Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

শেষ থেকে আবার

দোতলায় উঠে সম্প্রীতির ঘরের দরজায় নক করল সে। ভিতর থেকে আওয়াজ, “আয়।’’ ঘরে ঢুকলে দেখা গেল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে পল্টুর দিকে পিছন করে চুল আঁচড়াচ্ছে সম্প্রীতি। চিরুনির শাসনে অবাধ্য চুলেদের বশ্যতাস্বীকার।

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

অরিন্দম শীল
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সেই যেখানে পলাশ গাছটা একা একা দাঁড়িয়ে বসন্তের ফেয়ারওয়েলের স্টেজ সাজিয়েছে, তার থেকে হাত দশেক দখিনপাড়ার দিকে গেলেই সম্প্রীতির বাড়ি। পল্টু চলেছে সেই রাস্তাতেই। মাসখানেক আগে দোল গিয়েছে। গোবিন্দপুর হেমাঙ্গিনী ইনস্টিটিউশনের হেডস্যর অনন্তবাবু দোলে প্রত্যেক বার শান্তিনিকেতন যান বাড়িতে তালা দিয়ে। এ বার যাওয়ার মাস দেড়েক আগে বাড়ির বাইরেটায় ফিকে হলদে রং করান। ছেলেদের স্কুল থেকে না পালাতে পারার রাগ, ভ্যালেন্টাইন-ডে তে গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে ক্যাম্পাসে ঘুরতে না পারার আফসোস, সময়ে প্রোজেক্ট জমা না দিতে পারায় কানমলার অপমান, পরীক্ষার সময় হল ম্যানেজ করতে না পারার দুঃখ, সব কিছুর প্রতিশোধের ইম্প্রেশন স্যরের বাড়ির দেওয়ালে প্রকাশ পেয়েছে দোলের রঙের দৌলতে। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে স্যর তাঁর বাড়ির এই দশা দেখে বেজায় ক্ষেপে গেলেন। তাই দেখে পল্টু এক বার ফিক করে হাসল, তার পর নিজের রাস্তা ধরল।

রোয়াকে ওদের পোষা নেড়িকুকুর ছক্কা বসে আছে, পল্টুকে দেখে এগিয়ে এল। ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পল্টু হাঁকল, “মাসিমা!’’ এক মুখ বিরক্তি নিয়ে এক ভদ্রমহিলা বেরলেন, “কী হল আবার?” পল্টু বলল, “সম্প্রীতি আছে?”গোমড়ামুখে উত্তর, “দোতলায়।’’ সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গজগজানি শুনল পল্টু “এই ভরদুপুরে আবার আড্ডা শুরু হল। আর মেয়েও হয়েছে তেমনি, হবে না, যেমন বাপ ছিল বারমুখো…”

দোতলায় উঠে সম্প্রীতির ঘরের দরজায় নক করল সে। ভিতর থেকে আওয়াজ, “আয়।’’ ঘরে ঢুকলে দেখা গেল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে পল্টুর দিকে পিছন করে চুল আঁচড়াচ্ছে সম্প্রীতি। চিরুনির শাসনে অবাধ্য চুলেদের বশ্যতাস্বীকার। আয়নায় এক পলক দেখে নিয়ে বলল,“বল।”

“কী করে বুঝলি আমিই এসেছি?”

“গাধাত্বটা আর গেল না, আয়নায় দেখলাম।”

“সে তো আমি ঢোকার পরে, দরজায় খটখটের সময় মানুষ তো জেনারেলি ‘কে?’ বলে।”

“সিম্পল, গেটের গ্রিল খোলার আওয়াজ আর ছক্কাও ঘেউঘেউ জুড়ল না, সিদ্ধান্ত অবশ্যই চেনা কেউ, তার পর তুই হাঁকলি মাসিমাআআআআ... তোমার ওই বায়সকণ্ঠ আমায় বলে দিল আগন্তুক তুমি, আর তার পর মায়ের গজগজানিতে কনফার্মেশন সার্টিফিকেট, মানে মা ওই তোকে আবার একটু ইয়ে করতে পারে না বুঝিস নিশ্চয়ই।”

“জিতা রহো মেরে গোয়েন্দাগিন্নি, বিয়েটা হিমাংশুদাকে না করে হোমসকে করতে পারতিস, মেড ফর ইচ আদার।”

“ওহো হোমস সে ইয়াদ আয়া, পরশু ওকে নিয়ে হোম ডেকর্স অফিসে গিয়েছিলাম।”

“কী দেখলি?”

“অনেক চার্জ নেবে। আমি বারণ করছি, হিমাংশুটা মানছে না।”

পল্টু সতর্ক ভাবেই দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, “কামাচ্ছে তো ওড়াবার জন্যই। আমাদের মতো পকেটে টিংটিং মুখেতে মার্কেটিং বেচুবাবু তো নয়।”

“বাজে বকিস না তো, তুই যথেষ্ট কামাস।”

আবারও এক রাশ নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস পল্টু নিপুণ কায়দায় লুকিয়ে ভাবল, যদি সত্যিই যথেষ্ট, তবে কেন… মুখে বলল “ও সব ছাড়, কেনাকাটা কমপ্লিট?”

“হুম। গত রোববারই গিয়েছিলাম সুরানায়, রাশি রাশি বেনারসি, কিন্তু ওভারপ্রাইসড, বাজেটে আঁটে না, যা হোক একখান কিনেছি, বড্ড মায়া হয় অযথা পয়সা খরচ করতে। দেখছিস তো মায়ের অবস্থা, সামান্য চাকরি।”

“হুম, আর গয়না?”

সম্প্রীতির মুখে চিন্তার চিত্রনাট্য, “ওটাই তো চাপ।”

“বেফালতু চাপ নিলি, একটা ছোট ঘটনা, বুড়ি মানুষ, তোর বড্ড ইগো।”

“অপমান করলে চুপ থাকব? শোন একটা কথা পরিষ্কার। আমার মাকে কেউ ভিখিরি বললে মেয়ে হিসাবে আমি চুপ করে থাকতে পারি না। যাকগে কেন এসেছিস বলবি?”

এ বার তিন নম্বর দীর্ঘশ্বাস, সত্যিই কেন যেন এসেছে সে, বলল “একটা দরকার ছিল, মানে…” দরকারটা বলবার জন্যই পল্টু মহড়া দিয়েছে প্রায় তিন দিন। কী বলবে, কী ভাবেই বা বলবে, কী করলে ওকে রাজি করানো যায়! এটা খুব দরকার, অত্যন্ত বেশি দরকার। গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য একলব্যের যে ভাবে দরকার ছিল দ্রোণাচার্যকে। কিন্তু মন বলছে, মানবে না সম্প্রীতি। পল্টু দেখল, এক চোখ প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে ওকে দেখছে সম্প্রীতি। মনকে শক্ত করল সে, রাজি করাতেই হবে। তার পর বলল “ইয়ে স্যর, মানে পিআরবি স্যর, এক বার তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।”

সম্প্রীতির মুখে প্রকট হল রাগ। চোখের তারায় বেরিয়ে এল ক্ষোভের আগুন। চোয়াল হল শক্ত, নাকের পাটা ফুলিয়ে তুলল জেদ। সে বলল, “অসম্ভব।”

******

প্রভাতরঞ্জনের সকাল শুরু হয় দিনমণির নিত্যকর্ম শুরু হওয়ার অনেক আগে। সকালটা বড়ই ফুরফুরে, চারিদিকে ব্যস্ততা শালিক, চড়াই আর কাঠবিড়ালিদের। বাউন্ডারির পাশের চায়ের দোকানে চিরচেনা গলায় আকাশবাণী কলকাতা। পার্কের এই বেঞ্চটাতে আজ প্রায় বছর দশেক ধরে বসছেন তিনি। চারদিকে গুলঞ্চ, ছাতিম আর গুলমোহরের দল যেন সি-অফ করছে ঋতুরাজকে। আর বেশি দিন এ দৃশ্যপট দেখার সুযোগ হবে না। হয়তো বা বিদেশের আকাশ অনেক বেশি নীল, মিছিলনগরীর প্লাস্টিকদূষণ আর ফোটোকেমিক্যাল স্মগ সেখানে ব্রাত্য, তবু মিস করবেন তিনি কলকাতা। সাড়ে ছ’টা ঘড়িতে। প্রত্যুষ কেন যে দেরি করছে!

ছেলেটা বড্ড ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট নেই, কলেজের ইন্টারভিউয়ের সময় বুঝিয়েছিল কোয়ালিটি আছে। তার পর যখন শুনলেন বাড়ি হুগলির গোবিন্দপুরে, আর না করেননি। কত বার যেন তিনি গিয়েছেন গোবিন্দপুর, ছায়া-ছায়া স্মৃতিগুচ্ছরা ঘিরে ধরে মানুষটাকে। কেমন আছে সরমা? ফেরার চেষ্টা অনেক করেছেন, কিন্তু সরমা মেয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি। অনসূয়া প্রায় পনেরো বছরের ছোট ছিল তাঁর থেকে। তাঁর প্রথম স্কলার। লাউডগা সাপের মতো হিলহিলে ফিগার, চোখের তারায় গোখরোর সম্মোহন। মাখনরঙা মুখে চেরি কালারের লিপস্টিক ঠোঁট আকুল আহ্বান জানাত মিলনের। অনেক চেষ্টা করেছেন নিজেকে রুখতে, পারেননি। সেমিনারের দোহাই দিয়ে উইকেন্ডে আজ দিঘা কাল বকখালি। সরমার সরল বিশ্বাসে গুছিয়ে দেওয়া সুটকেস অবাক বিস্ময়ে দেখত হোটেলের ঘরে মিশে যাওয়া শরীর। ওই শরীরের আগুনের তাপেই সরমার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য কখন যেন বাষ্প হয়ে উবে গেল। বাধা মানেননি কোনও। এক দিন অনসূয়া বলল, তার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করছে। পত্রপাঠ বেরিয়ে এলেন প্রভাতরঞ্জন। তার পর চাকরি বদলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়। সরমার প্রেগনেন্সির ঠিক সাত মাস তখন। মাস ছয়েক এক সঙ্গে থাকার পর অনসূয়া বলল পোস্ট-ডক্টরেট করবে। নিজের সর্বোচ্চ যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অনসূয়াকে বিদেশে পাঠালেন প্রভাতরঞ্জন। তাঁর জন্যই সুযোগ, নইলে অনসূয়ার পেপারগুলো এমন কিছু ছিল না। মাস ছয়েক পর থেকেই যোগাযোগ কমে আসে। এক দিন চিঠিতে জানায়, সে আর ফিরবে না। ভারত দেশটা তার কাজের পক্ষে বড়ই ছোট, তা ছাড়া প্রভাতরঞ্জন আর তার বয়সের ফারাক অনেকটাই, মিলনে সে কখনওই তৃপ্ত হয়নি, বরং রিচার্ড অনেক ভাল, বিশেষ করে বিছানায়। আর যোগাযোগ রাখেননি প্রভাতরঞ্জন। প্রায় বছর পনেরো বাদে আবার কলকাতা ফেরেন। শুনেছিলেন সরমা এখন গোবিন্দপুরে বাপের বাড়িতে থাকে। ওখান থেকেই বিকাশ ভবন ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন, অফিসেও যান। কিন্তু সরমা দেখা করেনি। ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সরমা দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। বড্ড পাপ হয়েছে, যদি প্রায়শ্চিত্তটা হয়…

“স্যর...”

চিন্তাটা ছিঁড়ে গেল প্রভাতরঞ্জনের। “এই তো প্রত্যুষ, কাজটা হল?”

“অনেক কষ্টে নিমরাজি করিয়েছি, তবে একটা শর্ত আছে তার।”

“কী শর্ত? সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।”

“লাখ দশেক টাকা তাকে দিতে হবে লোন হিসাবে, সে সুদ-সহ তিন বছরের মধ্যে শোধ করবে।”

“যদি না নিই ফেরত?”

“আসবে না বলেছে সে ক্ষেত্রে।”

হেসে ফেললেন প্রভাতরঞ্জন। যার সব কিছু প্রাপ্য সে কিনা আজ ধার চাইছে! তিনি তো উজাড় করেই দিতে চান সারা জীবনের সঞ্চয়। বললেন, “কী কারণে চাইছে টাকাটা বলতে পারো?”

“ও বলতে বারণ করেছে, তবুও বলছি, আর আপনি আমাকে পল্টু কেন বলেন না স্যর?”

“ভুলে যাই, বয়স হচ্ছে তো, ওকে পল্টু, বলো।”

পল্টু এক বার দেখেনি ল ভদ্রলোককে। পিআরবি অর্থাৎ প্রভাতরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, তার রিসার্চ গাইড। রাশভারী ঠোঁটকাটা বদনামের মানুষটা প্রথম দিন থেকেই তার প্রতি কেমন যেন অতিরিক্ত সদয়। কথায় কথায় কেবলই তার গ্রামের খবর জানতে চাইতেন। তার পরে এক দিন ড্রয়িংরুমে হঠাৎই সিগারেট অফার করেন। সেই সন্ধেয় সে জানতে পারে স্যরের ইতিহাস। সম্প্রীতির সাথে বন্ধুত্ব নার্সারি থেকে, পাড়ায় কানাঘুষো থেকে জানত সম্প্রীতির বাবা বিদেশে থাকে, সম্প্রীতির মা মানে সরমা মাসিমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি সম্প্রীতি জন্মানোর আগে থেকেই, স্যরই যে সম্প্রীতির সেই বাবা শুনে প্রথমটায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রীতিকে সবই বলেছে, শুনে সম্প্রীতি বলেছে তাদের কোনও খবর যেন ওই লোকটাকে না দেওয়া হয়। ডিপার্টমেন্টে গোলমাল চলছে এখন, কী সব বেআইনি টেন্ডার পাসের প্রতিবাদ করায় সংসদ থেকে হেনস্থা করা হয় স্যরকে, মারা হয়েছিল চড়থাপ্পড়ও। মন ভেঙে গিয়েছে ভদ্রলোকের। তাই বিদেশ চলে যাচ্ছেন, ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। পল্টুরও কাজ প্রায় শেষ। বাকিটা নিজেই করে নিতে পারবে। তা ছাড়া যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেট তো রইলই। যাওয়ার আগে এক বার মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে চান নিজমুখে। বড্ড দুঃখী মানুষটা, তিন কুলে কেউ নেই, তাই পল্টু চেষ্টা করেছে এক বার সম্প্রীতির সঙ্গে দেখা করানোর। অনুরোধ করার সময় সে দেখেছে, স্যরের চোখে জল চিকচিক করছিল। পল্টু বলতে লাগল ঘটনাটা...

সম্প্রীতির পাকাকথার সময় পাত্রপক্ষ কিছু চায়নি। হিমাংশুরা যথেষ্টই বড়লোক, ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পরে মিষ্টিমুখের পর্ব চলছে, হঠাৎই হিমাংশুর বুড়ি ঠাকুমা বলতে শুরু করলেন, “আমার বিয়েতে বাপু চল্লিশ ভরি গয়না লেগেছিল, আমাদের সোনার বেনেদের গয়নাই আসল, আজকালকার মেয়েরা নিজে নিজেই সোনার টুকরো ছেলেগুলোকে ধরছে, কী সব মেয়ে বাপু, বাপের আবার চরিত্তিদোষ, নেহাত নাতি নিজে পছন্দ করেছে তাই, নইলে এই সব ঘরে কি আমাদের বিয়ে হয়, সবই কপাল!” হিমাংশুর বাবা তাঁর মাকে ধমকে চুপ করিয়েছিলেন। কিন্তু কথাটা সম্প্রীতি জানতে পেরেছিল। তার পর জেদের বশেই ফোন করে হিমাংশুর বাবাকে জানায়, তার মা চল্লিশ ভরিই দেবে। হিমাংশু নিজে লাখ পাঁচেক দিতেও চেয়েছে, সম্প্রীতি নেয়নি। ছোট থেকেই বড় জেদি। টাকা জোগাড় হচ্ছে না এ বার। বেসরকারি চাকরি, আগেই পার্সোনাল লোন নেওয়া আছে, মা-দাদুর চিকিৎসার জন্য অনেক খরচ, হাতেও নেই কিছু। দশ ভরি আগেই জমা ছিল। এখন তিরিশ ভরির টাকা আসে কোত্থেকে?

সব শুনে স্যর বললেন পরশু ঠিক বিকেল পাঁচটায় এই পার্কে আসতে। তিনি চেক বই আনবেন। যদি একান্তই এগ্রিমেন্ট চায় সম্প্রীতি, তা হলে কাগজপত্র যেন সে-ই ঠিকঠাক করে নিয়ে আসে। তার পর বললেন “এক্কেবারে মায়ের মতো জেদি হয়েছে, বুঝলে!” পল্টু ভাবল, জেদ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তাই বোধ হয় এত দিনের মুগ্ধতাটা দেখতে পায়নি সম্প্রীতি, বোঝেনি সেই প্রাইমারি থেকে কলেজবেলা অবধি সম্প্রীতি ছাড়া আর কেউ স্বপ্নেতে আসেনি পল্টুর। অনেক ঘুম-না-আসা রাত পল্টু সম্প্রীতির কথা ভেবেই কাটিয়েছে, কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে বয়ফ্রেন্ড হতে পারেনি সে। পল্টু নিজে থেকে বলেনি কিছু, কেন বলবে? গোয়েন্দাগিন্নিপনা কি শুধু বাইরে, বুকের ভিতরের রসায়ন কি আন্দাজ করতে নেই?

******

পার্কের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে পল্টু, আর একদম শেষ মাথায় নির্জন জারুল গাছটার ছায়ায় স্যর আর সম্প্রীতি। কথাবার্তা চলছে, সম্প্রীতি প্রথমে আঙুল উঁচিয়ে কী সব বলছিল, স্যরও হাত নেড়ে না-না করছিলেন। এই সময় ঘটনাটা ঘটল। বেশ স্পষ্ট শোনা গেল সম্প্রীতির গলা “এ দিকে এস।”দোলনাগুলোর কাছে পল্টুর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মহিলা। এত ক্ষণ নজরে পড়েনি। কাছে আসতে মুখটা স্পষ্ট হল। সরমা মাসিমা! এখন স্যর চুপ করে মাথা নিচু করে। সরমা মাসিমাও তাই। শুধু সম্প্রীতি কথা বলছে। মাথাটা গুলিয়ে গেল পল্টুর। এই বার দেখা গেল সম্প্রীতি হনহনিয়ে ওর দিকেই আসছে। কাছে এলে পল্টু বলল, “মাসিমা কোত্থেকে এল?”

“নিয়ে এলাম অনেক বুঝিয়ে।”

“আর টাকার কথাটা?

“লাগবে না আর।”

“অ্যাঁ! গয়না কী করে কিনবি?”

“ভাবছি কিনব না।”

“তা হলে বিয়েটা, হিমাংশুদার বাবাকে তো তুইই…”

“বিয়েটা হচ্ছে না।”

“কী! তুই কি পাগল?’’ পল্টুর গলায় হালকা উচ্ছ্বাস কি?

“কাল সারা রাত ভেবেছি, হিমাংশুই বা কেন ওর ঠাকুমার কথাটা নাকচ করল না? গয়নাটা দেওয়া হলে সেই পণপ্রথাকেই তো সমর্থন করা হচ্ছে। হিমাংশুর মতো আধুনিক ছেলে কী করে মেনে নিচ্ছে এটা! এখন চল বাবার টিকিটটা ক্যানসেল করে আসি, আর বিদেশ যেতে দিচ্ছি না।”

“বাবা!” নিজের কানটাও কি শেষে ব্রুটাসগিরি শুরু করল?

“হুম বাবা। বড্ড দুঃখী মানুষটা। একটা পাপের সাজা পঁচিশ বছর ধরে ভুগল।”

******

পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। কত কাল ধরে কত মানব-মানবী হেঁটে যায় পাশাপাশি। পিছনে পার্কে বাক্যহীন দু’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। অবাক চোখে দেখছে ভাবীকালের ঘর বাঁধা। এই বারবার ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, যুদ্ধ, দূষণ, রিসেশন, ক্যানসারে ভরা বুড়ি পৃথিবীটায় কেন আজও লেখা হয় প্রেমপত্র? পুড়ে যাওয়া ঘর ফের বাঁধে ঝুপড়িবাসী? দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারবারি লেখে হালখাতার দিন ‘শুভ লাভ’। ধর্ষিতা মেয়ে আবারও চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করে। ডিভোর্সের মাস ছয়েক বাদে আবার ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট খুলে দেখে কোনও ছেলে। বুড়ো, বুড়ি, সাহেব, হরিপদ কেরানি, বেকার ছেলে থেকে বোমায় পরিবার হারানো সিরিয়ার ট্যাক্সিচালক...সবার ভিতরেই কি একজন রবার্ট ব্রুস লুকিয়ে থাকে?

দারুণ হাওয়া উঠল একটা। গরমকাল আসছে, বিকেলের আকাশ লালে লাল। পল্টু কোথায় যেন পড়েছিল একেই বলে কনে দেখা আলো। কথাটা কি সত্যি? পল্টু এক বার দেখে নিল সম্প্রীতিকে। এই তো সময়, পল্টুর ডান হাতের কড়ে আঙুল হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঠেকে যাচ্ছে সম্প্রীতির হাতের মুক্তোটায়। একটু দম নিয়ে হঠাৎ সে হাতটা ধরল সম্প্রীতির। মেয়েটার হরিণচোখে বিস্ময়, সে বুঝেছে এ হাত ধরা একদম অন্য রকম। উস্কোখুস্কো মাথায় এক বার হাত বুলিয়ে পল্টু বলল “একটা কথা বলা যায়?”

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Arindam Sil
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy