Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

খুদে চুটিয়া

শীতকাল। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা মনোরম শহরটিতে সশব্দে হাই তুলতে তুলতে ঢুকে পড়ল ট্রেন। এর পর আর একটি মাত্র স্টেশন, ট্রেনের গন্তব্য। ভোরের আড় ভাঙেনি। গোঁ গোঁ করে একঘেয়ে নাক ডাকতে লাগল ইঞ্জিনটি।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:৫০
Share: Save:

কঠিন লোহার স্তম্ভ, নীচে শক্ত সিমেন্টের বলয়ে প্রথিত। তারই আড়ালে আড়ালে ওরা লুকিয়ে থাকে। কিংবা রেলপথের উপর দিয়ে যে উড়াল সেতু, তার সিঁড়ির তলায় গাদা করে রাখা মালপত্রের মাঝে, অথবা পানিগুমটির অন্তরালে। দেখা দিতে না চাইলে কেউ ওদের দেখতে পায় না। যারা থেকেও নেই, তাদের পক্ষে আত্মগোপন অতি সহজ কাজ।

যাত্রীরা রেলের বেঞ্চে গুছিয়ে বসার পর যখন যে-যার চিন্তায় মগ্নতার অবসর গড়ে, তখন যে ভাবে গুটি গুটি বেরিয়ে আসে ছারপোকা, কামড়ায় কুটুস-কাটুস, ঘুরঘুর করে রেলজাত খুদে আরশোলা, অতি চালাক নেংটি ইঁদুর পড়ে-থাকা ছোলাভাজা, বাদাম বা বিস্কুট নিয়ে পালায় তেমনি ওরা। একটু-আধটু চুরিচামারি, খাদ্যলোভ, তারই মধ্যে সদর্প আত্মসম্মানপ্রদায়ী উপার্জন প্রয়াসও দেখা দেয়। প্ল্যাটফর্মে যখন রেলের তকমা-আঁটা মালবাহক মেলে না, তখন ওরা গুটিগুটি জমা হয়ে যায়। কোন অজানিত গোপন গা-ঢাকা সরিয়ে প্রগাঢ় ছায়ার মতো উদয় হয়ে ক্রমশ বিকাশ পেতে থাকে বাস্তব চেহারায়।

******

শীতকাল। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা মনোরম শহরটিতে সশব্দে হাই তুলতে তুলতে ঢুকে পড়ল ট্রেন। এর পর আর একটি মাত্র স্টেশন, ট্রেনের গন্তব্য। ভোরের আড় ভাঙেনি। গোঁ গোঁ করে একঘেয়ে নাক ডাকতে লাগল ইঞ্জিনটি।

দলে দলে লোক নামছে। খুব বড় আর ভারী স্যুটকেস নিয়ে মেয়েটি অপেক্ষা করছিল। টেনে-হিঁচড়ে নামাতে পারল যখন, অন্যরা হাঁকাহাঁকি করে মালবাহকদের দখল নিয়েছে। যাত্রীর তুলনায় মালবাহকের সংখ্যা নগণ্য। সব কিছু ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই সে একা হয়ে গেল। একা হওয়ার মধ্যে সাধারণত এমনই আকস্মিকতা থাকে। কার্যকারণ সম্যক উপলব্ধির আগেই বিপুল বোঝা সমেত মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে সঙ্গীহীন, নির্ভরতাহীন। মেয়েটি এ দিক-ও দিক দেখছে। কথা আছে, এ কজন আসবে তাকে নিয়ে যেতে। সে সঙ্গে এনেছে অনেকগুলি বই, কিছু খাতা, শীতের পোশাক, অন্যান্য জামাকাপড়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি— সাবান, শ্যাম্পু, ক্রিম, প্রসাধনী।

যে তাকে নিতে আসবে, বলেছিল, ‘‘এ শহরে সব পাওয়া যায়। তুমি কী ক্রিম মাখো? কোন বডি লোশন? কোন শ্যাম্পু? এখানে সব পাবে। সমস্ত বড় বড় বাজার এখানে যাবতীয় পসরা নিয়ে হাজির। শুধু শুধু একগাদা বয়ে এনো না।’’

মেয়েটি শোনেনি। এ সব তার নিজস্ব। ফেলে আসবে কেন?

স্যুটকেসের হাতল ধরে মেয়েটি তার কথা ভাবতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যেই প্ল্যাটফর্ম শুনশান হয়ে উঠেছে। তার পিছনে চালচিত্রের মতো দাঁড়ানো, লালে-হলুদে ছোপানো রঙিন ট্রেন নড়ে উঠল। লোহার কঠিন চাকা আর শক্ত সহনশীল লৌহপথে ঘষাঘষির শব্দ তুলে চলতে শুরু করল। এখনও কুয়াশা ঘন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রইল। সে বলেছিল, ‘‘তুমি পৌঁছবার আগেই আমি চলে আসব। পোর্টার পাবে না অত সকালে। স্যুটকেস আমি নামিয়ে দেব। যদি একটু দেরি হয়, সকালে কুয়াশা থাকে, গাড়ি চালানো অসুবিধে, তখন তোমার কামরা থেকে নেমে, ঠিক সেখানেই অপেক্ষা কোরো।’’

‘‘স্যুটকেস?’’

‘‘কেউ না কেউ ঠিক নামিয়ে দেবে। সুন্দরীদের স্যুটকেস বইবার লোকের অভাব হয় না।’’

বাস্তবে সে রকম হল না। কেউ মেয়েটিকে সাহায্য করল না। সৌন্দর্য অবহেলিতও হয়, প্রতারিতও হতে পারে। মেয়েটিও সহযাত্রীদের ওপর নির্ভর করে বসে ছিল, এমন নয়! সে যার সহায়তা প্রত্যাশা করছিল, সে পৌঁছয়নি।

কোনও বেঞ্চে বসবে কি না ভাবতে লাগল মেয়েটি। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল সে দাঁড়িয়ে আছে। ছ’টা পাঁচে ট্রেন ঢুকেছিল। ছ’টা কুড়িতে নড়তে নড়তে চলে গেল। এখন হিম হাওয়ায় তার কান ব্যথা করছে। জমে যাচ্ছে নাকের ডগা, হাতের পাতা। মাথার উলের টুপি টেনেটুনে কান ঢাকল। স্যুটকেস দাঁড় করিয়ে দু’হাত ঘষল। খালি বেঞ্চের আশায় ডান দিক বাম দিক দেখল। জরাজীর্ণ কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ে শুয়ে আছে কারা যেন। নিশ্চিন্ত ঘুম। যেখানেই হোক, ঘুম আসাটাই বড় কথা। এলে সে আরাম নিয়েই আসে।

চল্লিশ মিনিট। সে অপেক্ষা করছে তো করছেই। এত ক্ষণে পকেট থেকে ফোন বেরিয়ে এল। যেন এই ঠান্ডায় পকেটমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল যন্ত্রটি।

ফোন কানে চেপে আছে। কথা নেই। হয়তো বেজে চলেছে। হয়তো ব্যাপৃত থাকার কুঁক কুঁক।

সাতটা বাজতে দশ। কুয়াশা ভেদ করে আলো ঢুকে পড়েছে রেল চত্বরে। হুহু ঠান্ডা বাতাসের বিরাম নেই। আর পনেরো মিনিট দাঁড়াতে পারলেই পুরো এক ঘণ্টার অপেক্ষা হয়ে যেত। কিন্তু মেয়েটি আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। বার বার ফোন তুলছে কানে। ভারী স্যুটকেস টানতে গিয়ে বার বার হাতবদল করছে।

কোথায় যাবে? গায়ে পুরু জ্যাকেট ও জিন্স ট্রাউজার্স সত্ত্বেও কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে।

তখনই ছেলেটির আবির্ভাব হল। রোগা, কালো, পুঁচকে। নাকের পোঁটা টানছে। গায়ে ছেঁড়া ময়লা সোয়েটার। একটু ছোটও। ঢলঢলে আধপেন্টুল। পায়ে কিছু নেই। খালি। বলল, ‘‘কোথায় যাবে? অ্যঁা? দিদি? ও দিদি! কোথায়? ও দিকে? ট্যাসকি ইস্ট্যান্ড?’’

‘‘না। এমনিই। আমাকে নিতে আসবে।’’

‘‘গাড়ি আনবে? হ্যাঁ, দিদি? গাড়ি?’’

‘‘হুঁ।’’

‘‘তা হলেও তো ওখানেই যেতে হবে। ওভার বিরিজের ওপার। ট্যাসকি ইস্ট্যান্ডের পিছনে কার পার্কিং।’’

মেয়েটি উড়াল-সেতু উঠবার চওড়া সিঁড়ির কাছে দাঁড়াল। অনেক উঁচু। এই স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না সে। এক জন মালবাহককেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সে আবার ফোন কানে তুলল। কথা হল না।

‘‘ওপারে তোমাকে যেতেই হবে।’’

‘‘সে তো বুঝলাম।’’

‘‘এখন তুমি কুলিও পাবে না। পরের গাড়ি সাড়ে দশটায়। তখন সব হাট্টাকাট্টা কুলিরা আসবে।’’

‘‘তার আগেই আমি চলে যাব।’’

‘‘সে তো যাবে। কিন্তু ওপারে যেতে হবে তো। ওখানে দাঁড়ালে যত গাড়ি ইস্টিশানে ঢুকছে, তুমি দেখতে পাবে। রোদ উঠেছে, আরাম হবে দিদি। এখানে তো অনেক হাওয়া।’’

‘‘তোমার কী চাই? তুমি ঘুরঘুর করছ কেন?’’

‘‘আমি ভিক্ষা চাইছি না। চাই না।’’

‘‘তো?’’

‘‘বেশি না, দু’শো টাকা দাও, তোমার বাক্সটা ওপারে করে দেব।’’

‘‘দু’শো!’’

‘‘দেখেই বুঝেছি, ভারী।’’

‘‘তাই বলে দু’শো? আর তুমি তুলবে এই স্যুটকেস? তুমি!’’

‘‘না, আমি একা না। আর এক জন আছে, দু’জনে। ডেকে আনি?’’

‘‘দু’শো দেব না কিন্তু।’’

‘‘কত দেবে?’’

‘‘পঞ্চাশ।’’

‘‘আচ্ছা দেড়শো টাকা দাও। অ্যঁা? দেড়শো?’’

‘‘বললাম তো। পঞ্চাশ।’’

‘‘আচ্ছা আশি টাকা দাও দিদি।’’

‘‘পঞ্চাশ।’’

‘‘পঞ্চাশ টাকায় হয় না। কুলি ধরলে দেড়শো নিয়ে ছাড়ত। সকালে এটাই প্রথম বিজনেস, তাই নিচ্ছি। ডেকে আনি তা হলে? অ্যঁা? টাকাটা কিন্তু আমার হাতেই দিও দিদি।’’

মেয়েটি কিছু বলার আগেই ছেলে ছুট লাগাল এক হাতে পেন্টুল সামলাতে সামলাতে। সঙ্গে নিয়ে ফিরল ওর চেয়ে দু-তিন বছরের বড় এক জনকে।

‘‘চলো এ বার। এই রাজু, তুই ও দিকে ধর, আমি এ দিকে।’’

‘‘দাঁড়াও,’’ মেয়েটি বলল, ‘‘আমি তো বলিনি তোমাদের দিয়ে কাজটা করাব।’’

‘‘তবে যে দরাদরি করলে।’’

‘‘শোনো, তোমার বয়স কত?’’

‘‘আমার? ছয়-সাত হবে।’’

‘‘আমার দশ,’’ খুব দর্পের সঙ্গে বলল সদ্য-আগত রাজু। মেয়েটি বলল, ‘‘তোমরা খুবই ছোট। শিশু। তোমাদের দিয়ে কাজ করাতে পারব না কারণ সেটা বেআইনি। শিশুশ্রম বেআইনি, বুঝলে?’’

‘‘কিন্তু আমরা তো পঞ্চাশেই রাজি।’’

‘‘বলেছি তো, দেব না তোমাদের।’’

মেয়েটি আবার কানে ফোন তুলল। কথা নেই। ছেলে দু’টি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল একটু, তার পর মিলিয়ে গেল।

‘‘আমি বয়ে দিই বাক্সটা? ওই পঞ্চাশই দেবেন। খুশি হলে না হয় দেবেন আর দশটা টাকা। আমার বয়স আঠারো।’’

মেয়েটি চমকে তাকাল। যেন মাটি ফুঁড়ে এল ছেলেটা। রোগা, লম্বা, কালো, নোংরা শার্টের ওপর ছেঁড়া ছেঁড়া হাফহাতা সোয়েটার। রুখু চুল। নোংরা ট্রাউজার্স। পায়ে এক জোড়া হাওয়াই। আর ঠোঁটের ওপর গোঁফের হালকা আভাস।

‘‘পারবে?’’

‘‘পারব না? এর চেয়ে ভারী ভারী মাল তুলি দিদি।’’

‘‘বেশ। নাও। চলো ও পারে।’’

ছেলেটি টলোমলো করে স্যুটকেসটি নিল। চললও টলে টলে। তার সাধ্যাতিরিক্ত ভার তুলেছে। হঠাৎ আগের দু’টি ছেলে উদয় হয়ে পথ আটকাল।

‘‘আমাদের দিলে না, ওকে দিলে যে!’’

‘‘ও তো বড়।’’

‘‘কত বড়? অ্যঁা? আঠারো বলল? আঠারো? কালু পনেরোর বেশি কিছুতেই নয়।’’

‘‘বললাম তো, তোমরা শিশু, তোমাদের দিয়ে কাজ করাব
না আমি।’’

সরে পড়ল ওরা। মেয়েটি কালু নামের ছেলেটিকে অনুসরণ করছে। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলেছে কালু। এই বুঝি স্যুটকেস ফেলে দিল! এই বুঝি গড়িয়ে পড়ল নিজেই। হাওয়াই চটিতে একটা সেফটিপিন। গেঁথে
না যায়।

বড়ই উদ্বেগে সেতু অতিক্রম করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে গেল তারা। রোদ্দুর ঝলমল করছে। কালু ছেলেটা কপালের ঘাম মুছল। মেয়েটি ষাট টাকা দিল তাকে। সেলাম করল কালু। চলে গেল। মেয়েটি এ বার ঘন ঘন নিষ্ফল ফোন করতে লাগল।

******

দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল মেয়েটি এই স্টেশনে নেমেছে। যার আসার কথা, আসেনি এখনও। ফোনও ধরেনি। মেয়েটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোথায় যেতে চায় জিজ্ঞেস করে গিয়েছে কয়েক জন। সে অকম্পিত বলেছে, ‘‘ট্যাক্সি চাই না। এক জন আমাকে নিতে আসবে।’’

কিন্তু এখনও এল না কেন? কেন ফোন তুলছে না? কোনও অসুবিধে! অসুস্থতা! দুর্ঘটনা! উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় মেয়েটি গরম বোধ করছে। উলের টুপি খুলে ফেলল। জ্যাকেটের চেন টেনে নামাল।

‘‘দিদি, ও দিদি!’’

সে তাকাল। কালু নামের ছেলেটা।

‘‘দিদি, ওদের বুঝিয়ে বলো তো, তুমি নিজেই আমাকে মাল বইতে দিয়েছ। আমি তোমাকে ভাঙাইনি।’’

‘‘মানে?’’

‘‘ওই ওরা... আমার কথা বিশ্বাস করছে না।’’

‘‘কারা?’’

মেয়েটি ঘুরে তাকাল। সেই খুদে দু’জন। সঙ্গে এক দল জুটিয়েছে। বলছে, ‘‘আমি যখনই রাজুকে ডাকতে গেলাম, ও এসে তোমার সঙ্গে রফা করে নিল, তাই না? ও-ই বলল তো, আমাদের মাল না দিয়ে ওকেই দিতে?’’

‘‘না তো। আমি তোমাদের কেন স্যুটকেস টানতে দিইনি, সে তো বললাম।’’

‘‘কিন্তু তুমি ওকে ষাট টাকাও দিলে। আর আমরা দু’জন পঞ্চাশে করে দিচ্ছিলাম।’’

‘‘দেখো, আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে, আমি করেছি, অত কথা তোমাদের বলতে পারছি না।’’

আরও এক বার সেলাম করে চলে যাচ্ছে কালু। শহরের রাস্তা থেকে নেমে রেলচত্বরের অভ্যন্তরে। ধীরে, নিশ্চিন্তে হাঁটছে সে। খুদে দলটি ওর দিকে ধাবমান। পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। ও ছাড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করল, পারল না। আক্রমণকারীরা খুদে, কিন্তু দলে ভারী। পাঁচ জন ওকে মাটিতে ফেলে লাথি-ঘুষি মারল। কেড়ে নিল টাকাকড়ি। কালুর ঠোঁট কাটল, মাথা থেঁতলে গেল, চোখের নীচে কালশিটে পড়ল। কষ্টার্জিত রোজগার ছিনতাই হয়ে গেল। ও ধুলোয় পড়ে রইল। মেয়েটি ফোনে কথা বলার প্রয়াস সমেত নির্বিকার চোখে দৃশ্যটি দেখল। কালুও প্রতিক্রিয়াহীন দেখছিল মেয়েটিকে। হাতে রক্ত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল।

******

স্টেশনের বাইরে টিমটিমে আলো জ্বলা ঝোপড়ি। আসলে খাবারের দোকান। ভাত, ডাল, রুটি, তরকারি, ডিমভাজা সস্তায় পাওয়া যায়। কালু রুটি-সবজির জন্য বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিল। মাথার ওপর খোলা আকাশ। কনকনে ঠান্ডা কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। এগারোটায় একটা গাড়ি আসবে। তার পর দেড়টায়। স্টেশনে সামান্য জনসমাগম হবে তখন।

ঝোপড়ির আড়াল থেকে একটা ছোট্ট ছায়া দেখা দিয়েই লুকিয়ে পড়ল। আবার উঁকি মারল। রুটি বেলছিল এক মহিলা, ভাজছে এক জন পুরুষ। মহিলা চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘আবার এসেছিস? বললাম না পয়সা না দিলে কিছু পাবি না! এটা কি লঙ্গরখানা? নাকি যিশুর প্রসাদ? যা ভাগ!’’

কালু বলল, ‘‘কে কাকি? চুটিয়া?’’

‘‘আব্বার কে? উনতিরিশ টাকা ধার। ফের বাকিতে খাওয়ার তাল। আর দিতে পারব না।’’

কালু ডাকল, ‘‘এই চুটিয়া, এদিকে আয়।’’

জড়তাময় পায়ে ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়াল সকালবেলার সেই খুদে। মুখ নিচু। পোঁটা টানছে। কালু বলল, ‘‘তোর টাকা কী হল?’’

‘‘রোজগার হয়নি।’’

‘‘সকালে আমাকে মেরে কেড়ে নিলি যেটা?’’

‘‘রাজারাম হাতি কেড়ে নিয়েছে।’’

‘‘কেন?’’

‘‘ধার ছিল। জ্বর হয়েছিল। টাকা নিয়ে ওষুধ কিনেছিলাম।’’

‘‘বসে যা। চারটে রুটি বলেছি। তুই দু’টো খা, আমি দু’টো।’’

শান্ত ভাবে মাথা নেড়ে খেতে বসল খুদে চুটিয়া। সারা দিন প্রায় কিছুই জোটেনি। প্রথম রুটিটা গোগ্রাসে খেল। তার পর দু’ঢোক জল পান করে বলল, ‘‘এখনও ব্যথা আছে কালু?’’

‘‘ভুলে যা।’’

ওর মাথায় কাপড়ের পটি। গালে তুলোর ওপর লিউকোপ্লাস্ট। চোখের তলায় কালশিটে তপতপ করছে। খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে দু’জনে কাঁপতে কাঁপতে স্টেশনে চলল। কোথাও সেঁধিয়ে যাবে। একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। খুদে বলল, ‘‘কালু, দ্যাখ।’’

ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে এসেছে সেই মেয়েটি। মাথায় উলের টুপি। গালে তুলোর ওপর লিউকোপ্লাস্ট। ঠোঁট ফুলে আছে। চোখের নীচে কালশিটে। গায়ে জ্যাকেট।

ডিকি থেকে স্যুটকেস বের করে রাস্তার ধারে রেখে দিল ট্যাক্সিওয়ালা। মেয়েটি এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছে।

খুদে বলল, ‘‘যা কালু, আমাকে তো দেবে না।’’

‘‘বোধহয় এগারোটার গাড়ি ধরবে। কোনও হাতি আসে কি না দেখি।’’

স্টেশনের তকমা-আঁটা পূর্ণবয়স্ক মালবাহকদের ওরা হাতি বলে।

‘‘গালটা দ্যাখ, কেটে গিয়েছে। তোর মতো। মেয়েছেলেকে কে
মারল রে?’’

‘‘অন্য ভাবেও লাগতে পারে।’’

‘‘এহ্‌! মেয়েটা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন হাতিগুলো সব মাল খেয়ে আছে। তুই যা কালু।’’

‘‘তুইও চল না।’’

‘‘চল।’’

দু’জনে মেয়েটির কাছে গেল।

‘‘কুলি লাগবে দিদি? কোন গাড়ি ধরবেন?’’

মেয়েটি উদাস! ওদের চিনতেও পারল না যেন। বলল, ‘‘কোন গাড়ি? কলকাতা যাওয়ার গাড়ি আছে?’’

‘‘রাত দেড়টায়।’’

‘‘ওতেই যাব।’’

‘‘বিরিজ পেরিয়ে ও দিকের প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে দিদি।’’

‘‘চলো।’’

খুদে চুটিয়া ফট করে বলে বসল, ‘‘আড়াইশো টাকা। গাড়িতে তুলে দেব, একদম লেডিজ কামরা।’’

‘‘বেশ তো।’’ কোনও দরাদরি নেই। প্রশ্ন নেই।

দু’জনে মুখ চাওয়া-চাউয়ি করল। কালু টলমল করতে করতে স্যুটকেস ঘাড়ে তুলে নিল। চুটিয়া তার পাশে পাশে চলতে লাগল। মেয়েটি আসছে ধীরে, এলোমেলো পায়ে। স্যুটকেসের দিকেও চোখ নেই। অন্য কোনও জগতে তার মন।

চুটিয়া বলল, ‘‘আমার দেড়শো।’’

কালু বলল, ‘‘কেন? মাল আমি টানছি না? তোকে পঞ্চাশ দেব।’’

‘‘আমি বুদ্ধি খাটিয়ে আড়াইশো বললাম না? তুই তো সকালের রেটটাই বলতে যাচ্ছিলি।’’

‘‘আমাকে দেড়শো দে, তুই একশো রাখ। কাল দু’জনেই এক জোড়া করে চটি কিনব, হ্যঁা?’’

‘‘ঠিক আছে। দেড়টা পর্যন্ত ঘুমোতেও তো পারব না। ডবল মাল পাহারা দিতে হবে।’’

‘‘ফাঁকা ইস্টিশান। মেয়েছেলে মানুষ। দিতে তো হবেই।’’

‘‘কালু।’’

‘‘বল।’’

‘‘হাতিরা সুযোগ পেলেই আমাদের পেটায়। আমরা দলে ভারী থাকলে যে একলা তাকে পিটাই। মেয়েছেলেকে কে পেটায়?’’

‘‘সবাই।’’

‘‘কেন?’’

‘‘লেডিজ না?’’

‘‘কালু, তোর মা আছে?’’

‘‘ছিল। মরে গেছে। নয় জন মিলে মেরেছিল। তোর মা?’’

‘‘আছে।’’

‘‘কোথায়?’’

‘‘কী জানি! আছে কোথাও!’’

দু’জনে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কাল খুব সুন্দর একটা দিন। নতুন চটি কিনবে। খুদে চুটিয়া গান ধরল, লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE