Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

নীরা আজ ভাল আছে?

করোনার কালে প্রেমের হাল খারাপ। পরকীয়ার পথ বন্ধ, স্বকীয়া অষ্টপ্রহর বন্ধ ঘরে মুখোমুখি কাটিয়ে হাঁসফাঁস। আশ্চর্য কী? রোমিয়ো-জুলিয়েটের প্রেমটাই মহামারির কোপে মরে গেল, আর আমরা তো সামান্য মনিষ্যি! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘সমস্যাটা কী জানো? এই যে সারাক্ষণের নৈকট্য, এটা প্রেমের ক্ষতি করে। স্ত্রী বা স্বামী পরস্পরের আয়নার মতো। তোমার মুখের সামনে সারাক্ষণ কেউ আয়না ধরে থাকলে তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না।’’

যৌবনপ্রমত্তা: শকুন্তলা, রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবিতে

যৌবনপ্রমত্তা: শকুন্তলা, রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবিতে

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০২:৪২
Share: Save:

এই করোনাকালে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেম হত না। মহাকবি কালিদাস হাজার চেষ্টা করলেও তা অধরাই থাকত। মৃগয়ায় বেরিয়ে দুষ্মন্ত আচমকা না জেনে কণ্বমুনির তপোবনে ঢুকে পড়েন। পুরুবংশের ক্ষত্রিয় রাজা না-হয় শিরস্ত্রাণ ও রাজপোশাকের সঙ্গে এখন মুখে মাস্ক এঁটে থাকতেন, অসুবিধে নেই। নাটকের মঞ্চে আলো পড়ে ভালই লাগত।

কিন্তু বাকিটা? নাটকের ওই দৃশ্যেই আমরা জানলাম, মহর্ষি কণ্ব তপোবনে নেই। সোমতীর্থে পর্যটনে গিয়েছেন। দেশজোড়া লকডাউন থাকলে মহর্ষি তীর্থযাত্রা করতেন কী ভাবে?

প্লটের খাতিরে এটুকুও না হয় ছাড় দেওয়া গেল। ধরে নেওয়া গেল, কণ্বমুনি যখন সোমতীর্থে, সেই সময়েই মোদীজি চিচিং বন্‌ধ বলে দিয়েছেন। সুতরাং, দুষ্মন্ত এসেছেন, শকুন্তলা আছেন, কণ্ব নেই। কিন্তু তপোবনে লুকিয়ে লুকিয়ে রাজা প্রথম বার শকুন্তলাকে কী ভাবে দেখলেন? নায়িকা তার সখী অনসূয়াকে বলছে, ‘আদিপিণদ্ধেণ বল্কলেণ… — প্রিয়ংবদা আমার বুকে এমন আঁট করে বল্কল পরিয়ে দিয়েছে যে কষ্ট হচ্ছে, তুমি বল্কলের গিঁটটা একটু ঢিলে করে দাও।’ প্রিয়ংবদা পাল্টা হেসে গড়িয়ে পড়ল, ‘বটে, আমার পরানোর দোষ! নিজের যৌবনকে গাল পাড়ো না! যৌবন যে পলে পলে তোমার পয়োধর বিস্তৃত করছে, তা বুঝি দেখতে পাও না?’ সেই আওয়াজ না-হয় আশ্রমকন্যা হজম করলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে কি, তিন মিটারের ‘সোশাল ডিসট্যান্স’ রাখার হুকুম জারি থাকলে অনসূয়া শকুন্তলার বুকে বল্কলের গিঁট আলগা করতে এগোত না, মহাকবির কল্পনাও স্যানিটাইজ়ড হয়ে যেত।

কালিদাসের কাল তো কবেই গিয়েছে। এই করোনাময় পৃথিবীতে ফোনে ধরা গেল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর ঘুণপোকা উপন্যাসের নায়ক শ্যাম প্রেমিকা ইতুকে খেপায়, ‘আমাকে ধরতে পারে না।’ কিংবা যাও পাখি উপন্যাসে সোমেন অনুভব করে, নায়িকা রিখিয়ার চোখ দুটো আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরার মতো ঝকঝক করে। সোশাল ডিসট্যান্স মানলে চাকরি-হারানো শ্যাম ওই ভাবে ইতুর সঙ্গে খেলতে পারত? আর, মুখে মাস্ক-সাঁটা রিখিয়ার চোখ? অমন উপমার জন্মই হত না। হাসছেন শীর্ষেন্দু, ‘‘সে তো প্রেমই এখন লকডাউনে চলে গিয়েছে। অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? মেয়ে-ইস্কুলের সামনে ছেলেরা দল বেঁধে গল্প করতে পারছে না, মহামারির ভয়ে লেকের ধারে বাদামভাজা খাওয়ার সাহসও কারও নেই!’’

মহামারি তো এ ভাবেই প্রেমকে তছনছ করে দেয়। শেক্সপিয়রের রোমিয়ো আর জুলিয়েট যাজক ফ্রায়ার লরেন্সের সাহায্যে গোপনে বিয়ে করেছে। কিন্তু দুই যুযুধান পরিবার এই প্রেমকে স্বীকার করে না। স্ত্রীর সঙ্গে ঠিকঠাক মিলনও হয় না, ভেরোনা শহর থেকে রোমিয়ো অচিরে বহিষ্কৃত হয়। ফ্রায়ার লরেন্স বুদ্ধি বার করেন, জুলিয়েটকে তিনি একটি ঔষধি দেন। ওটি খাওয়ার পর জুলিয়েট মড়ার

মতো পড়ে থাকবে, কিন্তু মৃত্যু হবে না। বাড়ির লোকজন তাকে গোর দিতে পারিবারিক সমাধিস্থলে নিয়ে আসবে, যাজক গোপন চিঠিতে রোমিয়োকে ভয় পেতে বারণ করবেন। চিঠি জানাবে, জুলিয়েট বেঁচে আছে।

এইখানেই মহামারির খেলা। প্লেগের ভয়ে যাজকরা কোয়রান্টিনে, অতএব ওই চিঠিটাই রোমিয়োকে দেওয়া যায়নি। নাটকের পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ফ্রায়ার লরেন্স জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কিন্তু চিঠিটা? রোমিয়ো পেয়েছে তো?’’ যাজক ফ্রায়ার জন উত্তর দেন, না, ‘নর গেট আ মেসেঞ্জার টু ব্রিং ইট দি,/ সো ফিয়ারফুল ওয়্যার দে অব ইনফেকশন’। সংক্রমণের ভয়ে কোনও বার্তাবাহক যেতে চায়নি। অতঃপর জুলিয়েটের মৃত্যুকে সত্য ভেবে রোমিয়োর আত্মহত্যা। জুলিয়েট প্রেমিক ও স্বামীর মৃত ঠোঁটে চুমু খায়, ‘আই উইল কিস দাই লিপস’, তার পর নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়, ‘ও হ্যাপি ড্যাগার... লেট মি ডাই।’ ইটালীয় প্রেমিকপ্রেমিকার কালজয়ী ট্রাজেডির জন্যে দায়ী আসলে প্লেগ।

প্লেগ রোগটাকে শেক্সপিয়র হাড়ে হাড়ে চিনতেন। রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট লেখার ঠিক আগের বছরে, ১৫৯৩ সালে লন্ডনে হানা দিয়েছিল মারাত্মক বিউবোনিক প্লেগ। এই সংক্রামক রোগটির জন্য তখন শহরের থিয়েটার হলগুলি বন্ধ থাকত, কেউ মারা গেলেই পাড়ার গির্জায় ঢং ঢং ঘন্টা বাজত। শুধু ১৫৯৩ নয়, ১৫৯৭, ১৫৯৯, ১৬০৩— বার‌ংবার এই রোগে লন্ডন প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। তাঁর জন্মের কয়েক মাস আগে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভন-এ প্লেগ, মারা গেলেন তাঁর এক দাদা ও দিদি। আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে গেল ছোট্ট ছেলেটি। ১৬০৩ সালের প্লেগে মারা গেলেন তাঁর বাড়িওয়ালি মেরি মাউন্টজয়। সংক্রমণের বাজারে শেক্সপিয়র তখন ঘরবন্দি হয়ে কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ লিখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আরও মানুষ মরবে, মানুষের শরীরে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হবে। অনেকের ধারণা, শেক্সপিয়রের জীবনটাও হার্ড ইমিউনিটির আশীর্বাদ।

একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন— শেক্সপিয়রের চরিত্ররা যুদ্ধে, গুপ্তহত্যায়, খুনজখম থেকে আত্মহত্যা, নানা ভাবে মারা গিয়েছেন। কিন্তু প্লেগে নয়। রানি এলিজ়াবেথ, রাজা প্রথম জেমস দু’জনের আমলেই নাটকে প্লেগে মৃত্যু দেখানো যেত না। সামাজিক ট্যাবু ছিল। আধুনিক নায়ক-নায়িকাদের প্রেমে মহামারির এই ট্যাবু নেই। মোক্ষম প্রমাণ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অরক্ষণীয়া উপন্যাসে অতুল শেষ অবধি ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত কুরূপা জ্ঞানদাকে বিয়ে করে। আর শ্রীকান্ত থেকে গৃহদাহ, অনেক উপন্যাসেই হানা দিয়েছে প্লেগ। গৃহদাহ আবার ত্রিকোণ প্রেম এবং এক নারীর দোলাচলচিত্ততার গল্প। সুরেশ বন্ধুপত্নী অচলাকে ইলোপ করে পশ্চিমের এক শহরে নিয়ে এসেছে, কিন্তু শেষ অবধি অচলা তার শয্যায় ধরা দিতে রাজি হয়নি। উপন্যাসের ৩২ নং অধ্যায়ে সুরেশ অচলার ঘরে আসে, ‘সহসা তাহার সমস্ত দেহটা বাতাসে বাঁশপাতার মতো কাঁপিতে লাগিল, এবং চক্ষের পলক না ফেলিতেই সে দুই হাত বাড়াইয়া অচলার মাথাটা টানিয়া বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।’ অতঃপর অচলার জিজ্ঞাসা, ‘‘তুমি এ ঘরে এসেছ কেন? ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়োগে।’’ সুরেশের গলা কাঁপতে থাকে, অচলার হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে সে বলে, ‘‘তা হলে তুমিও আমার ঘরে এসো।’’ অচলা শান্ত ও সংযত স্বরে ‘না, আজ নয়’ বলে হাত ছাড়িয়ে নেয়। বাঙালি পাঠক জানে, সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত ও চরম রোমাঞ্চিত রাত সুরেশের জীবনে আসেনি। এই ঘটনার পরই সে গ্রামান্তরে প্লেগ রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সংক্রমণে মারা যায়। বাস্তবে শরৎচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রী ও শিশুপুত্র রেঙ্গুনে প্লেগ সংক্রমণে মারা যান, কিন্তু সে নিয়ে লেখকের কোনও ট্যাবু ছিল না। তাঁর ট্যাবু অন্যত্র। ফুসলিয়ে নিয়ে-যাওয়া ব্রাহ্ম নারী অচলাকে তিনি হিন্দু সুরেশের অঙ্কশায়িনী হতে দেবেন না!

ইতিহাসের বাস্তব অন্যত্র। আমি-আপনি নগণ্য মনিষ্যিমাত্র, দিনের পর দিন দোকান-বাজার বন্ধ থাকলে জাহাঙ্গির আর নুরজাহানের প্রেমকাহিনিও হত না। ১৬১১ সালের মার্চ মাস। পার্সি নববর্ষ বা ‘নওরোজ়’। মুঘল প্রাসাদের মেয়েরা, অভিজাত আমির-ওমরাহের স্ত্রী, কন্যারা এই দিন খেলাচ্ছলে সম্রাটকে নানা জিনিস বিক্রি করে। সম্রাট জাহাঙ্গির সে বাজারে এলেন। সে দিনই প্রাসাদের সেই মেয়েকে প্রথম দেখলেন তিনি। তাঁর বন্ধু আলি কুলি ইসাজুলুর বিধবা স্ত্রী।

এই আলি কুলিকে একদা তিনিই ‘শের আফগান’ পদবি দিয়েছিলেন, বর্ধমানে জায়গির দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখেনি সে। সময়মতো খাজনা তো দিলই না, উল্টে তাঁর সেনাধ্যক্ষ খুবুকে খুন করল। খুবুর অনুচররাও ছেড়ে দেয়নি, তাদের তরবারিতে লেগে রইল শের আফগানের শেষ রক্ত।

অতঃপর শের আফগানের বিধবা স্ত্রী মেহেরুন্নিসা ও সন্তানদের বর্ধমান থেকে মুঘল প্রাসাদে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেটা ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দ।

চার বছর পর নওরোজ়ের সেই বাজার থেকে বদলে গেল ইতিহাস। জাহাঙ্গিরের সম্রাজ্ঞী হয়ে সিংহাসনে বসলেন মেহেরুন্নিসা। তাঁর নতুন নাম তখন নুরজাহান!

জ্বর আর সেল্ফ কোয়রান্টিন রাজদম্পতিকেও ছেড়ে দেয়নি। এই বিয়ের পরই দুরারোগ্য এক রোগে মারা গেলেন জাহাঙ্গিরের সুহৃদ আফজ়ল খান। তাঁর বাবা আবুল ফজল একদা আকবরের বিশ্বস্ত ছিলেন। রোগশয্যায় আফজ়লকে আর চেনা যাচ্ছিল না, তাঁর সারা গায়ে ফোস্কার মতো গোটা বেরিয়ে গিয়েছিল।

রোগের সেটাই শুরু। বছর দেড়েক পর খোদ সম্রাট আক্রান্ত। ইংরেজ পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ জানাচ্ছেন, লাহৌরে যেতে যেতে তিনি সম্রাটের মৃত্যুসংবাদের গুজব শুনলেন। চোর, ডাকাত, ফৌজদার সবাই অরাজকতার সুযোগে লুটপাটে নেমে পড়েছে। মহামারির ফেক নিউজ় কি আজকের গল্প না কি?

সম্রাটের তখন প্রজাদের ‘মন কি বাত’ জানানোর সুযোগ নেই। তিনি প্রথম ধাক্কাতেই ‘সেল্ফ কোয়রান্টিন’-এ চলে গেলেন। নুরজাহান ছাড়া আর কেউ তাঁর ঘরে প্রবেশ করবে না। ‘নুরজাহান বেগম ছাড়া কাউকে জানতে দিইনি, অন্যদের চেয়ে ও আমাকে বেশি ভালবাসত,’ আত্মজীবনী তুজ়ুক-ই-জাহাঙ্গিরি’তে লিখে গিয়েছেন সম্রাট। পরে জ্বর নিয়ে আজমেঢ়ে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগাতেও সুস্থতার প্রার্থনা করলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২২ দিন ভোগান্তি চলেছিল।

মনের কথাটা খুলেই বলি। আমার যদি নুরজাহান থাকত, অক্লেশে দুই সপ্তাহের সেল্ফ আইসোলেশনে চলে যেতাম। মহামারি লকডাউন কোনও কিছুকে পাত্তা দিতাম না।

প্রেম বরাবর দুঃসাহসী। তিন ফুট দূর অস্ত্, স্বকীয়া-পরকীয়ার যাবতীয় ‘সোশাল ডিসট্যান্স’ সে এক লহমায় ঘুচিয়ে দেয়। রাস্তায় বেরনোর সময় সরকারি নির্দেশে মাস্ক পরতে পারি, কিন্তু এই লকডাউনেও যে নারীকে সকলের অগোচরে, গভীর গোপনে স্বপ্ন দেখি, তাকে চুমু খেতে গেলেও মাস্ক এঁটে থাকতে হবে? মাই ফুট!

পরকীয়া নিয়ে সঙ্কোচ-টঙ্কোচ আমার নেই, চৈতন্যচরিতামৃত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, ‘পরকীয়াভাবে অতি রসের উল্লাস।’ কিন্তু লকডাউনে পরকীয়ার পরিকাঠামোও নেই যে! এই ভীত, ত্রস্ত লকডাউনে ‘রুবির সঙ্গে হীরাবন্দরে’ যাবই বা কী ভাবে? সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ওই গল্পে ডায়মন্ড হারবারকে হীরা বন্দর নামে আখ্যায়িত করা ছাড়া আরও একটি উপমার জন্ম গিয়েছিলেন। বিবাহিত নায়ক অফিস কেটে প্রেমিকা রুবির সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুঁজছে রেস্তোরাঁর এক পরদা-ঢাকা কেবিন, মানে ‘এমন একটা ঝিনুক, যাতে মুক্তো আছে।’ নির্মলা মিশ্রের গাওয়া এই গান সে সময় খুব জনপ্রিয় ছিল।

হীরা বন্দর দূর অস্ত্, এখন অফিস কেটে ভরদুপুরে বার-রেস্তোরাঁর কেবিন থেকে বাইপাস, রাজারহাটের গেস্ট হাউস, সকলেরই দরজা বন্ধ। টিভি সিরিয়ালের চিত্রনাট্যকাররা জানেন না, এই শহরে ওই শরীরী আশ্লেষের গেস্ট হাউস না থাকলে পরকীয়া জমাট বাঁধে না। তারুণ্যের সহজ প্রেমে লেকের ধারে মাথা উঁচু করে হাঁটা যায়, কেউ দেখে ফেললেও ভয় থাকে না। কিন্তু পরকীয়ার ধুকপুকুনি অন্য রকম। কেউ দেখে ফেলল না তো? জানাজানি হল না তো এই কেচ্ছাভুক, একনিষ্ঠ মনোগ্যামাস পৃথিবীতে? আরক্ত, তীব্র সংরাগ তাই গোপনেই সারতে হয়। কে আর শখ করে নিজের সংসার খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়? অতএব ভাজা মাছ উল্টেপাল্টে খেয়ে উভয় পক্ষই মুখ মুছে আপন কোটরের শান্তিতে ফিরে যায়। স্বামী বনাম প্রেমিক নয়, তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাব গোছের হাফ-আখড়াই উন্মাদনা নয়, ঠান্ডা মাথায় ক্রিজ়ে টিকে থাকাটাই এই খেলার নিয়ম।

কিন্তু ওই যে লকডাউন! ‘অফিসে চাপ আছে’ বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে সকাল-সকাল লং ড্রাইভে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে কোলাঘাট বা গাদিয়াড়া আর যাওয়ার জো নেই। সবই বিপজ্জনক ‘রেড জ়োন’। মাল্টিপ্লেক্সের পর্দায় রোমান্টিক দৃশ্য দেখতে দেখতে একটু ঘন হয়ে বসা, ছল করে হাত ধরার পর সেই নারীর কপট রাগ, মধ্যান্তর-শেষে সঘন আতপ্ত নিঃশ্বাস এবং অভিমানী পাউটিং, সব এখন গত জন্মের দূরাগত স্মৃতি। কোনও এক মেহের আলি মাথার ভিতরে শুধু চিৎকার করে, ‘তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়!’

কী ভয়ঙ্কর এই করোনা-জর্জর পৃথিবী! মোবাইল-অ্যাপে বাড়িতে সকলের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখা যায় ঠিকই, স্ত্রীর আড়ালে ‘আজ কী দেখলে? ইরফানের ছবিটা ডাউনলোড করে নিয়ো’ গোছের কিছু নির্দোষ হোয়াটসঅ্যাপও চালাচালি হতে পারে ঠিকই, কিন্তু সেখানে থাকে না আমাদের নিজস্ব দহন। যে গোপন বিষের কথা জানে শুধু সে ও আমি।

লকডাউন এখানেই ভয়ঙ্কর! সন্দীপনের পরবর্তী প্রজন্মে আমাদের হীরা বন্দর খুঁজতে হয়নি, মাসকয়েক আগেও ভরদুপুরে মেয়ে ইস্কুলে ও স্বামী অফিসে থাকার সুযোগ নিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে যে যাইনি, ভ্রুভঙ্গিতে ছদ্মকোপ দেখিয়ে সকলের অজান্তে সে প্রশ্রয় দেয়নি, এমনও নয়! কিন্তু এখন? সন্তানের স্কুল নেই, পতিদেবতার হোম-অফিস। আমাকে দেখে চমকে গেলেও তাড়িয়ে দেবে না, কিন্তু ভয় পাবে— জ্বর-সর্দি-কাশি এবং আরও কিছু নিয়ে হাজির হল না তো? মহামারির মার এখানেই। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলেও সে নারী আমাকে রুগ্ণ ভাববে। এই সময়ে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। প্রেমে প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা তবু সহ্য হয়, কিন্তু অসুস্থ অবিশ্বাস?

অতঃপর হাতে স্যানিটাইজ়ার ঢেলে দিয়ে সে ড্রয়িং রুমে আসতে বলবে। স্বামী এবং প্রেমিক দু’জনের জন্যই চা নিয়ে আসবে নির্বিকার। কিন্তু ওই সব খেজুরে গল্পে আর স্যানিটাইজ়ারে কী লাভ? মৃত্যুমুখী এই করোনা-পৃথিবীতেও দাম্ভিক স্বামীরা জানে না, ‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ/ এই হাতে কি আমি পাপ করতে পারি!’

এ তো গেল পরকীয়া। আর স্বকীয়া? সোশ্যাল মিডিয়া এরই মধ্যে স্বামীরা কত ভাল কাপড় কাচছেন, ঘর মুছছেন সে সব নিয়ে হরেক রসিকতায় মুখর। দুঃখের কথা কী আর বলব, আমি এ সব রান্নাবান্না, ঘর মোছায় তাঁর বান্ধবীদের স্বামীদের মতো পটু নই বলে স্ত্রীর কাছে এই লকডাউনে মাঝে মাঝে গঞ্জনাও শুনতে হয়েছে। দাম্পত্যে শান্তিরক্ষার্থে আমি তাঁকে মহাভারতের কাহিনি শুনিয়ে দিয়েছি। সেখানে বনপর্বের শেষ দিকে শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা এসে দ্রৌপদীকে যা বলেন, তার মর্মার্থ, ‘আমি তো ভাই একটি স্বামীতেই জ্বলেপুড়ে অস্থির। তুমি এই পঞ্চস্বামীকে সামলাও

কী ভাবে?’ দ্রৌপদী লম্বা এক ফিরিস্তি দিয়েছিলেন, ‘আমি প্রত্যহ উত্তমরূপে গৃহ পরিষ্কার, গৃহোপকরণ মার্জন, পাক, যথাসময়ে ভোজনপ্রদান করিয়া থাকি। ভর্তৃগণ স্নান, ভোজন ও উপবেশন না করিলে কদাপি আহার বা উপবেশন করি না।’

এই কাহিনি শুনে তার্কিক গৃহিণী পাল্টা মন্তব্য করেছেন, একটির বদলে পাঁচটি স্বামী থাকলে তিনিও নাকি তা-ই করতেন। সে দিনই বুঝেছি, এই লকডাউনে মহাভারতীয় সভ্যতা থেকে আমরা বিচ্যুত। করোনা কেন, ভবিষ্যতে আরও অনেক দুর্ভোগ কপালে আছে।

সাহিত্যে ঢুকেও নিস্তার পেলাম না। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পটার কথা মনে পড়ল। মোতালেফ মিঞা খেজুর গাছ থেকে রস পাড়ত, তার বউ মাজুবিবি সেই রস জ্বাল দিয়ে ভাল গুড় বানাত, হাটে গেলেই মোতালেফের সব গুড় বিক্রি হয়ে যেত। এ হেন মোতালেফ আর এক মেয়ে ফুলবানুর প্রেমে পড়ল, মাজুবিবিকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে বিয়ে করল। কিন্তু ফুলবানুর তৈরি গুড়ে সে স্বাদ নেই। মোতালেফ এক দিন ছলছল চোখে মাজুবিবির নতুন সংসারে হাজির। অন্য কারণে নয়, সে যদি একটু গুড় বানিয়ে দেয়! লিখতে লিখতে মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন ঝিলিক দিল। যদি ওই গ্রামে লকডাউন থাকত, মাজুবিবি সারা দিন গুড় বানিয়ে যেত, তা হলেও কি দাম্পত্যটি অটুট থাকত? বোধহয়, না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই সব লকডাউন, প্রেম নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘সমস্যাটা কী জানো? লকডাউনে আটকা থাকার ফলে এই যে সারাক্ষণের নৈকট্য, এটা প্রেমের ক্ষতি করে। স্ত্রী বা স্বামী পরস্পরের কাছে আয়নার মতো। তোমার মুখের সামনে সারাক্ষণ কেউ আয়না ধরে থাকলে তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না।’’

সারাক্ষণ এই ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ নৈকট্যের কারণেই কি লকডাউনে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বাড়ছে? লকডাউনে হুইস্কি থেকে বাংলা কোনও মদ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই কি পুরুষ ভিতরে ভিতরে হয়ে উঠছে আরও হিংস্র এবং ভঙ্গুর? মানবজমিন-এর লেখক অবশ্য অন্য কথা বলছেন, ‘‘মহামারির সময়টা কী হচ্ছে জানো তো? সারাক্ষণ সকলের মধ্যে একটা টেনশন, ভয়, অনিশ্চয়তা, উদ্‌ভ্রান্ত বোধ। মানুষের ধৈর্য থাকছে না।’’

অধৈর্য বিপন্নতা অবশ্য হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। আগে পাড়ার যে সব বৌদিরা বিকেলে গা ধুয়ে, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ছাদে পরস্পরের সঙ্গে খোশগল্প করতেন, এখন তাঁরা কেউ ঘরের বাইরে বেরিয়ে ছাদে ওঠার ভরসাও পান না। গৃহ-পরিচারিকার অনুপস্থিতিতে তাঁরা নিজেরা রোজ প্রাণপণ বাসন মাজেন আর কাপড় কাচেন। দুপুরবেলায় ‘হোম অফিস’ করা পতিদেবতারা সেগুলি ব্যালকনির দড়িতে মেলে দিয়ে যান। লকডাউন-শেষে এই সব নিয়মতান্ত্রিক দাম্পত্যেও হয়তো উঁকি মারবে বিস্তীর্ণ কোনও চোরাবালি। কিন্তু আপাতত সব শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে। জড় ও জীবের মাঝামাঝি এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাস হঠাৎ গোটা মানবপ্রজাতিকে তটস্থ করে ছেড়ে দিয়েছে।

মহামারিতে তাই প্রেমও এখন বিপন্ন। স্বকীয়া হাঁসফাঁস করে, আর পরকীয়া? সে তো লুকিয়েচুরিয়ে দু’এক পশলা মজা ছাড়া আর কিছু নিতে চায়নি। কিন্তু ভাইরাস-কাতর এই পৃথিবী চুরি করে ওই আপেলভক্ষণের মজাও মানুষকে আর নিতে দিচ্ছে না। এখন বাড়িতেই থাকো, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোও।

ভয় পেয়ো না, এই ক্ষণভঙ্গুর সভ্যতা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে একমাত্র প্রেম। আজকাল সবাই দেখি কথায় কথায় আলবের কাম্যুর প্লেগ আর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা উদ্ধৃত করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। বেচারি গার্সিয়া মার্কেস! উনি উপন্যাসটা লিখেছিলেন এক ভেবে, যে, প্রেম আসলে কলেরার থেকেও সংক্রামক। যে সংক্রমণ গোপনে তোমাকে আর আমাকে শেষ করে দিল। আমাদের দু’জনের কাছের মানুষরাও কিছু আঁচ করতে পারল না। অথচ বাঙালি ভাবল, ওটি মহামারি নিয়ে উপন্যাস।

এই ভ্রান্ত সভ্যতা যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে! স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা, প্লেগ থেকে ডেঙ্গি, এডস, ইবোলা, কত কী এল গেল! কিন্তু নীরার কি করোনা হয়? কেনই বা সে কোয়রান্টিনে যাবে? আমি জানি, ‘নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে/ সব নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি/ হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়/ নীরা আজ ভালো আছে?’

তাই, আমাদের আবার দেখা হবে। সে দিন তোমার মুখে আমি করোনা-কালের এই মাস্ক দেখতে চাই না। দেখতে চাই তোমার ঠোঁট ও আলজিভের ওঠাপড়া। একদা-সুস্থ সে কোন পৃথিবীতে তুমিই

তো আমায় শুনিয়েছিলে সুধীন দত্তের কবিতা, ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।’

করোনা পেরিয়ে এক দিন আমরা আবার গোপনে সেই অমরাবতীর সন্ধানে যাব। দেখে নিয়ো!

অন্য বিষয়গুলি:

love extra marital corona
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy