Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

রসিক বিবি

বাকি রইল উন্মেষা। কেশবের মূল তিন স্বপ্নচারিণীর মধ্যে তৃতীয় জন। এই সুন্দরী আবার সাংঘাতিক হট।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

সুস্মিতা নাথ
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০২:১৫
Share: Save:

টাক-এর সঙ্গে টাকার তফাত শুধুমাত্র একটা ‘আ-কার’-এর হলেও ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন এই তফাতটা আসলে কী সাংঘাতিক। সত্যিটা হল, টাকের সঙ্গে টাকার ফারাক রীতিমতো দিন-রাত্রির। ঈশ্বর কাউকে টাক দেন তো কাউকে টাকা। অর্থাৎ টাক যাকে দেন তাঁকে টাকা থেকে বঞ্চিত রাখেন, কিংবা এর উল্টোটা। একই ব্যক্তিকে টাক ও টাকা দুটোই দিয়েছেন এমন উদাহরণ কম। কেশ-এর সঙ্গে ক্যাশ-এর গভীর আত্মীয়তা। রতন টাটা থেকে ধীরুভাই-পুত্র মুকেশ (আহা! নামেই কেশ-এর উল্লেখ), কিংবা বিল গেটস দ্য বিলিওনেয়ার, কেউই বীতকেশ নয়। অতএব টাক হটাও টাকা লাও। টাকাকে জীবনে আহ্বান করতে হলে সুকেশ হতে হবে। ক্যাশ ও কেশহীন পুরুষ যেন কেশরবিহীন সিংহ।

আমাদের অলকেশবাবুর কথাই ধরা যাক। অলকেশ থেকে অল্পকেশ এবং ক্রমান্বয়ে বীতকেশ হতে হতে ভেবেছিলেন, বিবি আগে টাক দিচ্ছেন, পরে ওতে ‘আ’-কার জুড়ে দেবেন। কিন্তু দিন-মাস-বছর গেল, যৌবন ফুরিয়ে প্রৌঢ়ত্ব এল, এখন বার্ধক্যেরও উঁকিঝুঁকি, তবু সেই অমূল্য আ-কারটি অধরাই রইল। বিবি বেমালুম এড়িয়ে গেলেন সেটি। আজীবন টাকার পিছনে ঘুরে ঘুরে হা-ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর বোধোদয় হল যে, বিবি বশে না থাকলে এই আ-কারকে সাকার করা সর্বশক্তিমান নিরাকারের দ্বারাও সম্ভব নয়। এতটা শুনে যদি অলকেশবাবুর বিবি অর্থাৎ স্ত্রীধনটিকে দোষারোপ করতে উদ্যত হন, তা হলে শুরুতেই জানিয়ে রাখি, অলকেশ এ ব্যাপারেও নির্ধন, মানে অকৃতদার। অর্থাৎ এই বিবি সেই বিবি নয়, হিয়ার ‘বিবি’ ইজ় দ্য শর্ট ফর্ম অব ‘ভাগ্যবিধাতা’। এই বিবি পাত্রবিশেষে বড়ই রসিক।

অলকেশবাবুর ভাইপো কেশবের কেসটি বিবির এ হেন রসিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উত্তরাধিকার সূত্রে বাপ-কাকার টাকা না পেলেও নিটোল টাকখানা পেয়েছে সে। মধ্যযৌবনেই এমন একটি টাকের অধিকারী হয়ে কেশব বুঝল, জীবনে কেশই সব। টাকা জীবনকে যতটা সহজ করে, টাক ততটাই কঠিন করে তোলে। শুধু টাকের জন্যেই টুকটাক সমস্যা লেগেই রইল জীবনে। শুধুমাত্র

টাকের জন্যেই টেকসই হল না কত সম্পর্ক! কবরীর সঙ্গে তার বাল্যপ্রেম ছিল। ছিলই বলছি, কারণ এখন সে অতীত। স্কুলজীবনে যে মাখোমাখো ভালবাসা ছিল, একে অপরকে চোখে হারাত, সেটাই আমূল বদলে গেল কলেজে গিয়ে। চোখের মণি থেকে চক্ষুশূল হওয়ার শুরু তখনই। শিরোদেশে সবে ডিফরেস্টেশন শুরু হয়েছে, কবরী নাক কুঁচকে বলত, ‘‘কিছু একটা কর, দিনকে দিন তো টেকো জেঠু হয়ে উঠছিস।’’

কবরীর কথাগুলো যেন কেশাঘাত, থুড়ি কশাঘাত করত। চিনচিন করে উঠত বুকের মাঝখানে। কবরী তো বলেই খালাস, আর কী করত সে? হোমিয়োপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, টোটকা, জড়িবুটি, যে যা বলেছে সব করে দেখেছে, কিন্তু জঙ্গল উজাড় হওয়া রুখতে পারেনি কেউ। আজকাল খালি মস্তকে কেশ চাষ সম্ভব বটে, কিন্তু সে কেশোৎপাদন বড় কস্টলি অ্যাফেয়ার। উপযুক্ত ক্যাশের অভাবে কেশ সংস্থাপন সম্ভব ছিল না। ফলে কলেজে ছাড়ার আগেই কপাল বেড়ে তালু ছুঁয়ে ফেলল। কিন্তু কপাল বাড়লেও কপাল খুলল না মোটেই। উপরন্তু হৃত কেশের মতো অনেক কিছুই হারিয়ে গেল জীবন থেকে। কবরী কেটে পড়ল। ওর নেড়া বাগান ছেড়ে উড়ে গিয়ে বসল কোনও ঝাঁকড়াচুলোর অঙ্গনে। মসৃণ চকচকে টাকে পিছলে যেতে লাগল অন্যান্য সুন্দরীর দৃষ্টিও। উঁচু ক্লাসের মেয়েরাও এমন ভাবে তাকাতে লাগল, যেন সে পাড়ার কাকু। ঘাড়ের কাছে পলকা কয়েকগাছা কেবল ‘স্মৃতিটুকু থাক’ হয়ে রয়ে গেল।

সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, কেশ একাই নয়, দেখা গেল কেশের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে আরও অনেক কিছু। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল কনফিডেন্স। কেশহীনতা এক ধরনের হীনমন্যতার সৃষ্টি করে, যা কিনা আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়। ফলে টাকের সঙ্গে টাকার যেমন বিরোধ, তেমনই ‘বল্ড’ হওয়ার সঙ্গে ‘বোল্ড’ হওয়ার। কেশবতী কবরীর বিদায় তাই রুখতে পারল না সে। তার পরেও বিচ্ছেদের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে চলল। এক সময় কেশব বুঝতে পারল, প্রেম-পিরিতি নয়, প্রেমে পীড়িত হওয়াই ওর ভবিতব্য।

তবে হিন্দিতে একটা কথা আছে, ভগবানের ঘরে ‘দের আছে, আন্ধের নয়’। অর্থাৎ বিলম্বে হলেও সুবিচার করেন তিনি। তাঁর রাজ্যে অন্ধকার নয়, আলোই আলো। অন্তত পৃথিবীর এক দিকে সূর্যাস্ত হলে অন্য দিকে ভোর হয়। কেশবের ক্ষেত্রেও কথাটা অনেকটা সত্যি। মাথার উপরের অংশে সৃষ্টিকর্তা কার্পণ্য করলেও ভিতরের গ্রে ম্যাটারটির বেলায় কিছুটা উদার ছিলেন। ফলে লেখাপড়ায় সে বরাবরই ভাল। কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ-টাশ করে সাহেবসুবোর মতো এক চাকরি পেয়ে গেল সে। যে অফিসের সে বস, সেখানে অন্তত জনাকুড়ি অধস্তন ওকে মান্যিগন্যি করে, ‘স্যর স্যর’ বলে হুকুম তামিল করে।

কেশব যে সুসজ্জিত কেবিনে বসে, সেটার তিন দিকের দেওয়াল কাচের। যদিও দামি পর্দা ঝোলানো, তবু পর্দার ফাঁকফোকর দিয়েই স্বচ্ছ কাচের ও পারের পুরো অফিসটাই নজরে আসে ওর। কিছুটা পর্দা সরিয়ে রাখে সে। অধস্তনরা ভাবে, অফিসের কাজকর্মে নজর রাখছেন বস। কিন্তু একমাত্র কেশবই জানে, কারণটা এরও গভীরে। নজর সে রাখছে, তবে কর্মে নয়, কতিপয় কর্মীর উপরে।

অফিসটাকে একটা ফুলবাগিচা মনে হত কেশবের। যেখানে কুঁড়ি, সদ্য প্রস্ফুটিত, অর্ধপ্রস্ফুটিত থেকে শুরু করে বাসি নেতিয়ে যাওয়া ফুলেরাও রং ছড়িয়ে রেখেছে। পুরুষকর্মীও আছে, তবে অফিসের অন্দরমহলে তারা সংখ্যায় কম। তারা মার্কেটিং, প্রোমোটিং, ক্লায়েন্ট মিটিং, নানা প্রোজেক্টের সাইট ভিজ়িটিং ইত্যাদি বারমুখো কাজেই বেশি। ফলে এই ফুলবাগিচায় ভ্রমরের মতো বিচরণ করার উদ্দেশ্যেই পর্দা সরিয়ে রাখত কেশব। সুযোগ পেলেই দৃষ্টিমাধ্যমে সেখানে ঢুঁ দিয়ে আসত। কুঁড়িসম ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি উন্মেষা, অ্যাকাউন্টসের সদ্য প্রস্ফুটিত প্রজ্ঞা, পূর্ণ পরিণত মিস সুনৃতা, ওর প্রিয় ফুলেদের কয়েকজন। ছিল আরও অনেকেই। সব নাম করতে গেলে তালিকা দীর্ঘ হবে। কিন্তু সমস্যাটা হল, এত কিছু সত্ত্বেও কোনও ফুলেই জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পাচ্ছিল না কেশব। সবাই যতই মধুর ব্যবহার করুক, ‘ইয়েস স্যর, ইয়েস স্যর’ করে বিনয়ের প্রতিভূ হয়ে থাকুক, আসল ক্ষেত্রে এক-এক জন যেন পাঁকাল মাছ। ধরতে গেলেই পিছলে যায়। বহু বার জাল ফেললেও প্রচেষ্টা জলে গিয়েছে। কোনও লাভ (মুনাফা ও প্রেম, এই দুই অর্থেই) হয়নি কেশবের।

এক বার মিস সুনৃতাকে ডিনারের প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজিও হয়েছিল সুন্দরী। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে অফিস ছুটির ঘণ্টাখানেক আগেই পিসিমার খুড়শ্বশুরের হার্ট অ্যাটাকের খবর শুনিয়ে কেটে পড়ল সে। কেশবের হার্টের কথা একটুও ভাবল না। এমনকি, পিসিমার সেই অশীতিপর খুড়শ্বশুরের শোকে পরবর্তী মাস দুয়েক এমন শোকাহত হয়ে থাকল যে, এর পরে তাকে

কোনও প্রমোদে আমন্ত্রণ করা নিতান্তই বিবেকহীন প্রমাণিত হত। অগত্যা লিস্ট থেকে সুনৃতার নাম কেটে গেল আপনিই।

এর পরের টার্গেট ছিল প্রজ্ঞা। এই মেয়ের ব্যাপারটা খানিক অন্য রকম। এমনিতে বেশ তরতাজা চনমনে ডাকাবুকো মনে হলেও সে বড় রোগে ভোগে। বিশেষ করে ডিনার বা মুভি দেখার প্রস্তাবে প্রাথমিক সম্মতি জানালেও, পরমুহূর্তেই

ওর হয় আর্থ্রাইটিসের সমস্যাটা বেড়ে যায়, নয়তো জ্বর বাঁধিয়ে, রক্তচাপ কমিয়ে সিক-লিভ নিয়ে ঘরে পড়ে থাকে। অগত্যা কেশব ভয়েই ওকে ঘাঁটায় না।

বাকি রইল উন্মেষা। কেশবের মূল তিন স্বপ্নচারিণীর মধ্যে তৃতীয় জন। এই সুন্দরী আবার সাংঘাতিক হট। সাক্ষাৎ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। লাভ ও লাভা দু’টোতেই ঝলসে দিতে পারে। কাজেই ওর দিকে এগোতে হয়েছে অনেক ভেবেচিন্তে। কিন্তু মজাটা হল, বিষয়টা যেমন কঠিন ভেবেছিল, তার উল্টোটাই ঘটল। সুনৃতা ও প্রজ্ঞাকে ডিনার কিংবা মুভিতে নিয়ে যেতে অসফল হলেও, উন্মেষার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সফল হল কেশব। কিন্তু তা বলে যদি ভাবা হয়, কেশবের কোয়েস্ট কমপ্লিট, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে ওর, তবে ভুল হবে। বরং যে অভিজ্ঞতা ওর হয়েছে, তাতে এর পরে যদি সে অবলাতঙ্কে ভুগতে শুরু করে, আশ্চর্যের কিছু নেই।

আসলে হয়েছে কী, উন্মেষাকে লং ড্রাইভে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কেশব। উন্মেষাও সানন্দে সম্মতি জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আশাতীত উৎসাহ দেখিয়ে বলে উঠেছিল, “ওয়াও! লং ড্রাইভ! নিশ্চয়ই যাব। আই লাইক ইট আ

লট স্যর। আরও মজা হবে যদি কোথাও গিয়ে উইকএন্ডটা কাটিয়ে আসা যায়।”

এ যেন মেঘ না চাইতে জল! মনে মনে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল কেশব। লুফে নিয়েছিল উন্মেষার প্রস্তাব। ঠিক হল, ড্রাইভ করে একদম তালসারি চলে যাবে। আগামী শনি-রবির ছুটি সেখানেই কাটাবে দু’জনে।

নির্দিষ্ট দিনে যাওয়ার জন্যে যখন গাড়ি নিয়ে তৈরি কেশব, যথাসময়ে সেজেগুজে উন্মেষাও হাজির। কিন্তু খুশিতে উদ্বেলিত হওয়ার মুহূর্তে কেশব দেখল, মুঠোফোনের মতো মুঠোয় ভরে নিজের বয়ফ্রেন্ডকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে উন্মেষা। পরবর্তী কাহিনি বিশদে লিখতে গিয়ে বিষাদে ভরে উঠছে কলম। শুধু বলি, তালসারিতে তালের খোসাই জুটেছিল কেশবের, শাঁস খেয়েছিল অন্য কেউ। পুরো ট্যুরের স্পনসর করাই শুধু নয়, পুরো তালসারি পর্ব কেশবকে চালক এবং চিত্রগ্রাহকের ভূমিকায় কাটাতে হল। উন্মেষা ও তার বয়ফ্রেন্ডের আবদার মেনে তাদের এ দিক-সে দিক গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, যুগলের জলকেলি, খুনসুটি ও বিবিধ ভঙ্গিমায় ভালবাসাবাসির মুহূর্ত লেন্সবন্দি করতে করতে কেশব হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল, বিবি কী ভয়ানক রসিকতা করেছেন ওর সঙ্গে।

এত কাণ্ডের পরে চাকরিটা থেকেই মন উঠে গেল কেশবের। মনে মনে ভেঙে পড়েছিল সে। তদুপরি

কফিনে শেষ পেরেকটা গেঁথে দিল বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত একটা খবর। সে জানতে পারল, সামনে ‘স্যর স্যর’ করলেও আড়ালে ওকে সারা অফিস ‘টেকো’ বলে ডাকে। এই অপমান সয়ে আর এ অফিসে থাকা যায়? সুতরাং পদত্যাগ।

যোগ্যতার তো অভাব ছিল না, বয়স ও অভিজ্ঞতার ভারও যথেষ্ট হয়েছিল, অচিরেই সমকক্ষ একটি চাকরি সে পেয়েও গেল। এ বারে কেশব অনেক সতর্ক। এমনিতেই যৌবন বিগত। উপরন্তু হরেক নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পরে প্রেম-পিরিতির ধার মাড়াবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সে। এবং আর যাতে ‘টেকো’ বিশেষণের জ্বালা সইতে না হয়, সে জন্যে নতুন অফিসে সে যোগ দিল পরচুলা পরে। আর কী আশ্চর্য! এতেই ম্যাজিক ঘটে গেল। নকল কেশ ওর সব ক্লেশ ঘুচিয়ে দিল। উইগ জয় করে নিল সমস্ত উইকনেস, ফিরিয়ে দিল কনফিডেন্স। সত্যি! এ দুনিয়ায় কে আপন আর কে যে পর, বোঝা দায়। আপন চুল থেকে পরচুলাই যে এত আপন হবে, ভাবতে পারা গিয়েছিল কখনও?

নতুন অফিসেও প্রমীলাবাহিনী প্রতুল। কিন্তু এ বারে আর কেশবকে ভ্রমর হয়ে ভ্রমণ করতে হল না। ফুলেরা নিজেই এসে ধরা দিতে লাগল। কেশের (যতই নকল হোক) এমনই ক্যারিশ্মা। এখন বল ওর কোর্টে। অনেক ভেবেচিন্তে কেশব যাকে বাছাই করল, সে হল সংস্থার ক্যাশিয়ার কেশবতী মিস সুইটি। নামে যেমন, আচরণেও তেমনই সে। আহা, কী মিষ্টি কথাবার্তা! কী মধুর সম্ভাষণ! কেশব একেবারে কাত।

সবচেয়ে বড় কথা, এ বারে আউটিং-এর প্রস্তাব এল ও দিক থেকে। নতুন বসকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাল মিস সুইটি। শুধু তা-ই নয়, প্রায়ই বসকে মিষ্টিমুখ করাতে নানাবিধ মিষ্টি নিয়ে আসে সে।

আকস্মিক এ রকম ভাগ্যবদলে কেশব একেবারে আনন্দে দিশেহারা। পরচুলাকে সে পুরোপুরি আপন করে নিল। শুধুমাত্র স্নান-ঘুম ছাড়া একে শরীরের অঙ্গ করেই রাখল। নতুন কর্মজীবন হয়ে উঠল কেশময়, থুড়ি রসময়। শুরু হল সুইটির

সঙ্গে মিষ্টিমধুর প্রেমপর্ব। একান্তে বসে হাতে হাত রেখে কেশব প্রেয়সীকে বলে, “আমাকে যেমন দেখছ, আমি নিরানব্বই শতাংশই তেমন। শুধু একটা মাইনাস পয়েন্ট কী জানো, কোনও কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ কিংবা কোনও রকম চুলোচুলি আমার একদম অপছন্দ।”

মিস সুইটি সুইট স্মাইল সহযোগে বলে, “আর আমার নেগেটিভ পয়েন্ট হল, আমার ভীষণ সুইট টুথ।”

“হা-হা-হা!” হেসে ওঠে কেশব, “সে তো বুঝেইছি। মিষ্টি ভালবাসো বলেই হয়তো তুমি এত মিষ্টি।”

আরও এক দফা মিষ্টি হাসি উপহার দেয় সুইটিদেবী।

কথা এগোয়, প্রেম বাড়ে, একে অপরের দোষ-ত্রুটি কবুল করে আরও ঘনিষ্ঠ হয় দু’জনে। অবশেষে বেশ কিছু দিনের রেস্তরাঁ, ডিস্কোথেক, লং ড্রাইভ পর্ব পেরিয়ে ছাদনাতলায় বসা।

‘অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার…’—গল্প যদিও এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হল না। বাধ্য হয়েই লখিন্দরের বাসরঘরে মা মনসার বাহনের মতো ফুলশয্যার রাতে ওদের বাসরঘরে গোপনে হানা দিতে হল। খাটের উপরে জমকালো শাড়ি-গয়না জড়িয়ে বসে আছে সুইটি দেবী। পরচুলাটা খুলে রাখার আগে কেশব বলল, “তোমাকে বলেছিলাম না, চুলোচুলি আমি এড়িয়ে চলি?”

“হ্যাঁ, সে তো বলেছিলে,” মিষ্টি হেসে বলল নববধু। কেশব যোগ করল, “সে জন্যেই মাথার সব চুল উঠিয়ে ফেলেছি। না রহেগা বাঁশ, না বাজেগি বাঁশরি। বুঝলে না?”

আঁতকে উঠল নববধু। চোখভরা বিস্ময় নিয়ে বলে, “তার মানে?”

“তার মানে হল,” পরচুলাটা খুলতে খুলতে কেশব বলে, “আসলের জায়গায় আমি নকল চুল পরি। এতে মেনটেন্যান্সের ঝামেলা নেই, তেল-শ্যাম্পুর খরচ নেই, আর চুলোচুলি, অর্থাৎ চুল টেনে কেউ আঘাত করবে, তেমন আশঙ্কা তো নেই-ই। কী? আইডিয়াটা কেমন?”

“জবরদস্ত,” এ বারে ফিচিক করে হেসে ফেলল নববধূ। তার পর বলল, “সে জন্যেই তো আমিও একই কাজ করেছি। তোমাকে বলেছিলাম না, আমার সুইট টুথ। মিষ্টি খেলেই যার ক্যাভিটির আশঙ্কা প্রবল?”

“হ্যাঁ বলেছিলে। তাও তুমি

মিষ্টি খাও।”

“খাই তো। কারণ আসল দাঁত যে আর নেই, সবই বাঁধানো। নকল দাঁতে ক্যাভিটির ভয় নেই। হিহিহি।”

“বলছ কী?” প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে কেশব। কেমন আর্তনাদের মতো শোনায় ওর স্বর।

কিন্তু নববধূ নির্বিকার। ধীর, অচঞ্চল। মুখ থেকে দু’পাটি দাঁত বার করে এনে, কেশবের একেবারে চোখের সামনে মেলে ধরে বলে, “তুমি যেমন চুল তুলেছ, আমিও তেমন দাঁত।”

এর পর সদ্য-বিবাহিতা ফোকলা বিবির দিকে তাকিয়ে বিবির (দ্বিতীয় জন ‘ভাগ্যবিধাতা’) প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না কেশহীন ক্লেশক্লিষ্ট কেশবের।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

অন্য বিষয়গুলি:

short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy