মাত্র তেইশ বছর বয়স। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে তরুণটি। ফার্স্ট হয়েছিল, তাই সহজেই বোম্বাই সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুরুতেই এত বড় দায়িত্ব! ধুলিয়া থেকে ৩৫ মাইল দূরে দশেরা গ্রাম। সেখানকার পাঞ্জেরা নদীর জল পাহাড় কেটে নিয়ে আসতে হবে এ পারে। তুরপুন দিয়ে পাহাড় কেটে বসাতে হবে বাঁকানো পাইপ। তার মধ্য দিয়ে আসবে জল, কিন্তু জলের প্রবাহও ঠিক রাখতে হবে। কঠিন চ্যালেঞ্জ, অনভিজ্ঞ তরুণ, তার উপর বর্ষাকাল। বর্ষায় পাঞ্জেরা পাহাড়ি নদীর মতোই ভয়ঙ্কর। যে সুড়ঙ্গ কাটার কাজ শুরু হয়েছিল, নদীর বালি জমে বন্ধ হয়ে গেল তার মুখ। কী করণীয়, বুঝতে না পেরে পিছিয়ে আসতে চাইল তরুণ। সাময়িক ভাবে কাজ বন্ধ রাখা হোক, বর্ষা চলে গেলে না-হয় শুরু করা যাবে। সম্মতি দিলেন না জেলার এগজ়িকিউটিভ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বললেন, ‘‘চাকরি জীবনের শুরুতেই দায়িত্ব এড়ানো ভাল কথা নয়, এর অর্থ অবাধ্যতা।’’ চ্যালেঞ্জ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে নামল সে।
আড়াই মাইল নদী পেরিয়ে ঘোড়ায় চেপে কাজের জায়গায় পৌঁছতে হত। মুষলধারে বৃষ্টিতে এক দিন নদীর দু’পাড় ভেসে গেল। শিবিরে ফিরতে পারল না সে। ভিল গ্রামবাসীরা নতুন অতিথিকে জায়গা দিল। জল কমলে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ভিলদের তৈরি ভেলার সাহায্যে নদী পার হল। কুলিরা ঘোড়া পার করে দিল। অশিক্ষিত অনভিজ্ঞ ভিলরাই ছিল প্রকল্পের শ্রমিক। তাদের সকলের সাহায্যে নির্ধারিত দু’মাসের মধ্যেই নদীর জলকে এ পারে আনার কাজ শেষ করল সেই তরুণ।
এ ১৮৮৪ সালের ঘটনা। সে দিন থেকেই দুরূহ দায়িত্ব পালন তার নিয়তি। দামাল নদীকে শাসন তার ভবিতব্য। সেই তরুণই মোক্ষগুন্দম বিশ্বেশ্বরাইয়া, যাঁর নাম ভারতীয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে।
কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ লাগোয়া বৃন্দাবন গার্ডেন, কর্নাটক
মহীশূরে তাঁর জন্ম হয় ১৮৬০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। এই দিনটি তাঁর সম্মানেই ‘জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস’ নামে পরিচিত।
এম বিশ্বেশ্বরাইয়া স্বীয় যোগ্যতায় অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় নিজের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির শীর্ষে ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তিনি দেশকে নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন। তাঁকে মহাত্মা গাঁধীও শ্রদ্ধা করতেন।
লড়াকু মানসিকতার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এম বিশ্বেশ্বরাইয়া। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের সাক্কুর জেলায় সাক্কুর পৌরসভার জল সরবরাহের প্রকল্প তৈরির কাজ ঠিক মতো চলছিল না। আগে এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন এক জন ইংরেজ। সেখানকার আবহাওয়া ছিল
চরম প্রকৃতির— হয় খুব গরম, নয় খুব ঠান্ডা। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য সাহেব কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জেলার এগজ়িকিউটিভ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এই কাজের জন্য বিশ্বেশ্বরাইয়ার নাম সুপারিশ করেন। কাজটি বিশ্বেশ্বরাইয়াকে আকৃষ্ট করে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সিন্ধু নদ থেকে সাক্কুরে পানীয় জল সরবরাহের প্রকল্প তৈরি হল। সাক্কুর পৌরসভা ও সরকার উভয়েই তা অনুমোদন করল। নদী থেকে পাম্প করে জল পরিস্রুত করে নিকটবর্তী পাহাড়ের চুড়োয় পাইপের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু শোধনাগার তৈরি করার মতো আর্থিক সঙ্গতি পৌরসভার ছিল না। বিশ্বেশ্বরাইয়া উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সমাধান করলেন। তিনি নদীর পাড়ে একটি কূপ খনন করলেন। নদীর তলা দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ তার সঙ্গে যুক্ত করা হল। বালির মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে আসা পরিস্রুত জল সেই কূপের মধ্যে পড়লে তা পাম্পের সাহায্যে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত জলাধারে পাঠানো হল। এ ভাবে বিনা খরচে নদীর অশোধিত জল পরিস্রাবণ করে সরবরাহের ব্যবস্থা হল। সরকার সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে তাপ্তী নদী থেকে সুরাতে জল সরবরাহের দায়িত্ব দেয়।
এখানেই বিশ্বেশ্বরাইয়া থেমে থাকেননি। মুসা নদীতে খাল কেটে পুণে ও সংলগ্ন সামরিক অঞ্চল কারকীতে জল সরবরাহ করা হত। খালের জল ফিপে হ্রদে সঞ্চিত হত। সেখান থেকে পরিস্রুত জল দেওয়া হত কারকী অঞ্চলে আর অপরিস্রুত জল পাঠানো হত পুণেতে। শহরের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের তুলনায় সঞ্চিত জল খুবই কম। গ্রীষ্মে হ্রদটি শুকিয়ে যেত আর বর্ষায় দু’কূল ভাসিয়ে দিত। চার পাশে উঁচু দেওয়াল দিয়ে জল আটকানো ছিল ব্যয়সাপেক্ষ এবং জল ছাড়ার চাপে দেওয়াল ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বিশ্বেশ্বরাইয়া এ সমস্যার সমাধান করলেন। তিনি একটি স্বয়ংক্রিয় দরজার নকশা করলেন, যার দ্বারা জল সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ানো যাবে। খাদকভাসলায় ফিপে হ্রদের বাঁধে তিনি এই দরজা বসালেন। এর ফলে বিপদসীমার মধ্যে আট ফুট পর্যন্ত জল ধরে রাখা সম্ভব হবে। তার বেশি
জল জমলে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল, জল আট ফুটের বেশি উঁচু হলে দরজা নিজে থেকে খুলে গিয়ে যাতে বাড়তি জল বেরিয়ে যেতে পারে। জলের মাত্রা আট ফুটের নীচে নেমে এলেই দরজা আবার আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সময়ের হিসেবে এ ছিল এক আশ্চর্য আবিষ্কার। সরকারের আর্থিক অসঙ্গতির কথা বিবেচনা করে কাজের জন্য তিনি কোনও পারিশ্রমিকও দাবি করেননি।
হায়দরাবাদ শহরকে নিয়মিত বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিশ্বেশ্বরাইয়া। মুসী ও এসি এই দুই যমজ নদীর তীরে হায়দরাবাদ অবস্থিত। হায়দরাবাদ শহরের মধ্য দিয়ে মুসী প্রবাহিত, নদীকে মাঝখানে রেখে দু’ধারে শহর গড়ে উঠেছে। নদীটি খুব বড় নয়, কিন্তু বর্ষাকালে মারাত্মক। প্রতি বছরই এ কারণে বিপর্যয় ঘটে। কিন্তু ১৯০৮ সালে বন্যা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আকারে দেখা দেয়। এক দিনেই ১২ ইঞ্চি থেকে ১৮ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়। নদীর প্লাবন শহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। তাই হায়দরাবাদ রাজ্য সরকার বন্যার প্রতিকারের জন্য বিশ্বেশ্বরাইয়াকে এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ার ও আর্কিটেক্ট নিয়োগ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার টি ডি ম্যাকেঞ্জিও। এক জন ভারতীয়র অধীনে কাজ করতে তাঁর আত্মসম্মানে বাধে। তিনি কাজ করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু বিশ্বেশ্বরাইয়ার মেধার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি। গুণমুগ্ধ বন্ধু হিসেবে পূর্ণ সহযোগিতা করেন। উৎসমুখ থেকে নদীটি যেখানে প্রধান নদী কৃষ্ণায় পড়েছে, সেই এলাকা তিনি জরিপ করেন। বন্যা সংক্রান্ত সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ খুঁটিয়ে পড়েন।
বিশ্বেশ্বরাইয়া প্রতিবেশী বোম্বাই ও মাদ্রাজ রাজ্যের বৃষ্টিপাতের পরিমাপ সংগ্রহ করেন। বিশ্বের ভারী বৃষ্টিপাত অঞ্চলগুলোর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও লক্ষ করেন। দেখা যায়, হায়দরাবাদের উপরে যেখানে মুসী নদীর জলের ঢল নামত, সেখানে প্রতি তিন বর্গমাইল অন্তর পাঁচটি করে মোট ৭৮৮টি ছোট ছোট জলধারা ছিল। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বন্যায় ২২১টি ধ্বংস হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল নিকটবর্তী পালমাখোল ও পাত্রি জলধারা অঞ্চলে। হায়দরাবাদ থেকে ২২ মাইল দূরবর্তী পাত্রি জলধারা ভেঙে পড়ে ভোর পাঁচটায়। ঘণ্টায় চার মাইল বেগে জল বেরোতে শুরু করে। সকাল এগারোটার সময় হায়দরাবাদের বন্যার জল সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে। জলধারা যত ছোট, বন্যার তাণ্ডব তত প্রবল। নিজাম সরকারের কাছে বিশ্বেশ্বরাইয়া যে বিস্তৃত প্রতিবেদন পাঠান, তার মধ্যে এই সব তথ্যও ছিল।
বিশ্বেশ্বরাইয়া শহর থেকে বিরাশি মাইল দূরে মুসী নদীতে একটি এবং সাড়ে ছ’মাইল দূরে এসি নদীতে আর একটি বাঁধ তৈরির প্রস্তাব করেন। শহরের মধ্যে নদীর পাড় উঁচু করে তার উপর পথ ও বাগান তৈরিও ছিল তাঁর অন্যতম প্রস্তাব।
কর্নাটকের মান্ডিয়ায় কাবেরী নদীর উপর কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ বিশ্বেশ্বরাইয়ার অন্যতম কীর্তি। সরকারি অাপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি মহীশূরের রাজা চতুর্থ কৃষ্ণ রাজ ওয়াদিয়ার সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁর সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করেন আত্মবিশ্বাসী বিশ্বেশ্বরাইয়া।
এ ছাড়াও তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা এবং সেই ময়লা জল চাষের কাজে ব্যবহার, রাস্তা চওড়া করা ও সিমেন্ট কংক্রিট করে ধূলিমুক্ত করা, অস্বাস্থ্যকর অঞ্চল ভেঙে দরিদ্রদের জন্য গৃহনির্মাণ। মুসীর বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯১৩ সালে। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বেশ্বরাইয়া মহীশূরের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন।
বিশ্বেশ্বরাইয়ার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশবাসী তাঁকে লখনউ শহরে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির আসনে বসিয়েছিলেন। লখনউ শহরে বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে বিশ্বেশ্বরাইয়া সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমাদের কৃষি, আমাদের খাদ্যাভাব, আমাদের জীবনযাত্রার ধারা, এক কথায় আমাদের সমস্ত ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ ধরে চলা একান্ত অপরিহার্য। অথচ এ জন্য আমাদের মনের ভিতর বিশেষ তাগিদ জাগেনি। যুদ্ধের ফলে আর সমস্ত জাতির ভিতর নতুন ব্যবসা বাণিজ্যের এবং নানা রকম অনুসন্ধিৎসার যে ঝোঁকটা জেগে উঠেছে, তা থেকে শুধু আমরাই বঞ্চিত। দারিদ্র জিনিসটা এমন যে চেষ্টা করলেই তার প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু আমাদের ভিতর সেই চেষ্টা জাগছে না।’’ তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের উন্নতির মূল কথাই হল সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা তিনি লেখেন ‘আ প্ল্যানড ইকোনমি ফর ইন্ডিয়া’ বইয়ে। কার্যত তিনিই প্রথম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির, পরে নানা কারণে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে নিজের পদ ছেড়ে দেন। ১৯৫৫ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেই তিনি ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত হন।
ভারতবাসীর প্রতি বিশ্বেশ্বরাইয়ার আহ্বান ছিল ‘শিল্পায়ন অথবা ধ্বংস’। তিনি ছিলেন এক জন মহান যন্ত্রবিদ, দক্ষ প্রশাসক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা। ১৯৬২ সালের ১২ এপ্রিল, ১০২ বছর বয়সে এম বিশ্বেশ্বরাইয়ার মৃত্যু হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy