ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
আজ অনেক দিন পর আবার ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখছে প্রবাল। আগে ট্রেন দেখতে বেশ ভাল লাগত তার। বিশেষ করে দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো যখন ধুলো উড়িয়ে সাঁ-সাঁ করে চলে যেত, তখন মনটা কেমন ছেলেমানুষের মতো হয়ে যেত।
ছোট স্টেশন। এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না। শুধু লোকাল ট্রেন দাঁড়ায়। এই ওভারব্রিজও এখন আর তেমন কেউ ব্যবহার করে না। লাইনের ধার দিয়ে সবাই শর্টকাট ধরে।
আগে যে নির্দিষ্ট জায়গাটায় এসে দাঁড়াত, এ বার অবশ্য সেখানে এসে দাঁড়ায়নি। আগে দাঁড়াত ডাউন প্ল্যাটফর্মের সিঁড়িটার কাছে। কিন্তু আজ দাঁড়িয়েছে একেবারে আপ প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে, যেখান থেকে সিঁড়িটা রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে নেমে গিয়েছে, সেখানে।
এই জায়গাটা বেছে নেওয়ার কারণ, অন্ধকার। এই অন্ধকারই এখন বড় প্রয়োজন তার। অন্ধকারই এখন তার নিরাপদ আশ্রয়।
আসলে সে ভয় পেয়েছে। আর ভয় পেয়ে প্রথমেই তার এই জায়গাটার কথা মনে পড়েছে।
প্রায় দশ মিনিট হল সে এখানে এসেছে। কিন্তু এখনও মৃদু হাঁপাচ্ছে। বুকের ধুকপুকুনি টের পাচ্ছে। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। এক কালে সে যথেষ্ট খেলাধুলো করেছে। ফুটবল খেলায় সারা মাঠ চরকির মতো পাক খেয়েছে। অথচ আজ এই একটুখানি রাস্তা দ্রুত গতিতে হাঁটতে গিয়েই সে হাঁফাচ্ছে! সবটাই অবশ্য শরীরের দোষ নয়। মনের ভিতর ভয় আছে যে! সে জন্যই ধুকপুকুনিটা কমছে না।
টগবগে রক্ত আর সাতাশ বছরের শক্ত-সমর্থ একটা শরীর নিয়ে এই রকম ভয় পাওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মনটা ভিজে মুড়ির মতো চুপসে গিয়েছে ।
কিছু ক্ষণ আগেই একটা লোকাল চলে গিয়েছে। স্টেশন এখন ফাঁকা। একটা এক্সপ্রেস ট্রেন দ্রুত গতিতে চলে গেল। তার আওয়াজটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘‘এর চেয়ে ভাল কোনও জায়গা আপনার বাছা উচিত ছিল মশাই!’’
চমকে উঠল প্রবাল। তাড়াতাড়ি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, তার ঠিক পিছনেই একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে কখন! মুখটা অন্ধকারে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। ছোট্টখাট্টো চেহারা। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে।
প্রবালের মনে হল, তার সামনে এখন দু’টো রাস্তা খোলা আছে। এক, কোনও রকমে পালিয়ে যাওয়া। আর দুই, সম্মুখসমর। কিন্তু যুদ্ধে নামার জন্য যে উদ্যম থাকা প্রয়োজন, এই মুহূর্তে তার কিছু অভাবই রয়েছে তার মধ্যে। তাই পালাবে বলেই মনস্থির করল সে।
ঠিক তক্ষুনি লোকটা ফের বলে উঠল, ‘‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি যার ভয়ে এখানে লুকিয়েছেন, আমি সে নই।’’
লোকটার কথার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যার জন্য প্রবালের ওকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল। তা ছাড়া যদি তাকে মারার জন্যই এসে থাকে, তা হলে শুধু-শুধু তাকে আশ্বস্ত করতে যাবে কেন? প্রথমেই মুখটা টিপে ধরে পেটে একটা আড়াই প্যাঁচ দিয়ে দিলেই তো খেল খতম হয়ে যেত। কাকপক্ষীতেও টের পেত না।
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তাই সে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কিন্তু আপনি কী করে জানলেন যে, আমি এখানে লুকিয়ে আছি?’’
‘‘আপনি যে হাওয়া খাওয়ার জন্য এখানে আসেননি, সেটা যে কোনও অভিজ্ঞ লোক দেখলেই বুঝতে পারবে। আমার আবার এই ব্যাপারে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে কি না!’’
‘‘কোন ব্যাপারে?’’
‘‘ওই লুকিয়ে থাকার ব্যাপারে। আমাকেও এক সময় আপনার মতো প্রায়ই লুকিয়ে থাকতে হত কি না! তাই লুকিয়ে থাকার নানা ঘাঁতঘোঁত আমার জানা হয়ে গিয়েছে। তাই বলছিলাম, এ রকম একটা ওপেন স্পেসে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকার বেসিক নিয়মটাই আপনি অমান্য করেছেন।’’
‘‘দেখুন, আমি আপনার মতো প্রায়ই লুকোই না। জীবনে এই প্রথম লুকোচ্ছি। তাও দায়ে পড়ে।’’
‘‘আহা, দায়ে না পড়লে খামোকা কেউ লুকোতে যাবেই বা কেন? আমিও তো দায়ে পড়েই লুকোতাম।’’
‘‘তা বটে।’’
‘‘তা আপনার দায়টা আমাকে একটু বলবেন দয়া করে? আমার একটু সুবিধে হত আর কী!’’
‘‘আপনার সুবিধে হবে? ঠিক বুঝলাম না তো!’’
‘‘বুঝলেন না? তা না বোঝারই কথা। আপনিই যদি সব বুঝে ফেলেন, তা হলে আমি কী করতে আছি? আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আসলে এই লুকনোর ব্যাপারে অন্যকে সাহায্য করাটাকে আমি এখন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। আপনিই বলুন, এক জন উকিল যদি আইনি পরামর্শ দিয়ে ফিজ় নিতে পারে, তা হলে আমিই বা লোককে লুকনোর ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে ফিজ় নেব না কেন? কারণেই হোক বা অকারণে, এখন মানুষের লুকিয়ে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু লুকিয়ে থাকার জায়গা ক্রমশ কমে আসছে। যতই হোক এত কাল আরামে কাটিয়ে এসে এখন তো আর বনে-জঙ্গলে গিয়ে লুকোতে পারে না। সুতরাং আমার কাছে ছুটে আসছে। তাই বলতে নেই, আপনাদের আশীর্বাদে আমার পসার বেশ জমে উঠেছে। মক্কেলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যতই হোক নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কি না!’’
প্রবাল বুঝতে পারল, ব্যাপারটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। অবশ্য ভয়টাও কিছুটা কমেছে এর মধ্যে। যতই হোক, সে এখন একা নয়। এক জন অন্তত সঙ্গে আছে। কিছুটা হলেও তো প্রতিরোধ করতে পারবে।
সে তাই কিছুটা আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘‘ একটু খুলে বলুন।’’
‘‘দেখুন, কোনও মানুষই এমনি-এমনি লুকোয় না। প্রতিটি লুকিয়ে থাকার পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলায় লুকনোর মধ্যে একটা খেলোয়াড়ি মনোভাব কাজ করে। বড়দের কারণগুলো আবার আলাদা। সেখানে পলায়নী মনোভাব কাজ করে।’’
‘‘যেমন?’’
‘‘যেমন ধরুন, আপনি কারও কাছে টাকা ধার করেছেন। এখন সেই পাওনাদারের ভয়ে আপনাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। সেটা এক ধরনের লুকনো। আবার ধরুন, রাগের মাথায় আপনি কাউকে শাসিয়েছেন। সে এখন বদলা নেবে বলে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিংবা ধরুন, চুরি করেছেন বা কাউকে একেবারে খুনই করে ফেলেছেন, পুলিশ আপনাকে খুঁজছে, আর আপনি পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন।’’
‘‘কোনওটাই নয়। আমাকে কি চোর বা খুনি বলে মনে হচ্ছে আপনার?’’ আহত হয় প্রবাল।
‘‘তা মনে হচ্ছে না। তবে কি আপনি কোনও পত্রিকার সম্পাদক?’’
‘‘মানে!’’
‘‘পত্রিকা সম্পাদকের অনেক জ্বালা, বুঝলেন কি না! দিন নেই রাত নেই, উঠতি কবিরা দিস্তে-দিস্তে কবিতা নিয়ে এসে হাজির হয়। তখন সম্পাদক বেচারার পালিয়ে বাঁচা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। এক সময় আমিও কবিতা-টবিতা লিখতাম তো, তাই মনে হল। এখনও ব্যাগে দু’-একটা আছে। শুনবেন না কি?’’
‘‘না-না, জীবনে আমি ও সবের ধার-কাছ দিয়ে যাইনি।’’
‘‘ভালই করেছেন না গিয়ে। তা হলে ব্যাপারটা কী বলুন তো? আমার তো আর কিছু মাথায় আসছে না!’’
‘‘আমার প্রেমঘটিত ব্যাপার!’’
‘‘ও! তাই বলুন! আমি আবার ওই ব্যাপারে একদম কাঁচা বলে ওটা আমার মাথায় আসেনি। এটা ঠিক নয়। পরের বার শুধরে নিতে হবে। তা বলুন আপনার কী সমস্যা।’’
‘‘প্রেম যখন আছে তখন একটা মেয়ে তো থাকবেই। আর মেয়ে থাকলে তার বাপও থাকবে। তো বাপটি আবার বেশ এলেমদার। হাতে অনেক গুন্ডা-বদমাশ আছে। প্রথমেই জানতে পারলে আর এগোতাম না। কিন্তু এখন ‘আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না, আর ও আমাকে ছাড়া বাঁচবে না’— এই রকম একটা অবস্থায় এসে গিয়েছি। তাই পিছোবারও জো নেই।’’
‘‘বুঝেছি। তা ওর বাবা কি শেষমেশ আপনার পিছনে গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?’’
‘‘ঠিক ধরেছেন। আজ একটু আগে মনের সুখে দু’জনে ফুচকা খাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা গুন্ডা এসে আক্রমণ করল!’’
‘‘আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! ওই অবস্থায় মেয়েটাকে একলা ফেলে রেখে পালিয়ে এলেন!’’
‘‘আসলে পালানোর কথাটাই প্রথম মাথায় এল যে! এখন অবশ্য মনটা খুঁতখুঁত করছে।’’
‘‘না না, কাজটা মোটেই আপনি ভাল করেননি।’’
প্রবাল এ বার দোষ স্বীকার করতেই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বলার আগেই তার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল! মূর্তিমান বিভীষিকার মতো সেই গুন্ডাটা একেবারে যেন মাটি ফুঁড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে!
‘‘এই তো তোকে পেয়েছি! ভেবেছিলি পালিয়ে বাঁচবি!’’
প্রবালের গলা শুকিয়ে কাঠ। ভাবল ওর পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করবে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও আওয়াজই বেরল না। তার সঙ্গীটি অবশ্য বেশ বুদ্ধিমান। চট করে বুঝে নিয়েছে ব্যাপারখানা। বিন্দুমাত্র দেরি না করে সে বলে উঠল, ‘‘ও তুই! ভালই করেছিস এসে। তোকেই তো আমরা খুঁজতে যাচ্ছিলাম!’’
‘‘তুই আবার কে রে?’’
‘‘তোর বাপ! তুই একাই গুন্ডা না কি? দাঁড়া, পিস্তলটা বের করি। তা হলেই বুঝতে পারবি আমি কে!’’
প্রবাল অবাক হয়ে দেখল, তার সঙ্গীটি সত্যি সত্যিই কাঁধের ঝোলা থেকে একটা পিস্তল বার করে গুন্ডাটার দিকে তাক করল। আর তার পরেই অবাক কাণ্ড! গুন্ডাটা পিস্তল দেখেই আর কোনও কথা না বলে একেবারে চোঁ-চাঁ দৌড় মেরে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল!
লোকটা এ বার হেসে বলল, ‘‘বেসিক্যালি এরা খুব অদ্ভুত। চেনা সিস্টেমের বাইরে যেতে পারে না। শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু যাদের এরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না, তাদের কাছ থেকে যদি অপ্রত্যাশিত পাল্টা মার আসে, তা হলেই এরা বেসামাল হয়ে পড়ে!’’
অবাক হয়ে প্রবাল বলল, ‘‘কিন্তু আপনিও তো সাংঘাতিক লোক মশাই! ব্যাগের মধ্যে কবিতা রাখেন। আবার পিস্তলও রাখেন!’’
‘‘দূর মশাই! পিস্তল-টিস্তল বড় সাংঘাতিক জিনিস। এটা নকল। সঙ্গে রাখি। অন্ধকারে বেশ কাজ দেয়।’’
হাঁফ ছেড়ে প্রবাল বলল, ‘‘এ বার আমাকে একটা ভাল করে লুকনোর ব্যবস্থা করে দিন তো। ও আমাকে সহজে ছাড়বে না। আবার আমাকে খুঁজতে আসবে।’’
‘‘দাঁড়ান-দাঁড়ান। এত ক্ষণ আপনি ওর ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন। এ বার ও আপনার ভয়ে লুকিয়ে থাকবে!’’
‘‘মানে!’’
‘‘দেখুন, লুকনো ব্যাপারটা একটা শিল্পের মতো। এর অনেক পর্যায় আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তম পর্যায় হল, নিজে না লুকিয়ে থেকে অপরকে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করা। মানে আড়ালটা একই রেখে অবস্থান বদলে নেওয়া। কাজটা কঠিন। বিস্তর সাধনায় আয়ত্তে আসে। তবে চিন্তা করবেন না। আমি যখন আছি, ঠিক আপনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেব।’’
‘‘কিন্তু ওকে এখন খুঁজে পাব কোথায়?’’ অবাক হয় প্রবাল।
‘‘আরে ও রকম একটা তৃতীয় শ্রেণির গুন্ডা কোথায় লুকোতে পারে, আমি জানব না! এ তো সাধনার একেবারে প্রাথমিক স্তর মশাই।’’
‘‘তা বটে! চলুন তা হলে
যাওয়া যাক।’’
‘‘হ্যাঁ, চলুন। ওকে খুঁজে বের করে এমন ব্যবস্থা করব যে, এ বার থেকে ও লুকিয়ে-লুকিয়ে বেড়াবে। আর আপনি বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবেন!’’
‘‘কিন্তু আপনার ফিজ়টা?’’
‘‘সে পরে দেবেন। আগে তো শিক্ষাটা শুরু হোক।’’
প্রবাল এ বার নিশ্চিন্ত মনে লোকটার সঙ্গে অন্ধকারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। অন্ধকার লুকোতে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু ভয় বাড়িয়ে দেয়। তার চেয়ে এই লোকটি লুকনোর যে নিয়ম বলছে, সেটা মনে হচ্ছে তুলনায় নিরাপদ। গুন্ডাটা তার ভয়। ভয়টাকে লুকিয়ে ফেলতে পারলেই আর তাকে লুকিয়ে বেড়াতে হবে না। সে তখন বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারবে।
হালকা পায়ে ওভারব্রিজ থেকে নামার সিঁড়ি ধরল সে।
ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy