থেকে পুবের দিকের পুঞ্চা-কাশীপুর, দক্ষিণের বান্দোয়ান-বরাবাজার থেকে উত্তরের মুড়াড্ডি, বেরো, রামচন্দ্রপুর— সর্বত্র চলেছিল পুঁথিচর্চা। পুঁথি যেমন লেখা হয়েছে কাশীপুর রাজবাড়িতে বা পুরোহিত গৃহে, তেমনই অব্রাহ্মণ বা তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষও লিপিকর্মে যুক্ত হয়েছিলেন। তালপাতাকে লেখার উপযোগী করার কাজ, তুলোট কাগজ তৈরি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে কালি তৈরির কাজে মহিলাদেরও অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৫৬-তে বিহার থেকে মুক্ত হয়ে আজকের পুরুলিয়া সংযুক্ত হয় বঙ্গে। ভাষা আন্দোলন ছিল সেই বঙ্গভুক্তির অন্যতম হাতিয়ার। এর সাফল্যের পিছনে যে পুরুলিয়ার পুঁথিগুলিরও ভূমিকা ছিল, সে কথা ভুলে গেছেন অনেকে। তখন ‘লোকসেবক সংঘ’ জেলার নানা প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করে এনেছিল অজস্র বাংলা পুঁথি। পুরুলিয়া যে আসলে বঙ্গভাষী ভূখণ্ড, পুঁথির সাক্ষ্যে সে কথা তুলে ধরার জন্য। ‘শিল্পাশ্রম’-এর অন্ধকারে আজ সেই প্রাচীন অমূল্য পুঁথিগুলি বিলুপ্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে।
সর্বার্থে পিছিয়ে পড়া (অনেকে স্বীকার করেন না) এই প্রান্তিক ভূখণ্ডে এমন পুঁথি-সম্পদ বিস্ময়ের বই কী! পুরুলিয়ার নাম ছৌ-ঝুমুর-ভাদু-টুসু-নাচনির দেশ বলে। কিন্তু সে সবের বাইরে জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চাও পুরুলিয়ায় যথেষ্ট হয়েছে। যোগ্য উত্তরাধিকার তৈরি হয়নি বলেই হয়তো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও পুরুলিয়া উপেক্ষিত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy