বাবা মারা যাওয়ার পর তিন নাবালক ভাইবোনের একমাত্র আশ্রয় তখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নিঃস্ব অগ্রজ বেরোলেন চাকরির খোঁজে। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তথা উপীন নামের এক আত্মীয়ের সূত্রে একটা চাকরির ব্যবস্থা হল। বেতন ৩০ টাকা।
কিন্তু অত কম টাকায় পোষায় না। ফের বেশি মাইনের চাকরির খোঁজ। এক দিন উপীনের কাছে কিছু টাকা কর্জ চেয়ে বসেন! টাকায় কী হবে? ‘‘এখানে থাকতে আমার মন চাইছে না, উপীন। রেঙ্গুনে নাকি ভাগ্য ফেরে।’’ অগত্যা উপীন তাঁকে জাহাজে তুলে দেন, সঙ্গে ৪০ টাকা। সালটা ১৯০৩।
ভিনদেশে গিয়ে কষ্ট অনেকটা ঘোচে। বর্মা রেলের এজেন্ট জনসন সাহেবের অফিসে ৭৫ টাকা মাইনেতে একটা চাকরি হয়। কিন্তু যাঁর ভরসায় রেঙ্গুন যাত্রা, সেই উকিল অঘোরনাথবাবু কিছু দিনের মধ্যেই নিউমোনিয়ায় মারা যান।
শরৎচন্দ্র ফের নিরাশ্রয়। এ সময় উত্তর বর্মার কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে থাকেন। গানের গলা বেশ ভাল ছিল তাঁর। রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গন) এক অফিসে চাকরি পান, গাইয়ে হিসেবে খ্যাতিও জোটে। বন্ধুদের অনুরোধে বেঙ্গল সোশ্যাল ক্লাবের সভ্য হন। প্রবাসী বাঙালিদের সান্ধ্যকালীন মজলিশ তখন তাঁর গানে মাতোয়ারা।
এক দিন শরৎচন্দ্রকে অফিসের মেসে নিয়ে যান সহকর্মী যোগীন্দ্রনাথ সরকার। গানের অনুরোধ আসতে থাকে, হারমোনিয়াম নিয়ে সুর ধরেন শরৎচন্দ্র— ‘শ্রীমুখপঙ্কজ—দেখবো বলে হে/ তাই এসেছিলাম এ গোকুলে।’ ঘরে ভিড় জমে গিয়েছিল, তবে হাসি-আড্ডার বদলে এ গানে করুণ রসের উদ্রেক হয়। গান শেষ হওয়ার পর ফের অনুরোধের আসর। অফিসের দাদামশাইয়ের মন্তব্য, ‘‘এমন মধুর গান এ-শালার-দেশে কেউ গাইতে পারে?’’
১৯০৫। শরৎচন্দ্র তখন থাকেন মণীন্দ্রকুমার মিত্র নামে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে। মিত্রবাবু এক দিন জানালেন, কবি নবীনচন্দ্র সেন রেঙ্গুনে এসেছেন, তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন হচ্ছে, শরৎচন্দ্রকে গান গাইতে হবে। বেঙ্গল সোশ্যাল ক্লাবে অনুষ্ঠান। তখন সেখানে শরৎচন্দ্রের গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘ওহে জীবন-বল্লভ, ওহে সাধন-দুর্লভ’। অনেকেই ধরে নিলেন, শরৎচন্দ্র কবি-সংবর্ধনায় এই গানটাই গাইবেন। অফিসে হুল্লোড়, জল্পনাও। কেউ কেউ আবার আগে থেকে অফিস ছুটি নেওয়ার ফন্দি করতে লাগলেন, না হলে ‘শরৎদা’র গান মিস হয়ে যেতে পারে! কুমুদিনীকান্ত কর নামে এক কর্মচারী উত্তেজনার চোটে থেকে-থেকে বলতে থাকলেন ‘‘শরৎদা কি জয়!’’
অনুষ্ঠান শুরু হল। ক্লাব ভরভরন্ত। এ দিকে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েই এক ফাঁকে বেরিয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র। নবীনচন্দ্র তখন গান শুনে আপ্লুত, ‘‘এ যে তোমাদের রেঙ্গুন-রত্ন!’’ গায়কের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র হাওয়া। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ক্লাবের এক ঘরে তাঁর সন্ধান মিলল। কিন্তু কিছুতেই কবির সঙ্গে দেখা করলেন না। ‘‘হৈ-চৈ করে এমনভাবে যশ কুড়িয়ে লাভ কী?’’
হেমেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন, ‘শরৎচন্দ্রের মুখে রবীন্দ্রনাথের নব নব গীত শুনে রেঙ্গুনের বাঙালীরা আনন্দে মেতে উঠতেন,—বৈষ্ণব পদাবলী প্রভৃতিতেও তাঁর দক্ষতা ছিল অপূর্ব্ব!’ তবু রেঙ্গুনে থাকাকালীন শরৎচন্দ্রের খ্যাতির লোভ ছিল না। দীর্ঘ প্রবাসে নির্জন ঘরে লিখে চলতেন। কিন্তু ছাপতেন না। তবু ১৯০৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ‘বড়দিদি’। লেখকের অজ্ঞাতসারেই। সে সময় কলকাতা থেকে সম্পাদক সরলা দেবীর নামে কাগজ চালাতেন সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। তিনি জানতেন, রেঙ্গুনে যাওয়ার আগে নিজের লেখাগুলি সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর কাছ থেকেই ছোট উপন্যাস ‘বড়দিদি’ আনিয়ে তিন কিস্তিতে ছেপে দেওয়া হয়েছিল। লেখকের মত নেওয়া হয়নি, কেননা তিনি মত দেবেন না, এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিলেন।
‘বড়দিদি’-র প্রথম কিস্তি পড়ে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার শৈলেশচন্দ্র মজুমদার সটান রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করে বসেছিলেন, তাঁদের দাবি অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’-তে লেখা দিয়েছেন বলে। রবীন্দ্রনাথ তো অবাক, ‘‘উপন্যাস লিখ্লামই বা কখন্ আর ভারতীতে তা প্রকাশিত হ’লই বা কেমন ক’রে?’’ শৈলেশবাবুর পাল্টা: ‘‘নাম না দিলেই কি এ আপনি লুকিয়ে রাখ্তে পারেন?’’ আসলে ‘বড়দিদি’ পড়ে বাঙালি পাঠকসমাজের একটা বড় অংশের ধারণা জন্মেছিল, এ নিশ্চয়ই ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘বড়দিদি’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে জনমতের চাপে শরৎচন্দ্রের নাম প্রকাশ করে ‘ভারতী’। তবে এত ঘটনার কিছুই জানতে পারেননি লেখক। এমনকি, এই উপন্যাস প্রকাশের খবরটাও এক বইয়ের দোকান থেকে পান রেঙ্গুনের সহকর্মীরা। শরৎচন্দ্র ‘ভারতী’তে চিঠি দেন, পরে মাসে মাসে পত্রিকা আসতে থাকে তাঁর কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy