সত্যসন্ধানী: ‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ (২০১৭) ছবির দৃশ্য। এরকুল পোয়ারো-র চরিত্রে অভিনেতা কেনেথ ব্র্যানাঘ, পরিচালনাও তাঁর
অপহরণ, খুন, আততায়ী। বাস্তব অপরাধের মোড়কে রহস্যের জাল বুনছেন এই লেখক। কী ভাবে? ডিসেম্বর মাস। বরফে মোড়া রেললাইন। ট্রেন তাই গিয়েছে থমকে। হঠাৎ খবর, পাশের কামরায় মার্কিন এক নাগরিক খুন হয়েছেন। নাম, স্যামুয়েল র্যাচেট। গোঁফওয়ালা, স্বভাবে খানিক অহঙ্কারী গোয়েন্দাটি নেমে পড়লেন তদন্তে। পেলেন একটা আধপোড়া কাগজের টুকরো, তা থেকে মিলল একটি নাম, ‘ডেইজ়ি আর্মস্ট্রং’। আর সেখানেই মোড় ফিরল ঘটনার। জানা গেল, র্যাচেটের আসল নাম— লানফ্রাঙ্কো কাসেটি। পাঁচ বছর আগে বিখ্যাত মার্কিন ধনী পরিবারের শিশুকন্যা ডেইজ়ি আর্মস্ট্রংকে অপহরণ করেছিল সে। মুক্তিপণ দেওয়ার পরেও শিশুটিকে খুন করা হয়েছিল। র্যাচেট আমেরিকা ছাড়ে। কিন্তু তার পিছু ছাড়েনি শিশুটির পরিবারের সঙ্গে নানান সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ। বেলজিয়ান গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর তদন্তে জানা গেল, ট্রেনের সেই কামরায় সকল যাত্রীই ‘খুনি’! প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে শিশুকন্যার কাছের লোক। প্রতিশোধ নিতে তাঁরা র্যাচেটকে খুন করেছেন।
লেখকের নাম— আগাথা ক্রিস্টি। আর উপন্যাসটি, ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’। প্রকাশকাল, ১৯৩৪ সাল।
সিনেমার মতোই জাম্প কাট করে চলে যাওয়া যাক তার দু’বছর আগে, ১৯৩২-এ। কয়েকটা নাম, কয়েকটা তথ্য। মার্কিন পাইলট চার্লস লিন্ডবার্গ। সাড়ে ৩৩ ঘণ্টা। ৫৮০০ কিলোমিটার। সঙ্গী— এক ইঞ্জিনের প্লেন, ‘স্পিরিট অব সেন্ট লুইস’। তাতে সওয়ার হয়েই নিউ ইয়র্ক থেকে সোজা প্যারিস। উড়ানের ইতিহাসে এই কৃতিত্বের জন্য তখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি চার্লসের।
এই খ্যাতিটাই যেন বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই সব কিছু থেকে দূরে, স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে নিরিবিলিতে একটু সময় কাটাবেন ভেবেছিলেন চার্লস। সে জন্যেই ছুটে যাওয়া নিউ জার্সি শহর থেকে দূরে, গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে তেইশটা ঘর! চার্লস, স্ত্রী অ্যান, তাঁদের কুড়ি মাসের ছেলে চার্লস অগাস্টাস লিন্ডবার্গ আর কয়েক জন পরিচারক— এই নিয়েই সাজানো সুখের সংসার।
আচমকা ছন্দপতন। মার্চ ১, রাত দশটা। চিৎকার করে উঠল পরিচারক। অগাস্টাস বেপাত্তা! তার ঘরের জানলার ধারে পড়ে রয়েছে মুক্তিপণের চিঠি। রাইফেল কাঁধে ছেলের সন্ধানে বেরোলেন চার্লস। কিন্তু কোথাও খোঁজ মিলল না। এমন খবর বেশি দিন চাপাও থাকে না। স্থানীয় পুলিশ, এফবিআই থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক— কে না যোগ দিলেন শিশুটির সন্ধান-অভিযানে! ইউরোপ, আমেরিকার সব ক’টা গুরুত্বপূর্ণ খবরের কাগজে প্রকাশিত হল খবর, বিজ্ঞাপন। তোলপাড় হল মার্কিন জনতা। আলোড়িত হলেন ক্রিস্টিও।
দাবি মতো মুক্তিপণ দেওয়া হল। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটা! সে কোথায়?
অপহরণের ঠিক তেতাল্লিশ দিনের মাথায় এল দুঃসংবাদটা। গ্রামের বাড়ি থেকে সাড়ে চার মাইল দূরে পাওয়া গেল শিশুটিকে। নিহত। থেঁতলে দেওয়া হয়েছে খুদে শরীরটা। শিউরে উঠলেন সকলে। আইনসভায় অপহরণ সংক্রান্ত আইন পর্যন্ত পাশ হল। কিন্তু খুনি?
সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪। বহু তদন্ত-তল্লাশির পরে একটা ছক কষলেন তদন্তকারীরা। মুক্তিপণ হিসেবে দেওয়া ‘গোল্ড সার্টিফিকেট’গুলিই একমাত্র সূত্র। প্রেসিডেন্ট রুজ়ভেল্ট নির্দেশ দিলেন, দেশ জুড়ে যত গোল্ড সার্টিফিকেট রয়েছে, সব জমা দিতে হবে কোষাগারে। মিলিয়ে দেখা হল সার্টিফিকেটের নম্বর। একটা সূত্র মিলল। জাল গোটাতে শুরু করল পুলিশ। ধরা পড়ল ব্রুনো রিচার্ড হপ্টমান। বছর পঁয়ত্রিশের, পেটানো চেহারার এক জার্মান যুবক। ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখে শীতল দৃষ্টি। জার্মানিতে ডাকাতির একটি মামলাতেও অভিযুক্ত সে। গত এগারো বছর ধরে থাকছিল স্টেটসে।
মনে করা হয়, চার্লস অগাস্টাস লিন্ডবার্গ ও হপ্টমানের আদলেই ক্রিস্টি যথাক্রমে তৈরি করেছিলেন ডেইজ়ি আর্মস্ট্রং ও লানফ্রাঙ্কো কাসেটি চরিত্রদু’টি। মিল আরও রয়েছে। লিন্ডবার্গের ঘটনায় জেরার চাপ সহ্য না করতে পেরে আত্মঘাতী হন ভায়োলেট শার্প নামে বাড়ির এক ব্রিটিশ পরিচারিকা। একই ভাবে ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ উপন্যাসেও ডেইজ়ির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা কর্মী সুসানেরও অপমৃত্যু ঘটে।
এমন ভাবে বাস্তব খুনের উপাদান তুলে উপন্যাসের প্লট সাজানোর কাজটি আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে করেছেন আগাথা ক্রিস্টি।
সে বারের ঘটনাস্থল ইংল্যান্ড। ১৯৩০ সাল। কর্নওয়াল প্রদেশের এক গ্রাম, অদূরেই ছোট্ট জনপদ ট্রেনহর্ন। জনসংখ্যা মোটে ২১ জন। সেখানেই ফার্নে ঘেরা কানাগলির ধারে একটা বাড়ি। ভাড়া থাকেন মধ্যবয়স্কা এক বিধবা। নাম, সারা অ্যান হার্ন। কাকিমা আর পঙ্গু বোন লিডিয়াকে নিয়ে তাঁর দিন কাটে। আর মাঝেসাঝে সময় কাটান কেক-পেস্ট্রি বানিয়ে। এক সময়ে দু’জনেই মারা গেলেন। একা হয়ে পড়লেন হার্ন।
আড্ডা দেওয়ার সঙ্গী জুটল হঠাৎ। উইলিয়াম টমাস ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিস। পড়শি এই দম্পতির সঙ্গে বেশ ভাব জমল। এক দিন চড়ুইভাতির আয়োজন। আমন্ত্রিত উইলিয়াম ও তাঁর স্ত্রী। হার্ন নিয়ে গেলেন যত্ন করে বানানো স্যামন মাছের স্যান্ডউইচ আর স্যালাড।
কিন্তু তা মুখে দিয়েই বিপত্তি। উইলিয়াম ও অ্যালিস, দু’জনেরই শরীর কেমন যেন করে উঠল। উইলিয়াম গেলেন পাশের একটি সরাইখানায়, হুইস্কিতে চুমুক দিতে। অ্যালিস বারবার বলতে থাকলেন, মুখটা বড্ড বিস্বাদ লাগছে। তাঁকে যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন হার্ন। রবিবার ফের দুপুরের খাবার নিয়ে গেলেন। ঠিক দু’দিন পরে অ্যালিসের মৃত্যু হল।
এখানেই রহস্য। প্রাথমিক ভাবে পড়শিদের সব সন্দেহের তির গেল হার্নের দিকেই। পড়শিদের মধ্যে কানাকানি। অ্যালিসের মৃত্যুর ঠিক আগের রাতে হার্ন এক পড়শি মহিলাকে বললেন, ‘‘ওঁরা ভাবছেন, আমিই খাবারে বিষ মিশিয়েছি।’’
রহস্যের পট পরিবর্তন শুরু হল দ্রুত। মঞ্চে ঢুকলেন অ্যালিসের ভাই। তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করলেন হার্নকে। কিন্তু উইলিয়াম তেমন কিছুই বলেননি। কয়েক দিন বাদে হঠাৎ একটা চিঠি। হার্ন লিখছেন, ‘‘প্রিয় মিস্টার টমাস, বিদায়। আমি চলে যাচ্ছি..। আমি নিরপরাধ। কিন্তু সে মারা গিয়েছে, এবং আমার বানানো খাবার খেয়েই। এই সত্যটা আমি আর বইতে পারছি না।’’ পুলিশ এল। হার্ন বেপাত্তা। ইতিমধ্যে এক স্থানীয় রসায়নবিদ দাবি করলেন, তিনি হার্নকে আগাছা পরিষ্কারের ওষুধ দিয়েছিলেন। তাতে ‘আর্সেনিক’ ছিল। সন্দেহ হল তদন্তকারীদের। কবর থেকে তুলে বোন লিডিয়া ও কাকিমার দেহের ময়না-তদন্ত করা হল। জানা গেল, দু’টি ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ আর্সেনিক।
খোঁজ শুরু হল হার্নের। ইতিমধ্যে পাহাড়ের এক খাদে হার্নের পোশাক মিলল। সকলে ভাবলেন, তাঁর অপমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু হার্ন তখন বহাল তবিয়তে অন্য এক শহরে, এক স্থপতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করছেন। গ্রেফতার হলেন হার্ন। তবে আদালতে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের শেষে প্রমাণিত হল, হার্ন খুনি নন। কিন্তু খুনি কে বা কারা, সে উত্তর অধরাই রয়ে গেল।
কিন্তু উত্তরটা ধরে ফেললেন ক্রিস্টি। তাঁর উপন্যাস, ‘স্যাড সাইপ্রেস’-এ। বাস্তবের ঘটনার মতো এই উপন্যাসেও বিষ (এ ক্ষেত্রে মরফিন) ও খাবারই ছিল খুনের উপকরণ। মেরি জেরার্ড নামে বছর একুশের এক তরুণী দুপুরের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যান। কবর থেকে তাঁর দেহ তুলে জানা গেল, মেরি যাঁর কাছে থাকতেন, সেই লরা ওয়েলম্যান নামের মহিলাটিরও বিষে মৃত্যু হয়েছে।
এই ঘটনাতেও প্রাথমিক সন্দেহে লরার আত্মীয়া এলিনরকে অভিযুক্ত করা হল। কাহিনিতে এত দূর পর্যন্ত বাস্তব ঘটনার ছায়া দেখা যায়। কিন্তু এর পরেই প্রেম ও এরকুল পোয়ারোর গোয়েন্দাগিরি সংযোজন করলেন ক্রিস্টি। তাঁর রহস্যের বুনটে দেখা গেল এক নতুন চরিত্র। নার্স জেসি হপকিন্স। ক্রমে জাল ছিঁড়ল রহস্যেরও।
জনতার ভয়, ঘৃণা, ভালবাসা, আবেগ ভাল ভাবেই আন্দাজ করেছেন আগাথা ক্রিস্টি।
প্রেম ও রহস্য। এই দু’টি শব্দের মধ্যে সেতু তৈরির কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই ক্রিস্টির কাছে সহজ হয়ে গিয়েছে। কারণ, সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা। তেমনই একটি বিখ্যাত ঘটনা...
‘না, না এমনটা কোরো না!’— তরুণীর চিৎকার কানে গেল পাড়ার কয়েকজনের। পুলিশ এল। দু’-এক জন জানলা ফাঁক করে দেখলেন, বেলগ্রেভ রোডের উপরে লুটিয়ে পড়েছেন এক ব্যক্তি। ছুরির আঘাতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। পাশে ভয়ে কাঁপছেন তাঁর স্ত্রী, এডিথ টমসন।
বিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ধনী ইংরেজমহলে নামডাক ছিল তরুণী এডিথের। নাচ, গান, পড়াশোনা, সবেতেই তুখড়। সওদাগরি অফিসের ডাকসাইটে কর্মচারী। ছ’বছর নাগাড়ে প্রেমের পরে বিয়ে হয়েছিল পার্সি টমসনের সঙ্গে।
কিন্তু এডিথকে থানায় নিয়ে যেতে চক্ষু চড়কগাছ তদন্তকারীদের। স্বামীর খুনি নাকি এডিথের পরিচিত! নামও করলেন এক জনের, ফ্রেডেরিক বাইওয়াটার। তরুণ ইংরেজ, মার্চেন্ট নেভির
কর্মী। রহস্য ঘনীভূত হল, যখন তদন্তকারীদের হাতে এল অনেকগুলো চিঠি। প্রেমপত্র! তা-ও সংখ্যায় ষাটটি!
পরকীয়ার ছোঁয়া লেগে রহস্য জট পাকাতে শুরু করল। একাধিক চিঠিতে এডিথ লিখেছেন, ‘মুক্ত হতে চাই’। গ্রেফতার হলেন এডিথ ও বাইওয়াটার। বিচার-পর্বেও শোনা গেল যুগলের উচ্চকিত প্রেমের উচ্চারণ। এমনকি এডিথ ও বাইওয়াটারকে যখন ফাঁসির সাজা শোনানো হচ্ছে, তখনও প্রেমিক বাইওয়াটার বলতে থাকেন, ‘‘ইয়োর অনার, ও কিন্তু কিছুই জানে না।’’ এর পরেই কিন্তু জনতা আর সংবাদপত্রগুলির মেজাজ বাঁক নিল অন্য দিকে। রায়ের বিরুদ্ধে দশ লাখ মানুষ স্মারকলিপি দিলেন।
সাড়া ফেলে দেওয়া এই পরকীয়ার ছোঁয়াচকে রহস্যকাহিনির রূপ দিয়েছেন ক্রিস্টি, তাঁর উপন্যাস ‘ক্রুকেড হাউস’-এ। সেখানে দেখা যায়, পঁচাশি বছরের ধনকুবের এক বৃদ্ধ খুন হয়েছেন। তদন্তের গোড়ায় সন্দেহ করা হয় তাঁর থেকে বয়সে অনেক ছোট, দ্বিতীয়া স্ত্রী ব্রেন্ডাকে। খুনের মোটিভ হিসেবে উঠে আসে বিপুল সম্পত্তি আর ব্রেন্ডার সঙ্গে বাড়ির গৃহশিক্ষক লরেন্স ব্রাউনের পরকীয়া প্রসঙ্গ।
পার্সি খুনের তদন্তে বড় সূত্র হয়েছিল এডিথ ও বাইওয়াটারের প্রেমপত্রগুলি। উপন্যাসেও দেখা যায় ব্রেন্ডা-লরেন্সের চিঠি চালাচালি। তবে এ ক্ষেত্রে এই যুগলকে ক্রিস্টি খুনি হিসেবে আঁকেননি। এই না আঁকার পিছনেও হয়তো এডিথ-বাইওয়াটার মামলার ক্ষেত্রে জনতার মেজাজটুকু খেয়াল রেখেছিলেন তিনি।
জনতার ভয়, ঘৃণা, ভালবাসা, আবেগ ভাল ভাবেই আন্দাজ করেছেন আগাথা ক্রিস্টি। এর অন্যতম প্রমাণ, ‘দ্য এবিসি মার্ডার্স’ উপন্যাসটি। সেখানে পর পর খুন হন দু’জন মহিলা ও এক ধনী ব্যক্তি। রহস্যের জাল ছেঁড়ার আগে আমরা এরকুল পোয়ারো ও তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন আর্থার হেস্টিংসকে খুনের বিষয়ে আলোচনা করতে দেখি। সেখানে পোয়ারো বন্ধুকে মনে করাতে চান ‘জ্যাক দ্য রিপারের দীর্ঘ, ধারাবাহিক সাফল্যের কথা!’ পোয়ারোর মুখে এই নামটির উচ্চারণ করিয়ে ক্রিস্টি মনে করাতে চেয়েছেন লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল এলাকায় এগারো জন মহিলাকে হত্যা করা কুখ্যাত সেই খুনির কথা। কারণ, একটাই, উপন্যাসের ‘সিরিয়াল কিলার’ ফ্র্যাঙ্কলিন ক্লার্কের ভয়াবহতাটুকু জিইয়ে রাখা। ‘লেদার অ্যাপ্রন’ জ্যাকের তুলনা কাজে এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। বাস্তবের কুখ্যাত বা বিখ্যাত মানুষদের ক্রিস্টি লেখায় ঠাঁই দিয়েছেন একাধিক বার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিখ্যাত ব্রিটিশ গুপ্তচর টমাস এডওয়ার্ডস লরেন্স। ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ নামে খ্যাত টমাসের কর্মজীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে পশ্চিম এশিয়ায়। সেই অভিজ্ঞতার খানিকটা তিনি লিখলেন ‘সেভেন পিলার্স অব উইসডম’ বইতে। মারকাটারি গল্প আছে সেই বই প্রকাশ ঘিরেও। ১৯৩৫ সালে এক দিন, নিজের প্রিয় ব্রো সুপিরিয়র এসএস ১০০০ মোটরবাইকটি নিয়ে শহর পরিক্রমায় বার হলেন লরেন্স। আচমকা বিপত্তি, সামনেই দু’জন সাইকেল আরোহী। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা হাসপাতাল। সেখানেই মৃত্যু হল লরেন্সের। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ জনতার একাংশ এই মৃত্যুকে ‘ভুয়ো’ ভেবেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, জাতীয় ‘হিরো’ টমাসকে ফের পশ্চিম এশিয়ায় পাঠানো হয়েছে, কোনও গোপন কাজে।
পাঠকের এই ভাবনাটুকুই উস্কে দিলেন আগাথা ক্রিস্টি। বহু বছর পরে, ১৯৫১ সালে ফিরে এলেন লরেন্স, ক্রিস্টির উপন্যাস ‘দে কেম টু বাগদাদ’-এ। এ বার তাঁর নাম, হেনরি ‘ফকির’ কারমাইকেল। পেশায়, ব্রিটিশ গুপ্তচর। হোটেলের ঘরে ফকিরের মৃত্যু দিয়েই উপন্যাসের রোমাঞ্চ চড়াতে থাকলেন ক্রিস্টি।
তবে বাস্তবের মৃত্যু, খুন, অপহরণ থেকে উপাদান সংগ্রহের তালিকাতেই বিগত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই লেখক সীমাবদ্ধ, ভাবলে ভুল হবে। ১৯৭৬-এ ক্রিস্টির মৃত্যুর এক বছর পরের একটি ঘটনা।
ঘটনাস্থল, লন্ডনের একটি হাসপাতাল। উনিশ মাসের এক শিশুকন্যাকে নিয়ে গলদ্ঘর্ম চিকিৎসকেরা। কোনও ভাবে হাতের কাছে ইঁদুর-মারা ওষুধ পেয়ে মুখে দিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু বিষটা কী, কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ডাক্তারেরা। অদূরেই কাজের অবসরে রহস্যকাহিনি পড়ছিলেন এক নার্স। শিশুটির অবস্থা ও দিকে ক্রমশই অবনতির দিকে। মাথা থেকে চুল খসে পড়ছে! সেই দেখে চিৎকার করে উঠলেন নার্সটি: ‘থ্যালিয়াম সালফেট’! সকলের টনক নড়ল। রক্ষা পেল মেয়েটি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল।
বইটি— আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য পেল হর্স’। স্বাদহীন, বর্ণহীন থ্যালিয়াম জাতীয় বিষ মানবদেহে গেলে পর পর নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে কী হয়েছে, তা বুঝতে গিয়ে ফাঁপরে পড়েন চিকিৎসকেরা। কিন্তু ভবিষ্যতে তাঁর উপন্যাস পড়ে কেউ ফাঁপরে না পড়ে, সে জন্যই বোধহয় নিখুঁত ভাবে থ্যালিয়ামের উপসর্গগুলি লিখে গিয়েছিলেন ক্রিস্টি। আর সেটাই সঞ্জীবনী— উনিশ মাসের সেই শিশুটির, এবং পাঠকদের জন্যও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy