—ফাইল চিত্র।
সময়টা ১৮৬২। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি ছাত্রদের হাতে-কলমে শেখানো হত, রোগীকে কী ভাবে ওষুধ ও পথ্য দিতে হবে। ক্লাস হত রোজ সকালে। এক সকালে বনমালী চট্টোপাধ্যায় নামে এক ছাত্র নিজের মনে কাজ করছিলেন। হঠাৎ হাসপাতালের এক পরিচারকের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া শুরু। বনমালী মৌখিক হুমকিতে থেমে গেলেও, থামল না পরিচারকটি। বনমালী চলে যাওয়ার পরে সে ওষুধের ঘরে ঢুকে একটা কুইনাইনের পাত্র তুলে নিয়ে সোজা গেল তৎকালীন প্রিন্সিপাল লেক সাহেবের কাছে। অভিযোগ করল, কুইনাইন চুরি করবে বলে বনমালী পাত্রটা সরিয়ে রেখেছিল, পরিচারক এসে পড়ায় পারেনি।
লেক সাহেবের নেকনজর বরাবর মেডিক্যাল কলেজের ইংরেজি ক্লাসের প্রতি। বাংলা ক্লাসের ছাত্রদের তিনি আমলই দিতেন না। তাই অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই পুলিশে খবর দিলেন। এই ঘটনা প্রসঙ্গে ইন্দ্রমিত্র তাঁর বই ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’-এ লিখছেন, ‘প্রিন্সিপাল একটি ছাত্রকে চোর সন্দেহ করে পুলিশের হাতে দিয়ে দিলেন। আর, সবচেয়ে যা খারাপ কথা, প্রিন্সিপাল ওই বাঙলা বিভাগের প্রায় সব ছাত্রকেই গালমন্দ করে বললেন— ইতর, ছোটলোক, চোর, বদমায়েস।’ পুলিশও কোনও তদন্ত না করে, কুইনাইন চুরির দায়ে বনমালীকে দশ দিনের কারাদণ্ড দিল। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় ২২ ডিসেম্বর খবরটি বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
লেক সাহেবের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদে উত্তাল হল মেডিক্যাল কলেজের বাংলা ক্লাস। বিনা দোষে সহপাঠীর কারাদণ্ড মানতে পারলেন না ওই বিভাগের প্রায় শ’দেড়েক ছাত্র। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নেতৃত্বে সে দিন ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল মেডিক্যাল কলেজ চত্বর। জমা পড়ল গণইস্তফার চিঠি। দাবি উঠল, বনমালীর প্রতি অন্যায় আচরণের আর সমস্ত বাংলা ক্লাসের ছাত্রদের অপমানের প্রতিকার চাই।
আন্দোলনকে গুরুত্বই দিলেন না প্রিন্সিপাল। এতগুলো ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলেকে গালিগালাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনারও প্রশ্নই নেই। ছাত্রদের পদত্যাগপত্র তিনি পাঠিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে। লিখলেন মন্তব্য: ‘ছাত্রেরা একজন চোরের সহিত সমদুঃখতা ও অবাধ্যতা প্রকাশ করিতেছে, অতএব তাহাদিগের নাম কাটিয়া দেওয়া হইল।’
এই পরিস্থিতিতে বিজয়কৃষ্ণের নেতৃত্বে ছাত্রেরা এলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। বিদ্যাসাগর গোড়ায় বললেন, “আমি ওসব কিছু শুনতে চাই না। ছেলেরা অনেক সময়ে অযথা গোলমাল করে।” তাঁর কথায় ভুল ছিল না। এর আগে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে মেডিক্যাল কলেজে। ১৮৫০-এর জুন মাসে মিলিটারি শ্রেণির ছাত্ররা ধর্মঘট করেছিল। নানান দাবিদাওয়ায় কাজকর্ম, ক্লাস বন্ধ করে দেয়। কর্তৃপক্ষ তদন্তে নেমে জানতে পারে কিছু ‘দুশ্চরিত্র’ ছাত্র ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়েছে, বাকিরা পা দিয়েছেন প্ররোচনায়। তদন্তে সাত ছাত্রকে দুষ্কৃতী আখ্যা দিয়ে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দু’বছর পরে কয়েক জন ডাক্তারি ছাত্র বাইরের কয়েক জনের সঙ্গে ঝামেলা ও হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে। পুলিশি হস্তক্ষেপের পর দশ জন ছাত্রকে আদালতে তোলা হয়। বিচারক শাস্তি হিসেবে তাঁদের জরিমানা করেন। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের সচিব নিজ উদ্যোগে এই গুরুতর বিষয়টির তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেন শিক্ষা কাউন্সিলের কাছে। কাউন্সিল ওই দশ জনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছিল। এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনের ‘দ্য মেডিকাল টাইমস অ্যান্ড গেজেট’ পত্রিকাতেও।
এই সব ঘটনা মাথায় রেখেই বিদ্যাসাগর প্রথমে ডাক্তারি ছাত্রদের কথা শুনতে রাজি হননি। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণও নাছোড়। বললেন, আমাদের দুটো কথা শুনে, পরে যা ইচ্ছে বলুন। বাংলা বিভাগে যারা পড়ে তাদের কি বংশের বা জাতির মর্যাদা নেই? এরা সকলেই কি ইতর, ছোটলোক, চোর, বদমায়েশ? আপনিও এ কথা বলেন?
এর পর বিদ্যাসাগর শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন পুরো ঘটনাটা। পুরো ঘটনা বলে গেলেন বিজয়কৃষ্ণ। শুনে ফুঁসে উঠলেন বিদ্যাসাগর। ছাত্রদের বললেন, প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত কলেজে যেতে হবে না। তিনি এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। সময় নষ্ট না করে বসে গেলেন কাগজ-কলম নিয়ে। ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ লিখলেন ছোটলাটের কাছে। জ্বালাময়ী শব্দ ব্যবহারে উগরে দিলেন তাঁর ক্ষোভ। প্রতিকারও মিলল। লাটসাহেবের হস্তক্ষেপে প্রমাণ হল, গোটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রিন্সিপালের জেদ ও একপেশে মনোভাবের জন্য। ভুল স্বীকার করে নিলেন প্রিন্সিপাল।
যত দিন আন্দোলন চলেছিল, বৃত্তিধারী ছাত্ররা কলেজ থেকে একটা পয়সাও পাননি। তাঁদের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সমস্যায় পড়েছিলেন অনেকেই। ওই টাকাতেই তাঁদের খাওয়া-পরা চলত। কেউ কেউ বৃত্তির টাকা থেকে কিছুটা পাঠাতেন গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র মা-বাবাকে। তবে সময় মতো টাকা না পেয়েও তাঁদের কোনও অসুবিধা হয়নি এ বারে। স্বয়ং বিদ্যাসাগর পাশে ছিলেন যে! তিন-চার মাস ছাত্রদের এবং কারও কারও পরিবারেরও প্রায় সব ব্যয়ভার নিঃশব্দে বহন করেছিলেন ‘করুণাসাগর’।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy