Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

নীল তিমি

আজ শিক্ষক দিবস। স্কুল জুড়ে উৎসবের আমেজ। শিক্ষকদের পড়ানোর তাড়া নেই, ছাত্ররাও অনেকটা বাঁধনহীন।

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

সুস্মিতা নাথ
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

হ্যাপি টিচার্স ডে স্যর,” লাল রঙের সুদৃশ্য খামটা স্যরকে দিতে দিতে বলল কুশল।

আজ শিক্ষক দিবস। স্কুল জুড়ে উৎসবের আমেজ। শিক্ষকদের পড়ানোর তাড়া নেই, ছাত্ররাও অনেকটা বাঁধনহীন। ফোর্থ পিরিয়ডের পরে অ্যাসেমব্লি হলে টিচার্স ডে সেলিব্রেশন হবে। কুশল সেখানে বক্তব্য রাখবে ‘ছাত্রদের জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা’ নিয়ে। কয়েক জন বাছাই করা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অনুষ্ঠানটা করাচ্ছেন মধুরাম্যাম। কুশল বরাবরই ভাল বক্তা বলে, ওকেই প্রথম বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাবা-মা বা মধুরাম্যামের সাহায্য ছাড়াই স্পিচটা নিজেই লিখেছে কুশল। অনেক বার রিহার্সাল দিয়ে তৈরি।

অনিকেতস্যর ওদের অঙ্ক পড়ান। আবার ক্লাস টিচারও বটে। আজ পড়ানোর তাড়া নেই দেখে তিনি ক্লাসেই বসে সদ্য পাওয়া কার্ডগুলো খুলে দেখছেন। একটি করে কার্ড তুলছেন, কার্ডের তারিফ করছেন, এবং সেই সঙ্গে কার্ডদাতাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। ছাত্রদের সবার চোখ তাই স্যরের দিকেই। কুশলও উদগ্রীব হয়ে আছে, ওর কার্ডটা দেখে স্যর কী বলেন শোনার জন্য। স্যর নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। অনেক রাত অবধি জেগে নিজের হাতে কার্ডগুলো বানিয়েছে সে। ও ভাল আঁকতে জানে। জলরং ও স্প্রে পেন্টিং মিলিয়ে করেছে কার্ডগুলো। সকালে বাবা দেখে প্রশংসা করেছেন। নিজেরও ভাল লেগেছে কুশলের। যদিও পড়াশোনা, বিশ্রাম ও ঘুম বাদ দিয়ে এতটা সময় নষ্ট করে কার্ড বানাতে দেখে মা গজগজ করছিলেন। বলছিলেন, ‘‘কার্ড তো কিনেই আনা যেত।’’ কিন্তু কুশল রাজি হয়নি। কিনে আনা আর নিজের হাতে তৈরি করে দেওয়া কি এক হল? মাকে বুঝিয়েছিল সে।

এই তো, স্যর ওর কার্ডটাই তুলেছেন। খামটা উল্টেপাল্টে দেখে কার্ডটা বার করলেন তিনি। নড়েচড়ে বসে কুশল। স্যরের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে। স্যর কি খুশি হয়েছেন? নাকি অবাক হয়েছেন? উৎকণ্ঠায় ছটফট করছে সে। ঠিক তখনই কার্ডটা তুলে ধরে স্যর বলে উঠলেন, “সবাই এ দিকে দেখো, এটা দিয়েছে শ্রীমান কুশল ভৌমিক। কেনা নয়, বানানো।”

“ওয়াও! কী সুন্দর। তুই নিজে বানিয়েছিস কুশল?” পাশে বসা সুমনের বিস্ময় ভেসে এল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে পুরো ক্লাস। কিন্তু খুশিতে উদ্বেলিত হতে গিয়েও পলকেই থমকে গেল কুশল। কারণ পরমুহূর্তেই স্যর বলছেন, “দেখো কাণ্ড! পয়সা বাঁচাতে নিজেই কাগজে রং করে কার্ড বানিয়ে ফেলেছে কুশল। ওর কৃপণ বাবা একটা কার্ডও কিনে দিতে পারল না! একেই বলে জাত কৃপণ,” বলতে বলতে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠেছেন স্যর।

কুশল হতবাক! স্যরের হাসি থামতে না থামতেই এ বার ক্লাস জুড়ে হাহাহিহি হাসির সুনামি আছড়ে পড়েছে। মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে কুশলের। লজ্জায় অপমানে রক্তাভ হয়ে উঠেছে চোখমুখ। ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ওর বাবা কৃপণ নয়। বরং মা তো নিজের থেকেই বলেছিলেন, কার্ড কিনে নেওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না কুশল। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বার করতে পারে না। গলার কাছে ভীষণ একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠেছে। চোখ দু’টো অসম্ভব জ্বালা করছে। প্রাণপণে চোখের জল সামলাতে চেষ্টা করে সে। সে কল্পনাও করতে পারেনি এ ভাবে সকলের সামনে স্যর তাকে অপমান করতে পারেন।

স্যর ক্লাস থেকে চলে গেছেন। এর পরপরই এসেছেন সুচন্দ্রাম্যাম। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে আবার বলে উঠেছে, “হ্যাপি টিচার্স ডে ম্যাম।” অনেকেই ম্যামকে কার্ড দিয়ে আসছে। কুশলও ম্যামের জন্য কার্ড এনেছে। কাল গুনে গুনে বারোটা কার্ড বানিয়েছে সে। সব বিষয়ের টিচাররা ছাড়াও প্রিন্সিপালম্যাম, স্পোর্টস টিচার ও মধুরাম্যামের জন্যও বানিয়েছে। সে জন্যই তো অত রাত হয়ে গিয়েছিল। শুধু কার্ড বানালেই তো হবে না, খাম বানানো, কার্ডের ভিতরে সুন্দর করে নাম ও মেসেজ লেখা— কত কাজ! সব নিখুঁত করে করেছে সে।

কার্ডগুলো সযত্নে ব্যাগের ভিতরেই আছে। কিন্তু বার করে ম্যামকে দিয়ে আসতে আর ভরসা হচ্ছে না কুশলের। ম্যামও যদি অনিকেতস্যরের মতো ওর বাবাকে কৃপণ বলেন? ক্লাস সেভেনের কুশলের মাথায় আতঙ্ক চেপে বসেছে। এক এক করে সব শিক্ষকেরাই ক্লাসে এলেন। কিন্তু কাউকে আর কার্ড দিল না সে।

এখন টিফিন। এর পরে আজ আর ক্লাস নেই। অ্যাসেমব্লি হলে অনুষ্ঠান শুরু হবে। সবাই যে যার টিফিন নিয়ে বসেছে। সেই সঙ্গে চলছে হই-হুল্লোড়, হাসি হট্টগোল। কুশল এখনও ওর টিফিন বার করেনি। ওর আজকে খেতেই ইচ্ছে করছে না। চুপ করে নিজের জায়গায় বসে রইল।

হঠাৎ পিছনের বেঞ্চ থেকে আয়ানের চিৎকার ভেসে এল, “কী রে কিপটে কুশল, পয়সা বাঁচানোর জন্য কি আজ টিফিনও আনিসনি?” সঙ্গে সঙ্গে ভিকি, আদিত্য, চন্দনদের সমবেত হাসি। ‘কিপটে কুশল’ শব্দজোড়া ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ক্লাসের ভিতরে। কুশল দু’হাতে কান চেপে ধরে। মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে ওঠে। ঠিক তখনই পাশে বসা সুমন প্রতিবাদ করে ওঠে, “কুশল কত সুন্দর কার্ড বানিয়েছে দেখেছিস? তোরা ও রকম বানাতে পারবি কেউ? কেনা কার্ডের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ওর হাতে বানানো কার্ড।”

“আরে দেখ দেখ, রামের হনুমান এসেছে। আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে!” দল বেঁধে সুমনের দিকে তেড়ে এল আয়ানের দল। সুমন গুটিয়ে যেতে বাধ্য হল।

কুশলের এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন ও বড় হয়েছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সবার সামনে কেঁদে ফেলাটা লজ্জার কথা হবে। ও প্রাণপণে কান্না চেপে রাখে। টেবিলে মাথা গুজে নিশ্চল বসে থাকে ও। সুমন এসে ওর পিঠে হাত রাখে। বন্ধুর স্পর্শ পেয়ে চোখের জল বাধ মানে না কুশলের। সুমন বলে, “তুই কিন্তু অনিকেতস্যরের কাছে টিউশনটা পড়লেই পারতিস। টিউশন পড়িস না বলেই স্যর তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।”

সুমনের কথা শুনে অবাক চোখে তাকায় কুশল। বলে, “কিন্তু আমার তো আলাদা করে টিউশনের দরকার হয় না। অঙ্ক নিজেই করে নিতে পারি। তা ছাড়া বাবাও আমাকে দেখিয়ে দেয়।”

“জানি,” সুমন বলে, “কিন্তু কী জানিস, তোকে একটা সিক্রেট বলতে চাই। তুই কাউকে বলবি না তো?”

বন্ধুকে আশ্বস্ত করে দু’পাশে মাথা ঝাঁকায় কুশল। সুমন চারদিকে এক বার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিশ্চিত হয়, অন্য কেউ ওদের কথা শুনছে না। এর পর গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “ক্লাসের সবাই আমরা অনিকেতস্যরের কাছে টিউশন পড়ি। শুধু তুইই পড়িস না। এর জন্য স্যর তোর উপরে খাপ্পা। এ বার ইউনিট টেস্টে তুই যে অঙ্কে কম নম্বর পেয়েছিস, এই নিয়ে স্যর খুব হাসাহাসি করেছিল। বলেছিল,

স্যর নাকি ইচ্ছে করেই তোকে কম নম্বর দিয়েছে।”

যা শুনছে সবই বড় অবিশ্বাস্য ঠেকছে কুশলের কাছে। বিস্ময়ে বলে ওঠে, “সত্যি বলছিস?”

হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলায় সুমন। তার পর বলে, “স্যর বলেছিল, ‘দেখলি তো টেস্টে কত কম পেয়েছে কুশল? অ্যানুয়ালে আরও কম দেব। এ বারে অঙ্কে সব চেয়ে বেশি পাওয়া তো দূর, পাশ করে কি না দেখে নিস। এমন এমন ভুল বার করে কেটে দেব যে কিচ্ছু বলতে পারবে না। তখন সুড়সুড় করে আসবে টিউশন পড়তে! আরে, আমি নিজে যেচে টিউশনের কথা বললাম, তাও শুনল না? পুঁচকে ছেলের কী দেমাক!”

“স্যর এমন বলেছে!” বিস্ময়ে স্তব্ধ কুশল। যেন সাংঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছে। ভয়ার্ত চোখে সুমন বলল, “প্লিজ কুশল, আমি যে তোকে বলে দিয়েছি, এ কথা কিন্তু স্যরকে জানাস না। আমাকে খুব বকুনি দেবে স্যর। হয়তো আমাকেও অঙ্কে ফেল করিয়ে দেবে।” নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে বন্ধুকে নিশ্চিত করে কুশল।

অ্যাসেমব্লি হল ভিড়ে ঠাসা। প্রথম দুই সারিতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বসেছেন। পিছনে ছাত্রছাত্রীরা। কলাকুশলীরা স্টেজের পাশের সাজঘরে। অনুষ্ঠান শুরুর অন্তিম মুহূর্তেও মধুরাম্যাম ওদের একের পর এক ইনস্ট্রাকশন দিয়ে চলেছেন। এই অনুষ্ঠানটার জন্য খুব খেটেছেন ম্যাম। টানা এক মাস ধরে এর প্রস্তুতি চলেছে। রোজকার রিহার্সাল, ড্রেস সিলেকশন, মিউজ়িক সেট করা, স্টেজ সাজানো, সব কিছু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ম্যামই করেছেন। এখনও নানা কাজে ব্যস্ত ম্যাম।

উদ্বোধনী সঙ্গীত শেষ হতেই কুশলের নাম ঘোষণা হল। কুশল ধীর পায়ে স্টেজে উঠল। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করল ওর বক্তব্য। কিন্তু এ কী! ও যে কিছুই মনে করতে পারছে না! সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর করে স্পিচটা তৈরি করেছিল, অথচ এখন কিছুই মনে করতে পারছে না! সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। মুখোমুখি দর্শকাসনে স্যর-ম্যামেদের থমথমে মুখ নজরে আসছে। প্রথম সারিতেই অনিকেতস্যর বসে আছেন। স্যরের মুখে কেমন বিদ্রুপের হাসি না? অন্যরাও কি তেমন ভাবেই হাসছেন? কুশল বুঝতে পারছে না। যতই ভাবছে, ততই গুটিয়ে যাচ্ছে সে। একটা বাক্যও সম্পূর্ণ হচ্ছে না, একটা শব্দও ঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারছে না। চোখ ফেটে জল আসছে। হলের ভিতরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। হাসির শব্দও ভেসে আসছে। “ভুলে গেছে ভুলে গেছে কিপটে কুশল...” আর সহ্য করতে পারছে না কুশল।

ঠিক তখনই মধুরাম্যামের গলা, “নেমে এস কুশল।”

কুশলের চোখে এখন ঘন অন্ধকার। ছুটে নেমে আসে স্টেজ থেকে। সিঁড়ির মুখেই ম্যাম দাঁড়িয়ে, “কী হল কুশল? এত রিহার্সাল, তবুও...”

ম্যাম বিস্মিত, ব্যথিত। এত দিন ধরে এত পরিশ্রম করলেন তিনি, এত যত্ন করে শেখালেন, রিহার্সাল দেওয়ালেন, তবুও শুরুতেই এমন থমকে গেল অনুষ্ঠানটা! কুশলের এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। কাঁপা কাঁপা স্বরে শুধু বলতে পারল, “সরি ম্যাম।” তার পরেই কেঁদে উঠল সে।

“চুপ কর। এখন কেঁদে কেঁদে ন্যাকামি হচ্ছে? দিলি তো অনুষ্ঠানটা মাটি করে?” অনিকেতস্যরের ধমকে চমকে উঠল কুশল। স্যর যে কখন দর্শকাসন ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন, কুশল খেয়ালই করেনি। স্যর মধুরাম্যামের দিকে ঘুরলেন, “একে প্রোগ্রামে কেন নিয়েছ মধুরা? এ তো একটা অপদার্থ ছেলে।” মধুরাম্যাম শুনলেন কি না কে জানে, তিনি এখন পরবর্তী শিল্পীকে স্টেজে পাঠাতে ব্যস্ত।

স্যর আবার কুশলের দিকে ফিরেছেন। কেঁদে চলেছে কুশল। ওর কান্না শুনে স্যর যেন আরও খেপে উঠেছেন। হ্যাঁচকা টানে ওকে সরিয়ে আনেন কিছুটা দূরে। তার পর সজোরে কানে মোচড় দিয়ে হিসহিস করে বলে ওঠেন, “অপদার্থ ছেলে, সমস্ত অনুষ্ঠানটাই নষ্ট করে দিলি? এত খাটল মধুরা, শুধু তোর জন্য পরিশ্রম জলে গেল। তোর জায়গায় আমি হলে, এখনই আত্মহত্যা করতাম।”

আত্মহত্যা শব্দটা যেন সজোরে ধাক্কা দিল কুশলকে। অনুষ্ঠানে খুঁত হওয়ার দুঃখে, নাকি মধুরাম্যামের পরিশ্রম বিফলে যাওয়ায়, নাকি শুধু ওর প্রতি আক্রোশে স্যরের এমন তিরস্কার? বছর তেরোর কুশলের এতটা বোঝার ক্ষমতা নেই। ও শুধু এটাই বুঝল, ও সত্যিই অপদার্থ। আর এমন একটা ‘অপরাধ’ করার জন্য, ওর বেঁচে থাকার সমস্ত অধিকার চলে গিয়েছে।

স্কুল বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার ছাদটা ওকে টানছিল। ভীষণ ভাবে টানছিল। কার্নিশে উঠে এক বার ঝাঁপিয়ে পড়লেই হল। এই স্কুল, বন্ধুরা, স্যর-ম্যামেরা, ওর কেউ নয়। এমন অপদার্থ হয়ে বেঁচে থাকায় কী লাভ? ভাবলেশহীন মুখে সম্মোহিতের মতো ও দিকেই এগোয় কুশল। এ দিকটা এখন বেমালুম ফাঁকা। সারা স্কুল ভিড় করে আছে অনুষ্ঠানে।

কেউ টেরও পেল না যে, কুশল একা একা উঠে এসেছে পাঁচ তলায়। ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে আসা প্রশ্নে থমকে দাঁড়াল সে।

“কোথায় যাচ্ছ কুশল?”

মধুরাম্যাম! এখানে! এখন? তা হলে অনুষ্ঠান কি শেষ হয়ে গিয়েছে? মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে কুশলের। উত্তর জানে না সে। কিন্তু ম্যামের প্রশ্নের উত্তরও সে দিতে পারে না। সিঁড়ির মুখেই স্থাণু হয়ে যায়।

“কী হয়েছে তোমার, কুশল? কোনও সমস্যা?” কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ম্যাম। তাঁর স্নেহের হাত এখন ওর কাঁধের উপরে।

এ বারে বাঁধ ভাঙে সমস্ত কষ্টের। কেঁদে ফেলে কুশল। “আই অ্যাম স্যরি ম্যাম। আমি পারলাম না। সব ভুলে গেলাম।”

“ওহ মাই চাইল্ড! তুমি এখনও এই নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ? কখনও-সখনও এমন হতেই পারে ডিয়ার। এমনকি আমিও অনেক সময় স্টেজে উঠে নার্ভাস হয়ে যাই। কিন্তু তাতে কী? আমরা সবাই জানি, তুমি যে কোনও বিষয় সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারো। ভাল স্পিচ দাও। বেস্ট ওরেটর ইন দ্য স্কুল। কাম অন। চিয়ার আপ মাই চাইল্ড।”

প্রবল বর্ষণের মাঝেও পুরু মেঘের আস্তরণ সরিয়ে এক ঝলক রোদ খেলে যায় বছর তেরোর চোখেমুখে।

ম্যাম বলে চলেন, “পরের মাসে বার্ষিক অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে তো? তোমাকে আর অনুষ্কাকে পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। নাও গেট রেডি ফর ইট।”

মৃদু মাথা ঝাঁকায় কুশল, “ইয়েস ম্যাম”।

তার পরেই কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে এগিয়ে ধরে ম্যামের দিকে, “হ্যাপি টিচার্স ডে ম্যাম।”

কার্ডটা দেখে বিস্মিত এবং উচ্ছ্বসিত ম্যাম। অকৃপণ প্রশংসায় বলে ওঠেন, “ওয়াও! এটা তুমি বানিয়েছ কুশল? অপূর্ব! থ্যাঙ্কস আ লট মাই ডিয়ার।”

মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ আবার রোদ ঝলমলে। পালকের মতো হাল্কা পায়ে ফেরার পথ ধরেছে কুশল।

কেউ টেরও পেল না, একটা তরতাজা প্রাণ একটু স্নেহের পরশেই নীল তিমির শিকার হতে হতে বেঁচে গেল। শুধু কি আন্তর্জালের নিষিদ্ধ কুঠুরিতেই? সমাজের সর্বত্র ঘাপটি মেরে আছে অনিকেতস্যরের মতো শিকারি তিমিরা। তবে সুখের কথা এই যে, মধুরাম্যামেরাও আছেন অভেদ্য বর্মের মতো স্নেহের আঁচল বিছিয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

Literature Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy