সাহিত্যিক রাধারমণ রায় লিখেছেন, “সেনযুগে দুর্গাপুজো পরিণত হয় রাজ-রাজড়া আর দস্যু-তস্করের পুজোয়। রাজ-রাজড়ারা এই পুজো করতেন বছরের শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তকালে। যখন প্রকৃতি ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠত, তখন গরিব প্রজাদের কাছ থেকে খাজনার নামে ছিনিয়ে আনা রক্তরাঙা টাকায় রাজা-জমিদাররা দুর্গাপুজো করতেন জৌলুস-জাহিরের জন্যে। তখন এই পুজোর নাম ছিল বাসন্তী।” তিনি আরও জানাচ্ছেন, সেনযুগে সূচিত এই বাসন্তী দুর্গাপুজো আকবরের আমলে প্রায় ন’লক্ষ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন করেন ভাদুরিয়া-রাজশাহীর সামন্তরাজা জগৎনারায়ণ।
আকবরের রাজত্বকালেই ১৫৮০ সাল নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা করেন বলে জানা যায়। তা হলে কংসনারায়ণের পূর্বে শারদীয়া দুর্গাপুজোর অস্তিত্ব কি ছিল না? রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এ দেশে বসন্তকালে হত দুর্গাপুজো আর শরৎকালে হত নবপত্রিকা পুজো, যার স্থান আজ গণেশের পাশে। নবপত্রিকাই কালক্রমে চার পুত্র-কন্যাসহ দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে রূপান্তরিত। যে হেতু আকবরের রাজত্বকালেই কংসনারায়ণ মূর্তি গড়ে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন, তাই অনুমান করা চলে যে, ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণ যতই জাঁকজমক করে বাসন্তী পুজো করুন না কেন, তার স্থায়িত্ব বেশি দিন ছিল না। শারদীয়া দুর্গাপুজো অচিরেই হিন্দু জমিদার এবং স্থানীয় রাজাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। বহু অর্থব্যয়ে জগৎনারায়ণের বাসন্তী পুজোর দেখাদেখি কংসনারায়ণ আয়োজন করেছিলেন আশ্বিনের শারদীয়া দুর্গাপুজোর, যা আজ বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। অথচ জগৎনারায়ণের বাসন্তী পুজো আজ প্রায় অস্তিত্বহীন।
শাস্ত্রীয় বিশ্বাসের সূত্র ধরে যে সময়টা উত্তরায়ণ, অর্থাৎ দেবতারা জেগে থাকেন, সেই সময়েই তো বাসন্তী পুজোর নির্ঘণ্ট। তাই বাসন্তী পুজোয় দেবীর অকালবোধনের উপাচার নেই। আবার শীতের পরে বসন্তের অতি মনোরম, ঝড়-ঝঞ্ঝামুক্ত আবহাওয়াতেই এই পুজোর ব্যবস্থা হয়েছিল। শরৎকালে কিন্তু আবহাওয়া সর্বদা অনুকূল থাকে না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপে উৎসবে তৈরি হয় বিঘ্ন। তা ছাড়া এই সময়টা দক্ষিণায়ন, দেবতারা নিদ্রিত। ফলে প্রয়োজন অকাল বোধনের।
পুরাণ মতে রাজা সুরথ করেন বাসন্তী পুজো এবং রাবণ বধের আগে রামচন্দ্র করেন শারদীয়া দুর্গাপুজো। সেনযুগে যে বাসন্তী দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল, সেখানে রামের জন্মতিথিকে এই পুজোর নবমীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা রামনবমী নামে পরিচিত। সেনযুগে পাল আমলের বৌদ্ধ আধিপত্যের স্থানে বাংলায় হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার ফলস্বরূপ উত্তর ভারতের বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক আরাধনাকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই ফলস্বরূপ বাসন্তী দুর্গার নবমীর সঙ্গে একাত্মতা তৈরি হয় রামের জন্মতিথির। একই উদ্দেশ্যে রামের অকালবোধনের বিষয়টি যুক্ত হয় শারদীয়া দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে। বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাম কর্তৃক দেবীকে আরাধনা করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে, মূল বাল্মীকির রামায়ণে তা নেই।
আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, জগৎনারায়ণ এবং কংসনারায়ণ দু’জনেই অধুনা পূর্ববঙ্গের সামন্তরাজা হওয়া সত্ত্বেও এক জনের পুজো পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে, অন্য জনের পৃষ্ঠপোষিত উৎসব বিস্মৃতির অতলে। তবে শারদীয়া দুর্গাপুজোর গুরুত্ব বৃদ্ধির পিছনে মোগল আমলে রাজস্ব প্রদানের যে নতুন নিয়ম বলবৎ হয়, তারও খানিকটা ভূমিকা ছিল। নতুন নিয়মে দিল্লিতে মোগল সম্রাটের কাছে প্রাদেশিক শাসনকর্তা, অর্থাৎ নবাবকে ভাদ্র মাসের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব পাঠানোর নির্দেশ জারি হয়। অর্থাৎ স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের তার আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা জমা দিতে হত। এই নির্দিষ্ট খাজনা বাদ দিয়ে রাজস্বের বাকি অংশ ছিল স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের প্রাপ্য। তাই সঞ্চিত রাজস্বের অনুষঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে শরতের এই সময়টি ছিল বসন্তের তুলনায় উৎসব উদ্যাপনের উপযুক্ততর সময়। অতএব হিন্দু রাজা-জমিদারদের একটা বড় অংশ নিজেদের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শারদীয়া দুর্গাপুজোর প্রতি সমর্থন দেওয়া শুরু করেন। আবার এই মোগল রাজস্ব ব্যবস্থার হাত ধরেই যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল। তার সূত্রে কৃষ্ণনগর-সহ বেশ কিছু নগরভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটে। মধ্যযুগের বাংলায় এই সব হিন্দু অধিপতিরা, নদীকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার ‘গ্রামীণ’ বাসন্তী পুজোর তুলনায় শারদীয়া দুর্গার প্রতিই পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন। প্রসঙ্গত অষ্টাদশ শতকের হিন্দু নেতৃস্থানীয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা স্মরণ করতেই হয়। শাক্ত ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করতে গিয়ে তিনি তন্ত্রমতে দেবী অন্নপূর্ণার যে পুজো করেছিলেন, তার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় বাসন্তী পুজোর অষ্টমী তিথিতে। এর ফলে রাজার পৃষ্ঠপোষিত অন্নপূর্ণাই প্রধান হয়ে ওঠেন, গুরুত্ব নষ্ট হয় প্রাচীন বাসন্তী দুর্গার।
এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আঘাতটি অবশ্যই পলাশির যুদ্ধ এবং ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি হয়, তার ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে শারদীয়া দুর্গাপুজোর একমাত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইংরেজ শাসনে উদ্ভূত নতুন ধনবান ভদ্রশ্রেণির উন্নত সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব প্রদর্শনের উপলক্ষ হয়ে ওঠে বাৎসরিক শারদীয়া দুর্গোৎসব। আসলে ১৭৫৭ সালে পলাশি বিজয়ের উদ্যাপন হেতু ক্লাইভের মুন্সী নবকৃষ্ণ দেব যে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন, সেখানে স্বয়ং ক্লাইভ উপস্থিত ছিলেন। শোনা যায়, ক্লাইভ নাকি দেবীর উদ্দেশে পুজোও নিবেদন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাজা নবকৃষ্ণের দেখাদেখি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনসূত্রে রাতারাতি ধনবান হয়ে ওঠা অন্যান্য দেশীয় ব্যক্তিবর্গের বাড়িতেও দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। সেই পুজো যেমন ছিল তাদের কাছে সামাজিক কৌলীন্যের প্রতীক, তেমনই ইংরেজ রাজপুরুষদের সেই উৎসবে অংশগ্রহণ দেশীয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি করত, আবার নেটিভদের সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রশ্নে দুর্গাপুজোকেই কাজে লাগাত কোম্পানির সাহেবসুবোরা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইংরেজ রাজপুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ শারদীয়া দুর্গাপুজোকে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় ভূষিত করে, যার ফলে অন্যান্য উৎসব হয়ে পড়ে প্রান্তিক। পর্যবসিত হয় স্থানীয় অথবা আঞ্চলিক উৎসবে। অন্য দিকে যে হেতু কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই সেখানকার শারদীয়া দুর্গোৎসব পরিণতি পায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে, যে উৎসবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের নিমিত্ত সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে। এ-হেন ব্যবস্থা শুধু বাসন্তী দুর্গার ক্ষেত্রে কেন, অন্য কোনও উৎসবে থাকে না। বলতে বাধা নেই যে ইংরেজ শাসনে এই ভাবে শারদীয়া দুর্গাপুজোর আমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হওয়ার ঘটনা বাঙালির বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক যাপনের নিরিখে বিশেষভাবে নেতিবাচক। শুধু বাসন্তী দুর্গাপুজো নয়, হয়তো অচিরে অস্তিত্ব হারাবে এমন অনেক উৎসব, যা স্থানীয় স্তরে আজও টিকে আছে। সে রকম হলে মহানাগরিক শারদীয়া দুর্গার আগ্রাসনের সামনে বাসন্তী পুজোর মতো চিরতরে অস্তমিত হবে আরও অনেক সাংস্কৃতিক উদ্যাপন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy