Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

ভালবাসার স্বাদ নোনতা

‘লিভিং ইন ইয়োর লেটারস...’ গানটা কানে যেতেই ঘোর কাটে। সামনের বড় পর্দায় চলছে একটি সুইস ফিল্ম।

ছবি: বৈশালী সরকার

ছবি: বৈশালী সরকার

পত্রলেখা নাথ
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ইস। লজ্জায় তো লাল হয়ে গেছিস। কখনও তোর কোনও প্রেমিক তোকে ভিক্টোরিয়ায় আনেনি বুঝি? চেয়ে দেখ মেয়েরা কেমন তাদের প্রেমিককে জড়িয়ে ধরছে। তুই কী রে? এ রকম পরিবেশে এক মাইল দূরে বসে আছিস! যেন আমি পাত্রী দেখতে এসেছি,’’ ব্যঙ্গের হাসি হেসে রৌনক বলে।

‘‘রৌনক আমার ভয় করেছে! তোর না হয় ভয়ডর নেই। আমরা দু’জনেই স্কুলে পড়াই। কোনও ছাত্র যদি দেখে ফেলে!’’ বলে লিপি। সে রৌনকের থেকে একটু দূরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সত্যিই এই প্রথম কোনও পুরুষের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ায় এসেছে লিপি। এর আগে এ ভাবে আসার কথা ভাবলে নিজেকে কেমন অপরাধী লাগত। রৌনক এত ডেসপারেট। একটা কাগজের গোল্লা পাকিয়ে লিপির দিকে ছুড়ে দেয় রৌনক। মাথা নিচু করে ছিল লিপি। আচমকা কাগজের বল গায়ে এসে পড়তে চমকে ওঠে। রৌনক বলে, ‘‘তুই এত ভিতু কেন? সারাক্ষণ কেউ দেখে ফেলবে... দেখে ফেললে ফেলবে, মাস্টারমশাই দিদিমণিরা কি মানুষ নয়? ওদের প্রেম পায় না বুঝি! ছাড় তো। কাছে আয়,’’ রৌনক টেনে জড়িয়ে ধরে লিপির কোমর। ঠোঁট দুটো বাড়িয়ে বলে, ‘‘এই দেখ বাদাম চিবিয়ে ঠোঁটটা কেমন নোনতা হয়ে গিয়েছে।’’ ছন্দপতন। বাঁশির শব্দ। এক মোটাসোটা গার্ড রৌনকের পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘‘এই যে উঠে পড়ুন দাদা, সময় হয়ে গেছে।’’

‘‘ধুস, বাঁশি বাজাবার আর সময় পায় না হারামজাদারা,’’ গজগজ করতে করতে উঠে পড়ে রৌনক। সব রাগ গিয়ে পড়েছিল লিপির ওপর।

‘লিভিং ইন ইয়োর লেটারস...’ গানটা কানে যেতেই ঘোর কাটে। সামনের বড় পর্দায় চলছে একটি সুইস ফিল্ম। আর লিপি ফিরে গেছে সেই পাঁচ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিতে। সিনে সেন্ট্রালে গত পরশু থেকে সুইস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে। প্রায় চার বছর পরে কলকাতায় এসেছে লিপি। মাঝে এক বার এসেছিল খুব কম সময় নিয়ে। আগে এই নন্দন চত্বরটাই ছিল লিপি আর রৌনকের আড্ডা দেওয়ার জায়গা। রৌনক চাকরি করত তখন সোনারপুরের একটি স্কুলে, আর লিপি শ্যামবাজারের একটি প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল ছুটির পরে এই জায়গাটাই দু’জনের দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট থাকত। হঠাৎ সব এমন দ্রুত বদলে যাবে, ভাবেনি লিপি। চাকরি করতে করতে পিএইচ ডি-র জন্য চেষ্টা করছিল দু’জনেই। কিন্তু লিপির প্যানেলে নাম আসলেও রৌনকের নাম আসেনি। খবরটা আসার পরেই দু’জনের সম্পর্কটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রথম ক’দিন ব্যস্ততা দেখিয়ে দেখা বন্ধ করল রৌনক। ওর ব্যবহারে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিল লিপি। তার পর যা হল, তা লিপি কল্পনাও করতে পারেনি কখনও। রৌনক এক দিন লিপিকে ডেকে জানিয়ে দিল, সে চায় না লিপি একা দিল্লিতে থেকে রিসার্চ করুক। সে দিনটা কোনও দিনও ভুলতে পারবে না লিপি। রৌনকের কথা শুনে লিপির সে দিন মনে হয়েছিল, রৌনক অত্যন্ত স্বার্থপর একটা মানুষ। সেই থেকে দু’জনের মানসিক দূরত্ব। লিপি দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার এক মাস আগে থেকে রৌনক লিপির সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে সে দিন এক বারের জন্যও পিছন ফিরে তাকায়নি লিপি।

******

আজ প্রায় পাঁচ বছর পরে পুরনো নানা কথা ভিড় করে উঠছে লিপির মনে। এই সেই অ্যাকাডেমি চত্বর। যেখানে প্রেমের জন্য ছেলেমেয়েদের চিরন্তন অপেক্ষা, হরির চায়ের দোকানে নাটক দেখতে আসা মানুষের ভিড়। এখানে কত বার ওরা বসেছে দু’জন। কত দিন অপেক্ষা করেছে রৌনকের জন্য। রোজ লিপি আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। আর বাবু আসতেন প্রায় তিরিশ মিনিট পরে। এক দিন লিপি বলেছিল, ‘‘তুই আসার সময়টা ঠিক করে বললেই পারিস। তা হলে আর শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না,’’ রৌনক লিপির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল, তার পরে সিগারেটের একটা রিং ছেড়ে বলেছিল, ‘‘এইটাই তোর ভবিতব্য। তুই চিরকাল আমার জন্য অপেক্ষা করবি।’’

সাধারণত নন্দন দুই নম্বর হলে সিনে সেন্ট্রালের সিনেমাগুলো দেখানো হয়। ছোট হল। হল-এ সবাই সবাইকে মোটামুটি দেখতে পায়। ওর আর রৌনকের দুটো চেয়ার নির্দিষ্ট ছিল। বরাবরই ওরা ওইখানে বসবার চেষ্টা করত। কেউ বসলেও ওদের দেখলে মুচকি হেসে উঠে যেত। আজ লিপি বসেছে তারই একটায়। সাড়ে চার-পাঁচ বছরে মানুষের পছন্দ অপছন্দ অনেক বদলেছে। এখন আর সিনেমা হলগুলোতে তেমন ভিড় হয় না। সে সময়ের বেশ কিছু চেনা মুখ এ দিক-ও দিকে ছড়িয়ে আছে। লিপির পাশে রৌনক নেই। রৌনক বসে আছে লিপির ঠিক দুটো রো আগে অন্য একটি মেয়ের হাত ধরে। রৌনকের সঙ্গেই প্রথম সিনে সেন্ট্রালে এসেছিল লিপি। সিনে ক্লাবের সদস্য করে লিপিকে বলেছিল, ‘‘এই, অন্য কারও সঙ্গে আসবি না কিন্তু।’’ লিপি বলেছিল, ‘‘যদি তুই অন্য কারও সঙ্গে যাস?’’ রৌনক হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘‘বি আ স্পোর্টসম্যান ডিয়ার, আমার ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নিবি।’’ রৌনকের বলা সেই কথাটা আজ আবারও মনে পড়ে গেল ।

এত ক্ষণ ধরে সুইস ফিল্মটায় কী হয়েছে খেয়াল করেনি লিপি।চোখের সামনে সিনেমার মতো ভেসে উঠছে পুরনো দিনের কথা। এখন আবার লিপি মন দেয় সিনেমায়। একটি মেয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে …

লিপিও ভাল সাইকেল চালাত। আর রৌনকটা এত কুঁড়ে ছিল, নিজের সাইকেলটা বাড়িতে রেখে চিরকাল লিপির পিছনে বসে ঘুরে বেড়াত। এক বার লিপি বলেছিল, ‘‘তুই কী রে? আমার ঘাড়ে চেপে বেড়াস!’’

রৌনক বলেছিল, ‘‘আরে, পৃথিবী বদলে গেছে।’’

বার বার চোখ চলে যাচ্ছে সামনের রো-তে। রৌনকের বাঁ হাতটা সাপের মতো মেয়েটার কোমর জড়িয়ে আছে। লিপির মনে আছে, এ ভাবেই রৌনক ওকে আদর করত। মাঝে মাঝে বলত, ‘‘উফফ লিপি, তুই এত রোগা না, তোর কোথায় কী আছে ঠিক বুঝতে পারি না।’’

লিপি জানে না রৌনক ওকে দেখেছে কি না। এক বার ভাবে সিনেমাটা শেষ হলে এক বার ডাকবে! তার পর ভাবে, থাক, যদি ও চিনতে অস্বীকার করে!

‘‘ক’টা বাজে?’’

‘‘আমায় বলছেন?’’ পাশের ভদ্রলোক লিপির দিকে একটু অবাক হয়ে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি, ক’টা বাজে দেখেছেন ঘড়িতে?’’

হল-এ আলো জ্বলে উঠেছে, তার মানে সিনেমা শেষ হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লিপি চমকে ওঠে। আটটা বেজে গেছে। তার মানে সিনেমা শেষ হয়েছে সম্ভবত মিনিট পাঁচ আগে।

তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরোতে গিয়ে চোখ পড়ে যায় সামনের রো-তে। রৌনকদের সিট দুটো ফাঁকা। হল থেকে বেরিয়ে আর দেরি না করে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে। মনটা খুব খারাপ লাগছে লিপির। যদিও এটা সত্যি, এই ক’বছরে এক বারও মনে হয়নি রৌনকের কথা। কিন্তু ওই মেয়েটিকে সঙ্গে দেখে কেন যে মনটা খারাপ হয়ে গেল, নিজেও বুঝতে পারে না। রৌনকের সঙ্গে তো সব শেষই হয়ে গিয়েছিল।

******

বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রবীন্দ্রসদনের সামনে একটা বড় রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে লিপি। যদি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

‘‘এই ট্যাক্সি, যাবে?’’

গলার আওয়াজে ফিরে তাকায় লিপি। রৌনক একটা ট্যাক্সিকে হাত নেড়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছে। একটা ছাতার তলায় রৌনককে প্রায় জড়িয়ে আছে মেয়েটি। বৃষ্টিতে ওর শার্টটা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেগে গেছে। খুব ইচ্ছে করছিল লিপির ওই ভিজে শার্টটার মতো রৌনককে জড়িয়ে ধরতে। এক বার ওই ভেজা বুকে মাথা রাখতে। যদিও এই অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছে লিপি। মাথা বাঁচানোর জন্য লিপি দাঁড়িয়ে আছে রেস্তরাঁর তলায়। লিপির সামনে ট্যাক্সিটা থামে। ও পার থেকে দৌড়ে আসছে রৌনক ও ওর সঙ্গিনী। ট্যাক্সির দরজা খুলে খুব যত্নে মেয়েটিকে ট্যাক্সিতে বসায়। এ বার লিপি খুব কাছ থেকে দেখতে পায় রৌনককে। বছর পাঁচেকের ব্যবধানে একটু স্ট্রাগলের চিহ্ন পড়েছে রৌনকের চেহারায়। কিছুটা দায়িত্বশীলও হয়েছে বোধহয়। মুহূর্তে চোখাচোখি হতেই রৌনক হাত নেড়ে ডাকে, ‘‘আরে লিপি না, কবে এলি কলকাতায়? এখানে যে... আচ্ছা বৃষ্টিতে না দাঁড়িয়ে আগে এই ট্যাক্সিতে ওঠ। আমরা তো তোর ও দিকেই যাব।’’

ড্রাইভারের পাশে লিপি পাথরের মতো বসে আছে। পিছনে রৌনক ও মেয়েটি। কী ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে লিপির। কিন্তু রৌনক বেশ স্বাভাবিক। নানান কথা জিজ্ঞেস করছে ওকে। মাঝে মাঝে পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে বলছে, ‘‘মল্লিকা, লিপি আমার সেই পুরনো বান্ধবী, যার

কথা তোমাকে বলেছিলাম।’’ অস্বস্তি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে লিপির। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না, ট্যাক্সি চাঁদনি চকের কাছে আসতেই সে বলে ওঠে, ‘‘আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও, আমার একটা কাজ আছে।’’

রৌনক বলে, ‘‘এত বৃষ্টিতে সোজা বাড়ি চলে গেলেই ভাল করতিস। তোর তো খুব ঠান্ডা লাগার ধাত।’’

‘‘এখন আর সে ধাত নেই রৌনক। এখন আমি অনেক শক্ত হয়ে গেছি।’’ কথাটা বলে হাসিমুখে রাস্তার এক ধারে ট্যাক্সি দাঁড় করায় লিপি। নেমে পিছন ফিরে তাকাতে ওর নিজেরই কেমন যেন ইতস্তত লাগছিল। কী জানি কী ভাবে বসে আছে ওরা দু’জনে! তবু ভদ্রতার খাতিরে লিপি রৌনকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘আসি রৌনক। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। ভাল থেকো।’’

লিপির চোখ রৌনককে ভাল করে দেখে নিল। রৌনকের বুকপকেটে চোখ পড়তেই চমকে উঠেছে। একটা পার্কার কলমের মাথা দেখা যাচ্ছে ওর পকেটে। মনে পড়ল, এক বার ওর জন্মদিনে একটা পার্কার কলম ওকে উপহার দিয়ে বলেছিল লিপি, ‘‘এই কলমটা যত দিন তোর বুকপকেটে থাকবে, জানব তত দিন তুই আমাকেই ভালবাসিস।’’ এটা কী সেই কলমটা!

সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায় ট্যাক্সিটা। লিপির কাছে ছাতা নেই। ভিজতে ভিজতে লিপি ধীর গতিতে হেঁটে চলেছে। বৃষ্টির স্পর্শে তার ঠোঁটটা আজ আবার সেই দিনের মতো নোনতা লাগছে। ভালবাসার স্বাদ কি তবে নোনতা!

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy