Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
wrinmukti

ঋণমুক্তি

wWRমা কী বুঝেছিল কে জানে। হাসল। বলল, ‘না, আমার কাছে তোর কোনও ঋণ নেই। তোকে শোধ দিতে হবে না।’

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

উজ্জ্বল রায়
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২০ ০০:৩৩
Share: Save:

তোদের এই বৃদ্ধাশ্রমটার নামটা কিন্তু বেশ, বিকেলের ফুল।”

“হ্যাঁ। বুড়োবুড়িদের জন্য তো, তাই হয়তো এ রকম নাম রেখেছে। এখানে যারা আছে, তাদের সবারই তো বয়স হয়েছে। ঝরে যাওয়ার মুখেই প্রায় সবাই... তা তুই এলি কিসে? একা একা, এতটা রাস্তা...”

“এতটা রাস্তার কী আছে, গাড়ি করে এসেছি। বুবুনের ছেলেমেয়েদের তো এখন গরমের ছুটি। ওরা গিয়েছে ওদের মামার বাড়ি। আমি বুবুনকে বললাম, আমায় আজ একটু ছোড়দার কাছে নিয়ে যাবি? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ছোড়দাকে। আজ তো শনিবার, তোর ছুটি। ও বলল যে, না, ওর সময় হবে না। কী সব কাজ আছে যেন। ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে।”

“ও। তা এতগুলো মিষ্টি এনেছিস কী করতে, কে খাবে? আমি কি অত মিষ্টি খাই না কি?”

“খাবি। রোজ একটা করে। কড়াপাকের সন্দেশ, নষ্ট হবে না। খা না এখন একটা।”

“দে একটা, খাই। তুইও খা। খেয়ে জল খা... জলভরা! বাহ্‌।”

“এখানে তোর সময় কাটে কী করে রে ছোড়দা?”

“ওই... টিভি দেখি। একটু খবরের কাগজটা ওল্টাই। বিকেলবেলা বাগানে একটু পায়চারি করি। কিছুই ভাল লাগে না আজকাল।”

“বৌদির কথা মনে পড়ে, না?”

“হ্যাঁ, নিয়তিকে তো মনে পড়েই। চল্লিশ বছর এক সঙ্গে কাটিয়েছি। উঠতে বসতে স্মৃতি। ও বেঁচে থাকলে তো আর আজ আমায় এখানে এসে থাকতে হত না! আমি তো ওর কথা ভেবে অন্য রকম প্ল্যান করে রেখেছিলাম। আমারই তো চলে যাওয়ার কথা ছিল আগে। তবে এখন ভাবি, যা হয়েছে ভালই হয়েছে। ক্যান্সার তো আর সহজে সারে না। কষ্ট পাচ্ছিল খুব। তবু চোদ্দোটা বছর যে ও বেঁচে ছিল, সেই অনেক। ও বেঁচে ছিল স্রেফ মনের জোরে।”

“হ্যাঁ, অসম্ভব মনের জোর ছিল বৌদির। আমরা তো ঘরে তাই বলাবলি করতাম সবাই। তবে তোদের একটা ছেলে-টেলে থাকলে....”

“সে আর এখন ভেবে কী লাভ। আমি তো বলেইছিলাম একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার কথা, তোর বৌদি রাজি ছিল না। পরে অবশ্য বলত। যখন বুঝতে পারছিল, ওর আয়ু শেষ হয়ে আসছে, তখন আফসোস করত। আমায় নিয়ে ভাবত। কী খাব, কোথায় থাকব...। মৃত্যুর আগে তো মানুষের অনেক ক্ষোভ, আফসোসের কথা মনে পড়ে... কী-কী পাইনির চেয়ে কী কী দিতে পারিনি, করতে পারিনি, সেই সব কথা বেশি মনে পড়ে। সে দিন যেমন বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, বড়দা যে দিন শিলং চলে গেল কী একটা ট্রেনিং নিতে, আমি গিয়েছিলাম বড়দাকে ট্রেনে তুলে দিতে। গভীর রাতে ট্রেন। সেই সময় গোমো স্টেশনে একটা কম্পার্টমেন্ট আগে থেকে রাখা থাকত। ৭৪ ডাউন এলে ওর সঙ্গে জুড়ে দিত। ট্রেনটা হাওড়া যেত। বড়দা ব্যান্ডেলে নেমে ট্রেন বদল করে যাবে দমদম। কাকার বাড়িতে দু’দিন থেকে ওখান থেকে আসাম হয়ে শিলং। তা স্টেশনে রাখা ওই কম্পার্টমেন্টে চড়ে বড়দা আমায় বলল, ‘তুই বাড়ি চলে যা। রাত হয়েছে। বাবাকে বলিস, আমি জায়গা পেয়ে গিয়েছি।’ ফিরে আসতে আসতে আমার মনে পড়ল, এই রে, বড়দাকে তো প্রণাম করা হল না! তখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। তিন দিন পর দমদম থেকে কাকার টেলিগ্রাম এল, বড়দা মারা গিয়েছে। ওই একটা আফসোস রয়ে গিয়েছে এখনও। বড়দাকে প্রণাম করা হয়নি। আর হলও না।”

“ও তাই! বড়দাকে আমার তেমন মনে পড়ে না। আমি তো খুব ছোট ছিলাম তখন। তবে ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে আজকাল। গোমোর কথা। ধানবাদের কথা... ঝরিয়া, কাতরাস, সোনারডি। তখন আমরা কী গরিব ছিলাম, তাই না ছোড়দা? অথচ কী মজা ছিল জীবনে! আজকাল লোকের হাতে অনেক টাকা এসেছে ঠিকই, কিন্তু সেই মজা আর নেই। ছেলেমেয়েদের মনে সেই আনন্দ নেই। তাই না?”

“হ্যাঁ, ছেলেবেলায় আমরা খুব মজা করেছি। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো শৈশবই নেই। জন্মের কিছু দিন পরেই ওরা বড় হয়ে যায়। আড়াই বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলে কি কারও শৈশব থাকে! বাবা-মাও তেমন! পাঁচটার সময় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলল বাচ্চাকে টিউশন পড়াতে। আজকাল একটা বাচ্চাকেও খেলতে দেখি না। মাঠই নেই পাড়ায় একটাও, খেলবেই বা কোথায়!”

“আমাদের বাবা কী রাগী ছিলেন, না! কী ভয় পেতাম সবাই। বাবার স্নেহ-ভালবাসা আমি পেয়েছি অনেক পরে। বলতে গেলে আমার বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর।”

“তখনকার দিনে বেশির ভাগ বাবারাই তো ছিল ওই রকম। রাগী। হিটলার-মার্কা। নিজে যা ভাববে, মনে করবে, সেটাই সবাইকে মানতে হবে। এক চুল এ দিক-ও দিক হওয়ার জো ছিল না। অবশ্য সেই সময় বাবার রাগের যথেষ্ট কারণও ছিল। কতগুলো ভাই-বোন ছিলাম আমরা বল? ওই তো একটা ছোট দু’কামরার রেল কোয়ার্টার। তাতে গাদাগাদি করে আমরা আট-দশ জন ভাই-বোন। বাবা-মা। তখন তো আর মাইনে বেশি ছিল না। তার উপর ঘরে সব সময় কেউ না কেউ এসে থাকত। নয় মামারা, নয় পিসিমা।”

“তবে মা মারা যেতে বাবাকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম। একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো। এখনও সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে।”

“হ্যাঁ, বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। খুব অল্প বয়সে মা মারা গিয়েছিল কি না! পঁয়তাল্লিশ কী ছেচল্লিশ। তখনকার দিনে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা তো এখনকার মতো এত স্পষ্ট করে প্রকাশ পেত না। উপর থেকে দেখে বোঝা যেত না। ফল্গু নদীর মতো।”

“মায়ের কথা কিছু মনে পড়ে তোর ছোড়দা? মা কবিতা লিখতে পারত, না রে?”

“ছড়া। অমলদাকে মনে নেই তোর? ওর বিয়েতে মা ছড়া লিখেছিল। তখন তো বিয়ে, অন্নপ্রাশন, এইসবে ছড়া লেখার চল ছিল খুব। মায়ের হাতের কাজও ছিল খুব ভাল। মাছের আঁশ দিয়ে মা একটা ওঁ লিখেছিল। আঁশের গায়ে লাল নীল রঙ করা। খুব সুন্দর হয়েছিল দেখতে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা ওটা বাঁধিয়ে রেখেছিলেন।”

“হ্যাঁ, সেটা এখন আমার কাছে।”

“ও তাই?”

“হ্যাঁ রে, রাতে তোর ঘুম হয় ছোড়দা? আমার একদম ঘুম হয় না।”

“আমারও তাই। ঘুম আসে না আজকাল। অনেক বার করে ঘুম ভেঙে যায় রাতে। উঠি, বাথরুমে যাই। জল খাই। আবার বাথরুমে যাই। চোখ বুজলেই সব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। শরীরের তেমন পরিশ্রম হয় না তো, ঘুম হবে কী করে। সে দিন অমনি ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গিয়েছে। চোখ বুজে শুয়ে আছি। ওই রকম তন্দ্রার ঘোরে দেখছি, আমি স্কুলে বসে আছি, আর আমাদের বিভূতিস্যর ক্লাসরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন বলছেন, মায়ের ঋণ কেউ শোধ করতে পারে না। আমি ঘরে ফিরে এসে দেখি মা রান্নাঘরে বাটনা বাটছে। সামনে উনুন জ্বলছে। আমি মা’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, ঋণ কাকে বলে?’ মা বলল, ‘ধার করাকে ঋণ বলে। এই যেমন ধর, আজ সকালে দু’পয়সা দিয়ে আমি এক টিন মুড়ি কিনলাম। মুড়িওলাকে বললাম, কাল এসে পয়সা নিয়ে যেয়ো। ওকে বলে ধার করা। ঋণ।’ আমি একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমার কাছ থেকে কিছু নিইনি, তা হলে তো তোমার কাছে আমার কোনও ঋণ নেই!’ মা কী বুঝেছিল কে জানে। হাসল। বলল, ‘না, আমার কাছে তোর কোনও ঋণ নেই। তোকে শোধ দিতে হবে না।’ আমি লাফাতে লাফাতে চলে গেলাম। ঘুমটা ভেঙে গেল... এখন ভাবি, কী বোকা ছিলাম আমি। মায়ের ঋণ কথাটার অর্থই জানতাম না তখন!”

“তোর কত বয়স হল বল তো ছোড়দা?”

“হবে, আশি-বিরাশি। জানি না ঠিক।”

“ভ্যাট! তোর বিরাশি হলে আমার কত? তোর পঁচাশি।”

“তাই? পঁচাশি হয়ে গেল? ওব্বাবা! তা হলে তো অনেক! এত দিন বেঁচে আছি!”

“যাহ্‌, অমন করে বলিস না। আমার কাছে বাবার ডায়েরিটা আছে, ওতে সব লেখা আছে। কাল তোর জন্মদিন ছিল। কাল তো আমার আসার উপায় ছিল না...কই দেখি, তোকে একটা প্রণাম করি।”

“ও, তাই আজ মিষ্টি এনেছিস!”

“না, সেই জন্য কেন, এমনিই এনেছি। তুই খাবি।”

“ঠিক আছে, তা হলে আজ তুই যা, অনেক ক্ষণ তো হল। এগারোটা বাজছে। বেহালা ফিরতে ফিরতে তোর একটা বেজে যাবে।”

“দাঁড়া না, আর একটু বসি। আর তো কবে আসা হবে জানি না। তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি ছোড়দা।”

“আবার কী জিনিস? এই তো এক গাদা মিষ্টি দিলি!”

“তোর মনে আছে ছোড়দা, ছোট বেলায় আমরা কোনও দিন একটা গোটা ডিম খেতে পাইনি? মা সুতো দিয়ে আদ্ধেক করে কেটে দিত।”

“হ্যাঁ, খুব মনে আছে। এক বার বেশ মজা হয়েছিল জানিস। আমি বৌদির সঙ্গে কলকাতা গিয়েছি, বৌদির বাপের বাড়ি... অনেক

ছোট তখন আমি। খেতে বসেছি, দেখি, আমার পাতে একটা আস্ত

ডিম। আমি ভাবছি খাব কি খাব না। ইতস্তত করছি। তখন বৌদি আমার পাশে বসে বলল, ‘খাও। গোটা ডিমটাই তোমার।’ ওহ্‌, সে দিন যে কী আনন্দ হয়েছিল!’’

‘‘আর দেখ না, এখন এখানে দু’টো করে ডিম সেদ্ধ দেয়। আমি বলি, দু’টো খাব না। একটা তুলে নাও। ওরা নিতে চায় না।”

“ছোড়দা, তোর মনে আছে, এক দিন আমরা সবাই মিলে পাত পেড়ে নীচের ঘরে খেতে বসেছি। তুই, আমি, সেজদা, গঙ্গা, জনে। তোর পাশে আমি বসে। সে দিন বাড়িতে ডিম রান্না হয়েছিল। কী আনন্দ আমাদের! মা সুতো দিয়ে কেটে সবাইকে আধখানা করে ডিম দিয়েছে পাতে। আমরা সবাই ডিমটা সরিয়ে রেখেছি এক পাশে, শেষে খাব বলে। সবাই খেয়ে নিয়েছে। তুই তো খুব আস্তে আস্তে ধীরেসুস্থে খেতিস, আমার খাওয়া শেষ হতেই, আমি তোর পাত থেকে তোর ভাগের ডিমটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে মুখে পুরেই এক ছুট। মা কী মার মেরেছিল আমায় সে দিন! বাড়িতে সে দিন আর একটাও ডিম ছিল না। তোর চোখভর্তি জল। এখনও সেই কথা মনে পড়লে আমার কী খারাপ লাগে। আমি তো ও রকম দুষ্টু ছিলাম না কোনও দিন। সে দিন যে কী লোভ হয়েছিল আমার কে জানে! এখনও আফসোস হয় আমার।”

“কে জানে, হবে হয়তো। আমার মনে নেই।”

“জানিস, সে দিন আমাদের ফ্ল্যাটের পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, আজকাল তো একা একা বাইরে ঘুরতে বেরতে পারি না, হাঁটুর যা অবস্থা... দাঁড়িয়ে দেখছি, দু’টো বাচ্চা ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন বোধহয়, খালি গা, খুব গরিব, একটা সেদ্ধ ডিম হাফ-হাফ করে খাচ্ছে। ফট করে আমার সেই গোমোর দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল।”

“ও...”

“দেখ... তোর জন্য আজ একটা ডিম এনেছি আমি। সেদ্ধ করে।

খোলা ছাড়িয়ে।”

“কী! সে দিনের ওই ডিমটা আজ শোধ দিতে এসেছিস বুঝি? কী যে তোর সব ছেলেমানুষি ব্যাপার... দূর!”

“হাসছিস কেন রে ছোড়দা! হোক ছেলেমানুষি! তুই খাবি আজ আমার সামনে। একদম না বলবি না। নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। দাঁড়া, আমি টিফিন কৌটো থেকে বার

করি ওটা।”

“ঠিক আছে, দে তা হলে... এনেছিস যখন। তবে গোটাটা নয় কিন্তু, আদ্ধেকটা। আদ্ধেকটাই তো তোর ঋণ ছিল, তাই না? তা ছাড়া, জানিসই তো, পূর্ণতা আমার সয় না। আমার জীবনটাই তো অর্ধেক। বরাবরই আধখানা...”

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Short Stories Wrinmukti Rabibasariya Short Stories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy