সাম্প্রতিক ছ্যাঁকাওলা পাঁচ-ছ’টা বিষয় আলাদা আলাদা চিরকুটে লিখুন, চোর-পুলিশ-দারোগা খেলার ঢঙে: এনআরসি, কুকুরশাবকের প্রতি অত্যাচার, ফুটবল ক্লাব বিক্রি, ফিল্মস্টার-ফিল্মস্টার বিয়ে, মেয়েদের রাজনৈতিক প্রতিবাদ, শিশুর মোবাইলাসক্তি, বিশ্ব উষ্ণায়ন। এ বার বাড়ির সাড়ে তিন বছরের ছেলে বা পোষা বেড়ালকে দিয়ে (অর্থাৎ, যার কোনও পক্ষপাত নেই) একটা চিরকুট তোলান। টপিক-টির দিকে কিছু ক্ষণ মুগ্ধ তাকিয়ে থাকুন। ফোঁস শ্বাস ফেলে ভাবুন, আপনি ছাড়া কে-ই বা সমসময়কে নিখুঁত ধরবেন ২২৪ পাতায়? অবশ্য গাধারা এখনও কুন্দেরা-কে নিয়ে নাচে। সে যাক।
এ বার চট করে চেনা সাংবাদিককে ফোন। বা সেই বন্ধুকে, যে টিভি চ্যানেলের কত্তার তুতোভাই। কারণ এই হল ইন্টারভিউ দেওয়ার মহালগ্ন। গণমাধ্যমে চড়াং চড়াং বাজুক, আপনি কী নিয়ে বিস্ফোরক উপন্যাস লিখছেন। সে ইন্টারভিউ কাগজে ঝলসাক, টিভিতেও। আঃ, কে বললে, কথা বলার রসদ আপনার নেই? আগে লিখতে হবে, পরে সে-বিষয়ে কথা বলতে হবে, এ হল বাণিজ্য না-জানা মানুষের কুসংস্কার। ‘চলচিত্তচঞ্চরি’ নাটকে ভবদুলাল যা বলেছিল, তার আত্মাটাকে উল্টে ধরুন। সে জিজ্ঞেস করেছিল, তার লেখা বই লাইব্রেরিতে নেই কেন? যখন বলা হল, ‘দিন না এক কপি’, সে জানাল, এখনও ছাপা হয়নি। ‘ও, এখনও ছাপতে দেননি বুঝি?’ শুনে বলল, লেখা হলেই ছাপতে দেবে। আগে একটা ভূমিকা লিখতে হবে তো? সেটা কী রকম লিখবে তা-ই ভাবছে। এই নাটকের লেখক অতি প্রতিভাবান হলেও, নিতান্ত সুকুমারমতি। তিনি বোঝেনইনি, যাকে ব্যঙ্গের ছপটি মারছেন, আসলে তা-ই সংস্কৃতি-বিপণনের মূল কথা। মার্কেটিং শুরু হয় শিল্প-রচনা শেষের পরে নয়, শিল্প-রচনা শুরুরও আগে। তখন থেকে সদর্থক তরঙ্গ— বা সোজাসুজিই বলা যাক— বাঁইবাঁই হুজুগ তৈরি করতে পারলে, তবেই শেষ হওয়ার পর লেখাটি (বা গানটি, ফিল্মটি, পুতুলনাচটি) হাটেবাজারে পড়তে পাবে না, জনগণ উদ্গ্রীব গপাগপ। হট করে মনে হতে পারে, এ প্রবণতা অশালীন, বা অন্তত শিল্পীর পক্ষে বেমানান। শিল্পী বলতে আমরা বুঝি, ক’কপি বই বিক্রি হল, তা সম্পর্কে পূর্ণ উদাসীন এক উস্কোখুস্কো কর্মনিমগ্ন ব্যক্তি। ভুল। বই দু’কপি বিক্রি হওয়া আর দু’কোটি কপি বিক্রি হওয়ার যে পার্থক্য, তা শিল্পীর মনে পরবর্তী বই লেখাকালীন হৃদি-নিসর্গের মারকাটারি তফাত গড়ে দেয়। সাফল্য ও স্বীকৃতি না পেলে মন খারাপ হয়। আর খারাপ মন থেকে ভাল শিল্প সাধারণত বেরোয় না। ঝাপসা বাঙালির ন্যাকা প্রচারবিমুখতার মধ্যে আছে শারীরিক ও মানসিক আলস্য, আর অসামাজিকতা। এ সব কাটিয়ে, তেড়ে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করুন। গল্পটা অবশ্যই বলতে পারবেন না, লেখেনই তো নি। সঞ্চালক চাপাচাপি করলে উত্তর দিন, ‘‘আঃ, কাহিনি তো পুরোপুরি এখনও তৈরি হয়নি, কাজ চলছে, আর আমি তো অন্যদের মতো আধা-প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলি না, তবে এটুকু বলতে পারি সচেতন পাঠক এতে পরাবাস্তবতার একটা ছোঁয়া পেতে পারেন।’’ বুদ্ধিমান মানুষ যেখানটাই বুঝতে পারে না, সেখানটাকে পরাবাস্তব বলে। তাই যদিও আপনি দালি-র তিনটে ছবি দেখা ছাড়া সুররিয়ালিজ়্মের ছ’শো মাইলের মধ্যেও হামা দেননি, টার্মটা ঘচাং লাগিয়ে দিন। এ ছাড়া কিছুতেই না-বলতে চেয়েও বলুন, এ বই শুচিবায়ুগ্রস্তদের হয়তো মনপসন্দ হবে না। তক্ষুনি লোকে সুলসুলিয়ে উঠবে: সেক্স আছে। ইতিউতি আরও কিছু ছড়ান, যেমন, নায়ক এক রাতে একটা স্বপ্ন দেখে, যা তার বাস্তব জীবনে হুবহু পুনরাবৃত্ত হয়। এই বইয়ের ঘটনাগুলো সবই প্রায় খবরের কাগজের বিভিন্ন ছোট ছোট রিপোর্ট থেকে নেওয়া, যেগুলোর কাটিং আপনি বেছে বেছে জমিয়ে রাখেন নিয়মিত, যদিও দুটো নোটসের খাতা বাড়ি বদলের সময় হারিয়ে গেছে, যাকগে কী করা যাবে? একটু নিরাসক্তি আর মুচকি মিশিয়ে নিজের হোমওয়ার্ক, সাধনা, প্রতিকূলতা-মোকাবিলার ডায়লগ হেনে পৌনে-শ্বাস ছাড়ুন। ও হ্যাঁ, টিভিতে মাঝে মাঝে একটু তোতলাতে ভুলবেন না। তরতরিয়ে টানা বলে যায় শুধু মধ্যমেধার মুখস্থ-পার্টি, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে ভোগেন আসলি জ্ঞানীরা, কারণ তাঁদের মাথায় কমলকুমার শোপেনআওয়ার ও বারীন সাহা ঠেলাঠেলি করেন, বিবিধ প্রসঙ্গের নাগাড় কুস্তিতে ঘাই মারে এই নিৎশে ওই গীত শেঠি।
এই বার মূল খাটনি। ফেসবুক খুলুন। পরের বছর এই দিনে আপনার বই বেরোবে। এই এক বছর আপনাকে টানা, আপ্রাণ, নাছোড় ফেসবুকিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, ডেডলাইন এসে গেলে বইটা ঠিকই আপনি রাত জেগে, আদাজল খেয়ে শেষ করে দিতে পারবেন। না পারলে, তারও চমৎকার সাফাই আছে, ‘নভেলের এন্ড হয় তা-ই আমি বিশ্বাস করি না’ দুরন্ত হেডলাইন। কিন্তু ফেসবুকের সিনসিনারি থেকে যে অদৃশ্য হয়ে যায়, যে ছেদহীন ভাবে ফেসবুকে বকবকময়, ক্রোধী, সর্ব-কমেন্টুয়া, ছবিয়াল, উত্তেজিত, অপমানকারী, দীর্ঘ-পোস্টালু, চলতি-হাওয়ায়-পানসি-বাওয়া হতে পারে না, তাকে শেষ অবধি নিজ লেখা পড়ে শোনাতে হবে পালঙ্কের ছত্রিকে। প্রথমেই পোস্ট দিন, এক বচ্ছর উপন্যাস লিখতে এত ব্যস্ত থাকবেন যে ফেসবুক অ্যাক্কেরে করতে পারবেন না। মনটা নিভে আসছে, বিশেষত সেই বন্ধু ও ভক্তদের কথা ভেবে, যারা আপনার মতের পথ চেয়ে চোখ টাটিয়ে জয়বাংলা করে ফেলল এবং আপনার টিপ্পনী না সাপ্টালে যারা এ ঘোটালাপূর্ণ কালখণ্ডকে টুকুন বুঝতেই পারত না। কিন্তু মসিহারও তো মূল কর্মের আহ্বান আসে, অন্তরের সেই আকুলিকে তো সে কুলকুচো করে ফেলে দিতে পারে না। শুনেই যে ছেষট্টি হাজার হাহাকার (আপনি বিহনে কেমনে কাটিবে শতেক পিছল মিছিল-নিশা) ধ্বনিত হবে, তারিয়ে তারিয়ে ওম পোয়ান এবং প্রতি আধ ঘণ্টায় আপডেট দিতে থাকুন, মাস্টারপিস কী তরিকায় নির্গত হচ্ছে। লিখতে গিয়ে আপনার শৈশবের গবাক্ষ-গ্রিলের ছায়া এসে এ-ফোর পৃষ্ঠায় পড়ল, জারুল গাছ বলতেই ভিনসম্প্রদায়ের কিশোর-সখার কথা মনে পড়ে গেল (বেচারা দাঙ্গায় মার্ডার হয়) এবং সেই অনুষঙ্গে দেশের বিষাক্ত বিদ্বেষ এত পীড়িত করল যে মাথাব্যথায় দিনের পাণ্ডুলিপি-কোটা পূর্ণই হল না (অথচ ফেসবুকনি দিব্যি চালু, কারণ এটা না বিজ্ঞাপিলে তো পৃথিবী গ্রহের খরখরে ক্ষেতি হয়ে যেত), একটা অধ্যায়ে নিজের বাক্যগঠন দেখে আঁক্স বুঝলেন নিঃশব্দে কবে যত্নকোটরে সেঁধায়েছে রবীন্দ্রনাথের ঝিল্লিঝঙ্কার ও বটতলার লঙ্কাটঙ্কারের মকটেল, তীব্র অপ্রিয় স্মৃতি ভেবে নিংড়ে কাঁদলেন গোটা রজনী ও ব্ল্যাক কফি গিলে ভোরে হুবহু ওগরালেন সেই আবেগ। খাবলা খাবলা লাইন তুলে দিন। টিজ়ার। প্রোমো। যারা পড়ে বলবে এমন সাহিত্য ভূভারতে গজায়নি কো কভু, তাদের মৃদু তিরস্কার করুন (‘ছি ভাই, আপনি হট্কে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করার আগে ধূর্জটিপ্রসাদের নামটা মনে করবেন। ব্যথিত হলাম, একটি প্রেক্ষিত-বিচ্যুত লাইন পড়ে এতটা প্রশস্তি!’)। চিন্তা নেই, আপনি কেন মরতে প্রেক্ষিত থেকে ছিঁড়ে খাপচা লাইন পোস্ট করছেন, কেউ প্রশ্ন করবে না। আপনার বিনয়ে তারা ভ্যাবচ্যাক মেরে আছে, প্লাস বেহ্মতালু খিমচে ভাবছে, ধূর্জটিপ্রসাদটা আবার কে!
৪। যদি ছেলে হন, ফেসবুকে পরিবারের কাছে মুহুর্মুহু ক্ষমা ভিক্ষা করুন। পোস্ত আনছেন না, মশারি টাঙাচ্ছেন না, সমুদয় ডিউটি ধামসে নিজেকে লেখার টেবিলে নিবিড় স্টেপ্ল করেছেন দিবারাত্রি, আর স্নিগ্ধ সমঝদার হাসি হেসে স্ত্রী একা সামলে নিচ্ছেন সুনামি, দুই সন্তান টিপে টিপে হাঁটছে এবং নিচু স্বরে ব্যতীত বাঁদরামি করছে না: সিনারিয়ো বিশদ বর্ণনার পর বলুন, আপনার আচাভুয়া অপরাধের মার্জনা হয় না, তবে শিল্পের খাতিরে এই তুলনাহীন আত্মত্যাগত্রয় দেখতে পাওয়াও এক তুঙ্গ-সৌভাগ্য।
যদি মেয়ে হন, পুরো উল্টো-ছক। এই চার-অক্ষরী সংসার আপনার সৃষ্টিশীলতাকে বারংবার থেঁতলাতে চেয়েছে নৃশংস, এখনও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না, স্বামীর কাছ থেকে প্রেমের সময় যে সহগামী হওয়ার প্রতিশ্রুতি, চির-বন্ধুতার আশ্বাস পেয়েছিলেন, তা যে কতটা পরিকল্পিত তঞ্চকতাময়, আজ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, যখন কাফকার তটে উপবিষ্ট অবস্থায় আপনাকে ওমলেট ভাজতে যেতে হল। পেট্রিয়ার্কিকে আছড়ে শেষ করুন, সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার রণহুঙ্কার। মাঝে মাঝে ভার্জিনিয়া উল্ফ ও আশাপূর্ণা দেবীর ছবি পোস্ট করুন। মনে রাখবেন, ‘উলফ’-এ দুটো ‘ও’, নইলে সে-ও পুংতন্ত্রের ধারেকাছে শ্বাপদপ্রতিম হয়ে যাবে।
৫। প্রচ্ছদ কে করবে, সিরিয়াসলি ভাবুন। এম এফ হুসেন তো মারা গেছেন, চেনা কাউকে দিয়েই করাতে হবে। তাকে বলুন উদ্ভিন্নযৌবনা, বিস্রস্তবসনা, মদিরেক্ষণা কাউকে ঝলমলিয়ে আঁকতে। কথাগুলোর মানে বুঝছেন না? ডিকশনারিও গুদামে? পরোয়া নেই, জেনিফার লোপেজ় আর ক্যাটরিনা কাইফকে মিশিয়ে দিতে বলুন। এখানে একটা জরুরি পরামর্শ। সেক্স অবশ্যই থাকবে লেখায়, কিন্তু তার ডোজ় হবে হাফ-ট্যাবলেট। প্রাথমিক বিছানায় যাওয়ার বর্ণনাটা দিয়েই সিন কেটে দিন। পরের চ্যাপটারে চলে যান। যেন জীবনসত্যের খাতিরে এ উগ্রকর্ম করলেও, আসলে আপনার তামsickতা দেখলেই ন্যাকার ওঠে। চ্যাংমুড়ি কানিকে বাঁ হাতে ফুল ছুড়ে দিচ্ছেন মাত্র, বাস্তবের উপরোধে। অনেকগুলো যৌন দৃশ্য রাখুন, কিন্তু প্রতিটি সেন্সরসিদ্ধ। আঁচল সরেছে কি সরেনি, আপনি সরে পড়ুন। মঞ্চে এন্ট্রি নিক কাব্যিক ঘোলাটে। লিসা ও রিহান পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে ঠোঁট-গাল-চিবুকের স্বাদে মেগা-মশগুল, তাদের ঘেমো পোশাকও ছিটকে ঈশ্বরের ছবির গায়ে, কিন্তু তার পরে ‘সেই ঘরে নেমে আসে এক বজ্রবিদ্যুৎ সহ আকাশ। তোলপাড় হয় সমুদ্রের তরঙ্গ-কলিজা। মাঝে মাঝে শোনা যায় রাতপাখির উদ্বেল ডানা-ঝাপটানি।’ ফ্রয়েড এবং বাঙালি এর থেকে তেরোটা গাঢ় মানে নিষ্কাশিবে।
৬। লিখতে লিখতে আটকে যান। ইনস্টা-য় অ্যাকাউন্ট আছে তো? সেখানে দিচ্ছিলেন তো নিজের লিখন-রত ছবি? ধীরে চেহারাটা করে তুলুন উলোঝুলো, বুঝভোম্বল, বোতাম অন্য ঘরে লাগিয়ে ফেলা। ধাঁ করে ঘোষণা করুন, রাইটার্স ব্লক হয়েছে। কিছুতেই আর নিজেকে নিংড়েও একটিমাত্র অক্ষর-প্রসবও না-মুমকিন। সে কী! ক্যানোওওও? ঝরঝরিয়ে লেখা এগোচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আপনি কিচ্ছুটি লিখছেন না, কে যেন আপনার আঙুলে সুতো বেঁধে নিপুণ নাড়াচ্ছে, কি-বোর্ডের অক্ষরেরা আপনাআপনি কুচকাওয়াজ চালাচ্ছে সুশৃঙ্খল চারু মোক্ষম ও পূর্বনির্ধারিত বিন্যাসে, নিজেই পড়ে চমকে যাচ্ছিলেন ঐন্দ্রজালিক অনুচ্ছেদ দৈব বাক্যবন্ধ চাম্পি পঙ্ক্তি, ঈশ্বরের এই অনঘ অনর্গল ডিক্টেশন ফটাস বন্ধ! কাল অবধি ভাবছিলেন, একের জায়গায় তিনটে উপন্যাস হুমড়ি খাচ্ছে, ট্রিলজির ট্রি শেকড় ও তুঙ্গপল্লব-সহ ঝুলুঝুলু ব্যালকনির টবে, এর মাঝে হল কী? ইন্সপিরেশন মোলো কি? চুল ছিঁড়ে, ললাট ঠুকে, পার্কে পায়চারি মেরে নড়া ব্যথা করে, ইমেজের সন্ধানে কোলে মার্কেট ঢাকুরিয়া লেক ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর অফিসে ঝাঁপিয়ে (প্রতি স্থানে যথাযথ সেলফি তুলে) কিছুতে কিছু হল না যখন, দু’দিন ফেসবুক থেকে সিএল নিন। ফিরে এসে, শুধু লিখুন, ‘কারও কোনও ভাল সাইকায়াট্রিস্ট জানা আছে রে?’ প্লাবন নামবে। ওগো তোমার কী হল গো। আপনি ভাল হয়ে উঠুন, আমার পাঁঠার মাংস বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। ক’দিন পুরী ঘুরে আসুন, লক্ষ্মী। এ তো নীরব কেন কবি টু! আমি যাব এক বার? একটি বার? তিন দিন গ্যাপ ফের। সাসপেন্স যখন আছাড়িপিছাড়ি, স্টিলের বাসন ফসকে যাওয়ার মতো ঝনাৎ স্বীকারোক্তি। নার্ভাস ব্রেকডাউন আগেও হয়েছে দু’বার। এক বার আত্মহত্যা করতে গেছিলেন। আসলে জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবটা তো... ফুটকি আরও তেত্তিরিশটা দিতে পারেন। না, ন্না, হাজার অনুরোধেও, এমনকি ফেসবুকের পরমাত্মীয়দের কাছেও, আর কিচ্ছুটি ভাঙতে পারবেন না। আপনি অ্যাবিউজ়ড চাইল্ড? অঙ্কে প্রতি উইকলি-তে সাড়ে পাঁচ? ক্যানসার সার্ভাইভর? টিয়াপাখি পুষে চান করাতেই দেখেন কাকের গায়ে কে সবুজ পোঁচ মেরে দিয়েছিল? কোনও অনুমানের উত্তর নেই, টোটাল চুপ, আপনি যে বসিয়ে বিজনে থাকুয়া একলে, আর আপনার জন্যেই যে বাংলা ভাষা নিয়ে থরথর কাঁপছেন মেকলে, এই ট্র্যাজেডি-তৈলে সংস্কৃতিকে ভাজুন। চাইলে সেই সাংবাদিক বন্ধুটিকে ফোন করুন, যে রচনা-গোড়ায় আপনার ঝক্কাস ছবি পেজ থ্রি ফোর ফাইভে ছাপিয়ে দিয়েছিল। এ বার অবশ্য আরও ভাল মেক-আপ লাগবে। চোখে কালি, ত্বকে খড়ি, কমোডে বসে কামু পড়ি। হপ্তা দুয়েক পর, শ্যাম্পু-ট্যাম্পু মেরে কানটানা হাসির পোজ় দিয়ে আচমকা পোস্ট দিন, পরশু থেকে ভূত আপনার ঘাড়ে ভর করে লিখিয়ে নিয়েছে টানা ১২৬ পাতা, এখনও পড়ে দেখেননি, কিন্তু বুঝেছেন, না লিখে মুক্তি নেই, এই উপন্যাসই আপনার আত্মার আজিনো মোটো, আপনার প্রাণের টর্চ শুধু এর তরেই কোঁত পেড়ে জ্বলছিল। ফের এক দফা ইন্টারভিউ। মনের দৈত্য ও সাহিত্যের সইত্য।
৭। এ সবের মধ্যে উপন্যাসটা লিখেও ফেলতে হবে। তবে তা ভাল হতে হবে: এমন উদ্ভট দায় ঘাড়ে নেবেন না। অ্যালাব্যালা যা খুশি লিখুন। এমনিতেও তো গত ২৬ বছর কোনও ভাল লেখা পড়েননি, শুধু সমসাময়িক বাংলা লেখা মেপে নেন। তাই চিন্তার ইঞ্জিন দরিদ্র ও নিষ্প্রাণ হয়েই আছে। ক্লিশে ছাড়া কিস্যুই বেরোবে না। কিন্তু যা নিয়ে লিখছেন, তা ছাড়াও, একদম প্রথমে যে বিষয়গুলো লটারির চিরকুটে রেখেছিলেন, অল্প অল্প চুঁইয়ে দিতে দিতে যান। আলিপুর চিড়িয়াখানায় জন্তুদের খেতে দেওয়া হচ্ছে না, আসলে খাবারগুলো চলে যাচ্ছে পাইস হোটেলে— বইটা যদি আদতে এই নিয়ে থ্রিলারও হয়, চিড়িয়াখানা দেখতে আসা দুই কিশোরের মধ্যে সন্ধের ঝোঁকে সমকাম তো ঝলকানো যায় অনায়াসে। আবার প্রবীণ দম্পতি নাতনিকে নিয়ে হাতি দেখতে এসে এনআরসি-র মিছিলে আটকে পড়ে ভাবতে পারেন, দেশ ও দশের জন্যে অ্যাদ্দিন কী করলাম? তাঁদের নকশাল ছেলের ফ্ল্যাশব্যাকও উথলে ওঠে। যতগুলো পারবেন মশলাপাতি ছিটিয়ে দিন, কোনটা ফটাস হিট করে যাবে কেউ জানে না। একটা হালকা-ফুলকা রোম্যান্স রাখুন, আর সে-যুগলকে করুন সাড়ে-সচেতন। বোঝান, আজকালকার ছেলেমেয়ে কলেজ যেতে যেতে ভিখিরিকে টিফিন দিয়ে দেয়, বা গলন্ত পিচে আটকানো গঙ্গাফড়িংকে তুলে পকেটাশ্রয়ে রাখে। অ্যাপো করেও মোমবাতি মিছিলে চলে গেলে এতটুকু রাগে না। নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসও হল (গ্রেট শিল্পে বাধ্যতামূলক), জেন-ওয়াই’কে তোল্লাই দেওয়াও হল। এরা পেল্লায় জনমত তৈরি করে। আর হ্যাঁ, কয়েক জন চলতি সেলেবের নাম ব্যবহার করুন। ঋদ্ধিমান, দীপা প্রামাণিক, যিশু, মিমি। কারণ আছে।
৮। সর্বাধিক নামী কাগজের প্রভাবশালী লোকের ফোন নম্বর জোগাড় করে, ডেলি তাঁর লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করুন। যে-দিন তাঁর লেখা বেরোবে, ভোর-ভোর মেসেজ। অ্যাত্ত বড়, যেন ‘রিড মোর’-এ ক্লিক করতে হয়। এমন চিন্তাশীল আপনি কাউকে কখনও দেখেননি। বললে ধৃষ্টতা মনে হবে, কিন্তু সক্রেটিসও কি এতখানি...নাঃ। চালিয়ে যান তিন মাস। তার পর, যদি দেখেন হুঁ-হাঁ ছাড়াও উত্তর আসছে, কথা পাড়ুন। বইয়ের পাতা কে দেখেন? অভিমানী স্বরে লিখুন, আপনারা তো চেনা না থাকলে রিভিউ ছাপেন না, না? আপনার লাইন-পাঁচেক ‘টিজ়ার’ হিসেবে পাঠান। যদি উনি হাটিয়ে দেন, মুহূর্তে চলে যান চার-পাঁচ জন নামী ব্লগারের কাছে। একই ফর্মুলা। ব্লগের পুজো, শেষপাতে লজ্জা-লজ্জা আকুতি। সঙ্গে খবরের কাগজের নোংরামির নিন্দে ও সমাজমাধ্যমের পেশিশক্তির তোল্লাই। এরই সঙ্গে মন দিন বইটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। কে ওপন করবেন? সৌমিত্র বা অপর্ণা? সেলুলয়েড আর সুসংস্কৃতির কম্বো-আলোক এঁদের যা জম্পেশ জ্যোতি নির্মাণ করেছে, তার তুলনা কোথায়? পাবলিশার কি এঁদের নাগাল পাবেন? বইয়ে যে তিন খেলোয়াড়, সাত ফিল্ম অভিনেতা, দুই পলিটিশিয়ান, পাঁচ লেখক, চার গায়ক, আড়াই সমাজকর্মীর নাম ঢুকিয়েছিলেন, সবাইকে আস্তে আস্তে ট্রাই করুন। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন গ্ল্যামারাস।
৯। ওপনিং-এর দিন উপস্থিত প্রত্যেক সাংবাদিকের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান কথা বলুন, শেষে ঢালাও মদের ব্যবস্থা রাখুন। আপনার বক্তৃতার প্রথমটায় গলাটা ধরিয়ে ফেলুন। চোখ পিটপিট করে জল চান। ঠোঁট মুছে, প্রায় শোনা যায় না কিন্তু আসলে পুরোটা শোনা যায় এমন স্বরে বলুন (রিহার্সাল মাস্ট), ‘‘বড্ড নবনীতাদির কথা মনে পড়ছে। উনি আমার হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রেখে বলেছিলেন, কথা দে এই উপন্যাসটা তুই শেষ করবি!’’ কিছু ক্ষণ স্তব্ধতা। শুধু মাইকে আপনার গোখরো-দীর্ঘশ্বাস। তার পর মদের স্পনসরকে ধন্যবাদ জানাতে শুরু করুন।
১০। বইমেলার প্রথম দিন সন্ধে নাগাদ পোস্ট দিন, মাঠে এসে যেই শুনলেন এক ঘণ্টায় প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ, পুলকে বিস্ময়ে সার্থকতায় গলা চোক, চোখে গলগল। দাঁড়িয়েছিলেন মুখে রুমাল কামড়ে, অটোগ্রাফেচ্ছুরা ধাপ্পা খেয়ে একসা। না না, মিথ্যে তথ্য দিতে বলিনি, ১১ কপি ছাপা হয়েছিল: গৌণ ডিটেল চেপে গেলেই হল। স্টলে স্ট্যাম্পিড, নদিয়া থেকে আসা যোজনগন্ধা দাসের চোয়াল-চিড়ের আখ্যান অন্তে, ছ’শো বার বলুন, দুঃস্বপ্নে ভাবেননি, আপনার বই বেস্টসেলার! এ সব সাফল্য তো ঝানু ফাঁপা ভণ্ড টিআরপি-বাজ বাজারি লেখকরা পায়। ফেবু-সখাসখীরা ‘আ ছি আ ছি, কোথায় অরুন্ধতী রায় আর কোথায় ফালতো কৃশকায়’ সান্ত্বনালে, লজ্জার ইমোজি ও স্মাইলি পাঞ্চ করুন। রাতে, সাত চিরকুটে সে বছরের কারেন্ট টপিক লিখে, কুকুরকে তু-তু ডাকুন। অমর্ত্য আর আপনার কপালে তো বিশ্রাম নেই! সমাজ, সমকাল ও সম্ভোগশপিং-এর দাবি শুনিতে কি পাও? ভল্যুম বাড়াব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy